নিজের মনে ঢিল ছুড়ছিল বাপ্পা, আর অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর সেগুলো ব্যাঙবাজির খোলামকুচি হয়ে ডুবে যাচ্ছিল, যেন এখন গাছের ছায়া নিয়ে খেলা যায়, সারি সারি ঝুঁজকো কাপাস বাদাম মহানিম বুনোকুলের পাহারাকে আপন লাগে। বাড়ির যে গুমোট অবসাদ, মা সারাক্ষণ কাঁদে দাদার জন্য আর বাবা গুম মেরে থাকে, রাগী দুপুরের দাঁত কামড়ে ধরা যন্ত্রণাকে যে অবসাদ দিয়ে চেনা যায়, যে ঘরের লাল মেঝেতে শুয়ে বাবা দিনরাত একদৃষ্টে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিউরে উঠে গোঙালে বাপ্পার মনে হয় তার গলা টিপে ধরছে, সেই ঘর এবং সেই দুঃস্বপ্ন অন্ধকার ফাঁসুড়ে গম্বুজের মাথায় বন্ধুদের হট্টগোলের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে দুম করে হারিয়ে গেছে। এখন নিমবৃক্ষের খড়খড়ে গা জড়িয়ে ধরতে ভাল লাগে, ভাল লাগে সারারাত শুয়ে স্বচ্ছ তারাদের চলাচল দেখতে।
দেবু, বিষ্ণু, ছোটন, গণেশ, বাবাইরা মিলে নীচে দাঁড়িয়ে গম্বুজের গায়ে ছুরি দিয়ে দাগ কাটছে। কেউ কেউ হট্টগোল করছে, ‘আমার নাম আগে রাখ’, ‘বানান ভুল হল’। কতকালের পুরনো এ গম্বুজ, নাকি রাজা মেদনমল্ল এখানে বিশ্বাসঘাতকদের ধরে ধরে ফাঁসি দিত। এখনো ভেতরের একটা কক্ষে কড়িকাঠের গায়ে অসংখ্য দাগ, দিনের বেলা বোঝা যায়। মোটা দড়ির দাগ, ঘষটে গিয়ে চলটা তুলে ফেলেছে। বাবান ঘুরছে ছাদের ওপর, আর মাঝে মাঝেই নীচে মুখ করে চেঁচাচ্ছে, ‘স-সব খেয়ে ফেল-ফেলিস না কিন্তু। আম-মার জ-জন্য রাখিস।’ ছাদের ওপর ঝুঁকে পড়েছে বুনো গাছের দল, রাতপাখিরা মাঝে মাঝে সড়সড় আওয়াজ করছে। এখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে চোখ মেললে যতদূর দেখা যায়, শুধু অরণ্য, যার সীমা আদি অন্ত নেই। আকাশের দিকে হাত তুলে ধরা অসংখ্য পাতার ঝামরের মধ্যে বাপ্পা তার দাদার শান্ত গরীব মুখটির নির্ভরযোগ্য আলো দেখতে পায়।
[the_ad id=”270088″]
‘বাবান, এসো এবার। ধরাব’। দেবু গলা তুলল।
নীচে নেমে বাবান দেখল, ছোটন কায়দা করে সিগারেটটা ঠোঁটের এককোণায় ঝুলিয়েছে, হিরোদের মতো, কিন্তু ধোঁয়া উঠে চোখে জল। আরেকটা সিগারেট বাবাইয়ের মুখে। ‘বুকে ধোঁয়া রাখতে পারবি?’ জিজ্ঞাসা করল দেবু।
বাবাই গাল ফুলিয়ে ভক করে সাদা ধোঁয়া ছেড়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘বুকে নিলে ক্যান্সার হয়’।
‘বাল হয়! এই দেখ আমি নিচ্ছি’, সাপের লেজের মতো ধোঁয়া ছাড়ছিল ছোটন আর অন্যেরা ঈর্ষার ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকল।
‘খি-খিস্তি দিবি না ।’ বাবান রাগত ভঙ্গিতে বলল।
‘নাও টান দাও। সাবধানে কিন্তু’। দেবু সিগারেট বাড়িয়ে ধরল।
টান দিতে গিয়ে নাকে মুখে ধোঁয়া ছেড়ে কেশে অস্থির বাবান, লাল মুখে মাটিতে বসে পড়েছে আর ছোটন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে, বিষ্ণু আলতো স্বরে বলল, ‘কী ক্যালানে !’
বাবান তেড়েফুঁড়ে উঠতে গিয়ে আবার বিষম খেল, তার মধ্যেই বুক চেপে কাশতে কাশতে উঠে বিষ্ণুকে ঠেলা মারল, যার মধ্যে জোর না থাকায় বিষ্ণুর কিছুই হল না, উলটে বাবান পিছিয়ে এল কয়েক পা, ‘আমি ক্যা-ক্যালানে?’
[the_ad id=”270086″]
‘না, তুমি থামো এবার। আর টান দিও না। পেয়ারাপাতা চিবিয়ে নাও নাহলে বাড়ি গেলে মুখে গন্ধ পাবে।’ দেবু বাবানের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে পরপর জোরে দুটো টান মারল।
বাবান মরীয়া হয়ে দেবুর কাছ থেকে সিগারেটটা ছিনিয়ে নিতে গেল, দেবু বোঝেনি প্রথমে, একটু সরে গেল, টানাহ্যাঁচড়ায় সিগারেটটা মাটিতে পড়ে আগুনের ফুলকি ছেটাচ্ছিল, রেগে গিয়ে চিৎকার করে উঠল বাবান, ‘আমার প-পয়সা দ্দিয়ে কেনা, মাটিতে ফে-ফেলে দিলি? প-পয়সা ফেরত দে এবার !’
‘ও কোথা থেকে দেবে? ওর কাছে থাকে নাকি? ও তো তোমাদের চাকর।’ খি খি করে হাসল ছোটন, অন্যেরাও।
দেবু আগুন চোখে তাকাতে ছোটন একটু থমকাল বটে, কিন্তু বাবান চেঁচিয়ে চলেছে, ‘প-পয়সা নেই তো ফেলে ক্কেন দি-দিলি? দ্দিনরাত আমার প-পয়সায় খাবি, আমার ব্যা-ব্যাটে খেলবি, আমার সান-সানগ্লা-গ্লাস পরবি, আর আমাকে ভা-ভাগ দিবি না! শু-শুওর কোথা-কার !’
‘এই মুখ সামলে।’ এবার রুখে এল গণেশ, ‘তুমি ভদ্র ছেলে বলে কিছু বলি না। আমরা কি মানুষ নই নাকি?’
‘ক্কে- ক্কেন? ক্রিকেট খে-খেলার সময় তো মন-মনে থাকে না?’
‘হ্যাঁ তোমার ব্যাটে খেলি, আর তাই তোমাকে সবার শুরুতে ব্যাট দেওয়া হয়। তোমাকে আউট করা হয় না কারণ আউট করলে ব্যাট নিয়ে তুমি বাড়ি চলে যাবে। তুমি খেলতে পারো না, বল করতে পারো না, রান নিতে পারো না, কিচ্ছু পারো না–‘ হঠাৎ উত্তেজনায় গণেশ হাঁফাতে লাগল, অন্যেরা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে, শুধু ছোটন ঠোঁট মুচড়ে বাঁকা হাসির সঙ্গে মাথার গামছাটা পাক দিয়ে চলেছে।
‘এই থাম !’ দেবু বলল এবার।
[the_ad id=”270085″]
‘কেন থামব? ভিতুর হদ্দ একটা ছেলে! তুইই বলেছিস ঘুমের মধ্যে নাকি ভূতের ভয়ে চিৎকার করে ওঠে–‘
‘তু-তুই বলেছিস?’ ক্রুদ্ধ স্বরে বাবান বলল।
‘আমরা সবাই জানি’, এবার এগিয়ে এল বাবাই, ‘তুমি ভূতের ভয় পাও। তাই সন্ধে হলেই বাড়ি পালাও, আর নাহলে দেবুর পিছু পিছু হাঁটো যাতে ভূতে না ধরে’। এবার হো হো করে হেসে উঠল সবাই। তারপর কোরাস দিয়ে সুর করে করে বলতে লাগল, ‘ক্যালানে’ ‘ক্যালানে’। দেবু বাবানের দিকে পিছু না ফিরেই তার একটা হাত ধরল। ‘বাড়ি চলো’।
অন্ধকার গম্বুজ তাকিয়ে আছে অপলক। ঝড়ের মেঘের মতো ঘন হয়ে নেমে আসছে রাত, আর মাথার ওপর কয়েকটা বাদুড় উড়ছে দেখা গেল। বাপ্পা মুখ তুলে দেখল, অন্ধকার নিমগাছের ডালে জ্বলজ্বলে চোখ।
ঝটকা মেরে দেবুর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল বাবান, ‘আমি ভ-ভয় পাই না । তোরা শালা মিথ-মিথ্যুক। এই দেবু শুওরটা মিথ-মিথ্যে বলে। ভূ-ভূত নেই।’
‘নেই? ওই যে পুকুরে যখ থাকে, সে তাহলে কী?’
‘স-সব ঢপ। আ-আমি মানি না।’ বাবান এক পা পিছিয়ে গেল, ঠোঁটের কষে অল্প অল্প ফেনা জমা হয়েছে।
‘এদিকে তোমার মা যে পাঁচু ঠাকুরের কাছে হত্যে দেয়, ছেলে দুর্বল বলে? ছেলেকে যেন ভূতপ্রেত তুলে না নিয়ে যায়?’
‘আমি দু-দুর্বল ! আমি ভূতের মা-মাথায় পেচ্ছাপ ক-করি শালা!’ বাবান অসহায় চিৎকার করে উঠল।
দেবু ওর মুখে হাত চাপা দিল, ‘চুপ করো, কী সব বলছ! ছোটন, এবার তুই ক্যালানি খাবি কিন্তু আমার কাছে’।
হাত সরিয়ে দেবুকে লাথি মারল বাবান, ‘তু-তুই ওদের কা-কাছে এস-সব গল্প বলেছ-ছিস!’
‘হ্যাঁ, ও তো বলেছে,’ ছোটন বলল, ‘বলেছে যে তোমরা চাকর বাকর করে রেখেছ, তাই কিছু বলতে পারে না। যেদিন সুযোগ পাবে তোমাকে মেরে বিচি ফাটিয়ে দেবে।’
‘ছোটন !’ দেবুর ক্রুদ্ধ চিৎকার অন্ধকার জঙ্গল খানখান করে দিল।
নীচে নেমে এসেছে বাপ্পা, এবার এগিয়ে এল, ‘বাড়ি চল। ফালতু ঝগড়া করছিস তোরা !’
‘দে-দেবু তো চাক-করই।’ হিশহিশে ফণায় বাবান ছোবল মারল, ‘ভিখিরি শালা !’
দেবু অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকল, কিছু না বলেই।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বাড়ি যাও। অন্ধকার হলে ভূতে ধরবে’। হি হি করে সবাই হাসল।
‘ভূ-ভূত নেই !’
‘নাকি নেই! তোতলা কোথাকার!’
[the_ad id=”266919″]
বাবান হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘ক-কত টাকার বাজি? আমি ভ-ভয় পাই না?’
বাপ্পা এগিয়ে এল, ‘তোরা থামবি? আড্ডাটাই মাটি। অন্ধকার হয়ে গেছে, বাড়িতে পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেবে আমার বাবা।’
দেবু বাবানের দিকে স্থির তাকিয়ে ছিল, এবার নিশ্বাস ফেলল, ‘হ্যাঁ বাড়ি চল। যা হবার কাল হবে’।
বাবান মাথা ঝাঁকাল, ‘ন্না, যাব না।’
অন্ধকার গম্বুজ তাকিয়ে আছে অপলক। ঝড়ের মেঘের মতো ঘন হয়ে নেমে আসছে রাত, আর মাথার ওপর কয়েকটা বাদুড় উড়ছে দেখা গেল। বাপ্পা মুখ তুলে দেখল, অন্ধকার নিমগাছের ডালে জ্বলজ্বলে চোখ। ভাল করে দেখলে বোঝা যায়, একটা কালো বক। ‘বাড়ি চলো বাবান। তুমি আর ছোটন কথা বোলো না একে অন্যের সাথে, নাহলে এ ঝগড়া চলতেই থাকবে’।
ছোটন এগিয়ে এসে বাবানকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে হনহন করে। যাবার আগে হাতের মুদ্রায় দেখিয়ে গেল সঙ্গমেচ্ছা। সেদিকে তাকিয়ে বাবান দাঁত ঘষল, ‘কাল দেখিয়ে দেব’।
‘হ্যাঁ দেখিয়ে দাও,’ হঠাৎ বলল দেবু, বাপ্পা বিস্মিত তাকাল। দেবুকে ঠিক বুঝতে পারা যায় না।
‘কী দেখাবে? কী সব উলটো পালটা বকছিস?’
‘অত ভেবে কী করবি !’ দেবু দূরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
মিশমিশে কালো গাছপালার ভেতর জোনাকিরা জ্বলছিল। বাবান সেদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, ‘দে-দেখিয়ে দোব, আমি ভিতু নই, দ-দুর-দুর্বল নই, ক্যা-ল্যাননে নই।’ সে স্বরে জিরেন রসের হিম মিশে আর্তি জেগেছিল, মনে হচ্ছিল মাটির ঠাকুরের সামনে প্রার্থনারত, এবং সে বধিরতা প্রান্তর থেকে প্রান্তরব্যাপী। বাপ্পা বাবানের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘এসব ভেবো না, বাড়ি চলো’। এবং দেবু নীরব ছিল।
পরবর্তী পর্ব ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যে ছটা।
*ছবি সৌজন্যে Pinterest
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।