আমাদের বয়স হয়েছে, এখন কি আর ওই বাচ্চাকে সামলাতে পারি? তুই অবুঝের মতো করছিস।’
‘…………………’
‘আমাদের কি ভাল লাগে বল? নিজের মেয়ে খারাপ আছে দেখলে কার না কষ্ট হয়! কিন্তু আমাদের কথাটাও একটু ভেবে দেখ! তোর মা-কে তো জানিস, কেমন মানুষ। তার মাথার ঠিক থাকে না, তার ওপর টুনুর এই রকম হল—‘
‘………………………’
‘না এখন ঠিক আছে। জ্বরটাও কমেছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিল কিছু দেখে। কিন্তু এইভাবে আর কতদিন? যতদিন তোদের ছাড়াছাড়ি না হচ্ছে, বাচ্চাকে এখানে রেখে দিবি? অফিস থেকে দু’দিন ছুটিও তো নিতে পারিস! ও-ও তো মা-কে পাচ্ছে না। তোদের অশান্তির পরিবেশে ওর সমস্যা হচ্ছে বলছিস, এখানেও তো এই ব্যাপার ঘটল। তুই চলে না আসলে কী করে সামলাই?’
‘……………………’
‘আমাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছিস কেন? তুই নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলি ! আমরা বাধা দিয়েছি? আজ যে জামাইয়ের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না, ভুলেও একটা কথা বলতে গেছি কখনো?’
[the_ad id=”270088″]
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে নিচুগলায় দাদু ফোনে কথা বললেও টুনুর কানে আসছিল, এবং তবুও কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না। মায়ের সঙ্গে কথা বললে মনে হয় দুপুরের ফাঁকা বাসস্টপ, কোথাও কোনও দিক থেকেই কোনও বাস আসার আশ্বাসটুকু নেই, আর বাবা তো বেশি ফোনই করে না। আসানসোলের বাড়িতে সে বাবা-মায়ের দাঁতচাপা হিসহিস শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও কিছুতেই মা-কে ছেড়ে এখানে আসতে চায়নি। মা তখন বলেছিল, দিদা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এ কথা সত্যি যে শেষ দুই রাত দিদা তার সঙ্গে শুয়েছে, বারে বারেই রাত্রে উঠে তার জ্বর দেখেছে, জল খাইয়েছে, ধরে ধরে ওষুধ, আর তারপর ভোর হতেই জানালা খুলে দাঁড়িয়ে থেকেছে নিঃসাড়ে। তবুও, দিদার অতলস্পর্শী ভুলে থাকার চেয়ে রাত্রির ওটুকু স্পর্শই যেন স্পঞ্জের মতো টুনুর জ্বর শুষে নিয়েছিল, এমনকী মেলায় অজ্ঞান হয়ে যাবার ঠিক আগে যে চিৎকার তার ভেতর থেকে উঠে এসেছিল, সেটুকুও যে আসলে তার নয়, বস্তুত এক অপার শান্তিই প্রতি রাত্রে তার কপালে শুশ্রূষার স্পর্শ রেখেছে, তাই পাঁচু ঠাকুরের ওই ভয়াল মুর্তিটুকু ক্রমেই ঝাপসা। বরং সে গত দুইদিন একটা অদ্ভুত শান্ত স্বপ্ন দেখেছে। ঘন বেতের জঙ্গল ও বাঁশবন, তাদের মধ্যে মধ্যেই খাপছাড়াভাবে মাথা তুলেছে বুনোকুল বাদাম কাপাস মহানিমের দল, যাদের নামও সে জানে না কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্বপ্নে চিনে নিতে কোনও অসুবিধেই হচ্ছিল না, নিঝুম রাতে সেই বেতের জঙ্গল হাওয়ায় দুলছে, বাঁশবনে শিরশির শব্দ হচ্ছে, আর দীর্ঘ গাছের ছায়াগুলি মাঝে মাঝে হাওয়ায় সরে সরে গেলে দেখা দিচ্ছে একটা ভাঙা গম্বুজ। জনহীন গম্বুজের ফাঁকফোকরের মধ্যে বাতাস ঢুকে সি সি আওয়াজ হচ্ছে খালি। ঘুম ভেঙে সে অবাক হয়ে ভেবেছে, এটাই কি মেদনমল্লের গম্বুজ? সেই প্রাচীন সামন্তরাজ, ফাঁসুড়ে ও করাল–পরপর দুইদিনই একই স্বপ্ন কেন দেখল সে?
মায়ের সঙ্গে কথা বললে মনে হয় দুপুরের ফাঁকা বাসস্টপ, কোথাও কোনও দিক থেকেই কোনও বাস আসার আশ্বাসটুকু নেই, আর বাবা তো বেশি ফোনই করে না। আসানসোলের বাড়িতে সে বাবা-মায়ের দাঁতচাপা হিসহিস শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও কিছুতেই মা-কে ছেড়ে এখানে আসতে চায়নি।
দাদু ফোন রেখে ঘরে ঢুকল। সত্তরের কাছাকাছি বয়েস হলেও অতটা লাগে না, তার ওপর শান্তশিষ্ট ভালমানুষ হবার কারণে যেন অদৃশ্য হয়েই আছে এ বাড়িতে। হাতে মুড়ির বাটি, কাঁচাপাকা গোঁফে লেগে আছে মুড়ি, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা পরিপাটি গৃহস্থ। টুনুর পাশে বসে মুড়ি চিবোতে লাগল, ‘আজ থেকে তো একদম ফিট হয়ে গেছিস বাবা? আর ভয় লাগছে না তো? মুড়ি খাবি?’
একমুঠো তুলে নিল টুনু, এখন উবু হয়ে খাটের ওপর বসে দুলতে ভাল লাগে, মনে হয় বাইরের রাং রাং রৌদ্র ঝনঝনে থালার মতো মত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাখির শিস ভেসে আসবে এক্ষুনিণি। ‘দাদু!’
‘উঁ?’
‘দিদা কি আমার ওপর রেগে গেছে? আমার অসুখ হল বলে?’
‘ধুর পাগল’, দাদু সস্নেহে হাসল, ‘তোর দিদা কত কেঁদেছে জানিস? ঠাকুরের পায়ে মাথা কুটেছে যেন ভাল হয়ে যাস। সেদিন যখন তোকে ওরা মেলা থেকে বাড়ি নিয়ে আসল, তোর তো মনেও নেই কিছু, মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছিস আর চোখ কী লাল তখন, তোর দিদার সে কী কান্না ! সঙ্গে সঙ্গে মাথায় জলপটি দেওয়া, পথ্যি বানানো, রাত জেগে বসে থাকা, সবই তো ওই মানুষটা রে বাবা!’
[the_ad id=”270086″]
‘পাঁচু ঠাকুরকে ওরকম খারাপ দেখতে কেন?’
‘অমন বলতে নেই বাবা ! ভারী জাগ্রত দেবতা। বাচ্চাদের রক্ষা করে।’
আরো কিছুক্ষণ গল্প করে দাদু উঠে পড়ল। সন্ধ্যের সিরিয়াল শুরু হবে এবার। অল্প জ্যোৎস্না ফুটেছে, অন্ধকার বাগানময় ধোঁয়া উড়ছে, মশা তাড়াবার জন্য ডিমের ক্রেট পোড়াচ্ছে বিশ্বমামা। দোতলা এখন নির্জন। দাদু নিচে টিভি দেখবে, দিদা ব্যস্ত রান্নাঘরে। টুনু জানালার কাছে গিয়ে দেখল, বাড়ি থেকে ভাঙা আলো ছিটকে পড়েছে কুয়োতলায়, আর সেই আলোয় রীণামামিমা গুবলুকে কোলে নিয়ে ঘুরছে। তার শরীরখারাপের সময়টা একবারও ওপরে আসেনি। টুনু গাল চেপে উন্মুখ তাকাল নিচে, যদি ওপরে চোখ মেলে চায়, কিন্তু গুবলুকে নিয়ে মগ্ন হয়ে আছে, হাত তুলে কিছু একটা দেখাচ্ছে আর খলখল হাসছে গুবলু–রীণামামিমার হাসি কি মিষ্টি! টুনুর মনে পড়ল, রীণামামিমার খোলা বুকে বিশ্বমামার মাথা, তাকে ছিটকে দিল জানালা থেকে।
[the_ad id=”270085″]
ছোটমামা যদি ফিরে আসে, তাহলে কি দিদা ঠিক হয়ে যাবে? অন্তত যদি জানা যেতে পারত, কোথায় আছে। তালগাছে যদি সত্যিই ছোটমামা থাকে, তাহলে দিদার খাবার খায় না কেন? সে এর মধ্যে দেখেছে, সন্ধেবেলায় দিদা গিয়ে সব খাবার ফেলে দিয়ে থালাবাটি নিয়ে আসে। হয় ছোটমামা তালগাছে নেই, আর নাহলে দিদার রান্না পছন্দ করে না। তাহলে কী খায়? মাছপোড়া? মা বলেছে ছোটমামা বাটামাছ ভাজা খেতে খুব ভালবাসত। একানড়ে কি তাহলে গম্বুজের ওপর মাছ পোড়ায় ছোটমামার জন্যেই? সে কি এখনো একানড়ের জিম্মাতেই আছে তাহলে? তালগাছে বা অন্য কোথাও?
টুনু বাইরে বেরোল। নিঃশব্দ টানা বারান্দায় একটা টিউবলাইট জ্বলছে, যাকে ঘিরে ভিড় করেছে শ্যামাপোকার দল। শীত শীত করছে, হিম নেমে আসছে বাগানের বুকে, দেওয়ালদের ঠাণ্ডা পাথুরে চোখ। ঘরগুলো আবার তালা বন্ধ। ছোটমামার ঘরটাও। তবুও টুনু দাঁড়িয়ে পড়ল।
[the_ad id=”266919″]
এই ঘরেই বইটা দেখেছিল সে, হাউ টু রাইট লেটারস। স্কুলে তাদেরকেও লেটার রাইটিং শেখানো হয়। চট করে অনেকগুলো ভাবনা মাথায় খেলে গেল, হ্যাঁ, এটা একটা উপায় হতে পারে। হালকা উত্তেজিত লাগল তার, এবং সবে জ্বর ছেড়েছে, মাথাটা হয়ত দুর্বল, তাই টলেও গেল একটু। দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে উঠে দরজায় হাত রাখল। ভারী তালা ঝোলানো, ভেতরে অন্ধকার। উল্টোদিকের বারান্দার গ্রিলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে আম পেয়ারা সবেদার জড়ামড়ি গাছ, তাদের ঘিরে একঘেয়ে ঝিঁঝিঁ। টুনু দরজার ওপর কান রাখল। কী চুপচাপ ওপারটা, যেন অতল অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে।
কান সরিয়ে আনল টুনু। ঘরে গিয়ে কাজটা শুরু করলে হয়।
তখনই মনে হল, একটা ছায়া যেন সরে গেল দরজার নীচ থেকে।
মাথা তুলেছে বুনোকুল বাদাম কাপাস মহানিমের দল, যাদের নামও সে জানে না কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্বপ্নে চিনে নিতে কোনও অসুবিধেই হচ্ছিল না, নিঝুম রাতে সেই বেতের জঙ্গল হাওয়ায় দুলছে, বাঁশবনে শিরশির শব্দ হচ্ছে, আর দীর্ঘ গাছের ছায়াগুলি মাঝে মাঝে হাওয়ায় সরে সরে গেলে দেখা দিচ্ছে একটা ভাঙা গম্বুজ।
ছিটকে সরে এল টুনু। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, চোখ বুজে বুক চেপে ধরল। হতে পারে না, এসবই মিথ্যে। শরীর খারাপের জন্য সে ভুল দেখেছে। ঠিক যেমন পাঁচু ঠাকুরকে দেখে–দিদাকে এসব বললে আবার রেগে যাবে, বিশ্বাস করবে না কেউ। সব বাজে কথা, ঘরে কেউ নেই, থাকে না, তালাবন্ধ ঘরের ভেতর কে থাকবে, বরং সে অনেক বেশি কল্পনা করে, এর আগেও মায়ের কাছে কত বকা খেয়েছে তার আগডুম বাগডুম কল্পনার জন্যে।
যখন দরজায় কান পাতল, উল্টোদিকেও যেন কান পেতে ছিল কেউ। তারপর সরে গেল।
[the_ad id=”270084″]
টুনু নিচু হয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল মিশমিশে অন্ধকার। পায়ে পায়ে পিছিয়ে এল। মাথার ভেতরটা খালি লাগছে। শুধু মনে হচ্ছে, এক্ষুনি চিঠিটা লিখে ফেলতে হবে। ওটাই একমাত্র কাজ যা সে করতে পারে।
পিছিয়ে আসতে আসতে একদৌড়ে নিজের ঘর। হাঁফাচ্ছে, ধাতস্থ হতে সময় লাগল কিছুটা। তারপর চেয়ারে গিয়ে বসল। খাতা টেনে নিল। পেনসিল। কিন্তু কী লিখবে? বারে বারে দরজার বাইরে চোখ চলে যাচ্ছে। খাতা ফেলে আরেকবার দরজার বাইরে বেরোল। কোথাও কেউ নেই নিশ্চুপ।
ফিরে এসে খাতার ওপর ঝুঁকে পড়ল টুনু।
পরবর্তী পর্ব : ৫ জানুয়ারি, সন্ধে ছটা।
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
One Response
সচ্ছন্দ গতি। এগিয়ে চলুক।