পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী হলেও নিত্যদিন শিল্পচর্চা করতেন আমার বাবা। ললিতকলা একাডেমিতে ভাস্কর্য করতেন আর ছবি আঁকতেন বাড়িতে। তাই অনেক কম বয়েস থেকেই বিভিন্ন শিল্পীদের নাম, তাঁদের কাজ দেখে বড় হয়েছি। গোড়ায় কিছুই বুঝতাম না, বিশেষ করে অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং দেখে বোকার মত তাকিয়ে থাকতাম অনেক বড় বয়স পর্যন্ত। এরপর একদিন বাবার সঙ্গেই বিড়লা একাডেমিতে যাই যোগেন চৌধুরীর ছবির প্রদর্শনী দেখতে। সেখানে ওঁর ছবির পাশাপাশি ছিল টিশার্টের উপর ওঁর ছবির প্রিন্ট। সঙ্গে ওঁর সেই বিখ্যাত স্বাক্ষর ‘যো!’ সেই প্রথম ভালো লেগে গিয়েছিল অত সহজ ছবি দেখে।
পেশাগত ভাবে আমি বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি দশ বছর। অনেক সময় দেখেছি, কোনও বাঙালি ব্র্যান্ড কিংবা বাঙালি উৎসবের বিজ্ঞাপনে ঢালাও ব্যবহার হচ্ছে যামিনী রায়ের আঁকার আদলে কিছু ইলাস্ট্রেশন। কিন্তু আমার সব সময়ই মনে হত অন্য শিল্পীদের ছবির ধরন কেন ব্যবহার করা হয় না? বিশেষত যোগেনবাবুর ছবিতে যে সহজ লাইন থাকে, সেই রকম ছবি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতে পারলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হতে পারে যে কোনও ব্র্যান্ড কিংবা ক্যাম্পেইন। কিন্তু শিল্পের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের একটা বিশাল ফারাক তো আছেই, তাই হয়তো এই ভাবনাটাকে আমল দেওয়া বিলাসিতা হবে।
বিজ্ঞাপন ছেড়ে আমার ছবি বানানোর পথ চলা শুরু ডকুমেন্টারি দিয়ে। বছর চারেক আগে, বিজ্ঞাপন সংস্থা অগিলভি অ্যান্ড ম্যাথারের মুম্বই থেকে থেকে ফোন আসে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শিল্পকলার ওপর প্রায় ৭০টা তথ্যচিত্র বানাতে হবে টাটাস্কাই-এর একটা ক্যাম্পেনের জন্য। এই সংস্থায় আমার প্রথম চাকরি ছিল! তাই মুম্বই অফিসের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর এবং ওঁর টিমের অনেকেই খুবই পরিচিত। হইহই করে বানিয়ে ফেললাম ছবিগুলো। সেই সময় থেকেই আলাপ মধুছন্দা সেন-এর সঙ্গে, যিনি কলকাতার একটি বিখ্যাত আর্ট গ্যালারি চালান। তার নাম মায়া আর্ট স্পেস। সেখানে যে কেবল নানারকম প্রদর্শনীই হয় তা-ই নয়, বিভিন্ন শিল্পকলার উপর নিয়মিত ওয়ার্কশপও আয়োজিত হয়। মধুছন্দাদিই মুখ্য আহ্বায়ক এসবের। সেখানেই কয়েকটি ওয়ার্কশপে যোগ দিতে গিয়েছিলাম আমি। বিষয় ছিল ‘বিজ্ঞাপনে শিল্পের প্রভাব’।
এছাড়াও মায়া আর্ট স্পেস প্রত্যেক বুধবার একটা আলোচনা সভা আয়োজন করে যার নাম ‘মায়া আড্ডা’, যেখানে সমাজের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা নিজেদের কাজের এবং জীবনের নানা দিক নিয়ে আড্ডা মারেন। কখনও নিজেদের মধ্যে, কখনও দর্শক-শ্রোতারা থাকেন। এই অনুষ্ঠানের একমাত্র উদ্দেশ্য, বাঙালিদের মধ্যে রুচিসম্পন্ন বৈঠকি আড্ডার রেওয়াজ এবং শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখা।

ইতিমধ্যে মধুছন্দাদি একদিন আমাকে বলেন যে, বাংলার প্রবীণ শিল্পীদের নিয়ে উনি কিছু তথ্যচিত্র বানাতে চান। তাঁদের কাজের টেকনিক, তাঁদের পড়াশুনা, শিল্পী হয়ে ওঠার নেপথ্যে যে লড়াই এবং ইচ্ছে, সে সব কথা ক্যামেরাবন্দি করে ডিজিটালি সংরক্ষণ করা হবে এই ছবিগুলোর মাধ্যমে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ছবিগুলো দেখানো হবে বলেই, এগুলো স্বল্পদৈর্ঘ্যের হবে। এই উদ্যোগটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ARTALK’। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল শ্যুটিং। প্রাথমিক ভাবে তিনজনের কথা ভাবা হল – যোগেন চৌধুরী, গনেশ হালুই এবং সনৎ কর। ওঁরাও কিন্তু কোনও আপত্তি করলেন না। এমনকি, শুধু নিজেদের কাজ নয়, প্রত্যেকে তাঁদের জীবনদর্শন, কাজের তাগিদে ওঁরা কখন কী ভাবে পাল্টেছেন নিজেদের পথচলা, পরিবারের অবদান, সব কিছুই অত্যন্ত অকপটে মেলে ধরেছেন আমাদের ক্যামেরার সামনে। ভাবিকালের শিল্পীদের কাছে এই ছবিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলেই আশাবাদী আমরা সবাই।
সম্প্রতি যোগেনবাবুকে নিয়ে তথ্যচিত্রটির কাজ সম্পূর্ণ করতে পেরেছি আমরা। ওঁর কলকাতার বাড়িতে, যেখানে ছবি আঁকার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করেন উনি, এবং শান্তিনিকেতনের বাড়িতে শুটিং করা হয়। ওঁর স্ত্রী শিপ্রা চৌধুরীকেও দেখা যায় এই ছবিতে। খানিক হাল্কা মেজাজে স্বামীর নানা মুডের গল্প শোনান শিপ্রাদেবী। যোগেনবাবুকে নিয়ে শুটিং করব, এইটা যেমন আমার কাছে উত্তেজনার বিষয় ছিল, সে রকম ভয়ও কিন্তু পেয়েছিলাম সাংঘাতিক! শুটিংয়ের আগে একদিন আমি আর মধুছন্দাদি প্রেজেন্টেশন বগলদাবা করে গিয়েছিলাম ওঁর কলকাতার ফ্ল্যাট-এ। তাতে শট ডিভিশন, ছবির কালার টোন, প্রপ লিস্ট সব লেখা। উনি অবশ্যই আমাকে চিনতেন না। কিন্তু প্রেজেন্টেশনটা দেখে ওঁর খুব ভালো লাগে। তার পরেই একটু একটু করে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করেন। আমার তো এদিকে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরনোর মতো অবস্থা! বুক ধুকপুক, গলা শুকনো!

শুটিংয়ের দিন আমরা সকলেই খুব ভালো ভাবে হোমওয়ার্ক করে গিয়েছিলাম, যাতে একদম সময় নষ্ট না হয়। কিন্তু কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, যতবার কোনও শট একবারের বেশি টেক হচ্ছিল- যেমন সিঙ্ক সাউন্ড-এ শুটিং বলে সামান্য শব্দ হলেও ওঁর কথাটা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, ততবারই উনি একই উদ্যম নিয়ে শট দিচ্ছিলেন। যেহেতু তথ্যচিত্র, তাই সংলাপ কিছু বাঁধা ধরা ছিল না। উনি স্বতঃস্ফূর্ত সাবলীল ভাবে নিজের মতোই বলে যাচ্ছিলেন। টেকনিকাল কারণে শট ঠিক না হলেও কিন্তু উনি আবার পুরোটা নতুন করে বলছিলেন। এই বয়েসেও এরকম এনার্জি এবং অসীম ধৈর্য দেখে শেখার মতো!
শান্তিনিকেতনের শুটিংয়েও দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এই প্রথম ওঁর মত একজন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী আমাদের সাথে অক্লান্ত ভাবে ঘুরে ঘুরে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস, কলাভবন নিয়ে নানা অজানা গল্প শোনাচ্ছিলেন শুটিংয়ের ফাঁকে। এবং অনেক সময় ওঁকে না জানিয়েই আমরা ক্যামেরা অন রাখছিলাম যাতে উনি ক্যামেরার ব্যাপারে সচেতন না হয়ে সহজভাবেই নিজের কথাগুলো বলে যেতে পারেন। তবে সব বার শেষ রক্ষা হত না! উনি হাসতে হাসতে ধরে ফেলতেন আমাদের টেকনিক। ওঁর সবকটা গল্প থেকেই কিন্তু বেরিয়ে আসছিল একটাই বিষয়– রবীন্দ্রনাথের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।
এই ছবিটিই আগামী ১৭ই মে, রবিবার সকাল এগারোটায় রিলিজ করা হবে মায়া আর্ট স্পেসের ফেসবুক পেজ থেকে। ছবির চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন মৃন্ময় মন্ডল, যিনি এর আগে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা ছবি ‘সহজ পাঠের গপ্পো’-র চিত্রগ্রাহক ছিলেন। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন স্যমন্তক সিনহা। আশা রাখি এই ছবির মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে আমাদের শৈল্পিক ঐতিহ্যের কথা, তার সনাতন ধারাবাহিকতার কথা।
অর্থনীতিতে স্নাতক হলেও জীবনের অর্থ খুঁজে পেলেন বিজ্ঞাপনের কাজে। মুম্বই এবং কলকাতায় ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের চাকরির পাট শেষ করে, শুরু হল বিজ্ঞাপনের ছবি বানানো। সম্প্রতি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং রুদ্রনীল ঘোষকে নিয়ে বানানো শর্ট ফিল্ম 'C/o Chatterjees' সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ ভাইরাল। রবিবার বিকেলে ঠিক সময়ে ঘুম ভাঙলে ফুটবল খেলতে ভালোবাসেন।