ডেভিড স্কট সময় নষ্ট করেননি। সিয়েম দরবারের অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লোকলস্কর যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জাম গাধা ঘোড়া নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। ততদিনে নংক্ষল-এ স্থাপিত হয়েছে প্রকল্প রূপায়ণের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থানীয় দপ্তর। পাশেই গড়ে উঠেছে শ্রমিক-আধিকারিকদের অস্থায়ী আস্তানা এবং আস্তাবল। রাস্তার রূপরেখা নিয়ে ডেভিড স্কটের খসড়া অনুসারে শুরু হয়ে গেল জমি জরিপ ও আনুষঙ্গিক কাজকর্ম। শুরু হওয়ার পর বছর দেড়েক বেশ দ্রুতগতিতে এবং নির্বিঘ্নেই পরিকল্পিত রাস্তা বানানোর কাজ এগিয়েছে। নংক্ষল-এ নিজের বাড়িতে বসে ইউ তিরথ সিং নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন বিদেশিদের গতিবিধি আচার আচরণ কাজকর্মের ওপর। হঠাৎ তাঁর নজরে এল, রাস্তার ব্যাপারে স্থানীয় জনজাতির মানুষ কেমন যেন উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর স্থানীয় মানুষের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে অবিশ্বাসের ছায়া। সরেজমিন তদন্ত করে বুঝতে পারলেন, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বিপদের বার্তা। বিদেশিরা স্থানীয়দের ওপর অত্যাচার শুরু করেছে। স্থানীয়দের দৃঢ় বিশ্বাস সড়ক নির্মাণের নামে বিদেশিরা এখানকার পাহাড় নদী ঝর্না জমি জঙ্গল দখল করতে চাইছে।

১৮২৯-এর মার্চ মাসে আয়োজিত হল সিয়েমের দরবার। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল যে অনেক হয়েছে আর নয়। ডেভিড স্কট চুক্তি ভেঙেছেন। কাজেই বিদেশিদের চলে যেতে হবে। ভালো কথায় না গেলে মেরে তাড়াতে হবে। ব্রহ্মপুত্র বরাক উপত্যকা হয়ে সুরমা নদীর অববাহিকা পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা ডেভিড স্কটের স্বপ্ন। তা সফল না করে চলে যাওয়ার জন্য তো তিনি আসেননি। পরিস্থিতির হাল-হকিকত আন্দাজ করে তিনি গুয়াহাটি থেকে ব্রিটিশ ফৌজ আনানোর বন্দোবস্ত করলেন। তবে ফৌজ আসার আগেই ৪ঠা এপ্রিল রাতে ইউ তিরথ সিংয়ের নেতৃত্বে বিদেশিদের ওপর আক্রমণ করা হল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুই লেফটেন্যান্ট (বেডিংফিল্ড ও বার্লটন) নিহত হলেন। ডেভিড স্কট কোনওরকমে প্রাণ রক্ষা করে সোহরাতে (চেরাপুঞ্জি) পালিয়ে গেলেন। সেখান থেকে সরাসরি সিলেট।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়ার চেষ্টা হল। ইউ তিরথ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় জনজাতির সমস্ত গোষ্ঠীর মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। শুরু হয়ে গেল একটানা চার বছরের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সকলেই বৃটিশ বিতাড়নের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বাড়ির শিশুদের নিয়ে বয়স্করা গুহায় আশ্রয় নিলেন। যথেষ্ট পরিমাণে গোলাবারুদ কামান বন্দুক থাকা সত্ত্বেও তির-ধনুক আর তরবারি নিয়ে স্থানীয় পুরুষদের আচমকা আক্রমণ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ বাহিনী। এও একরকমের গেরিলা যুদ্ধ। খাসি গারো জয়ন্তিয়া পাহাড়ের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে উপকথা।
দেশরক্ষার যুদ্ধেও জড়িয়ে রয়েছে এমনই এক উপকথা। কা ফান ননগ্লাইট নামের এক সুন্দরী খাসি মহিলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজের সৈন্যদের নিজের রূপে ভুলিয়ে এক ঝর্নার ধারে নিয়ে যেতেন। তারা সেখানে যাওয়া মাত্রই পাথরের পিছনে লুকিয়ে থাকা গেরিলা যোদ্ধারা কোম্পানির ফৌজিদের হত্যা করতেন।
দেশরক্ষার যুদ্ধেও জড়িয়ে রয়েছে এমনই এক উপকথা। কা ফান ননগ্লাইট নামের এক সুন্দরী খাসি মহিলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজের সৈন্যদের নিজের রূপে ভুলিয়ে এক ঝর্নার ধারে নিয়ে যেতেন। তারা সেখানে যাওয়া মাত্রই পাথরের পিছনে লুকিয়ে থাকা গেরিলা যোদ্ধারা কোম্পানির ফৌজিদের হত্যা করতেন। মৃত ফৌজিদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে, তাদের দেহ জলে ভাসিয়ে দেওয়া হত। এভাবেই ইউ তিরথ সিংয়ের বাহিনীর হাতে আধুনিকতম অস্ত্র চলে আসে। তবে দীর্ঘদিনের এই যুদ্ধে তিরথ সিং এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন লিস্টার আহত হয়েছিলেন। কোম্পানির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে তিরথ সিংয়ের বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অহোম রাজ্যের শেষ রাজা চন্দ্রকান্ত সিংহ, ভুটিয়া রাজা সিংফৌ প্রমুখ।

বেচারি চন্দ্রকান্ত সিংহ! ১৮২৬-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে মাথা নুইয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। তবুও অহোম রাজের ছ’শো বছরের ঐতিহ্য ভুলতে পারেননি। নিজের দুরবস্থা ভুলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে চলতে থাকা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। গারো পাহাড়, গোয়ালপাড়া, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষ একযোগে ব্রিটিশ বিতাড়নের যুদ্ধে অংশ নিলেন। অর্থাৎ খাসি জয়ন্তিয়াকে বিদেশি মুক্ত করার কাজে গারো, মিকির, লিংগাম, ভই, ওয়ার, সিংটেং, ভুটিয়া, আহোম ইত্যাদি জনজাতির মানুষ একসঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকলেন। পাহাড়ের আড়াল থেকে বা গুহার ভেতর থেকে ছোঁড়া তিরের দাপটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজের অবস্থা নাজেহাল। এইরকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ডেভিড স্কট হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ১৮৩১-এর ২০শে অগস্ট মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে ডেভিড স্কট মারা গেলেন। প্রতিবেশীদের নিয়ে স্থানীয় মানুষের এই মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভের সম্ভাবনা যখন প্রায় নেই ঠিক সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নবনিযুক্ত কর্তাব্যক্তিরা বেছে নিলেন ব্রিটিশ রাজশক্তির চিরায়ত রণ কৌশল,- কূটনীতি।

ইউ তিরথ সিংকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলতে স্থানীয় জনজাতির বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রধানদের সঙ্গে গোপনে শলাপরামর্শ শুরু হয়ে গেল। উৎকোচ, ক্ষমতার প্রলোভন ইত্যাদির মারফত অনেক গোষ্ঠীপতিকে নিষ্ক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হল। পরিস্থিতি বিবেচনা করে কয়েকজনকে গোপনে হত্যাও করা হল। ইউ তিরথ সিং ক্রমশ একাকীত্বের শেকলে বাঁধা পড়তে থাকলেন। তাঁকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায় না। কখন কোথায় থাকেন তার হদিশ করা মুশকিল। তিনি নিজেও হয়তো আন্দাজ করতে পারছিলেন যে পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অবশেষে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হলেন। স্থির হল তিরধনুক কাঁধে ৩০ জন যুবক এবং ১১ জন গেরিলা যোদ্ধা সঙ্গে নিয়ে তিনি পোমলাকারি গ্রামে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে কথা বলতে যাবেন। এখনকার শিলং পিক-এর কাছে ডিংহেই পাহাড়ের পাশে ছিল এই গ্রাম।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়ার চেষ্টা হল। ইউ তিরথ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় জনজাতির সমস্ত গোষ্ঠীর মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। শুরু হয়ে গেল একটানা চার বছরের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সকলেই বৃটিশ বিতাড়নের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
যথারীতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজ কথা রাখেনি। নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করতে যাওয়া ইউ তিরথ সিংকে ১৮৩৩-এর জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয়। মাইরঙ সেনাশিবির হয়ে তাঁকে গুয়াহাটি আদালতে হাজির করা হল। সেখান থেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকার কারাগারে রাজবন্দী হিসেবে শুরু হয় নতুন জীবন। তাঁর সেবাযত্ন করার জন্য একজন ভৃত্য নিয়োগ করা হয়েছিল। সামান্য ভাতাও বরাদ্দ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পাহাড়ের জনরোষ রুখতে প্রশাসনের দায়িত্ব পালনের জন্য স্থানীয় এক যুবককে নিয়োগ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মানুষ তাকে মানতে রাজি হয় না। বাধ্য হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইউ তিরথ সিংকে শিলং ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিল। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে ঢাকার কারাগারে বন্দী থেকে রাজার সম্মান নিয়ে মৃত্যুকে বরণ করতে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাস হয়ে নংক্ষল-এর সিংহাসনে তিনি বসতে পারবেন না।

১৮৩৫-এর ১৭ই জুলাই ঢাকার কারাগারেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে। সেই সঙ্গে সমাপ্ত হয় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অধ্যায়। ১৮৫৭-র সিপাহী অভ্যুত্থান ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে স্বীকৃত। তার দু’ দশকেরও আগে ঘটে যাওয়া প্রায় চার বছরের এই ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম কিন্তু ইতিহাসের পাতায় সাধারণভাবে অনালোকিত। তবে এখনকার মেঘালয়ের মানুষ তাঁদের এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ভুলে যায়নি। প্রতি বছর ১৭ই জুলাই রাজ্য জুড়ে ইউ তিরথ সিং এবং তাঁর সংগ্রামকে স্মরণ করা হয়। ১৭ই জুলাই মেঘালয়ে সরকারি ছুটির দিন। এবং শিল্প-সাহিত্যে সেরা অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতি বছর মেঘালয় সরকার দেয় ইউ তিরথ সিং পুরস্কার।
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।
One Response
এই লেখক এর বইগুলো বাংলা লাইভ আমাদের কাছে মেলে ধরুক না। কবুলনামার অনলাইন বিক্রির ব্যবস্থা করা যায় না ?