Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বাংলা চলচ্চিত্রের উদ্ভাসিত আলোক ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

অমিতাভ নাগ

আগস্ট ২৬, ২০২০

Bhanu Banerjee
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

যে কোনোও নক্ষত্রের শতবর্ষে তাঁর সম্বন্ধে কিছু লিখতে বসলে বড্ড বিব্রত লাগে। এর মূল কারণ এই, যে কথাই তাঁর বিষয়ে লিখব ভাবি সেটাই হয়ত অপ্রতুল শোনাবে, কিংবা ব্যক্তিপূজার আর এক উপচার বলে সাধারণভাবে মনে হবে। এই দুইয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে কোনও শিল্পীকে পরিমাপ করতে গেলে হয়ত যেটা ভাবা দরকার সেটা হল তাঁর কীর্তির প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনে ঠিক কতটা। তাই আজ শতবর্ষের আলোয়, তাঁর মৃত্যুর প্রায় চার দশক পরে, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সেভাবেই দেখে নিতে চাইব।

ভানু
বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র ভানু

গোড়াতেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নক্ষত্র বলে উল্লেখ করেছি। সেটা সজ্ঞানেই কারণ জনপ্রিয়তার নিরিখে ভানু যথার্থই নক্ষত্র ছিলেন। আজকের দিনেও বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর সমতুল্য জনপ্রিয় অভিনেতা মেলা ভার। উত্তমকুমার যেমন একজন কিংবদন্তী অপ্রিতরোধ্য তারকা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক ক্ষীয়মাণ স্বর্ণযুগের অক্ষয় উত্তর অধিকার, প্রায় সমগুরুত্বে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এক জীবনবোধের প্রতীক। বাঙালি মধ্য-নিম্নমধ্যবিত্ত, বিধ্বস্ত মানসের এক কৌতুকখচিত মুখশ্রী ভানুর।

[the_ad id=”270088″]

উত্তম যদি হন মায়াস্বপ্নের স্বর্ণকুমার, সৌমিত্র কাব্যসুষমার একমেব পথিক, ভানু নিঃসন্দেহে পীড়িত মানুষের দীর্ণ জীবনের একমাত্র আলোকরশ্মি। সেই আলোয় কোনও হ্যালোজেনের খাদ নেই, নেই নায়কের মুখের ওপর জড়ো করা আলোকিক প্রতিস্থাপন। ভানুর উদ্ভাস তাঁর সরল জীবনবোধের প্রক্ষেপণে। নাহলে রোম্যান্টিক মুহূর্তেও তিনি কেন এত আবরণহীন, উন্মুখ, উন্মোচিত! তাই বহু ছবিতে ‘বাঙাল’ চরিত্রে প্রায় যান্ত্রিক পৌনঃপুনিক হয়েও কোথাও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও দম দেওয়া বাজারি ক্লাউন হয়ে ওঠেননি। তিনিঁ ‘বাঙাল’ থেকে ‘বাঙালি’র মুখ হয়ে উঠতে পেরেছেন অক্লেশে।

Bhanu Banerjee actor
সাড়ে চুয়াত্তরে এল প্রথম সাফল্য

মনে রাখতে হবে যেসময়ে ভানু সিনেমায় নামলেন, অর্থাৎ ‘৪০র দশকের মাঝামাঝি, সেসময়ে কৌতুক অভিনেতা কম ছিলেন না বাংলায় । তুলসী চক্রবর্তী, নবদ্বীপ হালদার, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, শ্যাম লাহা, দাপিয়ে অভিনয় করছেন। এবং বাকিদের মতোই ভানুও ওই দরকার মত দু-ছটাক কমিক রিলিফের কাজেই লাগতেন । ১৯৫৩য় নির্মল দের ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে যেমন প্রতিষ্ঠা পেলেন উত্তম-সুচিত্রা জুটি সেভাবেই উঠে এলেন ভানু-জহর ও। তার আগের বছরই শ্যাম লাহা-নবদ্বীপ হালদার লরেল-হার্ডির আদলে করেছেন ‘মানিকজোড়’। কিন্তু শুধু স্ল্যাপস্টিক কমেডির ওপর ভরসা করে স্বয়ং চার্লি চ্যাপলিনও এগোতে পারেননি। তাই সময়ের কালগর্ভে শ্যাম-নবদ্বীপ দূরতর নাম হিসেবে ম্রিয়মান হয়েছেন আর প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় বাঙালিত্বের অনিবার্য অভিজ্ঞান হয়ে রয়ে গিয়েছেন ভানু-জহর । অভিনেতার নামে সিনেমার নাম – ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’ বা ‘ভানু পেল লটারি’, সেই জনপ্রিয়তারই সিলমোহর ।

[the_ad id=”270086″]

ঠিক কোথায় ভানু তাঁর আগের, সমসাময়িক বা পরের (মূলতঃ অনুপকুমার ও রবি ঘোষ) অভিনেতাদের থেকে পৃথক? তার একটি হয়ত এই যে, একমাত্র হাতে গোনা অনুপকুমারের কিছু ছবি ছাড়া (‘পলাতক’, ‘নিমন্ত্রণ’ ইত্যাদি) বাকিরা কেউই অনায়াসে নায়কোচিতও নন । ভানুর মত এত স্বতঃস্ফূর্ত নায়কের চরিত্রের অভিনেতা হতে পারা অনেক নায়কের পক্ষেও হয়ত সম্ভব ছিল না । অথচ ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’এর মতো অসংখ্য ছবিতে নায়কের অনিত্য ভঙ্গুরতাতেই ভানু কোনও দেবোপম দূরত্বে বিগ্রহ হন না। জীবনে হিউমারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে চ্যাপলিন একবার বলেছিলেন, “হাস্যরস মনের কোমল এবং কল্যাণময় অভিভাবক যা আমাদের জীবনের আপাত গাম্ভীর্যে অভিভূত হতে বাধা দেয়”। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই ছবিগুলোতে আমরা সেই হাস্যরসে জারিত জীবনের সন্ধান পাই যা আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে রয়েছে, তাতে কোনও দূর কল্পনার রূপকথার হাতছানি নেই, আছে চোখ মেলে তাকানোর মুক্তির নিশান।

Bhanu Banerjee in Miss Priyangbada

 

তাঁর অভিনয়ে তাই ভানু প্রায় সবসময়ই সংক্ষিপ্ত, মিতব্যায়ী। কমেডি অভিনেতাদের প্রায় সকলেই অনেকক্ষেত্রেই অতিঅভিনয়ের মুদ্রাদোষে দুষ্ট হন। মাত্রাজ্ঞানরহিত তাঁরা কখনও সজ্ঞানে হন, কখনও অপটু পরিচালকের ক্ষীণকটি চিত্রনাট্যের ছিদ্র ঢাকতেও তাঁদের বাতুলতার আশ্রয় নিতে হয় বাধ্য হয়েই। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ভানু প্রায় সর্বত্রই এই দোষ থেকে মুক্ত। তাঁর প্রায় ৩০০ ছবির অভিনয়ে পুনরাবৃত্তির দোষ থাকলেও অতিরিক্ত অভিনয়ের অপরাধ তাঁকে সচরাচর দেওয়া যাবে না। তাঁর অপরিহার্যতা তার অভিনয় সুষমার অপার লাবণ্যের আখরে। হয়ত তাঁর জীবনযাপনের সাধারণ অথচ তেজময়তা তাঁকে এই দুরন্ত প্রাণশক্তি দিয়েছিল যা তাঁর মুখের দীপ্তিতে ভাস্বর থেকেছে চিরকাল।

ভানুর মত এত স্বতঃস্ফূর্ত নায়কের চরিত্রের অভিনেতা হতে পারা অনেক নায়কের পক্ষেও হয়ত সম্ভব ছিল না । অথচ ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’এর মতো অসংখ্য ছবিতে নায়কের অনিত্য ভঙ্গুরতাতেই ভানু কোনও দেবোপম দূরত্বে বিগ্রহ হন না।

 

তাঁর এই মিতাভিনয়ের বড় সম্পদ তাঁর আয়ত চোখের বাঙময়তা। সেই চোখের বৈশিষ্ট্যই হল তা গভীর, বিস্মিত এবং উদার। চ্যাপলিন, বাস্টার কিটন থেকে শুরু করে আমাদের দেশেরও প্রায় সব কৌতুকাভিনেতারাই উত্তুঙ্গ শরীরনিয়োজিত অভিনয় করেন, সেই অভিনয়ের সুরের বেনিয়মেই অভিনয়ের মাপ লুকিয়ে থাকে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতিরেকে আর কোনও কৌতুকাভিনেতার নাম মনে আসে না যিনি শরীরনিয়োজিত কমেডি অভিনয়কে প্রায় গুপ্ত রাখেন তাঁর সংযত দৈহিক অভিব্যক্তির প্রকাশে। আর সেকারণেই হয়ত ভানু অবলীলায় ভিন্ন ভিন্ন অভিনয় স্তরে একই দক্ষতায় বিরাজ করেন। ১৯৫৯ সালে নির্মল দের পরিচালনায় ভানু অভিনয় করেন এক কৌতুকশিল্পীর ভূমিকায় ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিতে। আদ্যন্ত করুণরসে সিক্ত এই ছবির প্রহ্লাদ চরিত্রটি কোথাও যেন সমগ্র কৌতুকাভিনেতাদের জীবনকাহিনি হয়ে ওঠে যেখানে ব্যক্তিগত দুঃখবোধের চেয়েও প্রধান হয়ে ওঠে তাদের হাস্যরস পরিবেশনের গুরু দ্বায়িত্ব।

[the_ad id=”270085″]

১৯৭৭ সালে চলে গিয়েছিলেন জহর রায়। তার ৬ বছর পর ব্র্যাকেটের অন্য সদস্য ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আমাদের এই বাংলাদেশে সাধারণভাবে সম্মানপ্রদর্শনের একটা অশুভ চল আছে যা বিদেশী অনুকম্পার ওপর নির্ভর করে। তাই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করার পরই কোথাও যেন উত্তমকুমারও স্বীকৃতি পান অধিকাংশ অগভীর ফিল্মসমালোচকদের কাছ থেকে। ভাবতে অবাক লাগে যে তুলসী, জহর, নৃপতি, রবি সকলেই সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল এই ত্র্যহস্পর্শে উৎকীর্ণ হন নবতর অভিনয়ের উচ্ছ্বাসে। একমাত্র ব্যতিক্রম ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক ব্যক্তিগত আলাপে বলেছিলেন “কখনও হয়ত ভানুর কোনও মন্তব্যে কিছুটা বিরূপ হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। যদিও মানিকদা সে বিষয়ে নিজে আমাকে কিছু বলেন নি। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবে অসম্ভব অভিব্যক্তিপূর্ণ ডাগর চোখের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তিনি তাঁর ছবিতে সাধারণত কখনও সুযোগ দেননি। নাহলে অনুপ, ভানুদা বা সাবিত্রীর মতো অভিনেত্রীও কি কখনও কোনও ছবিতে অভিনয় করতেন না? হয়ত মুখের বা চোখের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটাই ওঁর কোনও কারণে পছন্দ ছিল না।”

ভানু জহর
সহ অভিনেতা ও প্রাণের বন্ধু জহর রায়ের সঙ্গে

শ্রী চট্টোপাধ্যায় হয়ত নির্ভুল। এও হয়ত ঠিক যে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় উন্মুক্ত হতে পারত সত্যজিতের নির্দেশে। কিন্তু সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের উপেক্ষায় এক আনাও কোথাও কম পড়েনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমার বারো বছরের ছেলে যার কাছে অর্ধেকের বেশি সাদা-কালো ছবিই নিরর্থক, অবাস্তব, সেও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমলিন জীবনরসের কৌতুক উপস্থাপনায় অনায়াসে রসাস্বাদন করে। বাঙালির যে উজ্জ্বল সংস্কৃতির গরিমা, সেই ইতিহাসে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক এই কারণেই যুগোত্তীর্ণ অম্লান হয়ে রয়ে গিয়েছেন।

Author Amitava Nag

পেশাগতভাবে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। নেশায় সিনেমাপ্রেমী। চলচ্চিত্র বিষয়ক একাধিক বই লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজিতে। স্মৃতি সত্তা ও সিনেমা, কিছুটা সিঁদুর বাকিটা গোলাপ, সত্যজিত রে'জ হিরোজ অ্যান্ড হিরোইনজ, সিক্সটিন ফ্রেমজ এই লেখকের কিছু পূর্ব প্রকাশিত বই।

Picture of অমিতাভ নাগ

অমিতাভ নাগ

পেশাগতভাবে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। নেশায় সিনেমাপ্রেমী। চলচ্চিত্র বিষয়ক একাধিক বই লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজিতে। স্মৃতি সত্তা ও সিনেমা, কিছুটা সিঁদুর বাকিটা গোলাপ, সত্যজিত রে'জ হিরোজ অ্যান্ড হিরোইনজ, সিক্সটিন ফ্রেমজ এই লেখকের কিছু পূর্ব প্রকাশিত বই।
Picture of অমিতাভ নাগ

অমিতাভ নাগ

পেশাগতভাবে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। নেশায় সিনেমাপ্রেমী। চলচ্চিত্র বিষয়ক একাধিক বই লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজিতে। স্মৃতি সত্তা ও সিনেমা, কিছুটা সিঁদুর বাকিটা গোলাপ, সত্যজিত রে'জ হিরোজ অ্যান্ড হিরোইনজ, সিক্সটিন ফ্রেমজ এই লেখকের কিছু পূর্ব প্রকাশিত বই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস