এখনও অনেকে ‘আড্ডা’ শব্দটিকে ভাল চোখে দেখেন না। তাঁরা মনে করেন আড্ডা মারা মানে সময়ের অপচয়, আর বাজে কথার আড়তদারি করা। আড্ডা মানে পরচর্চা। আমাদের ইসলামে আড্ডার কোনও জায়গা নেই। পরচর্চাকে ইসলামি অনুবাদে বলা হয় গিবত। তার পরিবর্তে ওই সময়ে ধর্মশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা অনেক সওয়াব বা পূণ্যের। কিন্তু শুধু ধর্ম নিয়ে তো আর মানুষ বাঁচে না। মানুষ ধর্ম পালন করে ভয় ভীতি থেকে আর পরকালে সুখে শান্তিতে থাকার জন্য।
সে যাকগে। কথা হচ্ছিল আড্ডা নিয়ে। একা একা আড্ডা হয় না। তার জন্য একাধিকজনের সরব উপস্থিতি চাই। এর কোনও সিলেবাস নেই। কোথা থেকে শুরু হবে আর কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারে না। যারা আড্ডা দিতে ভালবাসে তাদের বলে আড্ডাবাজ। এখানে আড্ডা শব্দের সঙ্গে ‘বাজ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে। যে কারণে ব্যাকরণের ভাষায় একে ‘শব্দ প্রত্যয়’ বা ‘তদ্ধিত প্রত্যয়’ বলা হয়। সচরাচর কোনও শব্দের শেষে ‘বাজ’ থাকলে সেই শব্দের গুণগত মানের খামতি দেখা যায়। যেমন চালবাজ, ধড়িবাজ, ধাপ্পাবাজ, ফেরেববাজ, গলাবাজ ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে আড্ডাবাজ মানুষকেও এদের সমগোত্রীয়ই মনে করা হয়।
কিন্তু আড্ডা যে অবসর যাপনের একটা সেরা মাধ্যম, সেটা অস্বীকার করা যায় না। আড্ডাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সেরা সব রসসাহিত্য। আড্ডা না থাকলে সাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক অধরাই থেকে যেত। কবে থেকে এই রসশিল্পের উদ্ভব তার কোনও লেখাজোকা নেই। আড্ডাবাজ মানুষ অনেকক্ষেত্রেই আড্ডায় বসে তার নানান দুঃখ কষ্ট অভাব অনটন ভুলে যেতে পারে। ‘জমিয়ে আড্ডা’ বলে আমাদের বাংলা ভাষায় একটা কথাই তো আছে! আমাদের কৃষ্ণনগরে একটি প্রতিদিনের আড্ডাস্থান রয়েছে। এর নাম হল ‘কাঠিবন’। অনেকে প্রশ্ন করতে পারে ‘কাঠিবন’ কেন?
এর উত্তরে বলি কাঠি থেকে ‘কাঠিবন’। এই সংস্থার পনেরোজন সদস্য। আমি তাদেরই একজন। সকাল এগারোটায় কাঠিবনের আপিস খোলে। জজ কোর্টের উত্তরে সুবীর সিংহরায়ের বিশাল বাড়ির ছোট্ট একটা ঘরে। সামনে গলি রাস্তা। এই সিংহরায় পরিবার হচ্ছে নদিয়ার নাকাশিপাড়া থানার প্রাচীন জমিদার। এখন জমি নেই, তবে দ্বার ঠেলে ভিতরে উঁকি মারলে বিশাল জমিদারবাড়ি চোখে পড়ে। যদিও এটা তাঁদের সাবেক বাড়ি নয়। তবু এটা জমিদারির নমুনা হিসাবে ধরা যায়।
আড্ডাস্থানের নাম যেহেতু ‘কাঠিবন’ সে কারণে প্রত্যেকের কাজ হল অন্যের পিছনে কাঠি মারা। সেসব কাঠির বয়ান এমনি ধারাল যে কহতব্য নয়। যাঁরা কাঠিবনের সদস্য, তাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, সাহিত্যিক, আইনজীবী, অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ… কে নেই এখানে।
সর্বনিম্ন বয়স যাঁর, তাঁর নাম শেখর শীল। পেশায় অধ্যাপক। বিরাশি বছরের সর্বোচ্চ বয়সের সদস্যটিও অধ্যাপক। এর চেয়েও বয়স্ক মানুষ যিনি ছিলেন, তিনি কাঠিবনের প্রাণপুরুষ শ্রী সুধীর চক্রবর্তী। বাংলা সাহিত্যের লোকসংস্কৃতির গবেষক, সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক হিসেবে যিনি সর্বজনবিদিত। এখানে বয়স কোনও বাধা হয়ে উঠতে পারেনি।
সুধীরবাবু ছিলেন আমাদের সকলের স্যার। তাঁর লেখনীতে যে সাহিত্যরস খুঁজে পেতাম, তা কাঠিবনের আড্ডায় আরও খোলামেলাভাবে পেয়েছি। এমন কোনও বিষয় ছিল না যা আলোচনা হত না। আবার আড্ডা বিষয়ের বাইরে চলে গেলে যেমন রাশ টেনে ধরতেন তেমনি স্তিমিত হয়ে আসা আড্ডাকে জাদুকরী কথার খোঁচায় উসকে দিতেন প্রবলভাবে। তখন বাকি কাঠি-সদস্যদের মুখে কথার খই ফুটত।
সুধীরবাবু এখন নেই, তবু কাঠিবনের আড্ডা চলছে। তিনি ছিলেন আমাদের আড্ডার আচার্য। সুবীর সিংহ রায় উপাচার্য। আমি জানি না এরকম কোনও সংগঠিত আড্ডা অন্য কোথাও আছে কিনা। আর নামকরণ থেকেই বুঝতে পারছেন এখানকার আলোচনার ধরনধারণ।
আমাদের কৃষ্ণনগরে একটি প্রতিদিনের আড্ডাস্থান রয়েছে। এর নাম হল ‘কাঠিবন’। অনেকে প্রশ্ন করতে পারে ‘কাঠিবন’ কেন? এর উত্তরে বলি কাঠি থেকে ‘কাঠিবন’। এই সংস্থার পনেরোজন সদস্য। আমি তাদেরই একজন।
আমি ধুবুলিয়া থানার ন’পাড়া গ্রাম থেকে পনেরো কিমি ঠেঙিয়ে ওখানে পৌঁছতাম। আমাকে দেখে সুবীরদা মানে সুবীর সিংহ রায় বলতেন, ‘স্যার আনসার দেরিতে এসেছে।’ তার মানে ও আজ চা খাওয়াবে। শঙ্কর সান্যাল বললেন, ‘রামদা চা খাবে না, বড্ড মন খারাপ। ওর বউয়ের অসুখ।’ তখন বিভাস বললে, আমিও খাব না। স্যার বললেন, ‘তুমি তো বিয়েই করনি, তোমার চা খেতে আপত্তি কেন?’ সুবীরবাবু সবার মধ্যে জানান দিলেন আজ বিভাসেরও মন খারাপ। স্যার বিভাসের মুখের দিকে তাকিয়ে কারণ জানতে চাইলেন। একসঙ্গে এতজনের মনখারাপ, এটা ভাল লক্ষণ নয়।
সুবীরদা এবার আসল কথা ফাঁস করে দিলেন। বললেন, বিভাসের বিয়ে ভেঙে গিয়েছে স্যার, ও চা খাবে কী করে? হঠাৎ করে রামদা চাঙ্গা হয়ে উঠল সুবীরবাবুর কথা শুনে। বলে উঠল, ‘বেঁচে গিয়েছ বিভাস। বৌকে নিয়ে হাসপাতাল নার্সিংহোম করতে হবে না। গাদা গাদা টাকা খরচা করতে হবে না আমাদের মতো।’ স্যার সব শুনে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বিভাসের যখন ফাঁড়া কেটে গেল তাহলে আনসার নয়, আজ বিভাসই চা খাওয়াবে।’
আসলে আড্ডা তো কেবল শহরে নয়, গ্রামেও হয়। আগে অনেক বেশি হত। খুব ছোটবেলায় আমাদের গাঁয়ে আলম মোড়লের বাড়িতে আড্ডা বসতে দেখেছি। আমার দাদু মাহিরউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। দু’জন সমবয়স্ক আর সমমনস্ক মানুষ একত্র হলে নানান কথার গোঁফ গজাবে এতে আর আশ্চর্য কী! আমাদের বাড়িতে কোনও লোক কুটুমের আগমন ঘটলে দাদুর খোঁজ পড়ত। কারণ তিনিই মাতব্বর। তাঁর কাছে টাকা পয়সা। সেই টাকা দিয়ে কুটুম্বের খাতির যত্ন হবে।
আমাদের উপর হুকুম হত দাদুকে খুঁজে আনা। আমাদের অবশ্য খুঁজতে হত না। তিনি আলম মোড়লের বাড়ি আছেন সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। সোজা তাঁর ঘরের দাওয়ায় হামা টেনে উঠে পড়তাম। দাদুকে বলতাম, কুটুম এয়েচে, তোমাকে ডাকচে। দাদু তখন বেঘোরে আড্ডা দিচ্ছেন। আর হুঁকোয় মুখ ডুবিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন। আমাদের দেখে তাঁর মেজাজ বিগড়ে যেত। বলতেন, কুটুম এয়েচে তো আমি কী করব? আমি কি ঘরবাড়ি মাথায় করে তুলে এনেছি এখানে?
সুধীরবাবু ছিলেন আমাদের সকলের স্যার। তাঁর লেখনীতে যে সাহিত্য রস খুঁজে পেতাম, তা কাঠিবনের আড্ডায় আরও খোলামেলাভাবে পেয়েছি। এমন কোনও বিষয় ছিল না যা আলোচনা হত না। আবার আড্ডা বিষয়ের বাইরে চলে গেলে যেমন রাশ টেনে ধরতেন তেমনি স্তিমিত হয়ে আসা আড্ডাকে জাদুকরী কথার খোঁচায় উসকে দিতেন প্রবলভাবে।
দাদু ছিলেন কৃপণ মানুষ। কাউকে বিশ্বাস করতেন না। কেউ যাতে গোপনে বিক্রি করে দিতে না পারে সেইজন্য ধানের গোলায় তালা দিয়ে রাখতেন। সিন্দুকেও তাই। কুটুম্বের যত্নআত্তির জন্য আলম মোড়লের বাড়ির আড্ডা ছেড়ে বেরুতে হবে এই দুঃখে কোমরের কষি থেকে চাবির গোছা আমাদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিতেন বাইরে। আমরা ভীষণ আশ্চর্য হতাম! গার্হস্থ্য জীবনের এতটা বিষয়জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ স্রেফ আড্ডার কারণে চাবির গোছা কী করে ছুঁড়ে দিতেন বাইরে!
আলম মোড়লের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। বলা যায় এপাড়া ওপাড়া। আমার তখন বারো তেরো বছর বয়স। খেলতে প্রায়শ চলে যেতাম। কখনওসখনও আলম মোড়ল আমাকে ডাকতেন হাত ইশারায়। যাওয়ামাত্র বলতেন, কী রে, বাড়িতে কুটুম এয়েচে? দাদুকে ডাকতে এয়েচিস? আমি ‘না’ বলতেই আলম মোড়ল হাতে হুঁকো ধরিয়ে বলতেন, হুঁকোয় ভাল করে পানি ভরবি আর নতুন করে তামাক সাজবি কলকেয়।
তাঁর কথা মানতে হত। হুঁকোর খোলে টাটকা কলের জল ভরতাম। কলকে উপুড় করে পুরাতন ছাই ঝেড়ে নতুন করে তামাক সাজতাম। তারপর উনুন থেকে গনগনে আগুনের খারি কলকের মাথায় চাপিয়ে দিতাম। কাজটা খুব কঠিন হলেও বড়দের হুকুম। তাঁকে খুশি করতে হুঁকোর খোলে মুখ ডোবাতাম। গড়গড় করে হুঁকো ডেকে উঠত। মনে হত আলম মোড়লের হুঁকো আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
প্রথমদিকে অবশ্য খকখক করে কাশি হত। চোখমুখ লাল হয়ে উঠত। পরে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। তামাকে আগুন ভালমতো জ্বলে উঠলে আলম মোড়লের হাতে তুলে দিতাম। সেই হুঁকো খেতে খেতে দাদুর সঙ্গে ওঁর জমিয়ে আড্ডা হত। কী গল্প হত, সেদিকে আমার তেমন আকর্ষণ ছিল না। মাঝে মাঝে ওঁরা হো হো করে হাসতেন। হাসতে হাসতে দাদুর তো লুঙ্গির কষি খুলে পড়ার অবস্থা। ততক্ষণে কল্কের আগুন কেটে যেত। যে কারণে আমার ডাক পড়ত কলকে সাজার। আমি ওই ডাকের অপেক্ষায় দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকতাম। কারন ততদিনে আমাকে তামাকের নেশায় ধরেছে। খুব ভাল লাগত খাম্বেরি তামাকে সুখটান। এই সুখটান আমাকে ভুলিয়েছিল খেলাধুলো, পড়াশুনো।

আলম মোড়লের হুঁকোটাকে বড় আপন মনে হত। এত জোরসে হুঁকোয় টান দিতাম, যে তার অতবড় বাড়ির হেঁসেল, গোহাল সাদা ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে উঠত। মনে হত দমের টানে এবার বুঝি কলকে ফেটে যায়।
কিন্তু আমার তামাক সেবনের কথা কী করে যে বাবার কানে পৌঁছে গিয়েছিল, জানি না। হয়তো পাড়ার কেউ বলে থাকবে, না হলে সহপাঠীদের কেউ। বাবা আমাকে একদিন বললেন, ‘বড়খোকা, এদিকে শুনে যাও দিকিন।’ আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। এমন তোয়াজ করে বাবা তো কখনও ডাকেন না আমায়!
– আজ ইস্কুলে গিয়েছিলে?
– না। কাল যাব।
– আজ যাওয়া হয়নি কেন?
– শরীর খারাপ।
– কই আমাকে তো বলনি?
আমি পচাডাঙা হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। যিনি আমাদের ক্লাসটিচার তিনি বাবার এককালের সতীর্থ। বাবা তাঁকে বলেছিলেন, নেপাল, ছেলেটাকে একটু দেখিস। বেশ কিছুদিন আমাকে ইশকুলে দেখতে না পেয়ে নেপাল মাস্টার বাবার কাছে অনুযোগ করেছেন, তোর ছেলে তো ইশলেই আসে না, দেখব কী? মাস্টার মুখের ওপর এইভাবে বললে বাবার অপমানিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থেকে যায়। আমাকে বললেন, ‘হাঁ কর দিকিন?’ আমি হাঁ করলাম। ‘এবার জোরে নিঃশ্বাস ছাড়।’
বাবার আচরণ আমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। আমাকে তুই তুই করে কথা বলা বাবা তুমি তুমি করছেন। আবার জোরে নিশ্বাস ছাড়ার কথা বলছেন। কী ব্যাপার? আমার সন্দেহ হয়, এরকম করে তো ও পাড়ার ন্যাড়া ডাক্তার রোগের চিকিৎসা করে। বাবা আবার কবে ডাক্তার হলেন? আমি নিঃশ্বাস ছাড়তেই বাবার নাকে তামাকের কটু গন্ধ ধাক্কা লাগল। আর তখুনি খপ করে বাঁ হাত চেপে ধরে চড়থাপ্পড় দিতে শুরু করলেন।
– হারামজাদা! হুঁকো খাওয়া শিখলি কবে? তোর মুখের গন্ধে আমার মাথা ঘুরছে।
আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার মুখনিঃসৃত তামাকের গন্ধ সহ্য করতে না পেরে বাবা মুখ বিকৃত করে যথেচ্ছভাবে ধোলাই দিয়ে যাচ্ছেন। শেষপর্যন্ত মায়ের আঁচলের আশ্রয়ে কোনওমতে বেঁচে গেলাম। দাদু আলম মোড়লের বাড়ি থেকে আড্ডা শেষ করে বাড়ি ফিরতেই আর এক প্রসঙ্গে দক্ষযজ্ঞ বেধে গেল বাড়িতে। বাবা অনেকটা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
– আমার ছেলেকে শেষ পর্যন্ত হুঁকো খাওয়া শেখালে? দাদু তিরিক্ষি মেজাজে বললেন,
– কীসব আজেবাজে কথা বলিস? হুঁকো খাওয়া শেখাতে হলে তোকে শেখাতাম। তোর ছেলেকে শেখাব কোন দুঃখে?
– ও তো খায়। বিশ্বাস না হয় ওর মুখটা শুঁকে দেখ।
– কেউ নিজে নিজে খেলে তার জন্য আমি কী করতে পারি?
– তবু একবার শুঁকে দেখ।
বাবা একটু আধপাগল টাইপের। যে লোকটা আলম মোড়লের বাড়ি থেকে হুঁকোয় দম মেরে ফিরল, তাকেই কিনা বলছে ছেলের মুখ শুঁকে দেখতে। তামাকখোর মানুষ অন্যের মুখের তামাকের গন্ধ কীভাবে পেতে পারে, সেই আক্কেল বুঝি হারিয়ে ফেলেছেন বাবা।
বাড়ির এই ঝগড়াঝাঁটি চিৎকার চেঁচামেচি আশপাশের পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল, যেমন করে আলম মোড়লের হুঁকোর সাদা ধোঁয়া একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে। পাড়ার লোকজন ভিড় করল। সহপাঠীরা হাজির কেউ কেউ, তারা আমার ইশকুলে গরহাজিরার খবর জানাতে লাগল। আমি নেশাসক্ত কিনা, যাচাই করার জন্য এক একজন পড়শি এমন আচরণ করছে, যেন মনে হচ্ছে ওরা আমায় ভালবেসে আমার মুখে চুমু খেতে আসছে।
আমার পড়াশুনার হাল হকিকত কীরকম, তা বোঝার জন্যে যাবতীয় বইপত্র উঠোনে ডাঁই করে ফেলল বাবা। দেখা গেল শুকনো কালির দোয়াত। বইয়ের উপর ধুলোর আস্তরণ। বাংলা খাতা, অঙ্ক খাতা উইপোকাতে অর্ধেক সাবাড় করে দিয়েছে। ইংরেজি খাতা কীভাবে কাটতে হবে ওরা বুঝি তখনও বুঝে উঠতে পারেনি। দেশের মানুষ যখন ওই বিদেশি ভাষার কাছে ঘোল খেয়ে যায়, তখন উইপোকার আর দোষ কী! বাবা কড়া গলায় বললেন,
– কাল থেকে সোজা ইস্কুলে যাবি।
ছোমেদ চাচা বললেন,
– ছেলে কিন্তু নেশা করে ফেলেছে। ইশকুলে গিয়ে হুঁকো ছাড়া কি থাকতে পারবে? হঠাৎ করে নেশা ছাড়াতে গেলে শুনেছি মানুষ নাকি দম ফুটে মারা যায়।
দম ফুটে মরে যাবার কথা শুনে থপ করে বসে পড়লেন বাবা। ছোমেদ চাচা বললেন,
– তোমার আবার কী হল?
– ও কী কথা বললে তুমি?
– ওটা তো মানুষের কথা বললাম। তোমার ছেলে তো ছেলেমানুষ। ছেলেমানুষের জান খুব শক্ত হয়।
পুব পাড়ার প্যাঙা সেখ বললে,
– ছোমেদভাই কথাটা ঠিক বলছে না। নেশার কাছে ছেলেমানুষ বড়মানুষের কী আছে। অত ইক্সিতে কাজ নেই। ছেলে সকালবেলা এক কলকে খেয়ে ইশকুলে যাক, তারপর বাড়ি ফিরে এক কলকে খাবে ভাত খাওয়ার পর। এইভাবে আস্তে কাটাতে হবে।
আমার সন্দেহ হয়, এরকম করে তো ও পাড়ার ন্যাড়া ডাক্তার রোগের চিকিৎসা করে। বাবা আবার কবে ডাক্তার হল? আমি নিঃশ্বাস ছাড়তেই বাবার নাকে তামাকের কটু গন্ধ ধাক্কা লাগল। আর তখুনি খপ করে বাঁ হাত চেপে ধরে চড়থাপ্পড় দিতে শুরু করলেন।
বাবা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
– ছেলে বাঁচাতে হলে তোমরা যা বলবে তাই করতে হবে। এ কথা বলে বাবা আমার পাশে বসলেন। গায়ে মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁরে বাপ, নেশা না করে ইশকুলে গিয়ে সারাদিন থাকতে পারবি? আমি খাটো গলায় বললাম, পারব।
– বোঝ ভাল করে। যদি না পারিস, তাহলে ইশকুলে যাবার আগে তোর দাদুর সঙ্গে আলম মোড়লের বাড়ি গিয়ে এক কলকে খেয়ে আসিস।
বাবা কতটা অসহায় হয়ে আমাকে এহেন প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেটা বুঝেছিলাম। সেদিনই কঠোর পণ করেছিলাম, আর কোনওদিন তামাক ছোঁব না। হুঁকোর গালে চুমুক না দিয়েই পরদিন থেকে পচাডাঙা হাইস্কুলের বেঞ্চিতে বসে দিব্যি ক্লাস করতে লাগলাম।
গ্রামীণ আড্ডা বর্ষাকালে জমে ভাল। চারিদিকে ঝুপঝুপে বৃষ্টি আর ভিজে বাতাসের শনশন শব্দ। বাইরে বেরুনোর খুব একটা দরকার হয় না। বাড়ির খোপচালায় বসে সবাই মিলে বেশ আড্ডা দেওয়া যায়। এরকম আবহে আড্ডা চলছিল আমাদের গাঁয়ের দখিনপাড়ায় হাপু সেখের বাড়িতে। পথের ধারে বাড়ি। বাড়ির একপাশে খোপচালা। এখান থেকে রান্নাঘর সটান দেখা যায়। সেখানে খিচুড়ি রান্না হচ্ছিল। বর্ষাকালের পাগলা বাতাস খিচুড়ির সুবাস নিয়ে খোপচালার দিকে তেড়েফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছিল।

এমন সময় একজন পথচলতি মানুষ বাদুড় ভেজা হয়ে খোপচালায় ঢুকে পড়ল। সেখানে একটা মাথালি ছিল। সেটা মাথায় দিয়ে হাপু সেখের ছেলেরা একে একে রান্না ঘরে ঢুকে গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে আসে আর সরবে মেতে ওঠে আড্ডায়। আগন্তুক মানুষটিরও খিদে পেয়েছিল যথেষ্ট। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। পেটে খিদে নিয়ে কে আর অনর্থক আড্ডা শুনতে চায়। শেষমেশ হাপু সেখের ছেলেদের বলে উঠল, তোমাদের মাথালিটা একটু পাওয়া যাবে?
এবার ভিখারিদের আড্ডার কথা বলি। ওদের জীবনে যে আড্ডা আছে, সেটা চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেছি। কীভাবে? সেটাই বলি। আমাদের গাঁয়ে প্রতি বুধবার ভিক্ষার দিন। আশপাশের আটদশখানা গ্রাম থেকে ভিখারি আসে, ফকির আসে। গাঁয়ের পুবদিকে জলঙ্গী নদী। ওপারে হুন্দি গ্রাম। ওখান থেকে কিছু বাউল শ্রেণীর মানুষ আমাদের গাঁয়ে মাধুকরী করতে আসে। পরনে গেরুয়া বসন, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কাঁধে ন্যাকড়ার ঝোলা, সেটিও গেরুয়া।
আমার বাড়ির পাঁজরে একটি নিমগাছ। জষ্ঠিমাসে পাথরকাটা দুপুরে ওই নিমতলায় বসে ভিখারি ফকিরের দল বিশ্রাম নেয়। পাশেই টিউকল। হাতমুখ ধোয়, জল খায়। গেরুয়াধারীরা ওই শান্ত ছায়ায় বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দেয়। আমার বাবা আর চাচা ওদের ওই আড্ডায় মাঝে মাঝে অংশগ্রহণ করে। আমিও একটু দূর থেকে শুনি। যেটুকু বুঝেছি অধিকাংশ আলোচনা হয় দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, আর নিগূঢ় তত্ত্ব বিষয়ক। সুধীর চক্রবর্তী মহাশয়ের বই পড়ে এ বিষয়ে অনেকখানি ধারণা তৈরি হয়েছে।
এরকম আবহে আড্ডা চলছিল আমাদের গাঁয়ের দখিনপাড়ায় হাপু সেখের বাড়িতে। পথের ধারে বাড়ি। বাড়ির একপাশে খোপচালা। এখান থেকে রান্নাঘর সটান দেখা যায়। সেখানে খিচুড়ি রান্না হচ্ছিল। বর্ষাকালের পাগলা বাতাস খিচুড়ির সুবাস নিয়ে খোপচালার দিকে তেড়েফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছিল।
আমার বাবা আর চাচা বেশ মগ্ন হয়ে দেহতত্ত্বের পাঠ নেন। শোনেন কেমন করে কামরূপী কুমিরকে দমন করতে হয়। এমন সময় প্রায় সাড়ে ছ’ফুটের কাছাকাছি উচ্চতার জনৈক বাউল হাতে কমণ্ডলু নিয়ে আবির্ভূত হলেন। প্রথম বাউলের তত্ত্বকথা শুনে তিনি বড় আক্ষেপের সঙ্গে বলে উঠলেন, থামো গো থামো গোঁসাই। তোমাকে আর অত ব্যাখ্যা করতে হবে না। দিনের বেলা সবাই সাধু সাজো, আর সন্ধ্যেবেলা সব শালা বিলের ধারে কাঁদতে বস।
বাবা চাচার সামনে আমি এক শিক্ষিত ছেলে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করে যেন পাথর বনে গেলাম। জীবনের প্রকৃত পাঠ বুঝি একেই বলে। নিরক্ষর বাউলের কাছ থেকে জেনে নিলাম কাম কী, কুমির কী? আর বিল? হ্যাঁ বিশ্বের তাবৎ মানুষকে তার সামনে সত্যি সত্যি সন্ধেবেলা কাঁদতে বসতে হয়।
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Youtube
আনসারউদ্দিনের জন্ম ১৯৫৯-তে নদিয়ার শালিগ্রামে। কৃষ্ণনগর কলেজের স্নাতক হয়েও গ্রামের শিকড় ছেঁড়েননি। পেশায় আজও প্রান্তিক কৃষক। বাড়ি নদিয়ার ধুবুলিয়ায়। গ্রামিক জনযাপনের চিত্রলেখই তাঁর সাহিত্যকৃতির মূল বিষয়বস্তু বরাবর। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই 'আনসারুদ্দিনের গল্প' ধ্রুবপদ প্রকাশনা থেকে। তারপর আরও এগারোটি বই লিখেছেন। পেয়েছেন বাংলা অকাদেমির সোমেন চন্দ পুরস্কার, আন্নদাশঙ্কর রায় স্মারক পুরস্কার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইলাচন্দ পুরস্কার-সহ বহু সম্মাননা। শখ বলতে বই পড়া, খবরের কাগজ পড়া আর খবর শোনা।