আগন্তুকের সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে? উড়ে এসে জুড়ে বসা ছোটমামা মনমোহনকে (উৎপল দত্ত) কালটিভেট করার জন্য সুধীন্দ্র বোসের (দীপঙ্কর দে) বাড়ির বৈঠকখানায় জমায়েত হয়েছে। যাকে বলে বন্ধুসমাগম। কথায় কথায় বাঙালির মনোপলি, বাঙালির ইনভেনশনের প্রসঙ্গ পাড়লেন রঞ্জন রক্ষিত (রবি ঘোষ) বলে একজন। বললেন, সেটা মনমোহন নির্ঘাত বিদেশে খুব মিস করেছেন।
মনমোহনের কৌতূহল বাড়ল। জিজ্ঞেস করলেন, ‘রসগোল্লা?’ তখনও রসগোল্লার পেটেন্ট নিয়ে ওডিয়াদের সঙ্গে আমাদের আদায়-কাঁচকলায় হয়নি। বিলেত-আমেরিকায় কে সি দাসের স্পঞ্জ রসগোল্লার রফতানি শুরু হয়নি। ফলে এ কথা জিজ্ঞেস করার সঙ্গত কারণ ছিল। উত্তর এল – ‘আড্ডা! নির্ভেজাল আড্ডা! রকে বসে আড্ডা, পার্কে বসে আড্ডা, লেকের ধারে আড্ডা, কফিহাউসে আড্ডা – যেটা না হলে বাঙালির ভাত হজম হয় না! আড্ডা – মেড ইন বেঙ্গল!’
আর থাকতে পারলেন না মনমোহন। উঠে পড়লেন। ‘অ্যালাউ মি টু কনট্রাডিক্ট ইউ মিস্টার রক্ষিত!’ বলে কথার গতিমুখ ঘুরিয়ে দিলেন। তার পরের দেড় মিনিটে যে কথা-চালাচালিটা হল সেটাকে আড্ডা সম্পর্কে সত্যজিৎ প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান উদাসীনতার বিজ্ঞাপন বলা যেতে পারে। আগন্তুক ছবিটা চাইলেই দেখে নেওয়া যায় এখন। ইউটিউবে সার্চ করলেই হবে। দেখলে বোঝা যাবে আড্ডার কোন পরাকাষ্ঠাকে সামনে রাখতে চাইছেন সত্যজিতের মুখপাত্র মনমোহন।
আড়াই হাজার বছর আগেকার গ্রিসে যে আখড়া ওরফে জিমন্যাসিয়াম ছিল, তার কথা পাড়লেন তিনি। জুভেনালের ল্যাটিন প্রবচন তুলে এনে মনে করালেন আথেন্সের জিমন্যাসিয়াম ছিল সেই পীঠস্থান ‘যেখানে শরীর এবং মন দুটোরই চর্চা হত।’ সক্রেটিস, প্লেটো, আলসিবায়াডিসের মতো সে যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী-গুণীদের জমায়েত হত সেখানে। হরদম। আলোচনাচক্র বসত। কী নিয়ে? দর্শন রাজনীতি গণিত শিল্প সাহিত্য – কী নয়! প্লেটোর ডায়লগের পাতায় এর ধারাবিবরণী রয়ে গেছে। ‘একে আপনি কী বলবেন?’ আলগা করে কটাক্ষ ছুঁড়ে দিলেন মনমোহন। থতমত খেয়ে ঢোঁক গিলতেই হল মিস্টার রক্ষিতকে – ‘এ তো এক ধরনের আড্ডাই!’ ডান হাতের তর্জনি ওপরে তুলে মনোমোহন জুড়ে দিলেন, ‘বাট অ্যাট দ্য হায়েস্ট লেভেল! পরনিন্দা নয়, পরচর্চা নয়, মুখেন মারিতং জগৎ নয়।’
লিখতে বসে ওই তর্জনী-নির্দেশ দেখতে দেখতে রাফায়েলের আঁকা ফ্রেস্কো ‘স্কুল অফ আথেন্স’ মনে পড়ছিল। রাফায়েল যতই সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার স্থাপত্যরীতিকে অনুসরণ করুন না কেন, ওটা আদতে ওই জিমন্যাসিয়ামের ছবি। আলোচনাচক্র চলছে। ছবির একেবারে মাঝ বরাবর ওই রকম তর্জনি তুলে এগিয়ে আসছেন প্লেটো। তাঁর পাশে অ্যারিস্টটল।
আশেপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে যাঁরা আছেন, তাঁদের ঘরে ফেরানোর মধ্যেই রেনেসাঁসের মৌল সূত্র লুকনো– পিথাগোরাসকে নিজের সূত্র বোঝানোর চেষ্টা করছেন আর্কিমিডিস, সক্রেটিসের কথায় বুঁদ হয়ে আছেন এস্কাইনেস, আঁক কষছেন হেরাক্লিটাস, হেলান দিয়ে গা এলিয়ে বসে আছেন ডায়োজিনিস। কেউ কেউ ওই ফ্রেস্কোর মধ্যে আলেকজান্দার দ্য গ্রেটকেও খুঁজে পেয়েছেন। কেউ বলেছেন না, উনি অ্যালসিবায়াডিস। মিল পেতেই পারেন, কারণ যোদ্ধা আর দার্শনিকের কোনও বিরোধাভাস সে আমলের গ্রিসে ছিল না।
কিন্তু কলকাতায় ছিল। আড্ডা ‘অ্যাট দ্য হায়েস্ট লেভেলে’র জন্য একশো বছর আগেকার কলকাতা তৈরি ছিল না, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ‘কোদাল চালাই’ আর ‘মানের বালাই’য়ের আড়াআড়িকে মান্যতা দিয়েছিল কলকাতা। অনুশীলন সমিতি গোছের গুপ্ত সমিতি বা পুলিনবিহারি দাসের লাঠিখেলার আখড়া বা সুভাষচন্দ্র বসুকে সামনে রেখে এগিয়ে চলা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের কুচকাওয়াজ বা কুস্তি-জুজুৎসু শেখার মধ্যে মেধাচর্চা গুরুত্ব পায়নি। পায়নি বলেই গুরুসদয় দত্তর ব্রতচারী আন্দোলনের পেছনে শরীর ঝালাই আর মগজ ধোলাইয়ের সহাবস্থানই ছিল অভীষ্ট।
১৯৪০-এর দশকে পাকিস্তানপন্থী বাঙালিরা পার্ক সার্কাস ময়দানে ‘মুকুল ফৌজ’ গড়ে তুলেছে। সেখানে মোটেই জঙ্গিশাহির পাঁয়তারা কষেনি কেউ। স্বদেশী যুগে সাহেবি শিক্ষাব্যবস্থার সমান্তরালে দেহমনের যুগপৎ বিকাশের লক্ষ্যে নানান পথে ঘুরপাক খেয়েছে এই সব উদ্যোগ। কোনওটা লড়াইয়ের ময়দানে ঘুরে গেছে। কোনওটা থিতিয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠাকামী বাঙালির এক বড় অংশের কাছে এসব সাংগঠনিক উদ্যোগের বড় একটা গুরুত্ব ছিল না। ‘কালি কলম মন, লেখে তিনজন’ জাতের প্রবচন নইলে তৈরি হত না।
এভাবে মগজের সঙ্গে মেহনতকে না মেলানোই আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। জিমন্যাসিয়াম নিছক ব্যায়ামের আখড়া হয়ে থেকেছে। সেখানকার কৃতীদের নিয়ে সত্যজিতের যে বড় একটা আগ্রহ ছিল না, নিছক কৌতূহল ছিল, তার প্রমাণ আছে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে। হোটেলের ঘরে ব্যায়ামবীরের সঙ্গে ফেলুদা-তোপসে-জটায়ুর রংতামাশা মনে করুন, বুঝতে পারবেন।
তবে ‘আগন্তুকে’র সত্যজিৎ যেটা করেছেন, সেটা হাল আমলের আড্ডাবাজদের কাছে আপত্তিকর ঠেকতে পারে। সাবেক আমলের আড্ডাবাজদের কাছেও তা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। যে রকের আড্ডাকে সাহিত্যপদবাচ্য করে তুলছে তাঁর সমকালীন কলকাতা, তাকে আমল দিচ্ছেন না তিনি। পার্কে বসে আড্ডা বা লেকের ধারে আড্ডাকেও না। এমনকি ‘কফিহাউসের সেই আড্ডা’কেও গৌরবান্বিত করতে ভারী বয়েই গেছে তাঁর।
তবে খোদ সত্যজিৎ যে কফিহাউসে আড্ডা দেননি তা তো নয়! ডি জে কিমারে চাকরি করার সময় বা ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি করার সময় সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যু কফিহাউসের হাউস অফ লর্ডসে নিয়মিত ছিলেন তিনি। ইয়ারবকশিদের মধ্যমণি হয়েই বিচরণ ছিল তাঁর। অথচ গ্রিসের মাপকাঠি তুলে এনে সেই আড্ডাকেও নস্যাৎ করেছেন সত্যজিৎ ওরফে মনমোহন। আবার মনোমোহনকে কোট করি, ‘কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা হয়– মানে আমাদের সময় যা হত- এখন তো সবই নিম্নগামী – একটা অন্তঃসারশূন্য টোয়্যাডল ছাড়া আর কিচ্ছু নয়!’
টোয়্যাডল কথাটার চটজলদি বাংলা হল আবোলতাবোল বকা। গুলতানির চেয়েও যা অপকৃষ্ট। ‘লুকোচুরি’ ছবিতে কিশোরকুমারের গলায় কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ গানে আছে– ‘তাগড়াই বেঁটে বড়দা, খায় পান সাথে জর্দা/গুলবাজি ডিগবাজি রকবাজি শুধু চলে।’ এই গুলবাজি ডিগবাজি রকবাজিকে দুরমুশ করার জন্য টোয়্যাডল ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে গেছেন সত্যজিৎ। এক ক্ষেপণাস্ত্রে ঘায়েল করে গেছেন টেনিদা ঘনাদা সমেত যতেক লিটারারি আইকনকে।
তবে কি সত্যজিৎ আড্ডা দিতেন না? আলবাৎ দিতেন। কী ধরনের আড্ডা দিতেন? মানে তাঁদের সময়– অর্থাৎ ১৯৪০-৫০-এর দশকে আড্ডা কেমন হত?
কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘কুদ্রত রঙ্গিবিরঙ্গী’র একেবারে গোড়ার দিকে এ ধরনের আড্ডা আর আড্ডাবাজদের একটা লবেজান ছবি আঁকা আছে। তাকে ওই সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যু কফিহাউসের আড্ডার সম্প্রসারণ বলা চলে। কুমারপ্রসাদ বয়সের দিক থেকে সত্যজিতের খাস দোস্তদের চেয়ে বছর ছয়েকের ছোট হলেও মৌতাত জমতে অসুবিধে হয়নি। সত্যজিৎ না থাকলেও তাঁর সতীর্থদের কেউ কেউ এখানে আছেন। এ আড্ডার চার চরিত্র – কুমারপ্রসাদ, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ওরফে শাঁটুলবাবু, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত ও তপন রায়চৌধুরী। গানবাজনার দুনিয়ায় মশগুল হবার ধরতাই হিসেবে কুমারপ্রসাদ লিখছেন –
“… কিন্তু সবুর করুন, আড্ডাবাজ লোকেদের একটু করুণার চক্ষে দেখুন। আমরা গালগপ্পো করতে করতে একটু খেই হারিয়ে ফেলি, আরব্য উপন্যাসের মতো গল্পর পেট থেকে গল্প বেরিয়ে আসে। আর আড্ডার আপনারা কী দেখেছেন? শুধু চা কফি পকোড়ার জোরে দুটি পূর্ববঙ্গের বৈদ্যকুলরত্ন অধ্যাপক রবি দাশগুপ্ত ও তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে দিল্লির Constitution House–এর ঘরে সাড়ে এগারো ঘণ্টা নন্-স্টপ আড্ডা মেরেছিলাম। আর একবার রাধাপ্রসাদ গুপ্ত (শাঁটুল) আজ থেকে আনুমানিক চল্লিশ বছর আগে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বালিগঞ্জে আমার বাড়িতে এলেন পণ্ডিতিয়া রোড থেকে। এসেই বললেন, “আর বলবেন না, কী মুশকিল মশায়, সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে, একটা ছোঁড়া পড়তে আসবে শালকে থেকে।” যথারীতি ট্রাম স্টপেজে এগিয়ে দিতে গেলাম চারটে নাগাদ। যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেল, উনি প্রায় শেষ ট্রাম ধরলেন রাত সাড়ে দশটায়।
এডমন্ড হিলারি সায়েব তেনসিঙ্কে নিয়ে এভারেস্ট জয় করে ফেরার পর সে ছবি লাইট হাউস সিনেমায় দেখানো হয়েছিল। দেখে সুভাষ ঘোষাল বলেছিল, “ওদের জায়গায় তুমি আর শাঁটুলবাবু হলে বেলাবেলি ক্যাম্প্ ফাইভে ফেরা হত না, পা-টি ঝুলিয়ে এভারেস্টের মাথায় আড্ডা দিতে দিতে benighted হয়ে যেতে।”
কুমারপ্রসাদের লেখার এমন টান যে কোটেশন দিতে শুরু করলে এ লেখা আর শেষ হবে না। এখানেই ক্ষ্যামা দেওয়া যাক। শুনে মনে ও মেনে নেওয়া যাক যে, সে সব আড্ডা আর আড্ডাবাজ আজকের দিনে একেবারে নেই, তা নয়। তবে তাঁরা বিলীয়মান প্রজাতি না অভয়ারণ্যের জীব এ নিয়ে আর একটা আড্ডা জমতে পারে!
*ছবি সৌজন্য: Indiatimes, Facebook, Youtube
One Response
লেখাটা পড়ে খুব আনন্দ পেলাম । ক্রমাগত অন্তঃসারশূণ্য আড্ডায় যখন আমরা ক্লান্ত ও ধ্বস্ত তখন এই রকম লেখা আমাদের ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় । মনের কথা বলে । রবি ঠাকুর্রের কথায়, “তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার । “
খুবই ভালো বিষয় কিন্তু কতজন সহমত হবেন আর কতজন এই আড্ডার সঙ্গী হিসাবে উৎসাহী হবেন তা আলোচনা সাপেক্ষ । তাতে কিছু যায় আসে না ।