‘যে টেলিফোন আসার কথা’, এই লাইন মনে পড়লেই অনিবার্যভাবে যাঁকে মনে পড়ে, যে কবিকে– তিনি পূর্ণেন্দু পত্রী। ওঁর জন্ম হাওড়া জেলার নাকোল গ্রামে। আমার শৈশবের গ্রাম হরিহরপুরের পর দখিন মুখে কয়েকটা মাঠ পেরলেই। কবির খুড়তুতো ভাই অলকেন্দু পত্রী (পুরো নাম: অলকেন্দুশেখর পত্রী) ছিল আমার বন্ধু। আজ লিখতে বসে মনে হল স্মৃতি হাতড়াই। ছাই ওড়াই।
অলকেন্দুকে নিয়ে দু’-একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। তিনটি গল্প– দুটো সরাসরি আমার নিজের অভিজ্ঞতা, একটি শোনা। শোনা কথাটি যে শুনিয়েছিল, তাও তাঁর প্রত্যক্ষ বলেই জানতাম। পরে একই কাহিনি ইতরবিশেষে অন্যেও শুনিয়েছেন।
অলকেন্দু পেশায় নয়, নেশায় ছিল ছবি-আঁকিয়ে। বাণিজ্যিক পত্রিকায় প্রচ্ছদও করত মাঝেমধ্যে। আমার সঙ্গে ঠিক কবে আলাপ, মনে নেই। তবে তখনও ও বে’ করেনি। বিয়ে করবে কী? বাঁধা রোজগার কই? অবশ্য এর একটা সমাধান নিজেই বের করেছিল। ছেলেটিই রোজগার করবে? তা কেন! সংসারে যদি রোজগেরে বউ পাই তো বসে খাই! অলকেন্দু বিয়ে করেছিল বিদ্যাসাগর কলেজের সাতসকালের মহিলা বিভাগের রসায়নের অধ্যাপিকা ললিতা পত্রীকে। ললিতা অলকেন্দুকে আজীবন বহন করেছেন। ওদের একটিই সন্তান– মহর্ষি।
তো বিয়ের গল্পটিও বলে ফেলি? এটা ফাউ।
পাত্রী বিদূষী। কিন্তু শ্যামবর্ণা। মেজাজে গম্ভীর। মানানসই গতরে পৃথুলা। আর পাত্র, যাঁরা কফি হাউসে তাকে দেখেছেন, গুম্ফশ্মশ্রুশোভিত অলকেন্দুকে, ভাবতেই পারবেন না সাতের দশকে সেই বুদ্ধিদীপ্ত, ছিপছিপে, দীর্ঘকায় ছেলেটির কী ‘বাজার’ ছিল। দেখলে চোখ ফেরানো কঠিন! কিন্তু ললিতার চোখ যা ছিল বইয়ের পাতায়। অলকেন্দু পাতায় বসল মাছির মতো। ললিতা খাপ্পা! অনুমান করছি। অলকেন্দু খাপ খুলল, সরাসরি। আমাকে বিয়ে করবেন?
কালো মেয়েদের নিয়ে আমাদের বাংলায় রবি ঠাকুরের ‘কালো তা সে যতই কালো হোক’ কালো হরিণ-চোখের কৃষ্ণকলির কবিতা আছে, আছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আফ্রিকা’ কবিতার সেই গর্ভিনী নারীও, যে নবজাতকের নাম রাখবে আফ্রিকা, কালো মেয়েরা গায়ে প্রজাপতি বসলে ‘আ মরণ’– এই আক্ষেপে কাতর হত এই সেদিনও। এখনও? বিষয়ান্তরে চলে যাচ্ছি। এই বয়সে স্মৃতিরা ওতপ্রোত। প্রসঙ্গে ফিরি। ললিতা স্বভাবতই পাত্তা দেননি। অলকেন্দু লেগে থাকল।
– ভেবে দেখো ললিতা। তুমি ঘ্যাম একটি চাকরি করো। অধ্যাপিকা। ভাল বেতন। কিন্তু কালো। কে তোমাকে বিয়ে করবে? আমি আবার দেখতে মাকাল ফল। কিন্তু আয়পয় নেই। চাকরিও করব না। আমারও বিয়ের বাজারে দাম নেই। দু’জনেই বাতিলের খাতায়। হাত মেলাবে? এসো, সংসার পাতি।
ললিতা শুনতে শুনতে গলে গেলেন। পাথরও গলে! এই গল্পটিতে রং চড়তে চড়তে শেষ যে ভাষ্যটি পাওয়া গিয়েছে, তা হল অলকেন্দু বীণা সিনেমার উল্টোদিকের ফুটপাথে ললিতার পথ আটকে সাষ্টাঙ্গে প্রেম নিবেদন করেছিল। সত্যিমিথ্যা যাচাই করিনি। কিন্তু রোজগেরে বউ ও বেকার স্বামীর এই বন্ধন, এই গিঁট শিথিল হয়নি আজীবন। এই মডেলটি বেকার ছেলেরা ভেবে দেখতে পারেন। বিয়ের বাজারের অনেক হিসাব পাল্টে যাবে।
এবার গল্পে আসি। একজনেরই গল্প। তাই প্রথমে।
একেক্কে ১
বাগনান স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। ইলেকট্রিক ট্রেন সবে চালু হয়েছে। আমি প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দেখি– অলকেন্দু! তার এক হাতে এক প্যাকেট ব্রিটানিয়ার থিন অ্যারারুট বিস্কুট। আর এক হাতে বিস্কুটের একটি। আমাকে দেখে তার আধখানা বাড়িয়ে দিল– এসো,একসঙ্গে খাই? যাচ্ছ কোথায়? কোলকাতা?
মাথা নাড়লাম ‘হুঁ’ বোঝাতে।
অলকেন্দু উৎফুল্ল হল– যেতে যেতে কথা বলব। হাতে বিস্কুট। গালেও বিস্কুট। কিন্তু পকেটে চাবি। বাংলার সংস্কৃতির চাবিটিই আমার জিম্মায়। হুঁ হুঁ।
হুংকার নয়। হুঁ-কার। কিন্তু আমাকে টপকাল। ট্রেন আসছে। হঠাৎ আমার হাত পাকড়ে অলকেন্দু দৌড় দিল সামনে। মানে প্ল্যাটফর্মের আগায়।
–চলো, লেডিজে উঠব।
তখন এত কড়াকড়ি ছিল না। ছিল না অসভ্য ইভটিজিংও। তবু–
বাগনান থেকে লোকাল ট্রেনে শুরু থেকেই বসার সিট পাওয়া দুষ্কর ছিল। লেডিস থাকত ফাঁকাই। তা বলে–
অলোক টেনে তুলল।
বগিতে খুব বেশি হলে জনাপাঁচেক মেয়ে ও মহিলা। বাকি সিট ফাঁকা। অলকেন্দু বসল না, দাঁড়াল। দরজার পাশে। ফুরফুরে হাওয়ায়। আমি তার মুখোমুখি। ট্রেন সবে মোষডাঙার ব্রিজ ডিঙোচ্ছে। অলকেন্দু কী বলছে শুনুন!
–পার্থ, সামনের সিটে যে দিদি বসে আছেন, ওঁর হাতে একটি খবরের কাগজ দেখছি। কাগজটি চাওয়া যাক।
ঠিক ফিসফাস দ্বিরালাপ নয়। কথাগুলি শুনিয়ে বলা। দিদিরাও শুনছেন। আমি নিরীহদর্শন। আর অলকেন্দুও চোয়াড়ে বর্বর নয়। অবয়বে সুভদ্র। সুবেশ। বলা হয়নি, অলকেন্দু পরেছিল ধুতি ও পাঞ্জাবি। সুতরাং দিদিরাও একটু বিভ্রান্ত বইকি! এমনকী, চোখমুখ কোঁচকানোর, মুখ শক্ত করারও সময় পেলেন না, অলকেন্দু হাত পাতল।
–কাগজটা দেবেন দিদি?
‘দিদি’ ডাকটি এত মোলায়েম, ওঁরা, ক্রিকেটের পরিভাষায়, বলটি ঠিকমতো খেলতেই পারলেন না। কোনওরকমে ঠেকালেন।
–এটা গতকালের কাগজ।
পরের বলটি বাউন্সার।
–কালকেরটিই দিন!
বোল্ড! দিদিমণি ভাইয়ের হাতে কাগজটি তুলে দিলেন। অলকেন্দু কাগজ হাতে কুলগাছি পেরুল, বাউড়িয়া পেরুল, যেতে যেতে অপাঙ্গে কাগজটি উল্টেপাল্টে দেখছে তো দেখছেই। খাচ্ছে, কিন্তু গিলছে না। ইতিমধ্যে দিদিরা স্বচ্ছন্দ। আর ভয় নেই! এক বলের খেলা। ওখানেই শেষ। উত্তেজনা কখন থিতিয়ে গিয়েছে। ঠিক তখনই অলকেন্দুর স্বগতোক্তি। সোচ্চার— অলকেন্দু এবার রেফারি, উঁহু, রিপোর্টার, কিংবা তারও বেশি, নেভিল কার্ডাস।
–লক্ষ্য করেছ পার্থ? মেয়েদের হাতের গুণপনাই আলাদা। আমাদের হাতে আজকের কাগজ কালকের মনে হয়। ওঁদের হাতে কালকেরটিও আজকের!
এক দুগুণে ২
এ গল্পটি ছোট্ট। অলকেন্দুর খিদে পেয়েছে। আসলে খিদে পেতে পেতে ওই ট্রেনেই হাওড়া। তখন সাবওয়ে হয়নি। গঙ্গার গা-ঘেঁষে ছিল ‘দত্ত কেবিন’। আমার মতো বুড়োবুড়িরা মাথা ঝাঁকান। পাবেন। দত্ত কেবিনের কষা মাংস। আহা! অলকেন্দু তখনও বিয়েই করেনি। বা ললিতা বিয়ে করেনি অলকেন্দুকে। আমাকেই খাওয়াতে হবে। বিল মেটাতে হবে। শুরুতেই গেয়ে রাখলাম– হাফ হাফ প্লেট। তার বেশি না। রেস্ত নেই একেবারে।
তাই সই।

আমরা মুখোমুখি বসলাম। একই টেবিলে পাশের চেয়ারে এক অবাঙালি ননভেজ। বাড়িতে ভেজ, আর রেস্তোরাঁয় মাংস পেটাতে অনেক মারওয়াড়ি যুবককে দেখেছি সেই সময়। আমাদের সেই যুগে নিজামে গিয়ে জাত খোয়ানোর মতো। ইনি মধ্যবয়স্ক। বেয়ারা তিন প্লেট মাংস হাজির করল। দু’টি আধা। আমাদের জন্য। দাদার জন্য পুরো প্লেট। আমরা সঙ্গে নিয়েছি রুটি। দাদা সঙ্গে কী নিলেন, নজর করিনি। কিন্তু খেয়াল রেখেছিল অলকেন্দু। আমাদের প্লেট আধা বলেই দ্রুত নিঃশেষ হল। আমাদের পেটও আধেক ভরেছে। এবার অলকেন্দুর আর্তি–
– বেয়ারাকে একপিস মাংস এনে দিতে বললে দেবে না?
আমি কঠিন চোখে তাকালাম।
–তাহলে আর একহাতা ঝোল? চুমুক দিয়ে পেট ভরাই?
আমি বেয়ারাকে ডাকলাম বিল মেটাতে। অলকেন্দু বেয়ারাকে হুকুম দিল পাশের দাদাকে দেখিয়ে,
–উনি চাইলে আর একপ্লেট মাংস দাও। ওর থেকেই একহাতা ঝোল আমাকে দাও দিকিনি।
তিনেক্কে ৩
এই গল্পটা এখান থেকেই শুরু হতে পারত। এই হাওড়া স্টেশন থেকে। আসলে শুরু হয়েছে। এখান থেকেই। তদ্দিনে অলকেন্দু ললিতার গৃহে পালিত। খায়-দায় আড্ডা দেয়। আহা! গল্পটা বিভাসের মুখে শুনেছিলাম। উত্তম পুরুষে। তার মানে গল্পটি তার স্বোপার্জিত। বহু পরে এক বাংলা দৈনিকে এই গল্পের শরিকানা দাবি করেছেন আর একজন। তাঁর নাম করছি না। তাঁর গল্পটি আসলে ‘টোকা’ বলেই জমেনি। বিভাস নিজে ছিলেন প্রতিশ্রুতিবান গল্পকার। বাঁটুলে থাকতেন। নন্টে বাঁটুল নয়। বাগনানের নুন্টে বাঁটুলের ইনিও ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। অল্প বয়সে অস্তমিত। বাঁটুলের গলায় তাঁর বয়ানে আমার শোনা গল্পটি শোনাই তাহলে?
আরও পড়ুন: নবারুণ ভট্টাচার্যের কলমে: সাহিত্য আর বিপ্লব
হাওড়ায় নেমে অলকেন্দু বললেন,
–তোমার সময় হবে? চলো মানিকদার কাছে ঘুরে আসি।
আমি প্রমাদ গুণলাম। কিন্তু আমাকে আশ্বস্ত করে অলকেন্দু বলল, ‘ভয় পেও না। তোমার কোনও খরচ নেই। বাসের টিকিট আমি কাটব। ললিতা হাতখরচ দিয়েছে।’
আমাকে টেনে বাসে তুলল অলকেন্দু। বলল, ‘কন্ডাক্টর টিকিট চাইলে আমাকে দেখিও।’
সময়টা বলে নিই। সবে বাংলায় প্রথম যুক্তফ্রন্ট জিতেছে। সিপিএম ক্ষমতার শরিক। অজয়বাবু মুখ্যমন্ত্রী। উপমুখ্য জ্যোতি বসু। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, যানবাহন লালে লাল। বিপ্লব একরকম হয়েই গিয়েছে। কন্ডাক্টররা সোৎসাহে টিকিট কাটছেন। কারও ফাঁকি দেওয়ার জো নেই। এটিও বিপ্লবী কর্তব্য কিনা! অলকেন্দু ধুতি-পাঞ্জাবিতে দাড়িকামানো ললিতলবঙ্গ। রড ধরে দাঁড়িয়ে। কন্ডাক্টর আমাকে টিকিট চাইতে তাকে দেখিয়ে দিলাম। কন্ডাক্টর অলকেন্দুর কাছে হাত পাতল।
– টিকিট?
অলকেন্দু আস্তে করে বললেন– কবি।
কন্ডাক্টর গতিজাড্যে সবে এক কদম এগিয়েছেন। ট্রামে, ট্রেনে ‘মান্থলি’ চলে। কিন্তু এটা তো বাস? আর তিনিও রেলের বা ট্রামের টিকিট চেকার নন। চারদিকে তাকিয়ে যেন নিশ্চিন্ত হলেন। তাহলে ভদ্রলোক ঠিক বললেনটা কী? কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এতগুলো প্রশ্নে মাথা কেমন গুলিয়ে উঠল। ফিরলেন। এবার আরও স্পষ্ট করে চেয়ে বসলেন– টিকিট?
অলকেন্দু ততোধিক স্পষ্ট করে আবার জানাল– বললাম না কবি!
কন্ডাক্টর রীতিমতে খেপে গেলেন।
–কবি? তো? কবি তো আমার কী? বাসের কী? বাসে উঠেছেন, টিকিট কাটবেন। ব্যস! পয়সা বের করুন দেখি!
বাসশুদ্ধু লোক তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে। আমি ভাবছি অলকেন্দু পারেও। পয়সা যখন দিতেই হবে! সমস্ত বাস কাঁপিয়ে অলকেন্দু হাঁক দিলেন
–চলো, নেমে যাই। এই দেশের কিস্যু ভবিষ্যৎ নেই! এখানে কবির ছাড় নেই!
প্রয়াত পার্থ বসু মূলত কবি, গদ্য লিখেছেন সামান্যই। সাতের দশক থেকেই প্রকাশিত হয়ে চলেছিল তাঁর কবিতাবই। বইয়ের নামগুলি আশ্চর্যজনকভাবেই দীর্ঘ রাখতে ভালবাসতেন। ‘ব্যাঙ প্রথামত জিভটাকে উল্টে নেয়’, ‘নারী বশীরকণ জানে না’, ‘কবিতা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’, ‘দিদিমণি শূন্য দিন ও ঢ্যামনা কবিতাগুচ্ছ’ তাঁর অন্যতম। চাকরি করতেন ব্যাঙ্কে। বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর আবেগ ও উদ্বেগ ছিল বিস্ময়কর। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, কোভিড নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
One Response
লেখাটি পড়তে পড়তে অলকেন্দু পত্রীর কথা ঘুরে ঘুরে মনে পড়ল। শেষের দিকে পরিচয়। কফি হাউসে আড্ডা। থৈ পেতাম না এমন বৈচিত্র্যময় মানুষে। এক সকালে নতুন বই ও এক হাড়ি রসগোল্লা নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে হাজির। কথাবার্তার ভিতর ছিল বন্ধুতার গভীর ছোঁয়া।