‘আন গো তোরা কার কী আছে,
দেবার হাওয়া বইল দিকে দিগন্তরে
এই সুসময় ফুরায় পাছে…’
রবীন্দ্রনাথের গান ছিল তাঁর প্রথম ভালোবাসা। তাই দিদি, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী ইলা ঘোষের সঙ্গে যুগ্মভাবে এই গানটি রেকর্ড করেছিলেন সুনীল ঘোষ। ত্রিশের দশকে রবীন্দ্রনাথের গান-সহ নানা ধরনের কাব্যগীতিতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সুনীলবাবু। ১৯২১ সালে আজকের দিনটিতেই (১৩ সেপ্টেম্বর) উত্তর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
পারিবারিক সূত্রেই সঙ্গীত মিশে গিয়েছিল সুনীল ঘোষের রক্তে। সাংস্কৃতিক ও সাঙ্গীতিক আবহে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তিন বোন ও দুই ভাই– সকলেই সঙ্গীতমনস্ক ছিলেন। দিদি ইলা ঘোষ (পরে ইলা মিত্র) ছিলেন সেকালের স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী।
একেবারে বাল্যকাল থেকেই দিদি ইলার সঙ্গে ছোটভাই মন্টু ওরফে সুনীলের সঙ্গীতের চর্চা ও তালিম নেওয়া শুরু। পরবর্তীকালে কাজি নজরুল ইসলাম ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের একান্ত সাহচর্য ও স্নেহচ্ছায়ায় সঙ্গীতজীবনের পথ চলা। শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছেন দিকপাল সব শিল্পীদের, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন শ্রী অনাদি দস্তিদার, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, গিরিজাশংকর চক্রবর্তী প্রমুখ সঙ্গীতজ্ঞের নাম। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সান্নিধ্য পেয়েছেন বরদা গুপ্ত, সারদা গুপ্ত, দুর্গা সেনের মতো গুণী শিল্পীদের।

আসলে সুনীলবাবু ও তাঁর দিদি ইলাদেবীর সঙ্গীতজীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলেন কাজি সাহেব ও পঙ্কজবাবু। ৫০এ, রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট-এর যে বাড়িতে ঘোষ পরিবারের বাস ছিল, সেখানে নিয়মিত আসতেন এই দু’জন। তাঁরা যে শুধু ভাইবোনের সঙ্গীতশিক্ষক ছিলেন, তা-ই নয়, পরম শুভানুধ্যায়ী ও দায়িত্বশীল অভিভাবকদের মতো স্নেহচ্ছায়ায় ঘিরে রাখতেন ভাইবোনকে।
সুনীল ঘোষের সঙ্গীতজীবনের সূচনা হয়েছিল ১৯৩২ সালে। মাত্র বারো বছর বয়সে মিস্টার মণ্টু নামে একটি গান রেকর্ড করেন তিনি। তবে প্রথম যে গানের মাধ্যমে তিনি প্রচারের আলোয় আসেন, তা ছিল ১৯৪১ সালে। সে বছরই শ্রাবণমাসের বাইশে অভিভাবকহীন হয়েছে বাংলা। রবীন্দ্রনাথ পাড়ি দিয়েছেন অমর্ত্যলোকে। সে খবর শোনামাত্র নজরুল হাতে তুলে নিলেন কলম। রচনা করলেন ‘রবিহারা’ নামে একটি কবিতা। কলকাতা বেতারকেন্দ্র থেকে স্বকণ্ঠে এই কবিতাটি আবৃত্তি করলেন নজরুল। তাঁর মন্দ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হল—
‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপথের কোলে
শ্রাবণ মেঘ ছুটে এল দলে দলে
উদাস গগন-তলে।
বিশ্বের রবি ভারতের কবি
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি
তুমি চলে যাবে বলে।…
… বিদায়ের বেলা চুম্বন লয়ে যাও তব শ্রীচরণে,
যে লোকেই থাক হতভাগ্য এ জাতিরে রাখিও মনে।’

এরপরই শোকাহত কাজি সাহেব দেশবাসীর উদ্দেশে একটি গান লেখেন। আর স্বজনহারানোর ব্যথাতুর সেই গানকে কণ্ঠে তুলে নেন ইলা ও সুনীল ঘোষ। নজরুল নিজে বসে থেকে তাঁদের দুজনকে এ গান তোলান। এবং সেটি গার্স্টিন প্লেসের আকাশবাণী কেন্দ্র থেকে সারা ভারতে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। গানটি ছিল—
‘ঘুমাইতে দাও, শ্রান্ত রবিরে জাগায়োনা জাগায়োনা।
সারা জীবন যে আলো দিল ডেকে তার ঘুম ভাঙ্গায়োনা…’
তবে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান ছাড়াও সুনীলবাবু বেশকিছু রাগাশ্রয়ী, আধুনিক ও সিনেমার গান রেকর্ড করেছেন। কখনও একক কণ্ঠে, আবার কখনও বা তাঁর বড়দি ইলা ঘোষের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে। ১৯৪১ সালে ‘মনজুর’ ছবিতে ইলা ঘোষের সঙ্গে প্লেব্যাক করেন সুনীল। প্রকাশ রচিত, পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত সেই গান “আও শুনায়ে কহানি তুমহে…” বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

এছাড়া পঞ্চাশের দশকের হিট বাংলা ছবি, বিকাশ রায়-অরুন্ধতী দেবী অভিনীত ‘ছেলে কার’ -এও কালীপদ সেনের সুরে প্লেব্যাক করেন সুনীলবাবু। গানটি ছিল: ‘মেঘলা আকাশ ফরসা হোল, বিপদ গেছে কেটে।’ তাঁর বেসিক গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৪৭ সালে রেকর্ড করা “উমিদ্ হ্যায় দিল মে…”, যার কথা লিখেছিলেন পণ্ডিত ভূষণ এবং সুর করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। এছাড়া তাঁর গাওয়া “খিলাড়ি খেল যা…” গানটিও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ গানের রচয়িতা ছিলেন মুন্সি কাবিল এবং সুরারোপ করেছিলেন সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
মানবিক, জনদরদী, কোমলস্বভাব, অমায়িক এই মানুষটি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সঙ্গীতকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন, চর্চা করেছেন। তবে সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে নেননি বলে পেশাদার জগৎ থেকে কিছুটা দূরেই থাকতেন। কর্মসূত্রে তিনি ছিলেন পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ, ও পরে ক্যালকাটা টেলিফোনস-এর উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত ছিলেন চাকরিজীবনের নানা পর্বে। কিন্তু সব সময়েই তাঁর প্রথম ভালোবাসা ছিল সঙ্গীতজগৎ। ২০০০ সালের ১৬ অক্টোবর, প্রয়াণের দিনটি পর্যন্ত আকাশবাণী, অল ইন্ডিয়া রেডিও ও কলকাতা দূরদর্শনের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন শ্রী সুনীল ঘোষ।
কৃতজ্ঞতা শ্রী সঞ্জয় সেনগুপ্ত ও অভীক চট্টোপাধ্যায়কে, যাঁদের সহৃদয় সাহায্য ছাড়া সুনীল ঘোষ সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া সম্ভব হত না।
*ছবি সৌজন্য: লেখক
*ভিডিও সৌজন্য: Youtube
কৃষ্ণ রাস্না ঘোষের বড় হওয়া শোভাবাজার রাজবাড়ির সাংস্কৃতিক ও সাঙ্গীতিক পরিবেশে। বর্তমানে আদ্যন্ত হোমমেকার রাস্না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। কলকাতা সুচেতনা নামে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে সুন্দরবনের দুঃস্থ মানুষদের নিয়ে কাজ করেন।
2 Responses
খুব ভালো লাগলো পড়ে। বিষয় এবং লেখনী দুটিই সমান আকর্ষণীয়। কৃষ্ণ রাস্না ঘোষের আরো লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম
খুব ভালো লেখা। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম।