শিল্পমাধ্যমের জনপ্রীত আঙ্গিকগুলির মধ্যে একটির নাম ‘কমিকস।’ বাংলা শব্দ নয়, কিন্তু বাংলা প্রতিশব্দ তো প্রয়োজন। ‘কমিকস’ শব্দটির মধ্যে একটি কৌতুকময়তার দ্যোতনা লুকিয়ে আছে। শব্দ আর ছবি দিয়েই সেই কৌতুক উৎপাদন করা হয়। ভেবেচিন্তে একটি শব্দ নির্ধারণ করেছিলাম— শব্দচিত্রকৌতুকী। কিন্তু, কৌতুকের অনুষঙ্গ যে কমিকসে থাকবেই, এমনটা কিন্তু নয়। যথেষ্ট গম্ভীর বিষয় নিয়ে সিরিয়াস ঢংয়েও কমিকস তৈরি হতে পারে। এমনকী, বিনা শব্দে, শুধু ছবিগুচ্ছ পরপর সাজিয়েও কমিকস্ সম্ভব। তাই শব্দ ও কৌতুক দুই শব্দই বাদ পড়ল।
দ্বিতীয় পরিভাষার অবতারণা- ছবিগল্প। কারণ, শব্দকে বাদ দেওয়া গেলেও ছবি অবধারিত কমিকসে। ছবির মাধ্যমে গল্প বলাই তার অভিপ্রায়। এই একই কারণে চিত্রকথা, চিত্রকাহিনি এসব শব্দও চালু আছে কমিকসের পরিভাষা হিসেবে। ইংরেজিতে ‘গ্রাফিক নভেল’ শব্দবন্ধটিও খুবই পরিচিত। গ্রাফিক আখ্যান বলতে প্রধানত বোঝায় ছবির মাধ্যমে গল্প বা তথ্য উপস্থাপন। সিনেমার দৃশ্যবিভাজনের মতো এখানেও গল্পকে পরপর ছবির টুকরোয় ছড়িয়ে দেওয়া হয়; আর ক্যামেরার দৃষ্টিকোণের বৈচিত্র্যের মতো এই দৃশ্যসজ্জাতেও প্রেক্ষণকোণ বা পার্সপেকটিভ একটি তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা নেয়।
সাধারণত কমিক্সের প্রবণতা হল, একাধিক ছবিকে পারম্পরিকভাবে বিন্যস্ত করে একটি পরিণামী বার্তায় পৌঁছনো। এই প্রবণতার সূত্রপাত কবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। বাংলার বিষ্ণুপুর, হুগলি, বীরভূম, বা মুর্শিদাবাদের টেরাকোটা প্যানেল কিংবা মেদিনীপুরের পটশিল্পের উপস্থাপনভঙ্গির মধ্যে এই পদ্ধতির একটি পূর্বাভাস খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা-শিল্প লক্ষ করলে দেখা যায়, সেখানে অনেক সময়ে বর্গাকার বা আয়তাকার ছবি পাশাপাশি বা ওপর-নীচে সাজিয়ে ঘটনাপ্রবাহকে উপস্থিত করা হয়েছে। পটশিল্পীরা গোল করে গুটিয়ে রাখা পটের ছবিগুলি পরপর দেখাতে দেখাতে সংশ্লিষ্ট ঘটনা গেয়ে শোনাতে থাকেন। দুই ক্ষেত্রেই শব্দ বা অক্ষর সরাসরি অনুপস্থিত। আর শব্দ সংযোজিত হয়েই বাংলা কমিকসের যাত্রা শুরু।
অবশ্যই কমিকসের গোড়ার কথা রয়েছে কার্টুনে। কালীঘাটের সরাপটের বিশেষ ব্যঙ্গপ্রবণতার ধাঁচ নিয়েই উনিশ শতকের বাংলা সংবাদ ও সাময়িকপত্রে সমকালীন সামাজিক ঘটনা-চরিত্র-বস্তু নিয়ে কার্টুন ছাপা হত; তার মূল সুর ছিল সমালোচনার, বিদ্রুপের। এই যুগে ‘হরবোলা ভাঁড়’ আর ‘বসন্তক’ পত্রিকার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কমিকসের প্রধান অক্ষ সবসময় স্যাটায়ার বা বিদ্রুপ নয়, ফান বা মজা; ঘটনাধারার একটিমাত্র অঞ্চলকে বেছে নিয়ে নয়, ঘটনাক্রমের মাধ্যমে। একেই আমরা বলি কমিক স্ট্রিপ। লম্বা স্ট্রিপ না হয়ে কার্টুনের মতো ছোটও হতে পারে কমিকস, তাকে বলা যায় ‘ছবি-চুটকি’। ইংরেজিতে একে ‘ফানিস’-ও বলা যায়।

শিশুপাঠ্য-কিশোরপাঠ্য হিসেবেই কমিকসের জনপ্রিয়তা সবথেকে বেশি। গোড়ার দিকের কিছু কার্টুনধর্মী কমিকসের পরে বাংলায় মুদ্রিত রূপে এই ‘ফানিস্’-আঙ্গিকের আবির্ভাব ‘সন্দেশ’ পত্রিকার হাত ধরে। ১৯১৭-তে সুকুমার রায়ের ‘ও বাবা’-তে এর সূচনা, ১৯২৪-এর মধ্যে তাঁর ‘বুঝবার ভুল’ আর ‘ছবি ও গল্প’ প্রকাশ পায়। ‘সন্দেশ’-এ পৌষ ১৩২৮ সংখ্যায় প্রকাশিত সুখলতা রাও-এর ‘যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল’-এ প্রথম ‘স্পিচ বেলুন’ ব্যবহৃত হয়। ১৯২২ থেকে ১৯২৪-এর মধ্যে ‘ঘুমের ঘোরে’, ‘ময়রার চোর ধরা’, ‘পিঠে ভাগ’ ইত্যাদি আরও চারটি কমিক স্ট্রিপ এঁকেছিলেন সুখলতা।
সিধু গয়লাকে বোকা বানাতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবার গল্প (যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল- সুখলতা রাও), পরীক্ষায় গোল্লা পেয়ে হাবুর বাড়ি ফিরে আড়ংধোলাই খাবার গল্প (ছবি ও গল্প- সুকুমার রায়), ডিমের ডালনা রাঁধতে গিয়ে ডিম খেয়ে নেবার গল্প (ডিম রেঁধেছি খাসা- সুখলতা রাও), এইসব টুকরো টুকরো কথা প্রকাশ পেয়েছিল সেগুলিতে; সম্পূর্ণ গল্প বা আখ্যান নয়। সন্দেশে তিরিশ-চল্লিশের দশকে সুকুমার-সুখলতার পথ ধরেই নতুন-পুরনো ছড়ার সঙ্গে ছবি আঁকার একটা চলও হয়েছিল, তৈরি করেছিলেন সমর দে, শৈল চক্রবর্তীর মত শিল্পীরা। পরে শিশু সাহিত্য সংসদের ছড়ার বইতে বিমল দাশের ছবির ক্ষেত্রেও এই চলা অক্ষুণ্ণ থাকে। চিরন্তন সেইসব ছবি।
পাঁচের দশকে এলেন প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী ওরফে কাফী খাঁ ওরফে পিসিয়েল। বাংলা রাজনৈতিক কার্টুনের বিশ্বে তাঁর গতায়াত মসৃণ। পাশাপাশি, কাফী খাঁ নামে তিনি খুড়োর কমিকস, শেয়াল পণ্ডিতের কমিকস বের করলেন। বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যঙ্গপ্রবণ, বহুস্তরীয়। ষাট-সত্তর দশকের বাংলা কমিকস আস্তে আস্তে আবার অল্পবয়সীদের দিকে ঝুঁকল। এই সময়ের কমিকসজগতকে একরকম শাসন করতে থাকেন নারায়ণ দেবনাথ ও ময়ূখ চৌধুরী। দু’জনের যাত্রাও একই সময়ে শুরু। ১৯৬২ সালে একদিকে শুকতারায় বেরোয় নারায়ণ দেবনাথের ‘হাঁদা-ভোঁদার জয়’, আর একদিকে সন্দেশ পত্রিকায় বেরোয় ময়ূখ চৌধুরীর ‘ঋণশোধ’। নারায়ণ দেবনাথের হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে-ফন্টে ইত্যাদি কালজয়ী চরিত্রদের মাধ্যমে বাংলা কমিকসের ‘ফানিস’ শাখা সবথেকে বেশি বিস্তৃতি পেয়েছে।

অবশ্য নারায়ণ দেবনাথের আগেই শুকতারাতে বোলতা পরিচয়ে হাঁদা-ভোঁদার কমিকস এঁকেছিলেন প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। উচ্ছ্বল কয়েকটি কিশোর, তাদের নানাবিধ দুষ্টুমি, বিটলেমি, অভিভাবকস্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাত, আবার অন্যদিকে বীরত্ব, চারিত্রিক উদারতা, সমাজবিরোধীদের দমন, মোটামুটিভাবে এ-ই হাঁদাভোঁদা বা নন্টে-ফন্টের কাঠামো। বাঁটুল তো আগাগোড়া তার ‘গ্রেটনেস’-কেই প্রমাণ করে। কখনও হাঙর দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে, কখনও সিংহের দাঁত ভেঙে, কখনও টেনিস র্যাকেট দিয়ে গ্রেনেড সরিয়ে, কখনও প্যারাশ্যুটে চড়ে পাকিস্তানের বোমা পা দিয়ে আটকে।

শিল্পী দিলীপ দাসের দু’রঙা কমিকসেও এই একই গড়নে ছক্কা-পাঞ্জা, বুদ্ধু-ভুতুম, ছুটকি-বড়কির গল্প পাওয়া যায়। অন্যদিকে শক্তিপ্রসাদ রায়চৌধুরী ওরফে প্রসাদ রায় ওরফে ময়ূখ চৌধুরীর ছবিগল্পে ইতিহাস ও শিকারকাহিনি, গোয়েন্দাকাহিনির রহস্যরোমাঞ্চ ও অ্যাডভেঞ্চারের ছড়াছড়ি। এই ধারাটি সেকালের চিত্রকথায় বেশ পপুলার ছিল। সাময়িকপত্রের শিল্পীরা অনেকেই এই জঁরটিকে ব্যবহার করেছেন। এগুলি সবসময় আবার শিশুপাঠ্য নয়, কিছু কিছু অ্যাডাল্ট উপাদান (যেমন বহুগামিতা, পরকীয়া, যৌন প্রবঞ্চনা ইত্যাদি) জমে রয়েছে এখানে ওখানে।
বাংলা কমিকসে একেবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ জায়গা অহিভূষণ মালিকের ‘নোলেদা’-র। টেনিদা-ঘনাদার কমিকস সংস্করণ নোলেদা। তিনি চ্যাম্পিয়ন- ক্রিকেট, ফুটবল, রান্না, রসায়ন, জীববদ্যা, সাহিত্য, সবেতেই তিনি সেরা। তিনচুলো লম্বানাকু এই নোলেদার মজার কাণ্ডকারখানা নিয়ে এক-এক পাতায় অদ্ভুত সব কমিকস আঁকতেন অহিভূষণ। কমিকসের প্রচলিত প্যানেলনির্ভর আদলের একেবারে বাইরে গিয়ে ছয়ের দশকেই মৌলিক ছবিগল্প তৈরি করেছেন ধীরেন বল। তুতু-ভুতু, চ্যাঙা-ব্যাঙার মিষ্টি সব ছেলেমানুষি গল্প আক্ষরিকভাবে শিশুপাঠ্য বাংলা ছবিগল্পের সূচক। এই ধরণটি অনেকটা মেলানো যায় চৈনিক বা রুশ ছোটদের ছবিগল্পের সঙ্গে।

বাংলা কমিকসের শাখাপ্রশাখা কিন্তু অনেক বিস্তৃত। চিত্রকথার একটি গড়ন পাওয়া যায় ছোটদের জন্য তৈরি করা পুরনো গল্পের চিত্ররূপগুলিতে। যেমন, ১৯৫০-এর দশকে পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর ছবিতে রামায়ণ ও ছবিতে মহাভারত। চার-রঙা সেইসব ছবিকাহিনি আশি-নব্বই দশক পর্যন্ত বাঙালি কিশোরমনকে আচ্ছন্ন রেখেছিল। স্পিচ বেলুনের প্রয়োগ অনেক আগেই শুরু হয়ে গেলেও পূর্ণচন্দ্র কিন্তু খুব প্রথাগত টেক্সটবক্স আর ন্যারেশনবক্স ব্যবহার করেছিলেন। বাংলা জীবনীনির্ভর কমিকসের আবার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। কাফী খাঁর আশুতোষের গল্প, নারায়ণ দেবনাথের আঁকা রবি-ছবি, রাজার রাজা, ছত্রপতি শিবাজী, ময়ূখ চৌধুরীর ছদ্মবেশী, বিভিন্ন আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে প্রকাশিত শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, মাদার টেরিসা প্রমুখ মনীষীদের জীবনকথা, এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে।

কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক কমিকস ধারাবাহিকভাবে এঁকেছেন গৌতম কর্মকার। নারায়ণ দেবনাথের ‘ডানপিটে খাঁদু ও তার কেমিক্যাল দাদু’-তে অবশ্য শুরু হয়ে গেছিল এর। মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায় এঁকেছিলেন ‘প্রবাহনের স্বপ্নভঙ্গ’। রহস্যরোমাঞ্চ কাহিনির স্বাভাবিক জনপ্রিয়তার সূত্রে কমিকসেও ছিল সেই সত্যসন্ধানী দুঃসাহসী নায়কদের আখ্যান। শুকতারায় ছবিগল্পে কৌশিক রায় বা ইন্দ্রজিৎ রায়দের আগেই এনেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। সাংবাদিক কাম গোয়েন্দা রাপ্পা রায়কে নিয়ে অসামান্য কাজ করেছেন সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়, রহস্যভেদী রুবলের কথা বলেছেন অর্ক পৈতণ্ডী।
আর যেকথা না বললে নয়, তা হল অনূদিত কমিকস। টিনটিন, অ্যাসটেরিক্স, লাকি লুক, হেনরি, আর্চি, ম্যানড্রেক, ফ্যান্টম- এই সব নায়করা শুধু ইউরোপীয় বা মার্কিন মুলুক থেকে ইংরেজিতেই তো শুধু আসেনি, এসেছে বাংলায়। কুকুরের নাম কুট্টুস, গায়কের নাম কলরবিক্স, ঘোড়ার নাম টরটরে টাট্টু, পুচকে নেড়ামাথা ছেলের নাম গাবলু, এসব কি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বা লীলা মজুমদাররা না থাকলে সম্ভব ছিল? শুধু বিদেশি কমিকস থেকে নয়, হিন্দি কমিকসও অনূদিত হয়েছে বাংলায়। চাচা চৌধুরী বা পিঙ্কির ছবিগল্প নব্বইয়ের রঙিন কৈশোর ভরিয়ে রেখেছিল। বয়ঃসন্ধির হাজার বর্ণমালা ধরা দিয়েছিল ইন্দ্রজাল কমিকসের জাদুকর ম্যানড্রেক আর বেতালের চোখ-ধাঁধানো আধা-পরাবাস্তব গল্পকথায়।

আর ছিল পুরনো দিনের অমর চিত্রকথা। ছবিতে পৌরাণিক-ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের জীবনকথার ধারা তো ছিলই, খুব স্পষ্ট জাতীয়তাবাদী অভিপ্রায় থেকেই ভারতীয় সমস্ত লোককাহিনি, পুরাকথা, কিংবদন্তিকেও ছবিতে অবয়ব দিয়েছিলেন এ সময়ের শিল্পীরা। সেইসব চিত্রাখ্যান বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন অঞ্জলি রায়, আর অনবদ্য হাতের লেখায় তার বর্ণলিপি করেছিলেন মলয়শংকর দাশগুপ্ত।
অনুবাদ হয় এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায়। আর একটু তলিয়ে ভাবলে, পাঠযোগ্য গল্পের চিত্ররূপও এক ধরনের অনুবাদ, চিত্রানুবাদ। পূজাবার্ষিকী বা সাময়িকপত্রের পাতায় জনপ্রিয় গল্পের গ্রাফিক রূপ দেবার প্রচলন অনেক পুরনো। ভেবে দেখতে গেলে পূর্ণচন্দ্রের রামায়ণ-মহাভারতও তারই নমুনা। সেই চিত্ররূপের জগতে তুষার চট্টোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়, চুমকি চট্টোপাধ্যায়, তমাল ভট্টাচার্য, হর্ষমোহন চট্টরাজ, সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অনেকের নামই প্রতিষ্ঠিত। গান তৈরির সময় যেমন বাণী, সুর, সঙ্গীতায়োজন সব একসঙ্গে অথচ ভিন্ন ভিন্ন প্রকোষ্ঠে হয়, তেমনই গসিনি-ইউদেরজো জুটির মতো কমিকসনির্মাতা জুটি হিসেবে কাজ করেছেন অনেকেই। কেউ গল্প লিখবেন বা চিত্রনাট্য লিখবেন, কেউ ছবি আঁকবেন।
আরও পড়ুন: দ্যুতিমান ভট্টাচার্যের কলমে: কমিক্সে নারীরা কোথায়?
এই ধারাতেই সম্পূর্ণ অন্য খাতে কাজ করছেন শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাভারতের ব্যাস চরিত্র নিয়ে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আখ্যান নির্ভর করে ইংরেজি ভাষায় কাজ করেছিলেন আগে। বাংলাতেও মহাভারত অবলম্বনে শিবাজীরই কিরাত-পর্ব-এর ছবি এঁকেছেন। পরে ফ্রয়েডের টোটেম ও ট্যাবু নিয়েও এঁরা কাজ করেছেন। শেষেরটিকে প্রথাগত পরিভাষায় ‘কমিকস’ তো বলা যায় না, এমনকী খুব জোরালো আখ্যানও নেই এতে। কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের গ্রাফিক পরিবেশন, যা ঠিক স্কুলবইয়ের বা পঞ্চায়েতের ‘সচিত্র জীবনশিক্ষা’ বা ‘সচিত্র পরিবেশপাঠ’-এর মত নিরেট নয়।
একটা গোড়ার কথা ফিরিয়ে এনে লেখা শেষ করি। ছবিগল্পের শরীর গড়ে ওঠে ছবি আর কথা দুই দিয়েই। কিন্তু কথা সবসময় প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থাকবেই, তা তো নয়। সেখানে ছবির নিজস্ব এক ভাষা, সুর, ব্যাকরণ আর শাস্ত্র তৈরি হয়। স্থির ছবিতে চলমানতা বোঝানোর ব্যাকরণ। ডিজিটাল পৃথিবীতে মুভি ক্যামেরা, অ্যানিমেশন ইত্যাদি বিষয়ের সুলভতায় চলমান দৃশ্য ব্যাপারটিকে আর তত চমকপ্রদ লাগে না। কিন্তু গ্রাফিক আখ্যানের কাজই হল চলমান ঘটমান গতিশীল এক-একটা অবস্থাকে স্থির ছবিতে ধরা।
নায়ক ঝন-ঝনাৎ করে তলোয়ার চালাক, দুর্গম জঙ্গলে হিংস্র চিতা লাফ মেরে পড়ুক, হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ম্যানহোলে সড়াক্ করে পড়ে যান, ছিঁচকে চোরের মাথা খটাং করে দেয়ালে ঠুকে যাক্, সমস্তটাই ছবির চরিত্রের অভিব্যক্তিতে, ছবির ভেতরের ছোটবড় উপকরণে, রেখার সরুমোটা টানে, লিপির আকারপ্রকারে বোঝানো সম্ভব। হুবহু বাস্তবকে যেটুকু অনুকরণ করা সম্ভব নয়, সেটুকুই তো মনের চোখের কাজ। কমিকস আসলে সেই চোখেই আলো আনে।
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, 99thing ও লেখক
ডাঃ শ্রুতি গোস্বামী পেশায় বাংলার অধ্যাপক। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ তাঁর কর্মক্ষেত্র। নিজের পড়াশোনা প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্রুতির চর্চা ও আগ্রহের বিষয় বিবিধ। কথাসাহিত্য, নারীর লেখনী, সাহিত্যের রাজনৈতিক সম্পৃক্তি কিংবা প্রাচ্য অলংকার শাস্ত্র- তাঁর বিচরণক্ষেত্র। বাংলা কমিকস ও তার নানান দিক সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক নিবন্ধ ইতোমধ্যেই নানান পত্রিকায় প্রকাশিত। এ বিষয়ে বক্তৃতাও দিয়েছেন দিল্লি ও ইন্দ্রপ্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্রুতি একজন পেশাদার সঙ্গীতশিল্পীও বটে।