আশ্বিনের শারদপ্রাতে আলোকমঞ্জীর যেই না বেজে না ওঠে, মন একেবারে আলুথালু, বেয়াড়া। এ দিক সে দিক চলে যায়। কেন যায়, কোন দিকেই বা যায়, সে কেবল পুজোর হাওয়া জানে। এমন মনের অধীশ্বরী আমিও ছিলেম বটে বছর কয়েক আগে অবধি। ধরণীর এত আয়োজন যে কেবল আমারই জন্য, এ কথা কী আর অন্য কাউকে বাতলে দিতে হত? কখনওই নয়। বেশ বুঝতে পারতাম বাঁধনছেঁড়া আনন্দ পরিপাটি এসেছে কেবল আমারই হৃদে ফুটে উঠবে বলে। তখনও জানতাম নীল আইলাইনার কিংবা রুবি-উ শেডের লাল লিপস্টিকে মাতোয়ারা ভাব ধরা থাকে না। কিন্তু কিসেই বা ধরা থাকে সে? মা-দুগ্গার ভুরু-যুগলে না কি মুখচোরা ছেলের অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে, কিংবা নারকেল নাড়ুর আয়েশে,বা অষ্টমীর লুচি-আলুর দমে? খিলখিল উতরোল ছিল তখন আমার নারীত্বের অভিজ্ঞান।
কিন্তু হঠাৎ করে কবে যে মেয়ে থেকে মহিলা হয়ে গেলাম, সেটা বুঝতে পারিনি। কবে থেকে যেন আশ্বিনের শারদপ্রাতে বিসমিল্লার সানাইয়ের মতো বিষাদ বেজে ওঠে। কবে থেকে যেন আমার কাছে আমার কুটিপাটি উপচে ওঠা আনন্দ আর তেমন জরুরি নয়। যে উতরোল আমাকেই সংজ্ঞায়িত করত, তাকে যেন ভালয় ভালয় বিদেয় দিয়েছি। আর মনে মনে বলেছি, দুগ্গা দুগ্গা করে এগোও তো বাপু খিড়কি দিয়ে, এখন কি আর আমার দান চালার সময় রয়েছে? আমার তুরুপ মলিন হয়েছে যে, এ আমি বেশ বুঝতে পারি।
এ আমি বেশ বুঝতে পারি, যখন বুঝেছি তরুণ ছেলের দৃষ্টি আর আমার দিকে আটকায় না। যখন বুঝেছি অজান্তেই আন্টি হয়ে গিয়েছি। যখন বুঝেছি, আমার চুল কপালের দিক থেকে পাতলা হয়ে গিয়েছে। যখন বুঝেছি বর্ষাকালে ফুটপাথের পাশে ভরা জলের মধ্যে পাতা ইঁটের ওপর চলতে গিয়ে আমি সাবধানী হয়ে গিয়েছি। যখন বুঝেছি আমার ভাইপো-ভাইঝিরা কলকল করতে করতে আমায় দেখলে চুপ করে যায়, যখন জামা কিনতে গিয়ে বুঝি কোনও অল্প ফ্রিল দেওয়া টপ কিনতে গেলে মনে হয়, আমায় আর মানাবে না। আর যখন বুঝেছি আমার কাছে আমার আনন্দের চেয়ে আমার একরত্তির আনন্দ অনেক বেশি ম্যাটার করে। সব্বাই বলবে বুড়ো বয়সে ধেড়ে রোগ। বয়স যেমন আসবে, তেমন করেই তো মেনে নিতে হবে। আর সব বয়সেরই এক এক রকম মাধুর্য, আনন্দ, বদমাইশি থাকে। তাকে তেমন করেই এনজয় করতে হয়। না হলে এ বয়সটাও ফাঁকি পড়বে। আমি কি বোকা? এ সব কথা কি আমি জানি না? জানি তো, কিন্তু আমি তো এখনও মনে মনে তেইশ। ফলে যে মেয়ে চল্লিশ অবধি তেইশের জীবন কাটিয়ে এসছে, আজ তাকে মহিলা বলে দেগে দিলেই সে মনে মনে মেনে নিতে পারবে? এত সহজ? সত্যিকারের বয়স হিসেব করতে গিয়ে শেষে না মরতে বসি।
সহজ নয় গো বাবুমশাইরা। মেয়ে যখন বোঝে সে মেয়ে নয় মহিলা হয়ে গিয়েছে, তখন যে কী তীব্র যন্ত্রণা হয়, কী বলব। তবে কি একেই বলে বিগতযৌবনা? সে নিজেই প্রশ্ন করে নিজেকে, আমি কি তবে আর প্রেম অনুভব করতে পারব না? কিংবা সাধের যৌনতা কি তফাত যাবে? আর সত্যি কথা বলতে কী, এক দিন সুন্দর সকালে দড়াম করেই এই রিয়েলাইজেশনটি মনে আছড়ে পড়ে, ভূমিকা-উপসংহার ছাড়াই। স্রেফ ছালছাড়ানো সত্যটুকু।
হা রে হতচ্ছাড়ি, তোর মেয়ে সত্তাটাই কি সব? তুই মাতৃত্ব নিয়ে তৃপ্ত না? লাও ঠ্যালা, এ কথা আবার কে বললে? আমি কি এক বারও তা অস্বীকার করছি? কিন্তু মাতৃত্ব আলাদা, আর মেয়েলিত্ব আলাদা। যে মেয়েরা বলে মাতৃত্বেই পূর্ণ, হয় তারা বাজে কথা বলে কিংবা তারা নিজেদের আলাদা দুটো সত্তা বোঝে না, বা বুঝতে চায় না। আমি কিন্তু বেশ বুঝেছি, দুই সত্তাই। তার মধ্যে কোনও টানাপড়েন নেই, কিন্তু নিজের মেয়ে-জীবন হারিয়ে মহিলা জীবনে প্রবেশ আমার মোটেও ভাল লাগেনি। ভাল লাগে না, ভাল লাগবেও না। যখন আমার ষাট বছর বয়স হয়ে যাবে, তখনও আমার মনের মেয়েটাকেই বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করব। কারণ সেটাই আমি। সেটাই আমার অন্তর-অঙ্গ। সেটাই আমার সারা জীবনের চালিকাশক্তি। সেটাই আমার চরিত্র তৈরির কাঠামো। বহির-অঙ্গকে তো আর অস্বীকার করতে পারব না। কিন্তু আমার কষ্ট হবে, ভারী কষ্ট হবে। আমার কষ্ট হয়। কেবল ফিট থাকলে, জিম করলে আর রোগা হলেই তো জৌলুস ফিরে আসে না। ওটা যৌবনের কুক্ষিগত। আর ওটা কখনওই ওভার-থ্রো হয় না।
তাই তার জন্য আমার বাকি জীবন শোকপ্রকাশ থাকবে, থাকবেই। এ আমি স্বীকার করে নিলাম।
আর পুজোটুজো এলে এ সব ক্ষত থেকে যেন শোক উথলে ওঠে, ডুয়াল-টোন লিপস্টিক কিংবা ঘন মাসকারা, কেউই এঁটে উঠতে পারে না।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।
4 Responses
bhalo laaglo. eka eka laagle ar kauke na pele janbe ami achi, sudhu shonar jonne. bhalo theko.
sanchari amar moner kotha bolefelecho okopote.sobai shikar kore na.kintu ami shikar kori. tomar sathe ami akmot.
“কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে”
“কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে”
তাইতো!