মহানগরী কলকাতা আমাদের মননে ও সত্বায় এমন গভীর রেখাপাত করেছে যে তা প্রায় পশ্চিমবঙ্গের সমার্থক হয়ে গেছে। এই সেই প্রাসাদনগরী যা দেড়শো বছরের ও অধিক সময় ধরে ব্রিটিশ ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল, ছিল সারা পৃথিবীতে লন্ডনের পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নগরী, ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল আঁতুরঘর ও কর্মক্ষেত্র। স্বাধীনতা লাভের পরে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী হিসাবে তার জয়যাত্রা অব্যাহত – বঙ্গ জীবনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসাবে প্রথমেই কলকাতার নাম উল্লিখিত হয়ে থাকে। কল্লোলিনী তিলোত্তমার জৌলুসের কাছে বাকি সব কিছুই যেন ম্লান !
কিন্তু নদী তো অন্য কথা বলে – হুগলি নদীর বহতা স্রোত তো সেই সময়ের দলিল বহন করে যখন কল্লোলিনী কলিকাতা ভবিষ্যতের গর্ভে, যখন আগমন ঘটে নি প্রবলপ্রতাপান্বিত ইংরেজ জাতির, যখন হুগলি নদী নতুন করে সেজে উঠছে তার নবলব্ধ জলধারায় আর চারটি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির উপস্থিতির আলোকে। এই ইতিহাস সম্বল করে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বহু শতাব্দী আগে – পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। সেই সময় সরস্বতী নদী প্রবল স্রোতস্বীনি, সপ্তগ্রাম বন্দর (বর্তমান ত্রিবেণী অঞ্চল) তার গৌরবের শীর্ষে, বড় বড় বাণিজ্য জাহাজ সেখানে নোঙ্গর ভেড়ায়। অন্যদিকে হুগলি নদী তখন ক্ষীণকায়া, তার নির্জন তীরে তখন ধীবরদের বাস, যারা নদী তীরবর্তী বিক্ষিপ্ত গ্রামগুলিতে মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য থেকে, যেমন বিপ্রদাস পিপলাই ‘র ‘মনসামঙ্গল কাব্য‘, যা লেখা হয়েছিল পঞ্চদশ শতকের শেষে বা ষোড়শ শতকের গোড়ায়, আমরা জানতে পারি হুগলি নদীপথে অবস্থিত মনুষ্য–বসতি বা ছোট ছোট গ্রামের কথা। কিন্তু বিপদ ঘনিয়ে আসছিল খুব দ্রুত – ১৫০৫ খ্রি ঘটল সেই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প, যা সম্পূর্ণভাবে বদলে দেয় এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি। ভূমির ঢালের পরিবর্তনের ফলে সরস্বতী নদীতে পলি পড়তে থাকে এবং হুগলির জলধারা বেড়ে যেতে থাকে। বড় বাণিজ্য জাহাজগুলিকে সরস্বতীর অববাহিকায় প্রবেশের জন্য জোয়ারের অপেক্ষা করতে হত। পর্তুগিজ বণিকরা তখন সপ্তগ্রাম ছেড়ে ক্রমশই আকৃষ্ট হতে থাকল হুগলির প্রতি – সপ্তগ্রামের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ঘটতে থাকল হুগলি বন্দরের উত্থান। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত), তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘সপ্তগ্রাম অর সাতগাঁও‘ তে লিখেছিলেন : ‘সরস্বতী নদীতে পলি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সপ্তগ্রামের মৃত্যুঘন্টা বেজে উঠল। (‘জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল‘, ১৯০৯) এই প্রবন্ধে তিনি আরও লিখেছেন: ‘একটি খুব ক্ষীণ জলধারা, মাত্র চার থেকে পাঁচ ফুট চওড়া, পুরনো নদীখাত দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে‘। বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন যে পুরনো নদীখাতে পাওয়া যায় বড় বড় নোঙ্গর, শিকল, দড়ি ইত্যাদি। বর্তমান চন্দননগরের উল্টো দিকে খলিসানির উত্তরে এখনও সরস্বতী নদীর ক্ষীণ জলধারা প্রবহমান। পৃথিবীর ইতিহাসে ‘রিভার সোয়াপিং‘ র এমন ঘটনা বোধহয় খুবই বিরল !
ব্রিট্রিশ ঐতিহাসিক ফিলিপ ডেভিস একদা হুগলি নদী সম্মন্ধে মন্তব্য করেছিলেন যে হুগলি শুধুমাত্র একটি ভারতীয় নদী নয়, এটি সারা পৃথিবীর সম্পদ। ব্রিটিশ আগমনের পূর্বেই চারটি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি হুগলির পশ্চিম পাড়ে উপনিবেশ স্থাপন করে – হুগলিতে পর্তুগিজ, চুঁচুড়াতে ডাচ, চন্দননগরে ফরাসি ও শ্রীরামপুরে ডেনমার্ক। হুগলির পশ্চিমকূলকে সেই সময়ের নিরিখে অভিহিত করা হয়ে থাকে ‘মিনি ইউরোপ ‘নামে।
ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম ছিল যাদের সমুদ্রপথে ভারতবর্ষে আগমন ঘটেছিল সেই ১৪৯৮ খ্রি, ভাস্কো দা গামার হাত ধরে । ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দেখা যায় যে পর্তুগিজরা ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের বিভিন্ন জায়গায় উপনিবেশ স্থাপন করেছে। এমনই এক স্থান ছিল ‘পোর্তো পেকিনো‘ (ছোট বন্দর) বা ‘সাতগাঁও‘ (সপ্তগ্রাম) এবং পরবর্তীকালে তা স্থানান্তরিত হয়েছিল হুগলি–ব্যান্ডেল অঞ্চলে – বর্তমান কলকাতা থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার উত্তরে। হুগলি নদীতীরে প্রথমে আগমন ঘটলেও পর্তুগিজদের সবার প্রথমেই মুঘল দৌরাত্মের ফলে এই স্থান থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
সপ্তগ্রাম বন্দর পতনের ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতির আশংকায় পর্তুগিজরা স্থান পরিবর্তন করে দক্ষিণে পাড়ি জমাল, হুগলি নদীর নরম পলিমাটিতে হোগলার বনে ঘেরা ভূমির ওপর স্থাপন করলো হুগলি শহর ও বন্দর। গড়ে উঠল পর্তুগিজ বাণিজ্য কুঠি ও দুর্গ । ১৬৩২ খ্রি নাগাদ সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশেই কাশিম খানের নেতৃত্বে হুগলি অবরোধ করার ফলে পর্তুগিজদের পতন ঘটে এবং পরবর্তীকালে তা চলে যায় ইংরেজদের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু পর্তুগিজরা এতো শীঘ্র বিদায় নিলেও, বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতিতে তাদের অবদান আজও শুধু অটুটই নয়, অন্যান্য ফিরিঙ্গি জাতিদের থেকে তা অনেক অর্থেই বেশি। আলু, টমেটো, কাঁচা লঙ্কা, পেঁপে, পেয়ারা, এদেশে তাদেরই আমদানি। শুক্তো রান্না, ছানা তৈরি এবং পরবর্তীকালে তৈরি অনেক মিষ্টির মূল ইতিহাস কিন্তু পর্তুগিজদের সঙ্গেই জড়িত। প্রচুর আটপৌরে বাংলা শব্দ, যেমন, আলমারি, চাবি, জানালা, বালতি, সায়া, আলকাতরা, তোয়ালে, সাবান, সবই পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত।
ওলন্দাজরা নেহাত দায়ে পড়েই পত্তন করেছিল চুঁচুড়া শহরের – তাদের আসল নজর ছিল হুগলির প্রতি । শৌর্যে তখন হুগলি উজ্জ্বল, কিন্তু ওলন্দাজদের বেছে নিতে হল পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, যা তখন বন, জঙ্গল, জলাভূমি ও চিঁচিরা (এক ধরণের বেত) অধ্যুষিত এলাকা – সঙ্গে কিছু ছড়ানো ছিটোনো গ্রাম ও গ্রাম্যদেবতা ষণ্ডেশ্বর মহাদেবের মন্দির। কালক্রমে চুঁচুড়া হয়ে উঠল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি‘র অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র। ডাচেদের বাণিজ্যের ক্ষেত্র ছিল মূলত জবক্ষার (সল্ট পিটার), মশলা, তুলো, রেশম ও নীল। ১৭৪০ খ্রি নাগাদ ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৈর করে এক দুর্গ – ফোর্ট গুস্তাভাস। ৭ ই মে, ১৮২৫ খ্রি ইংরেজদের হাতে চুঁচুড়া হস্তান্তরের পরে সেই দুর্গের প্রতিটি ইঁট ভেঙেই ইংরেজরা তৈরি করেছিল সৈনিকদের থাকার জন্য এক বিশাল ব্যারাক, যা এখন চুঁচুড়া কোর্ট এবং এশিয়ার দীর্ঘতম ভবন। সেই হৃদয়বিদারী দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলেন চুঁচুড়ার শেষ ডাচ গভর্নর ড্যানিয়েল ওভারবেক, যিনি শত প্রলোভন সত্ত্বেও ইংরেজদের দেওয়া চাকরির পরিবর্তে দারিদ্রের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর গল্প অন্য কোনওদিন ।
হুগলি নদীর বঙ্কিম চন্দ্রের মত এক সুন্দর বাঁকে অবস্থিত চন্দননগর শহর। অনেকের মতে হয়তো ‘চাঁদের শহর‘ নাম থেকেই ‘চন্দননগর‘ নামের উৎপত্তি। চুঁচুড়া ও চন্দননগর কে প্রায়শই ‘টুইন টাউন্স‘ বা ‘যমজ শহর‘ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ১৬৮৮ খ্রি এক ফরমান জারি করে বাদশাহ আওরংজেব ফরাসিদের চন্দননগরে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করার অনুমতি দেন। ১৭০১ খ্রি এর মধ্যে দেখা গেল ফরাসিরা হুগলির পশ্চিম পাড়ে চন্দননগরে নির্মাণ করে ফেলেছে শক্তিশালী দুর্গ ‘ফোর্ট দ‘ অরলিয়া‘। কিন্তু ‘ফরাসডাঙ্গা ‘র একটি সমৃদ্ধশালী বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে উঠতে আরও অনেক বছর লেগেছিল; সে প্রায় ১৭৩১ খ্রি নাগাদ। ফরাসিরা ইউরোপে রপ্তানি করত কাপড়, পাট, আফিম ও নীল। মূলত ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থেই গড়ে উঠেছিল ‘ফরাসডাঙার তাঁত‘, যা এখনও জীর্ণপ্রায় অবস্থায় কিছু জায়গায় টিকে আছে। ১৭৩০ খ্রি চন্দননগরের অধীক্ষক হয়ে এলেন জোসেফ ফ্রাঁসোয়া দুপ্লে। ব্যবসা বাণিজ্য, স্থাপত্যকলা, নগরায়নের সে এক স্বর্ণযুগ। শিল্প, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য্যপ্রিয়তার জন্য বিখ্যাত ফরাসিরা কিন্তু সেখানেই থেমে থাকে নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নির্মাণ শুরু হল চন্দননগরের বিখ্যাত ‘স্ট্র্যান্ড’, ফরাসিরা যাকে বলতো ‘প্রমেনাদ‘, যা আজ ও চন্দননগরবাসীর কাছে এক বুক ভরা নিঃশ্বাসের গর্বের অনুভূতি। ‘স্ট্র্যান্ড’র পশ্চাৎপটে গড়ে উঠতে লাগল প্রাসাদোপম সব অট্টালিকা – চার্চ , সেন্ট জোসেফ ‘স কনভেন্ট, দুপ্লে প্যালেস, ক্লক টাওয়ার, থিসল হোটেল, রেজিস্ট্রি বিল্ডিং – যা আজও টিকে আছে সময়ের হাতছানি এবং অস্তিত্ব সংকট কে উপেক্ষা করে। আর আছে, ‘স্ট্র্যান্ড’ এর দক্ষিণ প্রান্তে বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ এর সান্নিধ্যধন্য ‘পাতাল বাড়ি ‘। এই শহরের বাতাসে মিশে আছে গোন্দলপাড়ার নুনের গোডাউন এর ম্যানেজার পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত আন্তনি ফিরিঙ্গির গানের সুর। ফরাসি ঐতিহ্যের সবচেয়ে জাগরুক উদাহরণ হলো চন্দননগরে আজও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে, চন্দননগর কলেজে, দুপ্লে প্যালেস ও মিউজিয়াম এ ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা। চন্দননগর আজ ভুবনবিদিত তার জগদ্ধাত্রী পূজা ও তার আলোকসজ্জার জন্য। আর সেই সঙ্গে রয়েছে সূর্য্য মোদকের মিষ্টি। হয়তো এই মিষ্টির টানেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বার বার ফিরে আসতেন চন্দননগরে। তাঁর পদ্মা বোটে ডাক পড়ত সূর্য্য মোদকের – দুরু দুরু বুকে মুক্তোর দানার মত এক নতুন ধরণের মিষ্টি পরিবেশন করে একদিন যিনি দেখলেন কবিগুরু আহ্লাদিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘মতিচুর!’ আর জামাই ঠকানো সেই বিখ্যাত ‘জলভরা ‘র কথা? এখানে যেন গল্পকথা ও ইতিহাসের এক অদ্ভুত মিশ্রণ, সেই ইতিহাস অনেক আদরের, অনেক যত্নের!
দক্ষিণ বাহিনী হুগলির উজান বেয়ে এবার আমরা মহানগরীর কাছাকাছি -মাত্র ২৫ কিলোমিটার উত্তরে। এ শহরের ইতিহাস অনেক পুরনো। ফিরিঙ্গিদের আগমনের অনেক আগেই এখানে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ -শ্রীরামপুর। ১৭৫৫ খ্রি নবাব আলীবর্দী খান ফরমান জারি করে ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে অনুমতি দিলেন বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের। ষাট বিঘা জমির উপর ডেনমার্কের উপনিবেশ স্থাপিত হল, নাম হল ‘ফ্রেডরিক্সনগর’, তাদের রাজা পঞ্চম ফ্রেডেরিকের সম্মানার্থে। এই নাম টিকে রইলো ১৮৪৫ খ্রি পর্যন্ত, যতদিন না ইংরেজরা তাদের কাছ থেকে এই নগর কিনে ‘শ্রীরামপুর ‘ নামটি পুনর্বহাল করল। শ্রীরামপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহু ধারায় বর্তমান। লাখো মানুষের সমাগমে এখানে অনুষ্ঠিত হয় মাহেশের রথযাত্রা, এখানে আছে রাজবাড়ী , আছে জগন্নাথ মন্দির, আবার আছে সেন্ট ওলাভ’স চার্চ , ডেনিশ গভর্নর ‘স হাউস,পুনর্নির্মিত ডেনমার্ক ট্যাভার্ন, উইলিয়াম কেরি, মার্শমান ও ওয়ার্ডের সমাধি এবং কেরি প্রতিষ্ঠিত দুই শতাব্দী প্রাচীন শ্রীরামপুর কলেজ (১৮১৮)। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শ্রীরামপুরে আগমন ঘটেছিল উইলিয়াম কেরি, জোসুয়া মার্শমান ও উইলিয়াম ওয়ার্ডের, যাঁদের একত্রে বলা হয়ে থাকে ‘শ্রীরামপুর ট্রায়ো’, যাঁরা শিক্ষা বিস্তারে ও সমাজ সংস্কারে এনেছিলেন আমূল পরিবর্তন ও যাঁদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুরের নবজাগরণ। কেরি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা গদ্যের জনক এবং বিভিন্ন বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন দ্বিতীয় বাংলা দৈনিক ‘সমাচার দর্পন’ (১৮১৮ )। কেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘শ্রীরামপুর মিশন প্রেস ‘ (১৮০০), যেখানে মুদ্রণের জন্য পঞ্চানন কর্মকারের তৈরি কাঠের বাংলা টাইপ প্রথমবার ব্যবহার হয়েছিল। শ্রীরামপুর এর বহু ধারায় সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চা যেন পুরাতন ও নুতন কে একত্রিত করার ডাক।
কলকাতায় ইংরেজরা যখন জাঁকিয়ে বসছে, হুগলির পশ্চিম তীরে ফিরিঙ্গি উপনিবেশ গুলি তখন অস্তাচলগামী — বহু শতাব্দী পার করে এসে তারা তখন ইংরেজদের কূটনৈতিক মেধার কাছে পরাজিত। তারপর একদিন, ইংরেজরা হয়ে উঠল দেশের রাজা, কলিকাতা–সুতানুটি–গোবিন্দপুর হয়ে উঠল সারা ভারতবর্ষে ইংরেজদের রাজধানী, মহানগরী ‘ক্যালকাটা ‘। কলকাতার কিছু দূরেই, হুগলির পশ্চিম পারের ইতিহাস কি তবে ভাগীরথীর স্রোতে ভেসে গেল? তাও কি সম্ভব ? খিলান দেওয়া মস্ত উঠোনের একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে যে তখন সহবাস করছে ফিরিঙ্গিদের সংস্কৃতি , রং বদলাচ্ছে সমাজের , আদরের স্মৃতি তে গল্পকথা হয়ে আছেন আন্তনি ফিরিঙ্গি, কেরি, ওভারবেক, দুপ্লে, আর রান্নাঘর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে শুক্তোর সুঘ্রাণ!
তথ্যঋণ:
১) Chandernagore Mon Amour: The Citadel of the Moon, Ed. Antara Mukherjee, University of Liverpool, 2018.
২) Bandyopadhyay, Rakhaldas, ‘Saptagram or Satgaon’, Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1909.
৩) আঢ্য, অক্ষয় কুমার, হুগলি চুঁচুড়ার নানা কথা, হুগলি সংবাদ , ২০১৪।
৪) বন্দ্যোপাধ্যায় , বিশ্বনাথ, চন্দননগরের প্রাক ঔপনিবেশিক ইতিহাস।
৫) চন্দননগরের বিবিধ প্রসঙ্গ; কালেকশন অফ আর্টিকেলস; চন্দননগর সরকারি কলেজ : সম্পাদনা , অন্তরা মুখার্জী, রুপালি, কলকাতা।
৬) রায় , শুভরাংশু কুমার : সেকাল ও একাল, গণপ্রগতি, ২০১৮।
পেশায় শিক্ষিকা পূর্বা শিক্ষকতার পাশাপাশি ইতিহাস ও সংরক্ষণ বিষয়ে গবেষণায় রত। তিনি 'হুগলি রিভার অফ কালচারস পাইলট প্রজেক্টের' সঙ্গে যুক্ত ইউনিভার্সিটি অফ লিভারপুল ও ভারত সরকারের উদ্যোগে যেটার কাজ চলছে।
2 Responses
এ ধরনের কাহিনী পড়তে পড়তে ডুবে যাই অতীতের অতলে। মনোগ্রাহী বিবরণ । ধন্যবাদ।—–মিলন চক্রবর্তী, শ্রীরামপুর, হুগলি।
কেমন বেড়িয়ে এলাম নাতিপ্রাচীন সময়ে। চন্দননগরে আমি জন্মেছিলাম। হাসপাতালে। গোন্দলপাড়ায় বাসা ছিল। খুব অল্প সময়ই ছিলাম। সেখানে মাসির বাড়ি এখনও। বড় হয়ে, কমবয়েসেই, চন্দননগরে একবার একটানা দু’মাস ছিলাম। ডুপ্লে মিউজিয়াম দেখেছি। আর ওই অলৌকিক স্ট্র্যান্ড। ভুলব না।