দিন শুরুর আগে বিপ্রতীপরা তৈরি হয়ে নেয়। এতটুকু ছোট স্কুলবাড়ির ঘরে আজ বিপ্রতীপের কুরুক্ষেত্র। বিপ্রতীপকে যে কোনও মূল্যে নিজের ঘাঁটি আগলাতে হবে। ভারী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শিক্ষিত সৈনিকরা নিজেদের কাজ বুঝে নিয়েছে। দু’শো মিটারের ভেতর সব রাজনৈতিক দলের পোস্টার পতাকা পরিষ্কার করে দিয়েছে। বিপ্রতীপ ঘরের ভেতর নিজের জায়গা বুঝে নেয়। খানিক পর পোলিং এজেন্টের আর্জি নিয়ে একটা ফর্ম-১০ আর আধার কার্ড সামনে আসে। চোখ তুলে বিপ্রতীপ অবাক হয়ে যায়। সুন্দর করে শাড়ি পরে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে একটি মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। দু’মুহূর্ত লাগে চিনতে। এ তো গতরাতের সেই সাহসি পোশাকের মোটর বাইকে করে আসা মেয়েটি! সনৎ বলেছিল ‘রূপশ্রী’ নাম। খুব নম্রভাবে হেসে বলে, “আমাদের যে আরও কয়েকজনের বসার কথা।” বিপ্রতীপও খুব অমায়িক গলায় বলে, “দেখুন ওই পাহারায় যারা আছে, ভেতরে আসা না-আসা নির্ভর করছে, ওদের ওপর। সেখানে আমার এক্তিয়ার নেই।”
মেয়েটি সেনা জওয়ানদের দেখিয়ে বলে, “কিন্তু এরা কী ভাবে এল? এই বুথ তো স্পর্শকাতর বলে চিহ্নিত নয়!”
— সে আপনারা ভালো জানবেন। যাইহোক, এখনই কাজ শুরু করতে হবে।
ক্রমে প্রমথদের পক্ষ থেকেও একজন এজেন্ট আসে। আরও কয়েকজন নির্দল সেজে আসতে চেয়েছিল। কাগজ দেখে বাইরের সৈনিকরা তুষ্ট হয়নি। তারা বুথ অবধি পৌঁছয় না। হাল্কা বাদানুবাদ কানে এসেছে। তবে সে সব সামান্য। সময়মতো ভোটদান প্রক্রিয়া শুরু হয়। মাঝখানে দু’বার অবজার্ভার ঘুরে গেলেন। বিপ্রতীপ বুঝতে পারে, সামনে বসে থাকা যুযুধান দুই পক্ষ এই মসৃণ প্রক্রিয়াতে সন্তুষ্ট হচ্ছে না। আর ক্রমে ক্ষোভ জমে উঠছে বিপ্রতীপের ওপর। ওদের অনেক ভোটার নাকি ভেতরে আসার সুযোগ পাচ্ছে না। বিপ্রতীপের একই জবাব,
— বুথের বাইরে আমার কোনও এক্তিয়ার নেই।
ক্রমে দিন গড়িয়ে যায়। সারাদিনে নিজের চেয়ার ছেড়ে ওঠেনি বিপ্রতীপ। সামনেই রূপশ্রী বসে। নামের সার্থকতা কিছুটা হলেও আছে। বিপ্রতীপের সহকর্মীদের অল্প বয়স। চোখ মন টানতেই পারে। বিপ্রতীপ চেষ্টা করে ওদিকে যতটা না তাকিয়ে থাকা যায়। কোনওরকমে সব রকম প্রকৃতির ডাক উপেক্ষা করে কাটিয়ে দেয়। প্রমথর দলের এজেন্টটি বলেই ফেলে, “সিগারেট তো বোধহয় খান না? স্যারের কি বাথরুমও পায় না?” বিপ্রতীপ জবাব দেয় না। মৃদু হেসে একমনে কাজ সারে। কোনও উত্তর না পেয়ে ছেলেটির হতাশা বাড়ে, “নাকি সুন্দরীকে ছেড়ে যেতে চাইছেন না?” ইঙ্গিত স্পষ্ট রূপশ্রীর দিকে। বিপ্রতীপ বুঝতে পারে, সারাদিনে নিজেদের কার্যসিদ্ধি হয়নি দেখে বুথের ভেতর ইচ্ছে করে গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করছে। বিপ্রতীপ চুপ থাকলেও রূপশ্রী কী ভাবে নেবে, তাই দেখার। তবে মেয়েটি বেশ পরিণত মনে হল। এইসব হাল্কা টিটকিরি সন্তর্পনে এড়িয়ে গেল।
দিনটা প্রায় শেষ হয়ে আসে। বুথের ভেতর রূপশ্রীদের অস্বস্তি বেড়েছে। যেমন পরিকল্পনা করা ছিল, তেমন কিছুই হয়নি। বুথের সীমানার বাইরে সব দলেরই লোকজন হাত কামড়াচ্ছে। নিজের ডেরায় বসে প্রমথ ফোনে নানা জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। তার মধ্যে অচেনা নম্বর থেকে ফোন।
— প্রমথবাবু কাল রাতে এসেছিলেন। বোঝেন তো, ডিউটির সময় হাত-পা বাঁধা থাকে। আজ সন্ধ্যের পর যদি ফাঁকা থাকেন, ‘মডার্ন পার্লার’-এ চলে আসুন। কথা আছে।
প্রমথ বুঝতে সময় নেয়। অন্য মনে একটু হাসে। চারপাশে বসে থাকা চাটুকারেরা বুঝতে পারে না। আকাশ থেকে খসে পড়া ঘুড়ি নির্বাচন শুরু করে। গ্রাম থেকে শহরের পথে, দুর্লভপুরের বিউটি পার্লার আর কেবল টিভি এক অন্যতম স্বয়ম্বর। সঙ্গে দ্রুত জায়গা নিচ্ছে মোবাইল ফোন। স্বপ্নের পথ মসৃণ, বাস্তবে অনেক চড়াই উতরাইয়ের অর্জন প্রয়োজন। কিন্তু এখন সবার অনেক তাড়া। তাই জনপদ ছুটতে আরম্ভ করেছে। অশিক্ষার ইতিহাসে অলক্ষ্যে লেজ জড়িয়ে যাচ্ছে। উড়ান অধরা থেকে যায়।
ক্রমে ভোটপর্ব নির্বিঘ্নে শেষ হয়। বিপ্রতীপ সকলকে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানায়। সনৎ আর তার সঙ্গীকে পর্যন্ত ডেকে আনে। সনৎ ভেজা বেড়ালের মতো বলে, “কিছু মনে করবেন না স্যার। চাকরি বাঁচাতে অনেক কিছু করতে হয়।” বিপ্রতীপ ভাবে, “চাকরি না হয় বাঁচল, মান সম্মান কি বাঁচে?” মুখে কিছু বলে না। যে যার বোধ নিয়ে চলুক। সই সাবুদ করে, ষোলো দফা নির্দেশ অনুযায়ী রিপোর্ট লিখে দায়িত্ব হস্তান্তর করে। ফেরার পথ আবার অন্ধকার। নির্বাচন উৎসবের শেষে ইতস্ততঃ পতাকা ফেস্টুন পড়ে রইল। যারা ছুটির দিন পালন করেছে, তারা আয়েস করে ভোট দিয়ে অথবা না-দিয়ে, টিভি দেখে, দিবানিদ্রা দিয়ে পাড়া বেড়াতে বেড়িয়েছে। কোথায় কেমন হল, সে সব নিয়ে জল্পনা কল্পনা। একটা জিপ এসে বিপ্রতীপের পাশে দাঁড়ায়। তাকিয়ে দেখে পুলিশের গাড়ি। ভেতর থেকে উর্দিধারী অফিসার ডাকে, “স্যার, চলে আসুন। আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।” বিপ্রতীপ অবাক হয়, “আমায়? আমি একা চলে যেতে পারব।”
— স্যার, আমায় চিনতে পারেননি। আমি প্রতাপ, আপনার প্রাক্তন ছাত্র। আর তাছাড়া ডিএসপি স্যারও আপনার কথা বলেছেন।
এরপর আর না বলা যায় না। ছাত্রদের কাছ থেকে পাওয়া সম্মান। শিক্ষকতার জীবনে এটাই বড় পাওনা। গাড়িতে উঠে বসে বিপ্রতীপ। প্রতাপ বেশ উচ্ছসিত গলায় বলতে থাকে, “ডিএসপি সাহেব আপনার খুব প্রশংসা করছিলেন। বললেন, আপনি ছিলেন বলে আজ বিশ্রি গন্ডগোল লাগা থেকে বেঁচে গেল। দুই দলেরই ঘোঁট পাকানোর মতলব ছিল।” বিপ্রতীপ বুঝতে পারে না, ঠিক কী করেছে। বলে “আমি আমার কাজটুকু করেছি। তার বেশি কিছু নয়।”
— আসলে সেটাই তো সকলের করার কথা। চাপের মুখে, লোভের মুখে সবাই তো আপনার মতো সোজা হয়ে থাকতে পারে না।
কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছিল। কিছুটা খটকাও। যাইহোক, হয়তো এটাই বিপ্রতীপের শেষ নির্বাচন।
******
এমনি দিনে, এই সময়ে বাজার পাড়া অন্ধকার হয়ে যায়। আজ ভোট বলেই হয়তো, বেশ কিছু আলো জ্বলছে। বাজারের একটা ঘেরাটোপ রয়েছে। তার বাইরেও ছড়িয়ে গেছে বিস্তার। বিশেষ করে, চাষিরা আনাজ নিয়ে বাইরে বসে। একটা মাঠ আর সংলগ্ন রাস্তা ক্রেতা-বিক্রেতায় ভরে থাকে। তার মধ্যে অনেকেই দুর্লভপুরের বাইরে থেকে আসে। ভোটের ভেতর বলতে পারেনি। সে সব মিটতেই প্রমথ বাজার কমিটির কাছে আসে। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে কড়া নির্দেশ, একটা ভোট শেষ হলেই পরের ভোট নিয়ে কাজ শুরু করে দিতে হবে। বাজার কমিটির বাঁশের বেড়ার ছোট ঘর, টিভি চলছে। কয়েকজন তাস খেলছে। হালকা চালে ভোট উৎসব নিয়ে আলাপ হচ্ছে। সকলেই বাজারের স্থায়ী বা অস্থায়ী অংশের ব্যবসায়ী। খানিক অলসভাবে সময় কাটাচ্ছে। সাদা গাড়িটা রাজহাঁসের মতো জটলার সামনে এসে দাঁড়ায়। সাধারণত এই ধরনের জনসংযোগের সময় প্রমথ গাড়ি থেকে নামে না। প্রমথর গাড়ি ভয়ে বা সম্ভ্রমে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
— এবারে পাঁচদিন ধরে অষ্টপ্রহর নামগান হবে। গাড়ির ভেতর থেকে প্রমথর ছুঁড়ে দেওয়া কথায় সবাই কৌতুহলে তাকায়। প্রমথ বুঝিয়ে বলে, “পুরো মাঠজুড়ে প্যান্ডেল হবে।”
পুণ্য অর্জনের সুযোগের জন্যে ব্যবসায়ীদের খুশির বদলে একটু অসন্তুষ্ট মনে হল। কিন্তু করার কিছু নেই। এ যেন রাজাদেশ। প্রমথ হেসে হেসে বলে, “সকলের জন্য ভোগের ব্যবস্থা হবে। চাঁদা জোগাড় করতে হবে। আমি পুরোহিত ডেকে দিনক্ষণ ঠিক করছি।” পুরো মাঠজুড়ে প্যান্ডেলের অর্থ পরিষ্কার। ওই ক’দিনে মাঠে যারা বসে তাদের দোকানদারি বন্ধ। শুধু নামগানে পেট চলবে? তার ওপর খরচের চাঁদাও দিতে হবে। বছরে একবার বাজার কমিটির দুর্গাপূজা উপলক্ষে মাঠ ব্যবহার হয়। এখন তার সঙ্গে নামগান যোগ হল। কিছুক্ষণ ভোট নিয়ে খবরাখবর আদানপ্রদান করে, নামগান নিয়ে নিজের রায় ঘোষণা করে প্রমথর গাড়ি পার্লারের দিকে এগিয়ে যায়।
তারপর দেখা যায় মডার্ন পার্লারের সামনে সাদা এসইউভি দাঁড়িয়ে। ভেতরে পুরুষ্ট শরীর নিয়ে অঙ্গসংবাহনে নিমগ্ন প্রমথ। মাথায় হাত পড়লে, ঘুম এসে যায় প্রমথর। আর সে হাত যদি মেয়েদের হয়। জুড়িয়ে আসা চোখে, বলতে থাকে
— তোরা হাত দিলে আমার ঘুম এসে যায়।
— আসলে কাঁচির শব্দে মাথার আরাম হয়। তাই ঘুম আসে।
— তোদের আঙুলেও হয়। তোদের দিদি আসবে না? ঘটা করে খবর পাঠাল? এখনও পাত্তা নেই?
— আপনাকে বলেছে যখন, নিশ্চই আসবে। ভোটের রিপোর্ট করছে হয়তো।
পাশের সিটে একটা দাড়িওয়ালা লোক বসে চুল সেট করছে। আজ প্রমথ একটু প্রগলভ। যদিও ফল বেরতে দেরি আছে, তবু ভোটপর্ব মিটেছে। নিজের এলাকার বুথে ইচ্ছে মতো খেলতে পারেনি বলে মনটা খিঁচড়ে ছিল। বিকেলে রূপশ্রীর ফোন পেয়ে খুশি হয়ে গেছে। ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও আদতে দু’জন তো একটি খেলারই খেলোয়াড়। পার্লারের ভেতর নরম মিউজিক, হাল্কা ফ্রেশনারের গন্ধ আর সঙ্গে এসি-র হিমেল বাতাস। সব মিলিয়ে মন তরতাজা। পাশের লোকটির সঙ্গে মশ্করা করতে ইচ্ছে হয়। জিজ্ঞেস করে, “লাইন দিয়েছেন?” লোকটি গভীর ভাবে নিজের চুলকাটা দেখছিল। একটু বুঝতে সময় নেয়, যে কথাটা ওকেই বলে হচ্ছে। তারপর আশ্চর্য হয়ে বলে, “কেন?”
— বা রে! কার্ড করাবেন তো? না হলে বার করে দেবে।
— কে বার করবে?
প্রমথ আর ভণিতা করে না। সরাসরি বলে, “এক কাজ করুন, দাড়িটা কেটে ফেলুন।” এবার লোকটি সূত্র ধরতে পারে। বলে, “কেন? ইন্দিরা গান্ধী মরে যাওয়ার সময় অনেকে দাড়ি কেটেছে, আমি কাটিনি।”
— তবে দাড়িটা থাক, গোঁফটা কাটুন।
লোকটি এবার থামে না, “এই জন্যেই আপনাদের আজ এই দুর্দশা। ঘরে বসে বসে যত বিপ্লব। আপনারা যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেছেন। শুধু লোকজনকে কী করে হেয় করা যায়, সেটুকুই চর্চা করছেন।” ওর চুলকাটা শেষও হয়ে গেছে। কথা শেষ করে পার্স খুলে টাকা মিটিয়ে বেরিয়ে চলে যায়। এখন প্রমথ ছাড়া আর কোনও খদ্দের নেই। প্রমথ জানেও না বাইরে বাকি দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। পার্লারের কর্মচারী ছেলেমেয়েগুলো একে একে বেরিয়ে যায়। শেষজন যাওয়ার সময় বলে, “আপনি অপেক্ষা করুন। আমরা এগোচ্ছি। এমনিতেই ভোট বলে গাড়ি কম। এরপর বেরলে ফিরতে পারব না।” এবার প্রমথর একটু অশান্তি লাগে। ফোন বার করে রূপশ্রীকে ডায়াল করে।
******
বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে প্রতাপ চলে যায়। ঘরে ফিরে ভালো করে স্নান সারে বিপ্রতীপ। চালে ডালে বসিয়ে দেয়। খিদেও পেয়েছে জোর। খাবার টেবিলেই আবার ফোনটা আসে।
— কী খবর? ক’দিন তো বেশ ভুলেই থাকলেন?
প্রথমে অবাক লাগলেও দু’য়েকটা শব্দের পরই বুঝতে পারে, সেই ‘দুর্লভপুরের বিপ্রতীপ’ ফোন করেছে।
— ভোটের ডিউটিতে আমি ব্যস্ত ছিলাম। তাছাড়া আমার তো আপনাকে ফোন করার দরকার হয়নি।
— তা কেন হবে? আপনি তো আমার নাম ভাঙিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন।
— দেখুন আমি খুব ক্লান্ত। গত রাতে ঘুম হয়নি। আজ একটু ভালো করে ঘুমোতে চাই।
— আমি কি ঘুমপাড়ানি গান শোনাব? আপনার ঘুম আপনি ঘুমোবেন, আমি কী করব? শুধু এমন খবর দেব যে আপনার ঘুম ছুটে যাবে।
— আপনার খবর আপনি রাখুন। আমার কোনও আগ্রহ নেই।
— আপনার আগ্রহ তো রূপশ্রীর শরীর!
— কী যা তা বলছেন?
— যা তা বললাম? রূপশ্রীকে পেতে ইচ্ছে হয়নি? আমি কি জানি না?
— আপনার দেখছি অনেক ক্ষমতা?
— অন্ততঃ আপনার মন বুঝতে অসুবিধে হয় না। রূপশ্রীর ঘরে যাওয়ার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ইচ্ছে হয়নি? বৌ চলে গেছে কতদিন? নারী শরীর ছুঁয়ে দেখার সাধ জাগা কি দোষের?
— আপনি কী বলতে চাইছেন? শুধু এই জন্য ফোন করছেন? আমি ছেলেকে আগেরবারই বলে রেখেছি, আমার ফোনের ওপর নজর রাখতে।
— ও নিয়ে আপনার চিন্তা নেই। স্বপ্নদীপ সব জানে।
— কী জানে?
— এই, আপনার ভোটের ডিউটি। সাহস দেখানো। রাজনৈতিক দাদা দিদির সঙ্গে টক্কর নেওয়া…
— কী করে জানল? ও ভোটের ডিউটি নিতে মানা করে, তাই আমি বলিনি।
— সব কি গোপন থাকে? ডিএসপি-কে সময় মতো যোগাযোগ না করলে, প্যারামিলিটারি পেতেন? তখন প্রমথ আর রূপশ্রীর মধ্যে পড়ে শহিদ হয়ে যেতেন।
— ওই অসৎ লোকগুলোর নাম আর করবেন না।
— এত রাগ?
— রাগ হবে না? ক্ষমতার অপব্যবহার করে সমাজকে শুষে চলেছে। নরকের কীট। আমার ক্ষমতা থাকলে…
— ক্ষমতা থাকলে কী করতেন?
— এক্কেবারে সরিয়ে দিতাম।
হিসহিস করে ওঠে বিপ্রতীপ। পিস্তল দেখানোর অপমানটা সে ভুলতে পারেনি।
— আপনার ক্ষমতা নেই, সেটাই বা ভাবছেন কেন?
— সে তো ভোট চলাকালীন ওই বুথের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখন তো আর ডিউটিতে নেই। কিন্তু ওরা তো আছে। এখন আমায় কোনও প্যারামিলিটারি বাঁচাতে আসবে না।
— যারা মারবে, তারা আগে বাঁচুক।
— তার মানে?
— মনের মানে কি সবাই জানে?
— এত হেঁয়ালি না করে ফোন রাখুন। আমার খিদে পেয়েছে।
— বেশ! আর জ্বালাব না। তবে মনের কথা শুনতে হয়। চলি। শুভরাত্রি।
বিপ্রতীপ আতান্তরে পড়ে। লোকটা কে? কী চায়? এমন সব কথা বলেছে ভেতর পর্যন্ত নড়ে গেছে। বিপাশাকে নিয়েও বলল। সত্যিই ভাবার আছে। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর থেকে একা একা কেটে গেল। পরক্ষণেই সে হেসে ওঠে। কে পাগল ছাগল ফোন করে কী সব বলছে, তাই নিয়ে এত ভাবার দরকার আছে?
খেয়েদেয়ে শুতে দেরী হয়ে গেল। একটা মস্ত বাড়ি। কিন্তু কোনও লোকজন নেই, ফাঁকা। বিপ্রতীপকে পঁয়ত্রিশ তলায় উঠতে হবে। লিফ্ট লবিতে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। সামনে অনেকগুলো লিফ্ট। লাল সবুজ বোতামের মতো আলো জ্বলছে। কেউ নেই যে অনুরোধ করবে সঙ্গে যেতে। একা লিফ্টে চাপতে ভয় করে। অতটা উঁচুতে… আর কেমন একটা বদ্ধ ঘর। জানলা টানলা কিছু নেই। তাও উঠতেই হয়। কেমন যেন শূন্যতা চেপে ধরে। লিফ্ট ওপর দিকে উঠতে শুরু করেছে। বিপ্রতীপ দম আটকে আছে। পঁয়ত্রিশ তলা আর আসছে না। কুড়ি একুশ পার হচ্ছে। কোথাও একটা ফোন বাজছে। বেজেই চলেছে। হঠাৎ খেয়াল হয় মাথার কাছের টেবিলে ফোন চার্জে বসানো রয়েছে। ধড়মড় করে ওঠে বিপ্রতীপ। ঘামে জবজবে হয়ে গেছে। কোনও রকমে মশারি তুলে ফোন ধরে।
— সরি স্যর। এত রাতে বিরক্ত করছি। আসলে খুব জরুরি একটা খবর!
লিফ্ট থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের বিছানাতে ফিরতে বিপ্রতীপ সময় নেয়। বুঝতে পারে প্রাক্তন ছাত্র প্রতাপ ফোন করেছে। সন্ধ্যাবেলায় জিপে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।
— হ্যাঁ, প্রতাপ বল। আসলে খুব ক্লান্ত ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
— তা ঘুমের কী দোষ? আসলে আমাদের তো রাত দিন বলে কিছু নেই। তার ওপর ভোটের সময় একটা চোরা উত্তেজনা থাকেই।
— এত রাতে আমায় কেন দরকার হল?
— সেই জন্যই তো ফোন করা। একটা খবর দিতে।
— কী?
— প্রমথ আর রূপশ্রী মার্ডার হয়ে গেছে।
কথাটা যেন বাজ পড়ার মতো শব্দ করল।
— কী বলছ? কী করে?
— কী করে সেটাই তো সমস্যা। তদন্ত শুরু হয়েছে। শেষ হলে জানা যাবে।
বিপ্রতীপ ভাবতে চেষ্টা করে, কিন্তু কোনও তল খুঁজে পায় না। প্রতাপ বলে চলে, “স্যার, তদন্ত সবে শুরু হয়েছে। আপনার সাহায্য হয়তো লাগবে।”
— আমার?
— হ্যাঁ, আসলে আগের দিনই ওরা আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল তো।
— তার সঙ্গে কী সম্পর্ক? ডিউটিতে থাকা প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলেরই একটু টানাপোড়েন চলে।
— তা হয়তো চলে। তবে সবার তো আপনার মতো সৎসাহস থাকে না যে ডিএসপি-কে জানিয়ে এক্সট্রা ফোর্স আনাতে পারে।
একটু আগে ফোনেও ওই লোকটা ডিএসপিকে ফোন করার কথা বলছিল। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না। কিন্তু প্রতাপকে তা বোঝানো মুশকিল। বিপ্রতীপ মন্ত্রমুগ্ধের মতো জিজ্ঞেস করে, “তারপর?” প্রতাপ বলে চলে, “প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, ঘটনার কিছু আগে, দু’জনের ফোনেই আপনার ফোন থেকে কল গিয়েছে। কাল সকালে হয়তো আপনাকে একবার আমার এখানে নিয়ে আসব। একটা স্টেটমেন্ট নেবার জন্যে।”
বিপ্রতীপের সব কেমন ওলোট পালোট লাগতে থাকে। ও কখন এই ফোনগুলো করেছে? এই বয়সে থানা পুলিশের হাঙ্গামা পোহাতে কার আর ভালো লাগে? বিপ্রতীপ বোধহয় সেই লোকটা, যে বাড়িয়ে দেওয়া আঁকশি দিয়ে দুর্লভপুরের ঘুড়িটা ধরতে চাইছে। এখন কাটাঘুড়িকে বাতাস কোনদিকে নিয়ে যায়, সেটাই দেখার। (শেষ)
আগের পর্ব – https://banglalive.com/novella-on-political-scenario-of-bengal-by-sourav-haoladar/
এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।