ক্লাস টেন পর্যন্ত সাহেবি মিশনারি ইস্কুলে পড়ার পর পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা মেনে নিয়েছিলেন যে ছেলে দৈহিকভাবে এদেশে থাকলেও মানসিকভাবে অতলান্ত সাগরের ওপারেই থাকে। মাইকেল জ্যাক্সন, ম্যাডোনা, প্রিন্সের অত্যাচার পর্যন্ত সহ্য করেছেন, কিন্তু কিছু একটা কাজে ভুল করার জন্যে যেদিন অনুশোচনাগ্রস্ত আমার মুখ দিয়ে এক ইংরেজি চার শব্দের বাক্য ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে এল সব্বার সামনে, পিতৃদেব অনুধাবন করলেন আমার চরিত্র সংশোধন ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। মায়ের দিক থেকে একটা ক্ষীণ আপত্তি ছিল, কিন্তু সেই আপত্তি ধর্মের ধাক্কায় ভেসে গেল আমার টিফিনবক্স থেকে বাসে করে রাজাবাজার-মল্লিকবাজার পার হওয়ার সময়ের কাবাবের গন্ধ পেয়ে।
[the_ad id=”270088″]
গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে, যার বাড়িতে ধম্মকম্ম লেগেই থাকে, তার এই জীবনযাত্রা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মা-বাবা দু’জনেই ক্লাস টেনের পরীক্ষার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন, আমাকে লুকিয়ে। রেজাল্ট বেরতে কলকাতার অদূরে এক আশ্রমিক বিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার ফর্ম এনে বললেন পরীক্ষায় বসতে। আমায় নিমরাজি দেখে টোপ দিলেন পরীক্ষায় পাশ করলে ১০০ টাকা দেওয়া হবে। সেই জমানায় থামসআপের বোতল দু’টাকা, চার্মস সিগারেট কুড়ি পয়সা– কাজেই একশো টাকার প্রলোভন জয় করা শক্ত- পরীক্ষা মন দিয়ে দিলাম আর রেজাল্ট কবে বেরবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাও জেনে নিলাম। নির্দিষ্ট দিনে গ্লোবে ‘সিলভারাডো’ দেখে গোলপার্কে হাজির হলাম পরীক্ষার ফলাফল জানতে। দেখলাম পাশ করেছি। বাড়িতে এসে খবর দিতেই বাবা সঙ্গেসঙ্গে একশোর নোট ধরিয়ে দিলেন হাতে আর বললেন ভর্তি হলে দু’টো নোট পাব। এককথায় ভর্তি হতে রাজি হয়ে গেলাম। ২৩ জুলাই ১৯৮৬ আমায় সেই আবাসিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হল। ভর্তির পর মা-বাবাকে সি অফ করতে যখন বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছি, আমায় গেটে আটকে দিল। মালুম হল আমি এখন থেকে হোস্টেলের ঘেরাটোপে বন্দি।
সকালবেলার চায়ের গ্লাস ধুতির মধ্যেই লুকিয়ে নিয়ে যেতাম। এতে সোজা চা নিয়ে ওপরে ওঠার অভ্যেস হয়ে গেল। সেইসঙ্গে বারোখানা মেরি বা থিন অ্যারারুট বিস্কুট সাতসকালে খাওয়ার অভ্যেসও। গোড়ায় এতগুলো বিস্কুটের পর ক্যোঁৎ ক্যোঁৎ করে অনেকটা জল খেতে হত, কিন্তু ক্রমে তাও অভ্যেস হয়ে গেল।
তখন ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভ কলেজের অংশ ছিল আর সেই আবাসিক শিক্ষায়তনে হোস্টেলকে বলা হত ‘ভবন’। নর্থ ব্লক আর সাউথ ব্লকে একতলায় আর দোতলায় সারি সারি ছাত্রদের থাকার ঘর। পশ্চিম ব্লকে একতলায় স্টাডি আর দোতলায় মন্দির। আর পশ্চিম ব্লকের একতলায় ডাইনিং হল আর রান্নাঘর। চার ব্লকের মাঝে একটা প্রশস্ত উঠোন, যেখানে সুন্দর বাগান করা রয়েছে। কিন্তু উঠোনের মধ্যস্থলে একটা কপিকল থেকে কেন একটা মস্ত লোহার রেল ঝুলছে সেটা বোধগম্য হল না। সাউথ ব্লকের তিনতলায় প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপালের বাসস্থান, আর তার পাশে একটা অত্যন্ত গোলমেলে ঘর– মাধ্যমিকে সেরা র্যাঙ্ক পেয়ে এখানে ভর্তি হওয়া চারজনের ওই ঘরে থাকার ব্যবস্থা। তাদের ওপর প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপালের সর্বদা কড়া নজর, যাতে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম চারটে পজিশন এই চারজনের দখলে থাকে। আমার স্থান হল এই গুরুগম্ভীর ভবনের নর্থ ব্লকের তিনতলায়।
[the_ad id=”270086″]
সাধারণ নিয়ম হল প্রতি ঘরে আশ্রমের হোস্টেলে থেকে মাধ্যমিক পাশ করে আসা ছাত্ররা আর নতুন আসা ছাত্ররা একসঙ্গে থাকবে। নতুন আসা ছেলেরা যাতে আশ্রমের হালহকিকত নিয়মাবলির ব্যাপারে গোড়া থেকেই সড়গড় হয়ে যায়, তাই এই নিয়ম। ঘরে গিয়ে দেখি আমারই মতো আরও কয়েক পিস ভিনদেশি তারা ওই তিনতলায় জুটেছে। শুনলাম নতুন-পুরনোর হিসেব নর্থ আর সাউথ ব্লকের একতলা আর দোতলায় কায়েম করা হলেও কোথাও একটা অঙ্কের গোলমাল করেছেন ওয়ার্ডেন, যার জন্যে শেষ মুহূর্তে হিসেব না মেলাতে পেরে এই নর্থ ব্লকের দু’টো ঘরে সাতজন নতুন ছেলে হয়ে গিয়েছে। এই ওয়ার্ডেন মহারাজ হোস্টেলের নিয়মকানুন নিয়ে কিচ্ছু বললেন না- নিয়মাবলি লেখা একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে পইপই করে বললেন পশ্চিম ব্লকের ছাদে যেন ভুলেও পা না দিই, কারণ নিচেই হচ্ছে প্রেয়ার হল ও মন্দির। সাবধান করে দিলেন এর অন্যথা হলে কড়া শাস্তি জুটবে। নতুন বন্ধুদের হাতেও দেখলাম একই কাগজ আর একই সাবধানবাণী বর্ষণ হয়েছে তাদের ওপরেও।
নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে করতে আর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে খাবার ঘণ্টা বাজল– খাবার ঘরে আরও অনেক নতুন ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। কার কী শখ, কে কোন খেলায় পারদর্শী, মাঠে কোন দলের সমর্থক, বাড়িতে কে কে আছে, এসব কোনও প্রশ্ন নয়। সব্বার চারটে প্রশ্ন– নিজের নাম, ইস্কুলের নাম, কোন স্ট্রিম আর কত নম্বর পেয়ে এসেছি। পুরনো আবাসিকরা নিজেদের আইডেন্টিটি বজায় রাখার জন্য খেতে যাওয়ার সময় হাতের থালাটা আঙুলে ব্যালেন্স করে সুদর্শন চক্রের মতো ঘোরাতে ঘোরাতে একে একে প্রবেশ করতে লাগল দেখে আরও মিইয়ে গেলাম। ভাবলাম, এঁরা তো বেশ ঘোরালো মানুষ! পরে বুঝেছিলাম এরা খুবই উপকারী, কিন্তু সেই প্রথম দিনে পুরনো আশ্রমিকেরা আলাপ করতে বেশি আগ্রহ দেখায়নি। পুরনো বন্ধুদের নিয়েই তারা মশগুল। মানে মানে আমরা সাতজন আমাদের তিনতলায় ফেরত এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সবাই শুয়েও পড়লাম। ঘুম আসতে দেরি হচ্ছে, বাড়ির কথা মনে হচ্ছে বারবার– মা-বাবা কি শুয়ে পড়েছেন? আমার কথা কি ভাবছেন? ঘরে ফ্যান নেই কারণ ব্রহ্মচর্য আশ্রমে আরামের অনুমতি নেই, এইসব ভাবতে ভাবতে, ঘামতে ঘামতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
শুনেছিলাম এক ছাত্র পরীক্ষার জন্যে ছবি তুলতে হবে বলে বাইরে যাওয়ার গেটপাস নিতে গেলে গবা তাকে বলেছিলেন পড়া ছেড়ে না উঠতে, নারানদা (হোস্টেলের রাঁধুনি) গিয়ে ছবি তুলে নিয়ে আসবে।
ভোরবেলা, তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি, ভয়ংকর আওয়াজে ঘরের সকলে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। নির্ঘাত ডাকাত পড়েছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সবাই জানালার সামনে জড়ো হয়ে নিচের দিকে তাকালাম– ও হরি! বিকেলে দেখা উঠোনের রেলের পাতটায় হাতুড়ি দিয়ে দড়াম দড়াম করে মারা হচ্ছে আর তার আওয়াজ এই নিস্তব্ধ পরিবেশের সুযোগ নিয়ে প্রত্যেক ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়ে আছড়ে পড়ছে। আমাদের কপালে কোনও পুরনো আবাসিকের পথপ্রদর্শন জোটেনি বলে আমাদের পিলে চমকে গিয়েছে। এই ঘণ্টা পড়ার মানে হচ্ছে প্রেয়ার হলে যাওয়ার সময় হয়েছে। সেখানে সকলের হাজিরা নেওয়া হবে। এরপর চা আর জলখাবার। তারপর পড়তে বসা। সাড়ে আটটায় উঠে স্নান ইত্যাদি করে নিচে ডাইনিং হলে খেতে যাওয়া। সাড়ে নয়টার মধ্যে কলেজের পথে রওনা দেওয়া। দশটাতে কলেজ। দুপুরে কলেজ ক্যান্টিনেই কিছু খেয়ে নেওয়া। বিকেলে ফেরত এসে জলখাবার। তারপর খেলার মাঠে যাওয়া। ফেরত এসে আবার প্রেয়ার হল। পড়তে বসা। সাড়ে আটটা থেকে ডিনার। প্রথম ব্যাচে ইলেভেন আর ফার্স্ট ইয়ার, দ্বিতীয় ব্যাচে সিনিয়ররা।
কয়েকদিনের মধ্যে অভ্যেস হয়ে গেল। সকালের ওই দানবীয় ঘণ্টায় আর ঘুম ভাঙত না– ঘুম থেকে উঠে পড়তাম তার আধ ঘণ্টা বাদে। হাফ প্যান্টের ওপর ধুতি জড়িয়ে কোনওমতে প্রেয়ার হলে হাজিরা দিতাম। সৌভাগ্যক্রমে প্রেয়ারের পরে হাজিরা নেওয়া হত বলে বেঁচে যেতাম। সকালবেলার চায়ের গ্লাস ধুতির মধ্যেই লুকিয়ে নিয়ে যেতাম। এতে সোজা চা নিয়ে ওপরে ওঠার অভ্যেস হয়ে গেল। সেইসঙ্গে বারোখানা মেরি বা থিন অ্যারারুট বিস্কুট সাতসকালে খাওয়ার অভ্যেসও। গোড়ায় এতগুলো বিস্কুটের পর ক্যোঁৎ ক্যোঁৎ করে অনেকটা জল খেতে হত, কিন্তু ক্রমে তা-ও অভ্যেস হয়ে গেল। কিছুদিন বাদে বুঝতে পারলাম আমরা প্রায় মোক্ষে আছি। আমাদের তদারকি করতে ওয়ার্ডেনের আসার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য, কারণ সাউথ ব্লকের তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে পুরো ঘুরে নর্থ ব্লকে এসে আবার তিনতলায় ওঠা ভারি চেহারার ওয়ার্ডেনের পক্ষে বেশ চাপের ব্যাপার ছিল। আরও শুনলাম নর্থ ব্লকের এই দু’টো ঘর আগে স্টোর হিসেবে ব্যবহার হত। এই প্রথম এখানে ছাত্ররা থাকছে। ওয়ার্ডেন মাঝেমাঝেই ভুলে যান এদের কথা। অতএব যথেচ্ছাচার শুরু হয়ে গেল। বেশি বর্ণনা না দিয়ে বলি, আশ্রমে যা কিছু নিষিদ্ধ তার ৭৫ ভাগই করেছি আমরা নিঃশব্দে। এমনকি শোওয়ার সময় লুঙ্গি আর পাজামা পরা শুরু করলাম যা কিনা আশ্রমে এক্কেবারে নিষিদ্ধ। অচিরেই ঘরে সরগমের জয়াপ্রদার ছবি ঝুলতে লাগল।
[the_ad id=”270085″]
ওয়ার্ডেন যিনি ছিলেন, তাঁর সন্ন্যাস জীবনের নাম আর পূর্বাশ্রমের নাম ইংরেজি oxymoron-এর আদর্শ উদাহরণ। তাঁর একটা ছাত্রদত্ত নামও ছিল– গবা। গবার ছিল দু’টো দুর্বলতা– এক, হোস্টেল আর ছাত্রদের আশ্রম চৌহাদ্দির বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে উনি খুব স্পর্শকাতর ছিলেন। শুনেছিলাম এক ছাত্র পরীক্ষার জন্যে ছবি তুলতে হবে বলে বাইরে যাওয়ার গেটপাস নিতে গেলে গবা তাকে বলেছিলেন, পড়া ছেড়ে না উঠতে, নারানদা (হোস্টেলের রাঁধুনি) গিয়ে ছবি তুলে নিয়ে আসবে। আর দুই, যেনতেনপ্রকারেণ এই ভবনকে সেরা করতে হবে, এই ছিল গবার জেদ। একটু আধটু লিখতে পারতাম বলে আর ইস্কুলে ম্যাগাজিন সম্পাদনার অভিজ্ঞতা থাকার জন্যে কলেজের বাংলা দেওয়াল পত্রিকার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তাল। তাই দেখে উনি তড়িঘড়ি ভবন পত্রিকারও দায়িত্ব আমাকে দিয়ে বললেন,
— শুধু কলেজ দেখলে হবে! হোস্টেলকে ভুলে গেলে? আমি তাড়াতাড়ি বললাম,
— ম্যাগাজিনের জন্যে তো মাঝেমাঝে বাইরে বেরতে হবে রঙ-তুলি-কাগজ ইত্যাদি কেনার জন্যে।
গবার উত্তর,
— যাবে! প্রত্যেক সপ্তাহে যাবে দরকার হলে!
ব্যস, আমায় আর পায় কে! এইটুকুই শুধু বাকি ছিল! এদিকে ম্যাগাজিনের কাজ দেখার জন্যে একদিন হঠাৎ গবা ঘরে এসে উপস্থিত। জয়াপ্রদার ছবি দেখে রেগে কাঁই! মৃন্ময় মাথা হেঁট করে বলেছিল,
— “ওটা আমার দিদির ফাংশানের ছবি, আপনি বললে খুলে দিচ্ছি!”
স্পন্দন সেটা খুলতে গেলে গবা বললেন,
— “না থাক থাক! আগে বলবে তো ওটা তোমার দিদির ছবি!”
কিন্তু সুদিন চিরকাল থাকে না। ওয়ার্ডেনের পাশের ‘আশাভরসা’ রুমের একজন আশ্রম ছেড়ে চলে যেতে আমাকে সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হল, কারণ ইতিমধ্যে ভাইসপ্রিন্সিপাল আমার মাথার পেছনে ‘জ্যোতি’ দেখতে পেয়েছেন।
আশ্রমের গল্পের এখানেই ইতি। বাড়ি ফেরার পর হোস্টেলের অভ্যেস থেকে গেল। স্কটিশ কলেজে ঢুকে সন্ধান পেলাম মহাত্মা তপন রায়চৌধুরী বর্ণিত ডাফ হোস্টেলের। ইউনিয়নকে পর্যন্ত ধরলাম একটা রুমের জন্যে, কিন্তু শুনেই ওরা আমাকে প্রায় মারতে এল। কারণ আমার বাড়ি কলেজের পাড়াতেই। এদিকে বাড়িতে মানিয়ে নিয়ে থাকাও অসম্ভব, কারণ ততদিনে দেশের সরকার আর সংস্কৃতির বদলের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছি। অগত্যা আস্তানা গাড়লুম প্রবীরের ৩০১ নম্বর ঘরে। আজ তিরিশ বছর পরেও ওই ঘর আমার স্বপ্নে ভাসে। ঘরের পাঁচ দিকের (হ্যাঁ পাঁচ দিক!) দেওয়ালে সুন্দর হাতের লেখায় লেখা – “আমার মেজকাকার আধখানা কুমীরে খেয়েছিল তাই বাকি আধখানা মরে গেলো”, “তুই দেখে যা নিখিলেশ আমি কেমন করে বেঁচে আছি”,”ব্যাঙ বলে ব্যাঙাচি আমি কি তোকে ভ্যাঙ্গাচ্ছি!”
বেশি বর্ণনা না দিয়ে বলি, আশ্রমে যা কিছু নিষিদ্ধ তার ৭৫ ভাগ করেছি আমরা নিঃশব্দে। এমনকি শোওয়ার সময় লুঙ্গি আর পাজামা পরা শুরু করলাম যা কিনা আশ্রমে এক্কেবারে নিষিদ্ধ। অচিরেই ঘরে সরগমের জয়াপ্রদার ছবি ঝুলতে লাগল।
একটা বাংলা মদের বোতলের ছবি, তার পাশে তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা “Innovation, Nostalgia, Eternity”। হাল্কা নেশা করে একটা লাইন নিয়ে ভাবতে শুরু করলেই ব্যোম্ নেশা। ওখানেই থাকতাম। বাড়ির কোনও দরকার থাকলে মা এসে খবর দিত। তখন বাড়িতে গিয়ে দেখা করে ফেরত চলে আসতাম। হোস্টেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার আমাকে দেখলেই দরজা বন্ধ করে দিতেন, ওঁকে একবার ভালোবেসে হেঁচকি নেশা করিয়েছিলাম বলে। তাতে আরও সুবিধে হল। কেউ হোস্টেল থেকে বার করে দিতে পারবে না!
কিন্তু পড়া একদিন শেষ হল। একদিন প্রবীর এই হোস্টেল থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে শ্যামবাজার মোড়ের এক পরিত্যক্ত আরজি কর হোস্টেলে আস্তানা গাড়ল। আমিও পিছু পিছু হাজির হলাম। ওই হোস্টেলের বিদ্যুতের লাইন কাটা যাওয়ায় আমরা “CESC MEN AT WORK” বোর্ড জোগাড় করে মধ্যরাতে মাটি খুঁড়ে লাইন হুক করে চালু করে মাটি বুজিয়ে দিয়েছিলাম। তাই ওখানে সর্বদা বিদ্যুৎ থাকত, কিন্তু বিলের ব্যাপার নেই। ওখানে বসে চা খেতে গিয়ে চায়ের কাপের নৃত্য দেখে ভূমিকম্প হচ্ছে ভেবে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে জেনেছিলাম, পাশের ট্রামলাইন দিয়ে ট্রাম গেলে ওখানকার চা নাচে। মেসের রাঁধুনি মুকুন্দ যারা মাইনে দেয় তাদের জন্যে একরকম আর যারা দেয় না তাদের জন্যে আর এক রকম রান্না করত। আমরা প্রথম দলে পড়তাম বলে মুকুন্দর রান্না খেয়ে বিলু আর আমি অফিস পর্যন্ত করেছি।
এই হোস্টেলের অন্য গল্পগুলো তোলা থাকল। যেমন তোলা থাকল কচুর মুম্বই TISS হোস্টেলে বান্ধবীকে ঘরে তোলার গল্প– বান্ধবী হঠাৎ বাড়ি চলে যেতে গিয়ে বিপদে পড়ায় পাঁচু ওকে IIT হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে কীভাবে বিনা কাপড়ে আশ্রয় দিয়েছিল সেই গল্প।
আমি কিন্তু এইসব হোস্টেলে এখনও থাকি। স্বপ্নে। ঘোরে। হৃদয়ে। এখনও যেখানে মুকুন্দদা ডিম-ভাত খাওয়ায় আর আমি দেওয়ালের গ্রাফিত্তি দেখতে থাকি শুয়েশুয়ে।
পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।
18 Responses
Eto anabil lekha jno dekhte pelam sob
স্কুলের হোস্টেলে দিন কেটেছে, অনেক মিল খুঁজে পেলাম। স্মৃতি সত্যই সুখের। দারুন লাগলো লেখা পড়ে।
স্বপ্নের জগতে চলে গেছিলাম। কি সাবলীল অথচ কি সুন্দর লেখা। পরতে পরতে কি মজা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা তে থাকলাম অন্য গপ্প গুলো শোনার জন্য।
অপূর্ব
খুব সুন্দর লাগলো পড়ে ۔স্মৃতি সততই সুখের ۔۔۔
Bahudin par dupure goriye goriye Pinaki Bhattacharya r anabadyo lekha porte porte pouchhe gelam nijer chhatro jibone
Pinaki!!!!!!! 😀 😀 😀 😀 😀 😀 আপনার লেখা পড়তে পড়তে, আপনার মা কে দেখতে পেলাম আর পেলাম তাঁর বান্ধবী দের যাদের তত্ত্বাবধানে আমরাও ছিলাম 😀😀😀👏👏👏👏
সব পেলে নষ্ট জীবন ….. একথা যেমন ঠিক, আবার যাঁরা মেস বা হোষ্টেল জীবনের স্বাদ পায় নি তাঁদেরও জীবন অপূর্ণ। পিনাকীর মত আমরাও অনেকে এখনো স্বপ্নে হোষ্টেলবাসি। শুধু জানতে ইচ্ছে করে এখনো কি ভোরের আলো ফোঁটার আগে রেলের পাতটা মাঝে মাঝে বাজে। অনেকের জীবনে কিন্তু মাঝ রাতে বেজে ওঠে, আর তারপর আর ঘুম আসে না। তবু্ও তাঁরা বেঁচে থাকে মুকুন্দদার হাতের ডিম-ভাত খাবার আশায়।
হোষ্টেলএর ব্লকের বিবরনে পশ্চিম ব্লক টা দুবার ভুলবশত লেখা হয়েছে, অবশ্য তাতে লেখার সুবাস এতটুকু কমেনি।
Oshadharon .. chaliye jao bondhu .. porer gulo taratari chai
khub bhalo,kintu arektu hole bhalo hoto
” আরো চাই, ওগো আরো চাই…”…” And left me craving for more”। দুটোই গানের কলি, আর দুটোই এই লেখাটির জন্য অসম্ভব প্রযোজ্য। লেখাটির শেষ শব্দে পৌঁছে মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। রাগও হলো। পুরো স্বপ্নভঙ্গ। শুধু তো পড়ছিলাম না। আপন মনের মাধুরী মেশানো একের পর এক ছবি দেখছিলাম চোখের সামনে। যেমন দেখতাম ছেলেবেলায় এনিড ব্লাইটন এর ম্যালারি টাওয়ার্স, সেন্ট ক্লেয়ার্স এর গল্প পড়ে। কতো যুগ বাদে ছেলেবেলা এমনভাবে ডাক দিয়ে গেলো। বাস্তবে আবাসিক স্কুল বা কলেজের বৈচিত্রময় জীবনের ওপর পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা নিয়ে ভবিষ্যতে অসাধারণ কোনো সিনেমা বা সিরিয়াল দেখার আশা রাখছি। আর এই মুহূর্তে পরের লেখাটার অধীর অপেক্ষায় এক মুগ্ধ পাঠিকা……
বাহবা সময় তোর ট্র্যাপিজের খেলা
পলকেই কেড়ে নিয়ে হোস্টেল জীবন,
ঘাটে আঘাটায় পোষা বেশ্যার মতন
ঘুরিয়ে পুড়িয়ে দিলি বসন্তের হন্তারক বেলা….
fatafati laglo
বেড়ে লিখেছেন মশাই…
Narendrapur niye public er mentality odbhut – result niye shobaar khub prottasha ebong shobai chheleder okhanei porate. Othocho hostel er niyom etc. ba sannyashi der niye keu nindashuchak kichhu bolle shobai khub entertained hoy!
Sriticharon kora mane je niyom srinkhola-ke taunt korte hobe emon kotha nei. Othocho ei lekhati te niyom ebong niyomer adhikarik – du pokkhokei immature bhabe ninda kora hoyechhe.
Niyom longhon er ei itibritto ottonto klantikor o boichitroheen. Hostel-e Pinaki babu ki korten – Shudhu biscuit khaoa aar bina permission e baire jaoa? Volleyball, cricket, table tennis ba NCC or NSS er kaaj to chhilo. Shegulo korten na? Porashona to baad i diam, ei activity gulo te attoniyog korle shujog er ei opochoy hoto na!
Ami 1987-90 UG porechhi Narendrapur e, Brahmananda Bhavan. Tai ei one-sided & inaccurate account of hostel life porar por likhte baddho holam.
খুব ভালো লিখেছো, পিণাকী। বেশ লাগলো পড়তে।
এত সাবলীল লেখা , বহু দিন পড়িনি।
ছোট বেলায় একই আবাসিক ছাত্র জীবনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
Khub bhalo laglo. Probir er ghor niye ekta lekha de.darun hobe