অনেকেই ভাবেন নরেন্দ্রপুরের ছেলে মানেই নিপাট গুডি গুডি টাইপের| বেশ ধার্মিক| মদ – সিগারেট ছোঁয় না| নেশা ভাং করা তো দূরের কথা — নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে| পড়াশোনা আর কেরিয়ার ছাড়া কিছুই বোঝে না| হোস্টেলের সব নিয়ম মেনে চলে চিরকাল|
যে সময়ের কথা বলছি (আশির দশকের মাঝামাঝি), এগারো – বারো ক্লাস তখন কলেজে পড়ান হত| স্কুলের নিয়মের বেড়াজাল পেরিয়ে কলেজে এসে দেখলাম প্রায় একইরকম নিয়মাবলী| কিন্তু বিশাল এলাকা নিয়ে কলেজ| হোস্টেল বিল্ডিং তিনটিও বিরাট| নিয়ম অনেক থাকলেও নিয়ম ভাঙার সুযোগও ছিল ততোধিক| নরেন্দ্রপুরের জীবনের নানা দিক নিয়ে অনেক জায়গায় লিখেছি| আজ কয়েকটা নিয়ম ভাঙার কথা লিখছি|
নরেন্দ্রপুর কলেজে তিনটি হোস্টেল ছিল — বলা হত ভবন| ব্রহ্মানন্দ, রামকৃষ্ণানন্দ ও গৌরাঙ্গ ভবন| নরেন্দ্রপুরে প্রত্যেকটি ভবনই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের নামে| ব্যতিক্রম ছিল গৌরাঙ্গ ভবন| নিয়মকানুন কার্যকর করার ব্যাপারেও এই ভবন ছিল ব্যতিক্রমী| বেশ খানিকটা ঢিলেঢালা| আমরা থাকতাম গৌরাঙ্গ ভবনে| কোথায় কোনও নিয়ম ভেঙে খানিকটা মুক্তির স্বাদ পাওয়া যাবে, সব সময় আমাদের মাথায় ঘুরত|
এই পাঁচিল ঘেঁষে অনেকটা জায়গায় ঘন ঝোপ-ঝাড়| তার পাশ দিয়ে পায়ে চলা শর্টকাট রাস্তা হয়ে গিয়েছিল| দুই আর তিন নম্বর গেটের মাঝামাঝি,পাঁচিলের একটা জায়গা খানিকটা নিচু ছিল কোনও কারণে| এই গলতার নামই ছিল আড়াই বা থ্রি পয়েন্ট ফাইভ|
সকালে-সন্ধ্যায় প্রেয়ার হলে প্রার্থনায় যোগদান বাধ্যতামূলক ছিল| এর অন্যথা হলে কলেজ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত হতে পারতো| ভোরবেলা উঠেই প্রেয়ার হলে যেতে মন চাইত না অনেকেরই| বিশেষ করে শীত আর বর্ষায়| আবার স্বর্ণালী সন্ধ্যার মুখে সেখানে ঢুকতেও ইচ্ছে করত না অনেক সময় | আমাদের ব্যাচের ছেলেদের প্রেয়ার হলে একটু বেশি মাত্রায় গরহাজির দেখে মহারাজ অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারের ব্যবস্থা করলেন| প্রেয়ার হলের ঠিক মুখে রেজিস্টার নিয়ে বসে থাকাটা হয়ত ভালো দেখাবে না, তাই ঠিক হয় অনিলদা আর কানাইদার ঘরে হাজিরা দিয়ে প্রেয়ার হলে যেতে হবে| প্রথম কদিন একটু বুঝে নিতে সময় লাগল আমাদের| হাজিরা দিয়ে গোমড়া মুখে, ঘুম চোখে প্রেয়ার হলে গিয়ে বসতে লাগলাম| কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা গেল, হাজিরা দিয়ে এসে সটান ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লে কেউই ধরতে পারবেন না| ধুতি পরে হাজিরা দিতে যেতে হতো| বাড়তি ঘুমের সময়টুকুর জন্য আমরা ধুতি পরেই শুতে যেতাম| এতে ভোরবেলায় খানিকটা সময় বাঁচত| আধ্যাত্মিক উন্নতির বদলে যারা তামসিক ঘুমকে এতটা গুরুত্ব দেয়, তাদের নিয়ে মহারাজ হতাশ হয়ে পড়েন কিছুদিন পর| অনিলদা – কানাইদার ঘরের হাজিরাও বন্ধ হয়ে যায় একসময়|
ছোট থেকে শুনতাম কলেজে প্রক্সি দেওয়ার ব্যাপারটা| বেশ মজা লাগত| কলেজে এক একটা ক্লাসে প্রায় পঁচাশি জন| জয়েন্ট ক্লাস হলে দেড়শোর ওপর| অধ্যাপকরা বেশির ভাগ ছাত্রদের নামে চিনতেন না| আমাদের মনে হল প্রক্সি দেওয়ার এমন সুবর্ণ সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না| পার্সেন্টেন্জও ঠিক থাকবে আর ওই সময় একঘেয়ে ক্লাসের হাত থেকে বেঁচে খানিকটা নিয়মভাঙার মজাও পাওয়া যাবে| একটা প্রক্সি টিম তৈরি হল| ঠিক করে দেওয়া হত কাকে কোনদিন ক্লাসে যেতেই হবে টিমের তরফে| যারা ক্লাস কাটতে চাইবে, সেদিনকার প্রক্সি টিমের ছেলেকে পিরিয়ড, নাম আর রোল নাম্বার দিয়ে দিতে হবে আগে থেকে| ভালোই চলছিল প্রক্সি টিমের কাজকর্ম| একদিন প্রক্সি টিমের অন ডিউটি ছাত্রের হাতে সাতটি রোল নম্বর এল| সে খেয়াল করে নি যে সাতটি নম্বরই পরপর ছিল| ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে খুব গম্ভীর গলায় ‘ইয়েস স্যার’ বলা শুরু করে| ক্রমে গলা মিহি করতে হয়| সাত নম্বরে এসে তাকে প্রায় বামা-কন্ঠে ‘ইয়েস স্যার’ বলতে হয়| অধ্যাপক বলে ওঠেন — নরেন্দ্রপুর কলেজ তো বয়েজ কলেজ বলেই জানতাম| কবে যে কো-এড হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না|
সিনেমা দেখতে গেলে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে একটা মানানসই বই নিয়ে যেত অনেকে| সেই ব্যাগ রাজপুরের রুম্পা হলের সিটে পেতে বসলে ছারপোকার কামড় থেকে বাঁচা যেত| আর প্রশ্নের মুখোমুখি হলে বলা যেত — একটু পুকুরপাড়ে খোলা হাওয়ায় বসে পড়াশোনা করে এলাম|
তখন এসপ্লানেডের সিনেমা হলে দাপিয়ে ইংরেজি ছবি চলত| নিউ এম্পায়ার, গ্লোব, লাইটহাউস, যমুনা| নরেন্দ্রপুর থেকে খানিকটা দূর পড়লেও, আকর্ষণটা ছিল অমোঘ| ক্লাস কেটে সারাদিনের মতো যাওয়ার অসুবিধে ছিল| একটা প্ল্যান ভাল চলত| কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কিনতে যাওয়ার কথা বললে গেট-পাস পাওয়া যেত| আর সারাদিন বাইরে থাকার ছাড়| কিন্তু অসুবিধে একটাই — ফিরে আসার পর, কী বই কেনা হল, মহারাজ দেখতে চাইতে পারেন| তারও একটা সমাধান বের করা হয়| কলেজ স্ট্রিট থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো বই কেনা হত| তার ভেতর গোটা দুই বই একটা ছোট ব্যাগে নিয়ে সটান চলে যাওয়া হত এসপ্লানেড| পাশাপাশি দুটো হলের টিকিট কাটা হত| পরপর দুটো শোয়ের– নুন আর ম্যাটিনি| নুন শোয়ের শেষে নিজাম থেকে চট করে খেয়ে নেওয়া যেত বিরিয়ানি আর কাবাব| অনেকের সিগারেটে ঠোঁটে খড়িও এই সময় — এস্প্লানেডেরই কোনও সিগারেটের দোকান থেকে| এইভাবে জনা তিন-চার বন্ধু বেশ ফুরফুরে একটা দিন কাটিয়ে, সন্ধ্যা পেরিয়ে ফিরে আসত নরেন্দ্রপুরে| তবে এত পরিকল্পনা বা খরচ তো সবসময় করা যেত না| যেমন ধরুন, রাজপুরের ‘রুম্পা’ য় ‘সাগর’ এসেছে| দেখা ছবি| কিন্তু সেই তারুণ্যের উষালগ্নে ডিম্পল কাপাডিয়াকে বারবার দেখেও আশ মিটত না| কখনও বা ইচ্ছে করত মেনগেটের বাইরে দিলীপের দোকানের পরোটা-আলুর দম খেতে| তখন ভরসা আড়াই বা সাড়ে তিন|
নরেন্দ্রপুরে আশ্রম জুড়ে বেশ কয়েকটা বড় গেট আছে| এক-একটা গেট , এক-একটা বাস স্টপ| বিরাট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আশ্রম| এই পাঁচিল ঘেঁষে অনেকটা জায়গায় ঘন ঝোপ-ঝাড়| তার পাশ দিয়ে পায়ে চলা শর্টকাট রাস্তা হয়ে গিয়েছিল| দুই আর তিন নম্বর গেটের মাঝামাঝি,পাঁচিলের একটা জায়গা খানিকটা নিচু ছিল কোনও কারণে| এই গলতার নামই ছিল আড়াই বা থ্রি পয়েন্ট ফাইভ| বাংলা আর ইংরেজিতে কেন যে এই নামের গরমিলটা ছিল, তা জানা যায় নি কোনওদিন | হুট্ করে ক্যাম্পাস থেকে বেরতে হলে এই আড়াই ছিল ভরসা| বেশ খানিকটা হ্যাঁচর-প্যাঁচোড় করে পাঁচিলের মাথায় উঠে ধুপ করে অন্যদিকে লাফিয়ে পড়তে হত| ল্যান্ড করার পর এক মুক্ত পৃথিবী — বাঁ দিকে রাজপুর| ডান দিকে কলকাতা| নরেন্দ্রপুর তখনও শহর কলকাতার বাইরে| আর তার ঠিক সামনেই শর্মাজী নামের এক বুদ্ধিমান ব্যক্তি এক ধাবা মতো খুলে বসলেন| একটা ছাউনির নিচে কয়েকটা চেয়ার টেবিল| আর বাইরে দুটো চৌকি| রুটি, ডিম আর প্লেন তড়কা, চিকেন আর মাটন কষা পাওয়া যেত| হোস্টেলের একঘেয়ে খাবার থেকে খানিক মুখ বদলাতে আড়াই টপকানোর হার খুব বেড়ে গেল| হঠাৎ দেখা গেল আড়াইয়ের দুটো ইঁট খসিয়ে দিয়েছে কে বা কারা| এতে টপকানো কাজটা আরও একটু সহজ হয়ে যায়| যতবার সারানো হত, ততবারই ইট খসিয়ে দেওয়া হতো| একসময় সারানোও বন্ধ হয়ে গেল| পাঁচিলের ফোকর দুটো বরাবরের জন্য রয়েই গেল|
আশ্রমে ঢোকার সময় মেনগেট দিয়েই ঢোকার রেওয়াজ ছিল| মহারাজদের সামনাসামনি পড়ে গেলে অবশ্য জুতসই গল্প খাড়া করতে হত| সিনেমা দেখতে গেলে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে একটা মানানসই বই নিয়ে যেত অনেকে| সেই ব্যাগ রাজপুরের রুম্পা হলের সিটে পেতে বসলে ছারপোকার কামড় থেকে বাঁচা যেত| আর প্রশ্নের মুখোমুখি হলে বলা যেত — একটু পুকুরপাড়ে খোলা হাওয়ায় বসে পড়াশোনা করে এলাম|
কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কিনতে যাওয়ার কথা বললে গেট-পাস পাওয়া যেত| আর সারাদিন বাইরে থাকার ছাড়| কিন্তু অসুবিধে একটাই — ফিরে আসার পর, কী বই কেনা হল, মহারাজ দেখতে চাইতে পারেন| তারও একটা সমাধান বের করা হয়| কলেজ স্ট্রিট থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো বই কেনা হত| তার ভেতর গোটা দুই বই একটা ছোট ব্যাগে নিয়ে সটান চলে যাওয়া হত এসপ্লানেড|
কলেজ জীবনের শেষ দিন| পরীক্ষা হয়ে গেছে| পরের দিন বাড়ি ফিরে যাওয়ার পালা| আমার বন্ধু কৌশিক গাঙ্গুলী (বর্তমানে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক) আর আমি ঠিক করলাম শর্মাজীর ধাবাতে গিয়ে জমিয়ে খাব| আবার কবে আসা হবে ফিরে| কৌশিক পড়ত আর্টস বিভাগে, আমি সায়েন্স| ভিন্ন রুটের বাস ধরার পালা চৌরাস্তা থেকে| সেদিন আর পাঁচিল টপকানো নয়| মেনগেট দিয়েই বেরোলাম| রাত হয়ে গিয়েছিল বেশ| তাও দারোয়ান বলল না কিছু| অনেক স্বপ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম দুজনে| রুটি আর ডিম-তড়কা খেতে খেতে| আশ্রমে ফিরে বললাম — চল, একবার মন্দিরে যাই| মন্দির বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে| দুজন মিলে মন্দির প্রদক্ষিণ করলাম সাতবার| তারপর ফিরে গেলাম যে যার হোস্টেলে| কলেজের অনেক রাতের ভেতর সেই রাতটা জেগে রয়েছে স্মৃতির ভেতর| নদীর ভেতর জেগে থাকা চরের মতো|
বহু বছর পর আমার এক বন্ধু — যার পড়াশোনার ট্র্যাক রেকর্ড তুলনাহীন — মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিকে প্রথম পাঁচে, IIT, IIM , মার্কিনি নামি কোম্পানির দামি চাকরি — তার সঙ্গে বসেছি বিলেতে আমার বাড়ির লনে| বিলেতি গ্রীষ্মের আলোছায়া মাখা গোধূলি| কয়েকটি পানীয়ের পর বন্ধু একটু আনমনা হয়ে বলেছিল — এত বছর তুই আর আমি মোটামুটি একই জায়গায়| আমি বা তুই কেউই নোবেল প্রাইজ পাব না| কর্পোরেট যাঁতাকলে পড়েই দিনগুলো কেটে যাবে| তুই জীবনের অনেকটা সময় নিজের মতো করে বেঁচেছিস| আমি শালা জীবনে কোনওদিন দমই ফেলতে পারলাম না| শুধু নিয়মই মেনে গেলাম……
দু দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনে প্রবাসী পাঞ্চজন্য পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট। অবসর সময়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন।
4 Responses
Panchojonno khub bhalo laglo porey. Choto belar smriti firey elo.
Thank You 🙂
দারুন লিখেছিস! পাঞ্চো, তোদের ভবনের সেই বিখ্যাত তাস খেলা আর তারপর ধরা পড়ে একজনের ব্রহ্মচারীকে বলা- “চুপ! আমি তোমার চেয়ে লম্বা মানে তোমার চেয়ে বড়!” লিখলি না!🤣
অনেক কথা মনে পড়ছে 🙂