আমাদের দেশের সবথেকে জমকালো অনুষ্ঠান কি? সবথেকে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান? আসমুদ্রহিমাচল লম্বা বেঁটে সাদা কালো গরিব বড়লোকের প্রাণের উৎসব ?– একটাই উত্তর দীপাবলি। স্থানভেদে নামের এদিক ওদিক হলেও অনুষ্ঠান মূলত একটাই– আলো জ্বালিয়ে অশুভ বিদায় দিয়ে শুভবরণ।মজার কথা হল, বছর জুড়ে আরও অনেক অমাবস্যা যায় আসে, শুধু এই অমাবস্যাতেই মানুষ অশুভকে তাড়াতে কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেন?
এর পেছনে আছে আপামর ভারতবাসীর প্রাণের আনন্দ। এই দিনেই তো চোদ্দো বছর বনবাস শেষে রাক্ষস নিধন করে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরেছিলেন সীতাকে সঙ্গে নিয়ে। রাজ্যজুড়ে আনন্দের বান ডেকেছিল। ঘরে ঘরে সহস্র প্রদীপ জ্বালিয়ে পুরবাসী বরণ করে নিয়েছিল তাদের রাজাকে। আজ অনেকেই হয়তো সেই গল্পটা জানে না কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছে সেই বিশ্বাস ও আনন্দ— পুণ্যলগনে আলো জ্বালতে হবে গগন ভরিয়ে।
[the_ad id=”266918″]
শুধু কি দীপাবলির আলো? কার্তিক মাস জুড়েই আলোর গল্প। আশ্বিন মাসের অমাবস্যায় পিতৃপুরুষরা এসেছিলেন উত্তরপুরুষের টানে। একমাস ধরে তারা মর্ত্যের টানে রয়ে গিয়েছিলেন মাটির কাছে। কার্তিকের অমাবস্যায় তাদের ফিরে যাবার পালা। এতদিন বাদে পথ যদি না চিনতে পারেন? মাটির মাধ্যাকর্ষণ বা সংসারের মায়ার বাঁধন দুটোই যে গলা জড়িয়ে ধরে বলে– যেতে নাহি দিব। তবু যেতে হয়। চোখের জলে চেনা রাস্তা ঝাপসা হয়ে যায় তাই পথভোলা পথিককে রাস্তা দেখাতে আকাশপ্রদীপ জ্বলে ওঠে দূরের তারার পানে চেয়ে। দীপাবলির আলোর মতো তার জোর নেই। বাঁশের মাথায় বাঁধা টিমটিমে এক আলো নরম ভালবাসার মতো জেগে থাকে সারারাত।
[the_ad id=”266919″]
নীরব বলেই সে হারিয়ে গিয়েছে। দীপাবলির আলোর পেশির জোর অনেক বেশি। একটার পর একটা কিংবদন্তীর হাত ধরে ক্রমশই তা আরও দীপ্যমান। বাঙালি হিন্দুর একাংশ কোজাগরী পূর্ণিমা অর্থাৎ আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপুজো করে। আর একটি অংশ আবার কার্তিকের অমাবস্যায় সেই পুজোটাই করে সামান্য আলাদা করে। এখানে নতুন ধান একটি প্রধান উপকরণ। আর নতুন হল ছোট্ট একটা নাটক। পুজো শুরু হবার আগে গোবর দিয়ে গড়া অলক্ষ্মীকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করে বাড়ির বাইরে রেখে আসা হয়। চোদ্দো প্রদীপ জ্বালা হয় অমাবস্যার আগের দিন ভূতচতুর্দশীতে। পরের দিন আলোয় ভেসে যাবার দীপাবলি। চোদ্দো পিদিম যেন প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর মতো।
এই দিনেই তো চোদ্দো বছর বনবাস শেষে রাক্ষস নিধন করে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরেছিলেন সীতাকে সঙ্গে নিয়ে। রাজ্যজুড়ে আনন্দের বান ডেকেছিল। ঘরে ঘরে সহস্র প্রদীপ জ্বালিয়ে পুরবাসী বরণ করে নিয়েছিল তাদের রাজাকে। আজ অনেকেই হয়তো সেই গল্পটা জানে না কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছে সেই বিশ্বাস ও আনন্দ— পুণ্যলগনে আলো জ্বালতে হবে গগন ভরিয়ে।
সলতে পাকানোর কথায় মনে পড়ল, ছোটবেলায় দিদিমা ঠাকুমার দেখাদেখি পুরনো কাপড়ের টুকরো সরু ঠ্যাঙের ওপর ফেলে সলতে পাকাতাম। সম্বচ্ছর ধরেই চলত সেই কাজ। সামান্য সরষে বা রেড়ির তেল দিয়ে পেতলের প্রদীপদানিতে সেই তেলে ভেজা সলতে জ্বেলে দেওয়া হত তুলসি গাছের গোড়ায় আর দেবদেবীদের বেদীতে। সেই রোগা নিখরচার আলোই ছিল তখন গেরস্তের সম্বল। উৎসবের মরশুমে সলতে পাকানোর কম্পিটিশন। সংখ্যাতে তো বটেই তার সঙ্গে আয়ুর জোরও মাপা হত। সলতে কতখানি দক্ষ রগড়ানি খেলে নিখুঁত হবে তা সলতে পটিয়সীরাই জানতেন, কারণ তার ওপরই নির্ভর করত আলোর জোর বা টিকে থাকার দম।
[the_ad id=”270084″]
কালিপুজো, আজকাল যার পোশাকি নাম হয়েছে দীপাবলি বা দিওয়ালি, দুর্গাপুজো শেষ হবার বিষণ্ণতা কাটাবার কাণ্ডারি, হেমন্তের বিষাদ এরপরই নেমে আসবে ঘন হয়ে। সেইজন্য শেষবেলায় আরও কিছু উৎসব। দীপাবলির দু’দিন আগে ত্রয়োদশীতে হয় ধনতেরাস। যদিও দীপাবলির সবথেকে বড় অনুষ্ঠান লক্ষ্মী ও গণেশ পূজা, ইদানীং তাকে ছাপিয়ে গিয়েছে ধনতেরাসের সমারোহ। গয়নার দোকানে অকাল দেওয়ালি সারা মাসভর। সমুদ্রমন্থনে উঠে এসেছিলেন সালংকারা লক্ষ্মী অমৃতপাত্র হাতে। সেই দৈবদৃশ্যে ছিল গয়না আর বাসন। গেরস্ত এটুকু অর্জন করতেই পারে, করতে চায়ও। বাকিটা, অর্থাৎ অমৃত আর লক্ষ্মী ধরা দেবে এই আশায়। উত্তরভারতের গণ্ডি পেরিয়ে এই লোকাচার আজ ভারতের অন্যান্য অংশেও তুমুল জনপ্রিয়।
আর কোনও মাসে বোধহয় একসঙ্গে এত আলো জ্বলে না। হিন্দুদের সঙ্গে শিখ জৈন সব ধর্মেই এই দিনটি শুভ, তাই আলোর রোশনাই-ও বেশি। আশ্চর্য লাগে ভেবে, পাঁজিতে কি আর কোনও দিন বা মাস ছিল না? এত উৎসবের আয়োজন হল কেন ঠিক এই সময়ে?
দীপাবলির আলোর পেশির জোর অনেক বেশি। একটার পর একটা কিংবদন্তীর হাত ধরে ক্রমশই তা আরও দীপ্যমান। বাঙালি হিন্দুর একাংশ কোজাগরী পূর্ণিমা অর্থাৎ আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপুজো করে। আর একটি অংশ আবার কার্তিকের অমাবস্যায় সেই পুজোটাই করে সামান্য আলাদা করে। এখানে নতুন ধান একটি প্রধান উপকরণ।
প্রথমত, গ্রীষ্মপ্রধান ভারতবর্ষে এই সময়টা অত্যন্ত আরামদায়ক। দ্বিতীয়ত এই সময়ে পোকামাকড়ের উৎপাত খুব বেড়ে যেত। ছোট ছোট সবজেটে পোকাগুলোর নামই তো শ্যামাপোকা– শ্যামাপুজোর অনুষঙ্গ ধরেই। আলো জ্বালিয়ে ফানুস উড়িয়ে পরিবেশ যথাসম্ভব গরম করে পোকামাকড়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই হয়তো প্রয়োজন ছিল আলোর উৎসব। কিংবদন্তী পুরাণকথার হাত ধরে ধর্মের মোড়কে তা খুব সহজে ছড়িয়ে দেওয়া যায় লোকজীবনে। ক্রমশ তা অবশ্য পালনীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
[the_ad id=”270085″]
তেলের প্রদীপের টিমটিমে আলোর থেকে বাহারি মোমবাতির হাত ধরে রকমারি চিনে আলোর ছটায় আজকের দীপাবলি ঝলমল করছে।সাবেকি প্রদীপ, মোমবাতির সঙ্গে বিভিন্ন নকশার চিনে আলো নিবাত নিষ্কম্প হয়ে জ্বলে থাকে যতক্ষণ ব্যাটারির দম থাকে।
তবে আলোর চেহারা যাই হোক না কেন, আজ দীপাবলির আলো অধ্যাত্মিকতার উত্তাপে উজ্জ্বল। আপামর ভারতবাসী বাইরের আলোর সঙ্গে মনের আলোটিও জ্বেলে দিয়ে আজ একটাই প্রার্থনা করে — অশুভকে বিনাশ করে অন্ধকার হতে আমাকে আলোয় নিয়ে যাও।
বাংলা সাহিত্য নিয়ে শান্তিনিকেতন ও প্রেসিডেন্সিতে পড়াশোনা। পরে শিক্ষাঙ্গনকেই বেছে নিয়েছেন কর্মজগত্ হিসেবে। তবে লেখালিখিই প্রথম ভালবাসা। ছোটদের ও বড়দের –-- দু'রকম লেখাতেই সমান স্বচ্ছন্দ। ছোটদের ও বড়দের গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের মেয়েদের হস্টেল জীবন নিয়ে তাঁর লেখা 'শ্রীসদনের শ্রীমতীরা' পাঠকসমাজে সমাদৃত। প্রিয় বিষয় সিনেমা, নাটক, রহস্য ও ইতিহাস।
4 Responses
কালী পুজো বা আপামর ভারতবাসীর দীপাবলি উৎসব পালনের এমন তাত্পর্য পূর্ণ ব্যাখ্যা সমৃদ্ধ লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো ।
লেখিকার এমন আরোও অনেক লেখার জন্য অপেক্ষায় রইলাম ।
. জয়তী দাস।
খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, এরকম আরো লিখুন। ভালো থাকবেন।
ঝর ঝরে লেখা গড় গড় কোরে পড়ে ফেললাম। যদিও রাম বাবুকে কোনোদিনই খুব ভালো লাগেনি। লোক নিন্দার ভয়ে স্ত্রী কে পরিত্যাগ! তবে কল্পনায় অযোধ্যা বাসী প্রজাদের উচ্ছাস উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশের দীপাবলি এযুগেও সমান তাৎপর্য বহন করে । ধনতেরাস ও আদি আয়ুর্বেদাচার্য্য ধন্নন্তরীর কাহিনী ও প্রাক দীপাবলির উল্লেখ যোগ করা যেতে পারে । Pesticide এর বদলে দীপাবলি ধর্ম আর সামাজিকতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন । আরও জানার অপেক্ষায় রইলাম ।
একটু আগে একটা পোস্ট দিছিলাম কিন্তু ভ্যানিস হয়ে গেলো । তাই আবার লিখছি ।কারণ লেখাটা ঝর ঝরে আর গড় গড় কোরে পড়া যায় । রাম বাবু ভদ্র লোকটিকে কোনো দিনই খুব ভালো লাগেনি । লোক নিন্দার ভয়ে স্ত্রী কে পরিত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কি বার্তা দিলেন, জানিনা। তবে অযোধ্যা বাসিরা তাঁর পতিগৃহে প্রত্যাগমন ও দীপাবলি উদযাপন ধর্মের মোড়োকে এক ঋতু পরিবর্তনের উৎপাত নিরসনের দিকনির্ণয়, সমাজ ও ধর্মের সমন্বয়ের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ । Pesticides এর বদলে আলো । তাই বোধহয় আজকের অযোধ্যা বাসীরা বহু সহস্র আলোক বর্তিকার প্রজ্যলন আবার ফিরিয়ে এনেছেন । পরিবেশ বাদীদের জয় হোক ।
ধনতেরাস ও আদি আয়ুর্বেদাচার্যঃ ধন্বন্তরীর উপাখ্যানের উল্লেখ থাকলে আরও জমে যেত ।
আরো এইধরণের লেখার অপেক্ষায় রইলাম ।