ভারতীয় চলচ্চিত্রে রাজ কাপুরের থেকে বিখ্যাত নাম আর কে? তাঁকে চিনে নেওয়ার ঠিকানাও যে অজস্র, তা আমরা খেয়াল করি না সচরাচর। একজন অত্যুত্তম অভিনেতা ও প্রযোজক, অসামান্য প্রতিশ্রুতি তাঁর উপস্থিতির ভাঁজে ভাঁজে। কিন্তু ব্যক্তি ও তারকা রাজকাপুরের জীবন-রহস্য জানার পর আমরা বুঝে উঠতে চাই না যে পঞ্চাশ দশকে আরব সাগর উপকূলে আসলে নবজাত জাতিরাষ্ট্রের একটি জীবনীও রচনা করে চলেছেন তিনি। অথচ একটু অন্তর্তদন্ত করলেই জানা যাবে, কি অলৌকিক সমাপতন যে একই বছর (১৯৫৫ সালে), কলকাতায় যখন সত্যজিৎ রায় পথের ‘পাঁচালি নির্মাণ’ করছেন, তখনই তদানীন্তন বোম্বাই শহরে রাজ কাপুর শ্রী ৪২০ — নীচের মহলের অন্য জীবন কথা আঁকছেন। একদিকে যখন সাহিত্য-সমর্থিত বাস্তববাদ চলচ্চিত্রের জন্য একটি মানচিত্র তৈরি করতে ব্যস্ত, অন্যদিকে রাজ কাপুর মেলোড্রামার আদলে গ্রাম থেকে শহরে আসার অভিজ্ঞতা ও রাষ্ট্রীয় বিধিসমূহ পরীক্ষা করে চলেছেন সেলুলয়েডে। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর গণতান্ত্রিক সমাজবাদ ও মিশ্র-অর্থনীতির ধারণায় এক ধরনের জাতি-গঠনের প্রয়াস মূর্ত হয়ে উঠেছিল। আওয়ারা (১৯৫১), বুটপালিশ (১৯৫৪), শ্রী ৪২০ (১৯৫৫), জিস দেশ মে গঙ্গা বহেতি হ্যায় (১৯৫৯) — উত্তর স্বাধীনতা পর্বে ভারতীয় জনজীবনে আধুনিকতার একটি দলিল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এ পরিক্রমায় আমরা বুঝতে পারব, একই সঙ্গে দিলীপ কুমার, দেবানন্দ, উত্তম কুমার কেন রূপান্তরের রূপকথা বলে যাচ্ছেন এবং তা এত জনসমাদৃত হচ্ছে!
প্রমথেশ বড়ুয়ার অধিকার (১৯৩৯) তথাকথিত বৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার নিয়ে যে প্রশ্ন তোলে, রাজ কাপুর সে উত্তরাধিকার স্ব-কৃতজ্ঞ চিত্তে বহন করে নেন আওয়ারা ছবিতে। অথচ সে সামাজিক প্রসঙ্গ আড়াল করে তিনিই তো সিক্ত যূথীর গন্ধ বেদনে আখ্যানের গহনে চলে যান। শাড়ির অন্তরালে একটি ছাতার তলায় নার্গিসও নিজেকে অমর করে দেন সঙ্গীতের চরণে ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’র মেলডিতে। নিজেকে জীবনের যাবতীয় বাসনার আড়ালে রেখে জানান, ওই রজনীতে ঝড় বয়ে যাবে রজনীগন্ধা বনে। এরপর কিংবদন্তীর মহিমা পেলেন রাজকাপুর-নার্গিস যুগল। রিচার্ড বার্টন-এলিজাবেথ টেলরের সম্পর্ক যদি গবেষণার বিষয় হয়ে থাকে, তবে রূপালি পর্দায় ও তার পরিশিষ্টে রাজকাপুর-নার্গিসের জীবনসাঁকো নক্ষত্রলোকের জীবনগাথা।
[the_ad id=”270088″]
বোম্বাই ভিত্তিক হিন্দি ছায়াছবি নব্বইয়ের দশক থেকে বলিউড নামে চিহ্নিত হবে। সেখানে সবচেয়ে শক্তিশালী কাপুর পরিবারের তিনি মধ্যমণি, রামায়ণের ইক্ষাকু বংশের যেমন শ্রীরামচন্দ্র। অবিভক্ত ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পেশোয়ার শহরে তাঁর জন্ম ১৯২৪ সালে। ছয় সন্তানের মধ্যে প্রথম রাজ অনুজ হিসেবে পেয়েছিলেন শশী ও শামি কাপুরকে। জনক পৃথ্বীরাজ কাপুর জীবিকার কারণে বোম্বে শহরে চলে আসেন। ভারতীয় গণনাট্যের প্রথম সারির নেতা পৃথ্বীরাজ শুধু সপরিবারে ভারতের নানা শহরে আস্তানা গেড়েছিলেন তাই নয়, পুত্রের মধ্যেও সংক্রামিত করেছিলেন খোলা চোখে গরিব ও নিচু তলার মানুষকে দেখার ঘরানা। এ সুবাদেই কিছুদিন কলকাতাতেও ছিলেন বালক রাজ। ছোটবেলা থেকেই যে বাংলা ভাষার উত্তম ব্যবহার তিনি জানতেন, তারও কারণ এ শহরের মায়াবী স্মৃতি। তাঁর প্রথম ছবির সাথেও কলকাতা জড়িত। ইনকিলাব (১৯৩৫) ছবিতে তাঁর আবির্ভাব শিশু-শিল্পী হিসেবে। সে ছবির পরিচালনা দেবকী বসুর আর প্রযোজনা নিউ থিয়েটার্সের।
[the_ad id=”270086″]
যদিও ডানা মেলতে রাজ কাপুর আরও সময় নিয়েছেন, আরও বারো বছর পর নীল কমল‘ ছবিতে মধুবালার বিপরীতে নায়ক হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন কিন্তু ১৯৪৯ সালে আন্দাজ ছবিটি মেলোড্রামার একটি বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়। রাজ কাপুর প্রথম মেঘমুক্ত হলেন আওয়ারার সাফল্যেই। ভারতবর্ষ তো বটেই, তখনকার সোভিয়েত ভূমি প্লাবিত হয়ে গেছিল ‘আওয়ারা হুঁ’ গানটিতে। ‘আওয়ারা’ ছবিতে একটি নারী ও শিশুর সাথে আদালত এবং আইনের যে সংঘর্ষ যা পরবর্তী ‘বুটপালিশ‘ ছবি (যাকে টাইম ম্যাগাজিন ক্ষুদ্রাকার মহাকাব্য বলেছিল) বা শ্রী-৪২০ প্রভৃতি ছবিতে দেখা যায়, রাজ কাপুর একটি দেশের গ্রাম থেকে শহরের রূপান্তরের পর্যায়ে যে উত্থান-পতন, যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, যে অশ্বক্ষুরের ধ্বনি, সেগুলিকে এক ধরনের রূপকথার আঙ্গিকে প্রয়োগ করছেন, তা শহুরে লোকনাট্য। তিনি যদিও সমাজের কথা বলছেন কিন্তু সেখানে প্রেম আর গান যেভাবে জড়িত আছে, তাতে অনেক সময় তা এক রকমের ব্যালাডের রূপ নিচ্ছে। যেমন ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ গানটি প্রায় জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়, তার কারণ তখন পঞ্চশীল ভারত এই আন্তর্জাতিক রাজনীতির চর্চা করে এসেছে। সেই রাজনীতি ‘অপরাজিত’র থেকে অনেক বেশি জনচিত্তহারী ছিল। মেহবুব খানের মাদার ইন্ডিয়া‘ যেমন, রাজ কাপুরের জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায় তেমন ভাবেই উত্তর ভারতের সম্পন্ন চাষির চোখ দিয়ে ভারতীয় নব জীবনগাথা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।
কিছুদিন কলকাতাতেও ছিলেন বালক রাজ। ছোটবেলা থেকেই যে বাংলা ভাষার উত্তম ব্যবহার তিনি জানতেন, তারও কারণ এ শহরের মায়াবী স্মৃতি। তাঁর প্রথম ছবির সাথেও কলকাতা জড়িত। ইনকিলাব (১৯৩৫) ছবিতে তাঁর আবির্ভাব শিশু-শিল্পী হিসেবে। সে ছবির পরিচালনা দেবকী বসুর আর প্রযোজনা নিউ থিয়েটার্সের।
রাজ কাপুরকে যে আমরা বড় শোম্যান বলি কারণ তিনি এ ধরনের ছবির সঙ্গে সঙ্গে বিনোদনেও নতুন মাত্রা এনেছিলেন। যেমন মুঘল-ই-আজম (১৯৬০) ছবিতে সেলিম আনারকলির প্রেমকে যেভাবে কল্পিত আবরণে ঢেকে রাখা হয় তাতে ইতিহাস ও কথকতার ভেদ ভুলে ধর্মনিরপেক্ষ একটা আদর্শ গড়ে ওঠে। এই যে প্রেমকে একটা নবপর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা, সম্রাটপুত্র ও পথের নটী যেখানে একাকার গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে,আওয়ারা থেকে ববি এমনকি রাম তেরি গঙ্গা মইলি পর্যন্ত রাজ কাপুর এমন একটি ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের রূপক অনেক সার্থকভাবে উপহার দিয়েছেন, তাতে আমরা কখনওই বুঝতে পারিনি তিনি একটি উদ্দেশ্য-মদির বাণিজ্যের পত্তন করছেন যেখানে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর যুগ্ম উপস্থিতিতে লক্ষ্মীর দিকেই পাল্লা ভারী হয়ে চলেছে। কিন্তু তাতে রাজ কাপুরের ব্যক্তিগত সাফল্যে কোনও দাগ পড়েনি। পরবর্তীকালে ববি, রাম তেরি গঙ্গা মইলি বা সত্যম শিবম সুন্দরম জাতীয় ছবিতে সব সময়েই নারী শরীরকে ব্যবহার করছেন তিনি। খানিকটা রজার ভাদিম যেভাবে ব্রিজিত বার্দোকে ফরাসি নব তরঙ্গের সময় ব্যবহার করেন, সেভাবেই ডিম্পল কপাডিয়া জিনাত আমনকে প্রদর্শনযোগ্য নারীত্বের মডেল হিসেবে প্রয়োগ করছিলেন রাজ কাপুর।
[the_ad id=”270085″]
আপাতভাবে পর্দানসীন নারীকে মুক্ত পরিসরে আনতে এই পরিচালক যে ছলনাময় বাণিজ্যের প্রবর্তন করছেন, তা এক ধরনের সফলতাও পাচ্ছে। কিন্তু এই সফলতা রাজ কাপুরকে কতটা শিল্পী হিসেবে উত্তীর্ণ করেছে তা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন থাকতেই পারে। আসলে রাজ কাপুর ভারতীয় গণনাট্যের আদর্শ নিয়ে শুরু করেন, হয়তো নববাস্তববাদের অনেক প্রভাব তার মধ্যে পড়েও ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে দাঁড়ান স্বপ্নের জাদুকর। এই যে ডিম্পল কপাডিয়া, মন্দাকিনি বা হেমা মালিনির মতো নায়িকাদের আগমন ও তাঁদের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁদের শরীর ও চোখের আহ্লাদকে যেভাবে হাতিয়ার করা হয়, তাতে আমরা বুঝি তিনি সিনেমাকে দৃশ্যের মিছিলের অতিরিক্ত ভাবতে চাননি। ইতিহাসের এই বিচারের সামনে ভবিষ্যতে রাজ কাপুরের এই ছবিগুলিকে দাঁড়াতেই হবে।
[the_ad id=”266919″]
রাজ কাপুর মানুষ হিসেবে আপাতভাবে ছিলেন ‘কমন ম্যান’। প্রথম বিদেশ সফরে রাশিয়ায় যাওয়ার সময় একবার জেনেভায় স্টপ-ওভার পান। সেই সুযোগে তিনি চার্লি চ্যাপলিনের কাছে চলে যান। যে চার্লিকে তিনি সারা জীবন ভজনা করেছেন, তাঁকে প্রণাম জানানোর এই সুযোগ তিনি ছাড়তে পারেননি। শ্রী ৪২০ যখন আপামর দুনিয়ায় বক্স-অফিস হিট তখন একটি ভারতীয় ফিল্মের ডেলিগেশানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রাজ কাপুর। তখন ইরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেন। সেখানে রাজ কাপুর কী সারল্যে বলেন, ‘আমি কখনওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে হাজির থাকিনি তো! আমাকে যখন কালো পোশাক পরতে হল তখন অধ্যাপকদের মতন কত বড় হয়ে গেছি!’ ভালবাসাই আসলে তাঁর সাম্রাজ্য শাসনের পাসওয়ার্ড! জন্মদিনে এই ভালবাসাটুকুই সাজিয়ে দেওয়া যায় তাঁকে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেমার মাস্টার মশাই ছিলেন বলে বা সরকারি প্রতিষ্ঠান 'রূপকলা কেন্দ্র'-র অধিকর্তা ছিলেন বলে তাঁর নামের পাশে 'চলচ্চিত্রবেত্তা' অভিধাটি স্বাভাবিক ভাবেই বসে যায়। আসলে কিন্তু সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় একজন চিন্ত্যক ও আমাদের সাংস্কৃতিক আধুনিকতার ভাষ্যকার। কাব্য বা উপন্যাস, চিত্রকলা বা নাটক,জনপ্রিয় ছায়াছবি বা রবীন্দ্রসংগীত-যে কোন পরিসরেই সঞ্জয় এক ধরনের মৌলিক ভাবনার বিচ্ছুরণ ঘটান। সেই মনোপ্রবণতায় আকাদেমিয়ার জীবাশ্ম নেই বরং ছড়িয়ে থাকে মেধার কারুবাসনা। আলোচনাচক্রে, দেশে ও বিদেশে,বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ভাষনে তিনি প্রতিষ্ঠিত বক্তা। ঋত্বিক ঘটকের প্রবন্ধাবলী সহ সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন ছটি বিখ্যাত সিনেমার চিত্রনাট্য। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আট। একমাত্র উপন্যাস 'বুনো স্ট্রবেরি' ইতিমধ্যেই তরুণ মহলের নজরে। হাইকোর্টসঙ্কুল এই শহরে তিনি নিজেকে 'আমুদে বাঙাল' ভেবেই খুশি।
One Response
মূঘল এ আজম কে আসিফ এর রাজকাপুর জড়িত নন।