জনমেজয় কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে,পৃথিবীর জন্মলগ্নের পর সভ্যতার ও সমাজের গোড়াপত্তন হইবার পর নারী পুরুষ একপ্রকার বন্ধনে আবদ্ধ হইবে। সেই রসায়ন কী রূপ হইবে তাহা সম্বন্ধে শুনিতে বড় কৌতূহল জন্মিতেছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর! আমি সেই আপাতঃঅদ্ভুত বিচিত্র সম্পর্ক, যাহাকে পরবর্তী সময়ে বিবাহ বলা হইবে ও এই বন্ধনে আবদ্ধ নারী পুরুষকে দম্পতি আখ্যানে ভূষিত করা হইবে, তাহাদিগের আখ্যান বর্ণনা করিব, আপনি শ্রবণ করুন। আমি তৎকালীন সমাজের সেই বহুচর্চিত, আপাতনিরীহ, বিপদসঙ্কুল দম্পতিদিগের চরিত্রকীর্তন করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন।
[the_ad id=”266918″]
হে রাজন্, যাঁহারা বিবাহ নামক বিষসদৃশ বন্ধনকে বিবাহ পূর্ববর্তী সময়ে মণ্ডার ন্যায় জ্ঞান করিবেন, অথচ বিবাহোত্তীর্ণ সময়ে স্ব স্ব জ্ঞানচক্ষু উন্মোচন করিয়া উহার প্রকৃত স্বরূপ জানিতে পারিয়া বিলাপ করিবেন, বিলাপ করিতে করিতেও বিবাহবন্ধন ছিন্ন করিবেন না, তাঁহারাই দম্পতি। যাঁহারা বিবাহের অর্থ পূর্বে বিশেষরূপে বহন করা অনুধাবন করিবেন ও পরবর্তী সময়ে উহারই অর্থ বৃষরূপে বহন করা বুঝিবেন, তাঁহারাই দম্পতি।

যাঁহারা যৌবনে ইন্দ্রিয়ের বশবর্তী হইয়া বিবাহ করিবেন, বিবাহের প্রথম বর্ষ নিশিকালে কামদেবের অনুগ্রহে নির্বাহ করিবেন এবং বিবাহের পঞ্চম বর্ষ অতিক্রান্ত হইলে তাঁহারাই নবজাতক শিশুকে বা শিশুদের নিশিকালের ক্রন্দন থামাইতে অসফল হইয়া বিরস বদনে পেচকের ন্যায় রাত্রিযাপন করিবেন, তাঁহারাই দম্পতি।
হে রাজন্, যাঁহারা সম্মুখে সুখ্যাতিরত,পশ্চাতে রোষকষায়িত নেত্রে কুখ্যাতিরত, পরস্ত্রীকাতর, পরস্বামীকাতর, সদাকলহরত, পরস্পরবিরোধী — তাঁহারাই দম্পতি।
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ পুরুষ আপন শশ্রুমাতার নিকট তাঁহার কন্যার গুণকীর্তন করিবেন, অথচ নিজ সুহৃদদিগের সম্মুখে আপন স্ত্রীর নিন্দা করিবেন, তাঁহারাই দম্পতি। অপরপক্ষে যে নারী তাঁহার সখিগণের নিকট স্বামীর গুণকীর্তন করিবেন, অথচ নিজ মাতার সন্মুখে উহার মুণ্ডপাত করিয়া তৃপ্তিলাভ করিবেন, তাঁহারাই দম্পতি।
[the_ad id=”266919″]
হে নরাধিপ, যাঁহারা সমগ্র দিবস কলহরত অবস্থায় সমাপ্ত করিবেন, রাত্রিকালে কলহ করিতে করিতে শয্যায় বিরাজমানপূর্বক একে অন্যের দেহসান্নিধ্য লাভ করিয়া সমস্ত কলহ বিস্মৃত হইয়া শারীরিক সংসর্গে রাত্রিযাপন করিবেন এবং প্রত্যুষে একে অন্যের মুখচুম্বন করিয়া দিবসের সূচনা করিবেন, তাঁহারাই দম্পতি। যাহারা নিজগৃহে শত কলহমধ্যেও আত্মীয় পরিজনের নিকট সুখী সংসারের অভিনয় করিবেন, তাঁহারাই দম্পতি।
হে নরশ্রেষ্ঠ! যাঁহাদের বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, কলহে শত ও একে অপরের নিন্দায় সহস্র, তাঁহারাই দম্পতি। যাঁহারা যুগ যুগ ধরিয়া নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য করিয়াও একবিংশ শতাব্দীতে দন্তবিকাশপূর্বক সেলফিপটু হইবেন, তাঁহারাই দম্পতি।
মহারাজ, পুনশ্চ শ্রবণ করুন, যাঁহারা দিবারাত্র একে অপরের মুণ্ডপাত সত্ত্বেও সংসারে বিপদের সম্মুখীন হইলে বিনা দ্বিধায় নিজ প্রাণ বিসর্জন করিয়া সংসার রক্ষা করিবেন, তাঁহারাই দম্পতি। যাঁহারা সমস্ত জীবনব্যাপী শত কলহ করিলেও বার্ধক্যে উপনীত হইয়া পরজন্মে পুনরায় আপনাদের স্বামী-স্ত্রী রূপে কামনা করিবেন, তাঁহারাই দম্পতি। যে নারী ও পুরুষ একে অপরকে যৌবনে প্রেমিক প্রেমিকার ন্যায়, প্রৌঢ়ত্বে শত্রুর ন্যায়, বার্দ্ধক্যে বিশ্বস্ত বন্ধুর ন্যায় গণ্য করিবেন, তাঁহারাই দম্পতি।

হে নরনাথ! আমি যাঁহাদিগের কথা বলিলাম, তাঁহাদিগকে লইয়া সমাজে নানারূপ সমস্যা সৃষ্টি হইবে, আবার ইহাদিগ ব্যতিরেকে সমাজ অচল প্রতিপন্ন হইবে। সমাজের মূল চালিকাশক্তি রূপে ইঁহারাই গণ্য হইবেন।
[the_ad id=”270084″]
জনমেজয় কহিলেন, হে মুনিপুঙ্গব! পৃথিবীর নারী-পুরুষের এই আদিম সম্পর্ক, যাহার মধ্যে অম্লত্ব ও মধুরতা অত্যন্ত বেশিমাত্রায় অনিশ্চিত, তথাপি তাঁহারা জীবনের অধিকাংশ সময় একে অপরের সহিত ব্যয় করে। বাস্তবিকই ইহা প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ রহস্যগুলির মধ্যে অন্যতম। আমি করজোড়ে দাম্পত্য রহস্যের কুশীলবদিগকে প্রণাম জানাই। দম্পতিদিগের জয় হউক, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন।
*লেখাটি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাবু’ রচনার অনুকরণে লিখিত।
অনুভা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সরকারি চাকরি করেন। লেখালেখি প্যাশন। সানন্দা ব্লগ, শুকতারা, এখন ডুয়ার্স, অপার বাংলা, প্রসাদ-সহ প্রচুর পত্রপত্রিকা, লিটিল ম্যাগাজ়িন, ওয়েবজিন ও সংবাদপত্রে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পেয়েছেন ছোটদের জন্য লিখে। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২০-তে, অমিয়া ভৌমিক স্বর্ণকলম পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতা আন্তর্জাতিক অণু চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১-এর বিচারক ও সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য।
2 Responses
অনুভা, তোমার এই সুন্দর রম্য রচনাটি মন দিয়ে পড়লাম। এককথায়, খুবই ভালো লাগল! পঞ্চান্ন বছরের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার পর আমি বিনাদ্বিধায় 'দম্পতি'-র সংজ্ঞা মেনে নিচ্ছি। যদিও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'বাবু' -র অনুসরণে তুমি লিখেছ, তা সত্ত্বেও কিছু মৌলিকত্ব আনতে সক্ষম হয়েছ অবশ্যই… ২০২১-এর 4G/ Internet -যুগে সেলফি তোলার কথা উল্লেখ করেছ । এই যুগের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে পারত, কিন্তু আমি মনে করি— যেটুকু লিখেছ, তা পাঠকবৃন্দ উপভোগ করবে প্রাণভরে। ভালোবাসার দিনে অনুভা তুমি সবাইকে দিতে পেরেছ নির্মল আনন্দ।
চমতকার হইয়াছে