মুর্শিদকুলি খান হাসেন। বলেন, খাঁ সাহেব, পালিয়ে আসা কিন্তু একজন চুঘতাই তুর্কিকে শোভা দেয় না!
তাঁর চেয়ে সামান্য নিচুতে গদিতে উপবিষ্ট আহসান খাঁ বলেন, বললাম যে, এ পালানো সে পালানো নয়।
মুর্শিদকুলি খান স্বর্ণ-রৌপ্য মন্ডিত আসনে নরম শিমুল তুলোর ধবধবে সাদা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বলেন, পরিস্থিতি থেকে পলায়নের কথাই বলছি হে! যুদ্ধে পরাজয় আশঙ্কায় পলায়ন, এদেশে কাপুরুষতা!
আহসান খাঁ বলেন, মেয়েটির চোখে নিজের অপরাধ এত স্পষ্ট ভাবে দেখলাম যে না পালিয়ে উপায় ছিল না। আপনি তো জানেন, হিন্দুর ধর্ম কী মারাত্মক! মেয়েদের জন্য বিশেষত, কোথাও কোনও ক্ষমা নেই, পিতার প্রভূত অর্থ-সম্পদ না থাকলে।
মুর্শিদকুলি খান উত্তেজিত সুরে বলেন, বিলক্ষণ জানি! যে বছর অপহৃত হলাম, তেমনটাই শুনেছিলাম, আবছা মনে আছে। আমার গ্রাম এলাকায় হয়তো সেবার খুব খরা হয়েছিল, হয়তো বেচে দিয়েছিল অনাবৃষ্টির কারণে, না হলে দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তানের তো অভাব নেই, খামোখা চুরি করতে যাবে কেন? একরাশ সন্তান নিয়ে যজমানি না হয় মন্দিরের পুরোহিতের কাজ, সংসার পালনের ক্ষমতা নেই অথচ ব্যাটাদের তেজ আছে! বিয়েও আছে গণ্ডা গণ্ডা! ভিক্ষা করবে তবুও অন্য পেশায় যাবে না! আর কখনও খোঁজ করেনি আমার! মুসলমানের আশ্রয়ে আছি জেনে ওদের জীবন থেকে আমাকে মুছে ফেলেছিল!
আহসান খাঁ জানেন, এমন সময় চুপ করে থাকতে হয়।
নবাব বলে চলেন, ও তো এক তুচ্ছ বৈষ্ণবী! আমি মুর্শিদকুলি খান! দিল্লির সুলতান আওরঙ্গজেব তাঁর ছেলেদের চেয়ে আমাকে বিশ্বাস করেন বেশি। পরিচয় জেনেও ওই গরিবের গরীব ব্রাহ্মণ পরিবার আমার মুখটুকু দেখতে চায়নি, পাছে জাত যায়!
মুর্শিদকুলি খান তাকিয়া ছেড়ে কক্ষে পদচারণা শুরু করেন, বলেন, ছিলাম সূর্যনারায়ণ মিশ্র। হলাম মহম্মদ হাদি। মিশ্ররা খুব কট্টর ব্রাহ্মণ জানেন তো? আজ স্বয়ং সম্রাটের প্রসাদধন্য আমি। আপনি জানেন তো ওর পৌত্র আজিম উস সান বাংলার সুবেদার ছিল। আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল অপদার্থ শয়তানটা। ওর অধীনে কাজ করছি বলে ওর গোলাম নই। হাজী সফি আমাকে গোলাম রেখেছিল। দিল্লি দরবারে কয়েক বছর থেকে পারস্যে চলে গেল নিজের দেশে। সঙ্গে চললাম আমি। বাধ্য কিশোর এক দাস! যতই স্বাচ্ছন্দ্যে থাকি না কেন দাসের যন্ত্রণা কী আমি জানি।
মুর্শিদকুলির গলা বেদনায় অবরুদ্ধ হয়ে আসে।
আহসান খাঁ দাস বিষয়ে সম্যক জানেন। আজীবন স্বাধীন তিনি। দেওয়ানের ওই দাস জীবনের অপূরণীয় বেদনা যে তাঁকে বইতে হয় না তাতে স্বস্তি লাভ করেন মনে মনে।
মুর্শিদকুলি খান বলেন পরিস্থিতি থেকে অতীত থেকে পালানো যায় না শেষ পর্যন্ত। সত্য এক প্রকার না হলেও তথ্য তথ্যই। সবাই সুবেদার বলে বটে কিন্তু আসলে আমি আজিম-উস- সান আর পরে ফারুকশিয়ারের দেওয়ান মাত্র।
আহসান খাঁ বলেন, স্বয়ং জাহাপনা আপনার উপর আস্থা রেখেছেন। সবাই বলে নাতি আজিম-উস-সানের উপর ভয়ানক রুষ্ট হয়েছিলেন তিনি আপনাকে গুপ্ত হত্যার ষড়যন্ত্রের কারণে। এ কি কম সৌভাগ্য? ওকে বিহারে সরিয়ে ফারুখশিয়ারকে বাংলার সুবেদার করার কারণ তো এইই!
মুর্শিদকুলি হাসেন, বলেন, আজিম-উস-সানকে যথাযোগ্য উত্তর দিয়ে হত্যা করতে পারতাম। করিনি। মুঘল রাজরক্তে আমার হাত রক্তাক্ত হলে জাহাঁপনা স্নেহ নাও করতে পারতেন! যতই হোক আমি আপনাদের মতো তুর্কি বা পারস্যদেশীয় বা মুঘল বংশজাত খাঁটি মুসলমান নই! অনেকেই বলবেন ওই যে মালিহাটির বাকযুদ্ধ ওখানে অংশগ্রহণের পিছনে হয়তো অজান্তেই আমার অতীত কাজ করছে।
আমি মুর্শিদকুলি খান! দিল্লির সুলতান আওরঙ্গজেব তাঁর ছেলেদের চেয়ে আমাকে বিশ্বাস করেন বেশি। পরিচয় জেনেও ওই গরিবের গরীব ব্রাহ্মণ পরিবার আমার মুখটুকু দেখতে চায়নি, পাছে জাত যায়!
আহসান খাঁ কথা ঘোরান, মৃদু হেসে বলেন, আমি সাধারণ চিত্রকর। গুপ্তচরদের বর্ণনার মাধ্যমে সন্দেহভাজনদের ছবি আঁকি। রাগলেখা পুরনো চিত্র সঙ্গে আনার কথা বলায় আমার অতীত স্বাধীন চিত্রকরের জীবন আবার ভেসে উঠলো। অনিশ্চিত সেই জীবনে আর ফিরতে পারব না, তবু যদি তার কাছাকাছি যেতে পারি তাই আরেকবার শেষ চেষ্টা করতে চাই। যদি আপনি অনুমতি দেন। আপনি আমাকে সম্মান দিয়েছেন। অর্থ প্রতিপত্তি দিয়েছেন। তাই এবারে অবসর নিতে যাওয়ার সময়ে বলি, চিন্তা ও স্মরণশক্তির ক্ষিপ্রতা কমছে আমার। নব্য যুবকেরা এই ব্যাপারে অধিক দক্ষ। আমার কাছে তালিম প্রাপ্ত সাগরেদ আছে। চাইলে নারীশিল্পীও দিতে পারি আপনাকে। অন্তরালে কাজ করবে।
কুলি খান বিস্ময় ভ্রূ তুলে বলেন, আপনার অবসরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে নেব। দেখি আপনার সাগরেদরা কেমন প্রস্তুত? তবেই মালিহাটি দেখছি আরবের জাদু কাহিনী? বাক্স থেকে গল্পের ঝুলি বেরোচ্ছে? বৈষ্ণবী ওই বিদ্যাও জানে?
আহসান খাঁ মাথা নাড়েন, বলেন, না না সে নয়, হিন্দু সমাজে পুরুষের সুযোগ বারবার। নারীর একবার। সে অভিশপ্ত, সংসার আর তার জন্য নয়। তার মায়ের অতীত কালিমা প্রকাশ্যে এসে গেছে। আর সে সংসারে ঠাঁই পাবে না। ওদিকে শেখ হিঙ্গান খবর পাঠিয়েছেন, রাধামোহনের জয় হয়েছে। ব্রজদেব রাগলেখাকে দেখে বোধহয় লড়াই করতে পারেননি! পারবেন কী করে? মা মেয়ে যেন দর্পণের প্রতিচ্ছবি! এত মিল! আমিও ওই অবস্থায় হাল ছেড়ে দিতাম।
কুলি খান হেসে বলেন, হিন্দু ব্রাহ্মণের অসুবিধে চতুর্গুণ! চণ্ডাল কন্যার সঙ্গ করতে পারবে কিন্তু স্বীকার করলে সমাজ নরকে পাঠাবে! উপাধ্যায়ের অবস্থা অনুমান করতে পারছি।
কুলি খান সম্মতির মতো ঘাড় নেড়ে সায় দেন। বলেন, রাধামোহনের এই বিজয়ে এদিকে বৈষ্ণব মহলে আমাদের আস্থা অর্জনে সুবিধে হল। হিন্দুরা থিতু থাকতে চায় এক জায়গায়। আমাদের মতো ভাগ্যান্বেষী নয়। পলিমাটির এত উর্বর দেশ ছেড়ে যাবেই বা কেন বলুন? জয়পুরের রাজা আমাদের প্রতি প্রসন্ন নন। জয়পুর উদয়পুর যতই পক্ষে থাকুক ওদের আত্মাভিমান ভয়ঙ্কর। রাধামোহন ঠাকুরের
আধিপত্যে আমরা নিশ্চিন্ত থাকব খানিক। জমি বন্দোবস্তে আমি আগেই হিন্দুদের নিশ্চিন্ত করেছি। বাপ পিতামহের জমি ওরা প্রাণের বিনিময়েও ছাড়তে চায় না।
কুলি খান ও আহসান খাঁ কথা বলতে থাকেন। মগরিবের নামাজের সময় হয়ে এলে উঠবেন দুজন। ভৃত্যরা অপেক্ষা করে দ্বারের পাশে।
ছবি সৌজন্য: Pinterest
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৮ মার্চ ২০২১
সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।
One Response
খুব উচ্চমানের ঐতিহাসিক ধারাবাহিক।