ভিকি:- তবে হয়ে গেছে। প্রায় সেটল হয়ে গেছে। (হাসে) পিতাজির বডি এখন একা ড্রইংরুমে পড়ে আছে। হয়তো এতক্ষণে ওনার ঠোঁটের কোণে মাছি বসেছে। আর আমরা বেডরুমে সাট্টার প্যাড খুলে বসেছি। কে কত পান্টার জিতল। সুরেশভাই, আমাদের সবার কিন্তু এক সাইকোলজি। আমি ঠকে যাব ক্ষতি নেই, (শরাফের কাঁধে হাত দেয়) ও যেন লাভ না করে। পাশের লোকের লাভ মানেই আমার লোকসান। এই দুনিয়ায় আমরা বাঁচি সুরেশভাই। এই দুনিয়ায়। এই ছোট ছোট অপমান, ছোট ছোট প্রতিশোধ, ছোট ছোট ঘৃণা, ছোট ছোট ইগো, এগুলো আমাদের এই দুনিয়ায় ক্রমে সবচেয়ে কাছের লোককে সবচেয়ে বেশি খতরনাক শত্রু করে তোলে। (থামে, হাসে) গাম্বাট ভিকি। পেটে পড়লেই গলগল করে সব বলতে শুরু করে। (সুরেশকে বলে) আপনার কি মনে হয় সুরেশভাই? ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই আমাকে নিয়ে পেছনে হাসাহাসি করে তাই না? নাকি ভয় পায়? ভাবে আমি যদি আবার সেই কমবয়সের মতো হাত চালিয়ে দিই। নাকি ঘৃণা করে? ভাবে আমি অমার্জিত, কর্কশ-কি তাই তো – সুরেশভাই?
সুরেশ:- তোকে সবাই ভালোবাসে ভিকি। তুই মিথ্যে এগুলো ভাবিস।
ভিকি:- আপনি আমাকে স্তোক দিচ্ছেন সুরেশভাই? কি ভাবছেন আমি এখনও সেই গাম্বাট ভিকি আছি? নেই, নেই। সময় আমাকে পাল্টে দিয়েছে।
সুরেশ:- (হাসে) জানিস তো শাহরুখ একবার একটা ইন্টারভিউতে বলেছিল, মানুষের টাকা আর নাম হয়ে গেলে তার মধ্যে কী সবচেয়ে বড় চেঞ্জ হয়?
ভিকি:- কী হয়?
সুরেশ:- শাহরুখ বলেছিল যে, সে তখন দার্শনিক হয়ে পড়ে। ফিলজফার।
(হাসে। শরাফের দিকে তাকায়)
শরাফ, জয়দেব তোমরা এক কাজ করো, সেলারের পেছনে দেখো একটা দরজা আছে। ওটা দিয়ে বেরোও। একটা ছোট টেরেস পাবে। ওটা ছিল আগে কোহিনূরে আমাদের স্মোকিং জোন। ভিকি যখন এই বাড়িতে মাঝে এসে থাকত, ওখানে গিয়ে আমরা সিগারেট খেতাম। যাও তোমরাও ওখানে গিয়ে একটু টেনে এসো।
জয়দেব:- (অবাক হয়ে) কিন্তু আমি তো স্মোক করি না স্যার।
শরাফ:- (জয়দেবের পিঠে হাত দেয়) আমি করি। চলো না একটু কমপ্যানি দেবে। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ‘লগান’-এর মতো একটা বড় স্ক্রিপ্ট লিখি। ক্রিকেটের গল্প শুনতাম একটু ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেনের থেকে। চলো যাই।
(শরাফ অনিচ্ছুক জয়দেব নিয়ে ভেতর দিকে বেরিয়ে যায়। ভিকি অবাক হয়ে সুরেশের দিকে তাকায়। সুরেশ উঠে তার গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে বলেন)
সুরেশ:- তুই এতক্ষণ ধরে এত সত্যি বলে যাচ্ছিস যে, আমার মতো মিথ্যেবাদী পলিটিশিয়ান অ্যাকটরেরও কিছু সত্যি বলার জন্য অনেকক্ষণ জিভ চুলকোচ্ছে। কিন্তু আমি তোর মতো এত ফ্র্যাংক নই, বুঝলি ভিকি। তাই ওদের একটু ঘুরে আসতে বললাম। চট করে আমি অমন সবাইকে বিশ্বাস করতে পারি না।
ভিকি:- তার মানে কি, আমি যা এতক্ষণ ধরে বললাম ওরা তা বাইরে বলে দিতে পারে? অ্যাঁ সুরেশভাই?
সুরেশ:- আরে না না। আমার তা মনে হয় না। কিন্তু ওরা তোর মতো আমার এত ক্লোজ নয়। তাই এই সতর্কতা।
(ভিকির খালি গ্লাসে মদ ঢালেন সুরেশ) আচ্ছা ভিকি, আর পাঁচজনের মতো তোরও নিশ্চয়ই মনে হয় আমি কেন পলিটিকসে জয়েন করলাম। খটকা লাগে না তোর বল? সন্দেহ হয় না আমাকে?
(ভিকি চুপ করে থাকে)
আরে বলই না। আমরা কতবছরের বন্ধু। তুই অন্তত খোলাখুলি কিছু বললে আমি কিছু মনে করব না।
ভিকি:- মনে হয় স্যার। সত্যিই মনে হয়। আমাদের কথা ছাড়ুন। হিরোরা সবসময়ই পলিটিকসে গেছে আমাদের দেশে। কিন্তু আপনার মতো এরকম ইজ্জতদার বড়ো অভিনেতা, থিয়েটার থেকে যে এসেছে, সে কেন রাজনীতির প্যাঁচের মধ্যে নিজেকে গিয়ে ফেলবে! আমি না, লোকে বলে এইসব।
সুরেশ:- অথচ দ্যাখ পাঁচবছর এম.পি থাকার পর এমনকি ভারতের সবচেয়ে বড় সুপারস্টারও বোফর্সের কাদা গায়ে নিয়ে রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন। আর কোনওদিন ফেরেননি। তাও বলবি হিরোরা পলিটিকসে অটোমেটিক চয়েস?
ভিকি:- ঘটনা। কিন্তু তারপরেও পলিটিকসে স্টারদের মিছিল আসা বন্ধ হয়নি। তারপরেও তারা এসেছে। কিন্তু আপনারা যারা থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন, যারা সিনেমায় এত বড় বড় রোল করেছেন, নাম করেছেন, সারা দেশ আপনাকে চেনে, সেই আপনি –
সুরেশ:- আমি তো আমার বন্ধু এন.এস.ডির প্রাক্তনী দিবাকর শেঠের উদাহরণ দিই। মাথাভর্ত্তি টাক নিয়ে দিবাকর যদি পাওয়ার গেমে ঢুকতে পারে, আমার মতো নিরীহ নিরিমিষ গুজরাতি সুরেশ মোরে কি দোষ করল!
ভিকি:- হ্যাঁ, দিবাকরজিকে নিয়েও এসব কথা পেছনে হয়। তবে আপনাকে নিয়ে বোধহয় বেশি হয়।
সুরেশ:- ঠিক। তার কারণ সোসাইটিতে একেকজনকে নিয়ে পারসেপশন একেকরকম। তোকে আমার কথা বলি? ভিকি, তুই কপাল, অভিশাপ এসব নিয়ে একটু আগে কথা বলছিলি বলে আমার কথা তোকে বলছি। মানুষের সবথেকে বড় অভিশাপ কী জানিস? তা হল, সে যদি কমবয়স থেকে জেনে যায় সে আর পাঁচজনের থেকে ডিফারেন্ট। অন্যরকম। না না, আমি ভাল–মন্দ, মহৎ-নীচ এইধরনের কোনও গুণবাচক প্যারামিটারের কথা বলছি না। আমার থেকে অনেক বেশি ভাল, অনেক বেশি মহৎ, অনেক বেশি যোগ্য মানুষ আমি বেঁচে থাকতে জীবনে অনেক দেখেছি। আমি বলছি আলাদা, ডিফারেন্ট। তার অভিশাপ হচ্ছে শুধু এই কারণে তো বটেই, এমনকি অকারণেও তার পেছনে সোসাইটির একটা অংশ লেগে যায়, এমনকি ভালবেসেও তাকে তারা খুন করতে চলে আসতে পারে।
ভিকি:- ভালবেসে খুন করতে আসে? কি বলছেন? সুরেশভাই?
সুরেশ:- আসে, ভিকি আসে। এখন ধর্, এই যে ইন্দীবরজি বা ধর জাফর, আমি বিশ্বাস করি এদের তোর মতো সরল বা বাচ্চাদের মতো মন না হলেও, এরাও কিন্তু বরাবর আর পাঁচজনের থেকে ডিফারেন্ট। এখন, ওদের যদি আলাদা করে জিজ্ঞেস করিস, দেখবি ওরাও ওদের অভিজ্ঞতা থেকে বলবে, অকারণে কিছু লোকে জীবনে ওদের পেছনে লেগেছে। খ্যাতি পাওয়ার পর বলছি না। আগে থেকেই লেগেছে। প্রফেশনাল রাইভ্যালরি না থাকা সত্ত্বেও লেগেছে।
ভিকি:- সে তো কিছু মানুষের স্বভাব ওরকম থাকেই।
সুরেশ:- তারপরেও ইন্দীবরজি বা জাফর এরা টপে চলে গেল, কী করে? আমার থেকে কি ওরা সবসময় ভালো অভিনয় করে? আমি তা মনে করি না। কিন্তু ওরা যে অ্যাডভান্টেজটা পেল, তা হল ওদের চেহারা। আর আমি বেঁটেখাটো গুজ্জু। অল্প কালো, অল্প নাদুসনুদুস ভুঁড়ি, বেসিক্যালি ইনট্রোভার্ট। আমাদের তো ভিলেন, কমেডিয়ান বা ক্যারেকটার রোল করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু যা পার্ট করেছি, আমি তাতেই দর্শকদের বুঝিয়েছি, আবার বলি ভালমন্দ নয়, বুঝিয়েছি আমি আর পাঁচজনের থেকে ডিফারেন্ট। আলাদা। এদিকে কিছু মানুষ কমবয়স থেকে বন্দুক, ছুরি হাতে আমাকে খুঁজে যাচ্ছে। খুঁজেই যাচ্ছে। এখন, আমার যদি সাকিব খানের মতো নুইসেন্স ভ্যালু তৈরি করার ক্ষমতা থাকতো বা তোর মতো পাল্টা হাত চালানোর, তাহলে একরকম হত। কিন্তু তোর ভেতর যেমন একটা বাচ্চা ছেলে সবসময় বেঁচেছে, আমার ভেতরেও সবসময় একটা ভদ্রলোক টিঁকে থেকেছে। জন্তুদের সঙ্গে লড়ার সময়ও, ওই ভদ্রতাকে আমি পুরোপুরি বিসর্জন দিতে পারিনি। অনেকটা ছুঁড়ে ফেলেছি, কিন্তু পুরোপুরি পারিনি। তাহলে জীবনে আত্মরক্ষা তুমি কী করে করবে? আমাদের দেশে সবথেকে শর্টকার্ট বর্মের নাম ওই রাজনীতি। রাজনীতির জন্য যাঁরা জীবন পুরো উৎসর্গ করেন, তাঁদের কথা আলাদা। সে লোকও আমি জীবনে দেখেছি। আবার আমার অভিনেতা বন্ধু দিবাকর শেঠের মতো পলিটিশিয়ানও তো আছে, যারা ওই পাওয়ার গেমের সাপলুডোতে সারাক্ষণ বাঁচেন। এসবের মধ্যে তাই ঢুকে পড়তে পারলে সাময়িকভাবে হলেও ওই খুনেগুলোকে সদর দরজার বাইরে হঠাৎ করে আটকে দেওয়া যায়। তাদের থতমত খাইয়ে দেওয়া যায়। তারা তখন পাঁচিলের চারপাশে ঘোরে, ভাবে ‘কবে এ মাল লালবাত্তি আর পুলিশ প্রহরা থেকে বেরোবে। ততক্ষণ ছুরিতে শান দিয়ে যাই, বেরোলেই টুঁটির কাছে ভোজালি ধরব’।
জন্ম ১৯৬৯, ২৫ সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুর। পূর্বতন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। পরবর্তীতে সিটি কলেজে অধ্যাপনা। নাটককার, পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্রাভিনেতা, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গীতিকার সম্পাদক। 'কালিন্দী ব্রাত্যজন' নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার ও 'ব্রাত্যজন নাট্যপত্রের' প্রধান সম্পাদক। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মন্ত্রী। পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি। উল্লেখ্য সত্যেন মিত্র পুরস্কার, শ্যামল সেন স্মৃতি পুরস্কার, দিশারী পুরস্কার, রমাপ্রসাদ বণিক স্মৃতি পুরস্কার, খালেদ চৌধুরী স্মারক সম্মান, অন্য থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ নাট্য নির্মাণ সম্মান। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন গজেন্দ্র কুমার মিত্র-সুমথনাথ ঘোষ স্মৃতি সম্মান। তাঁর সম্পাদনায় 'গিরিশ কথা' ও 'শিশির কথা' দু'টি বই তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, প: ব: সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। পেয়েছেন এবিপি আনন্দ 'সেরা বাঙালি ২০১৯' সম্মান। পেয়েছেন বাংলার নাট্যশিল্প জগতের সর্বোচ্চ সম্মান 'দীনবন্ধু মিত্র পুরস্কার'।
One Response
সুন্দর….