ঠিক বছরখানেক আগে, এই সময়, কোনও এক সাইটে অস্কার পাওয়া মুভির ট্রেলার দেখছি, দেখি কোনটা দেখা যায় এই ভেবে… “Omar”- প্যালেস্টাইন-এর ছবি, থ্রিলার, ট্রেলারটা শেষ হতেই, নিজের মতো আসা পরের ট্রেলারটায় চোখ আটকাল।
“হামাস, আ স্টোরি অফ অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন!”
ইন্টারেস্টিং! অতি সাধারণ কিছু প্যালেস্টাইনিদের দুর্দশার কাহিনি তুলে ধরা, একটি খাবারকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে। তারা না পারে অতীত নিয়ে ভাবতে, না পারে বর্তমানে বাঁচতে, না পারে ভবিষ্যতে এগোতে। হামাস সেখানে তাদের জীবনের প্রতীক। “They took everything… even our hummus…”- এই দিয়ে শুরু! ইজ়রায়েলের প্যালেস্টাইনি জমি অধিগ্রহণ, সংস্কৃতি অধিগ্রহণ, এমনকী তাদের সব চেয়ে প্রিয় খাবারটিও গ্রাস করা এবং আমেরিকার বাজারে পণ্যায়িত করা… এই নিয়ে চলচ্চিত্র। হামাস সেখানে বেঁচে থাকার আর প্রতিবাদের এক অস্ত্র!
মনে পড়ল, আরব দেশেই হামাস খেয়েছি। ফেলাফেল দিয়ে, পিটা রুটি দিয়ে, ডিপ করে। কখনও ভাবিনি এত আবেগ জড়িয়ে একটা খাবারের সঙ্গে! কখনও ভাবিনি এত লড়াই একটা খাবারের ইতিহাসে!
ইজ়রায়েল, প্যালেস্তাইন ছাড়াও লেবানন, তুরস্ক থেকে সিরিয়া– সবার দাবি, হামাস তাদের। মায় গ্রিসেরও। কিন্তু প্রমাণ কই! হামাস যা যা দিয়ে বানানো, সব তো কয়েকহাজার বছর পুরনো। সে তো কারও একার সম্পত্তি নয়! কাবলি ছোলা তো প্রায় দশ হাজার বছরের পুরনো, সবচেয়ে পুরনো লেগুম বা ডালশস্যের একটি। আর তিল? সেও বহু বহু বছর আগের। এই কাবলি ছোলাকে আপন করে তো ভারত-পাকিস্তানও চাইলে বলতেই পারে, হামাস আমাদেরও…

হামাস-এর সৌন্দর্য হল উপকরণের সাধারণত্বতে। বিজ্ঞানে যেমন সব চেয়ে শক্তিশালী ইকুয়েশনগুলো সব চেয়ে সহজ আর সুন্দর, ঠিক সেইরকম। ওই গরিব দেশগুলোয়, গরিব মানুষদের কাছে যেখানে মাংস খাওয়া বেশ বিলাসিতা, সেখানে শক্তি আর প্রোটিনের উৎস কাবলি ছোলা, আর সঙ্গে সাদা তিল, ওটা তো দারুন ভাবে মিনারেল, ভিটামিন আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-এর উৎস। তার মধ্যে লেবু, অলিভ অয়েল, রসুন, সব মিলেমিশে হামাস হলো “সুপার ফুড”! তা এই খাবার নিয়ে টানাপোড়েন হবে না?
টানাপোড়েন ছাড়িয়ে শুরু হল ‘হামাস ওয়ার’ ২০০৮-এ। লেবানন দাবি করলো হামাস তাদের, ইজ়রায়েল জোর করে তাদের খাবার গ্রাস করে নিয়েছে। শুরু হল সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে বেশি হামাস বানানোর যুদ্ধ!
মনে পড়ে, পশ্চিম এশিয়ায় হামাস খাবার আগে থেকেই বাড়িতে হামাস বানানোর চেষ্টা করতাম। লেবানিজ় খাবার, পিটা ব্রেড, শাওয়ার্মা, ফেলাফেল, এসবের সঙ্গে। কিন্তু হামাস এগজ়্যাক্টলি কীরকম খেতে, সেটা ওখানে গিয়ে খেয়ে বুঝলাম। না, তাও পুরোটা বুঝিনি। আসলে এক এক দেশে হামাস এক একরকমভাবে তৈরি হয়। মূল উপকরণ এক রেখেও স্বতন্ত্র। খুব সুন্দরভাবে সেই গল্প করা হয়েছে “Hummus the movie”-তে। হামাস নিয়ে কত গল্প কত সিনেমা। আপাতদৃষ্টিতে হামাস যুদ্ধ বাধিয়েছে বটে, আসলে কিন্তু বেঁধেই রেখেছে সবাইকে… তাই না? তাই চল, “Make hummus, not war…” বলে গান গাইতে গাইতে, হামাস বানিয়ে ফেলি?
‘Because you know…
I’m all about that paste…that hummus…’

তাহিনি বানাতে:
সাদা তিল এক কাপ
৪ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল বা সাদা তেল
অল্প নুন..
তিল টা গরম কড়াইতে গন্ধ বেরনো পর্যন্ত হালকা নেড়ে নিয়ে ঠান্ডা করে মিক্সারে তেল নুন মিশিয়ে অল্প জল দিয়ে বেটে নিলেই রেডি তাহিনি পেস্ট!
ওদিকে কাবলি ছোলা আগের দিন ভিজিয়ে রাখতে ভুললে হবে না। জল আর নুন দিয়ে ভাল করে সেদ্ধ করে ঠান্ডা করে রাখতে হবে।
এর পর আসি মাপজোকে
১ ১/২ কাপ সেদ্ধ কাবুলি ছোলা
১/৪ কাপ তাহিনি পেস্ট
১/৪ কাপ লেবুর রস
২ টো রসুন
৩-৪ টেবিল চামচ অলিভ অয়েল
১/২ চামচ জিরেভাজার গুঁড়ো
অল্প সুমাক বা লঙ্কাগুঁড়ো বা প্যাপ্রিকা ওপরে দেবার জন্যে
আর নুন..

ব্যাস, এবারে সব রেডি হলে একটা ছোট্ট কারসাজি! স্মুদ হামাস বানানোর রহস্য হল, ছোলাসেদ্ধ থেকে খোসাগুলো ছাড়িয়ে নেওয়া, একটু সময় নিয়ে। তারপর ওপরের তালিকার সবশুদ্ধ পেস্ট করে ভাল করে মিশিয়ে নিলেই রেডি। ওপরে অলিভ অয়েল আর সূমাক ছড়িয়ে পরিবেশন করা।
আচ্ছা, আমি এখানে আরও দুটো রকমের হামাস বানিয়েছি।
১. একটায় মটরশুঁটির পেস্ট মেশানো
২. অন্যটায় বিটের রস মেশানো
এ ছাড়া চিজ় মেশানো যেতে পারে, বাদামবাটাও।

নানা রকমের হামাস তো হল। খাবে কী দিয়ে? আক্ষরিক অর্থে যা খুশি দিয়ে। হ্যাঁ যা খুশি। পাঁউরুটি, থেকে পিটা ব্রেড। কাবাব থেকে শাওয়ার্মা। চিপস থেকে পাঁপড় থেকে নাচোস, ডিমসেদ্ধ বা চিকেন, কিম্বা সেদ্ধ সবজির ডিপ হিসেবে। কী দিয়ে খাবে সেই দায়িত্ব তোমাদের সৃজনশক্তির ওপর ছাড়লাম না হয়…
সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশন করে জানিও কিন্তু সবার কেমন লাগল!…
*সব রান্না ও ছবি সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।
One Response
Meri pyari Hummus..❤️❤️