কলেরা, ডায়ারিয়া বা ডিহাইড্রেশনের ওষুধ কি? কিভাবে পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ সুস্থ হয়ে ওঠেন প্রতিদিন? উত্তর আমাদের সবার জানা – স্যালাইন ড্রিপ বা ইনফিউশন। একবার ভাবুনতো যদি এই সামান্য, এবং অসামান্য, আবিষ্কারটি না হত তাহলে আজকের পৃথিবীর চেহারা কি হত? এই আবিষ্কারের প্রধান পুরোহিত একসময় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ছিলেন। কত ছাত্রকে নতুন পথে, মৌলিক চিন্তায় ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আমরা তাঁকে জানিনা কিংবা ভুলে গেছি। নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় মেতে থাকতেন এই মানুষটি। সেসময়ে অর্থাৎ ১৮৩৫-৪০ সালে, গরীব ভারতবাসী যাতে কমদামে ওষুধ পায় তার জন্য চেষ্টা করেছেন। তাঁর কেমিস্ট্রি ক্লাসের ছাত্ররা তাদের জ্ঞানকে নিজের দেশের সম্পদ উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য প্রয়োগ করতে পারেন সে শিক্ষা দিয়েছেন। বেশি দামী ইউরোপীয় ওষুধের পরিবর্তে দেশজ উপাদান থেকে নতুন পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরি করার জন্য ছাত্রদের বারংবার উজ্জীবিত করেছেন। এবার মানুষটিকে চেনার চেষ্টা করা যাক।
স্থান – ইংল্যান্ডের সান্ডারল্যান্ড, ২৬ অক্টোবর, ১৮৩১। তথাকথিত “ভারতীয়” কলেরায় আক্রান্ত প্রথম রোগী চিহ্নিত হল। মারাও গেল। একবছরের মধ্যে ২৩,০০০ মানুষের মৃত্যু হল কলেরায়। যদিও ল্যান্সেট-এর সাম্প্রতিক হিসেব অনুযায়ী এ সংখ্যা ৫০,০০০ ছিল – “In England, the first pandemic killed more than 50 000 citizens between 1831 and 1834, spawning a generation of research papers.” (ল্যান্সেট, “Knowing its place: mapping as medical investigation”, মার্চ ১০, ২০১২) এ হিসেব এখন তোলা থাক।
এ সময়ে এখানে এলেন এডিনবরা থেকে সদ্য পাস করে বেরনো এক উজ্জ্বল মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট। মাত্র ২২ বছর বয়স তখন। ১৮০৯ সালে আয়ারল্যান্ডের লিমেরিকে জন্ম। এরপরে স্নাতক হন ডাবলিনের বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজ থেকে। (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত চিকিৎসকদের প্রায় ৬০% একসময় এই ট্রিনিটি কলেজে প্রথম পাঠ গ্রহণ করেছিলেন) জন্মসূত্রে বাবা ক্যাথলিক, মা প্রোটেস্ট্যান্ট। অদ্ভুত হল, ইতিহাস ঘেঁটে আমরা এই যুবকের তিনটি নাম পাচ্ছি – প্রথমে উইলিয়াম স্যান্ডস, পরে উইলিয়াম ব্রুক ও’শনেসি, এবং সবশেষে উইলিয়াম ও’শনেসি ব্রুক। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠার যুগের শিক্ষক এবং তিনি দ্বিতীয় নামটিতে সবচেয়ে বেশি গবেষণাপত্র লেখার সুবাদে আমরা তাঁকে জানব উইলিয়াম ব্রুক ও’শনেসি বা শুধু ও’শনেসি বলে।

যেসময়ে ও’শনেসির জন্ম সেসময়ের সাহিত্য এবং জীববিজ্ঞানের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য আরও দুজন মানুষ জন্ম গ্রহণ করছেন – চার্লস ডারউইন (১৮০৯) এবং তলান্তিকের ওপারে এডগার অ্যালান পো (১৮০৯)। অর্থাৎ, পৃথিবীতে নতুন ভাবনা ও চিন্তা আসার ক্ষেত্রটি তৈরি হচ্ছে। ও’শনেসির ক্ষেত্রে কোনও সমস্যাকে উৎস থেকে ভাবার, এর সমাধানে পৌঁছনোর এবং সমাধানের পদ্ধতিকে বাস্তবে প্রয়োগ করার এক সহজাত বা জিনগত বৈশিষ্ট্য ছিল। একইসঙ্গে মেডিসিন, কেমিস্ট্রি, মেডিক্যাল টক্সিকোলোজি, ফরেন্সিক মেডিসিন এবং ফিজিক্স – এতগুলো বিষয় সমান দক্ষতায় বুঝেছেন, আয়ত্ত করেছেন। নিজের বোঝা পথ ধরে এগিয়েছেন, এবং সে পথে ভুল হলে স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি।
১৮৩১-এ ইংল্যান্ডে যখন কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটল তখন চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা অনেকাংশে প্রচলিত সংস্কারে আচ্ছন্ন, তখনও “মায়াসমাটিক” তত্ত্বের বাইরে (দূষিত বাতাস থেকে রোগের উৎপত্তি) একটি বড় অংশই বেরতে পারেননি। প্র্যাক্টিক্যাল কেমিস্ট্রিকে প্রয়োগ করা তো দূর কল্পনাতেও আসেনা। ও’শনেসি কলেরার ফলে রক্তে কী পরিবর্তন হয়, কেন রোগী অনেকটা নীল বর্ণ ধারণ করে, কেনইবা এত দ্রুত মারা যায় বমি এবং পায়খানার ফলে, এগুলো বোঝার জন্য রোগীর রক্তের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন। আমরা এখানে মাথায় রাখব একজন ২২ বছর বয়সী সদ্য পাস করে বেরনো একজন চিকিৎসক এই কাজটি করছেন – প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়ে! আমাদের নিজেদের ছাত্রজীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারি একবার।
যেসময়ে ও’শনেসির জন্ম সেসময়ের সাহিত্য এবং জীববিজ্ঞানের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য আরও দুজন মানুষ জন্ম গ্রহণ করছেন – চার্লস ডারউইন (১৮০৯) এবং তলান্তিকের ওপারে এডগার অ্যালান পো (১৮০৯)। অর্থাৎ, পৃথিবীতে নতুন ভাবনা ও চিন্তা আসার ক্ষেত্রটি তৈরি হচ্ছে।
তৎকালীন বিচারে অনেকাংশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মেডিক্যাল জার্নাল ল্যান্সেট-এ তাঁর গবেষণাপত্র ছাপা হল “Proposal of a New Method of Treating the Blue Epidemic Cholera by the Injection of Highly-Oxygenised Salts into the Venous System” (ল্যান্সেট, ডিসেম্বর ৩, ১৮৩১)। প্রথম কলেরা চিহ্নিত কেস ধরা পড়ল ২৬ অক্টোবর। ও’শনেসির গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে ৩ ডিসেম্বরে। দু’মাসেরও কম সময়ে তাঁর প্রাথমিক গবেষণার ফলাফল বেরল।
প্রসঙ্গত, বলা দরকার ১৮২৩-এর ৫ অক্টোবর তারিখে ল্যান্সেট-এর প্রতিষ্ঠাও অনেকাংশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থান থেকে। প্রথম সংখ্যার ভূমিকাতেই বলা হয়েছিল মেডিক্যালের জ্ঞানকে কেন্দ্রীভূত করার পরিবর্তে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে – “IT has long been a subject of surprise and regret, that in this extensive and intelligent community there has not hitherto existed a work that would convey to the Public, and to distant Practitioners as well as to Students in Medicine and Surgery, reports of the Metropolitan Hospital Lectures.” রক্ষণশীল ইংল্যান্ডের বৌদ্ধিক জগতে তখন এরকম ভাবনা কার্যত “বৈপ্লবিক”।
তাঁর প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ও’শনেসি বললেন – “in the briefest time I can employ, an outline of suggestions regarding the treatment of the Indian cholera … foundation of the subsequent observations is also strictly experimental and demonstrable in its nature.” তখনও অবধি তাঁর ধারণা ছিল রক্তে অক্সিজেন কমে যাবার জন্য (বিভিন্ন লবণ বেরিয়ে যাবার দরুণ) রোগীর মৃত্যু ঘটে। এরপরে আবার কলেরা রোগীর রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করলেন। এবার নতুন এবং নির্ভুল ফল পেলেন। ২৬ দিনের মধ্যে একজন যথার্থ বৈজ্ঞানিকের মতো তিনি তাঁর ধারণার পরিবর্তন করলেন। ২৯ ডিসেম্বর, ১৮৩১, ল্যান্সেট-এর সম্পাদককে চিঠি লিখলেন। চিঠিতে জানালেন –
“1. The blood drawn in the worst cases of the cholera, is unchanged in its anatomical or globular structure.
- It has lost a large proportion of its water, 1000 parts of cholera serum having but the average of 860 parts of water.
- It has lost also a great proportion of its NEUTRAL saline ingredients.
- Of the free alkali contained in healthy serum, not a particle is present in some cholera cases, and barely a trace in others.
- Urea exists in the cases where suppression of urine has been a marked symptom.
- All the salts deficient in the blood, especially the carbonate of soda, are present in large quantities in the peculiar white dejected matters.
… All my experiments, however, have been publicly performed, and can be authenticated by numerous witnesses”.
কলেরার ফলে রক্তের কী পরিবর্তন ঘটে পৃথিবীর চিকিৎসক এবং বৈজ্ঞানিককুল জানল প্রথমবারের জন্য। কলেরার চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে, টমাস কুনের ভাষায়, একটি “paradigm shift” হল। ও’শনেসি কুকুরের ওপরে পরীক্ষা করেছিলেন, মানুষের ওপরে নয়। এরপরে আরেক চিকিৎসক টমাস লাট্টা এর বাস্তব প্রয়োগ করলেন মানুষের ওপরে – কলেরা আক্রান্ত রোগীর শরীরে ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন ইনফিউসন দেওয়া শুরু হল। তারিখটি ১০ মে, ১৮৩২। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক মাইলফলক। এক নতুন যুগের সূচনাবিন্দু।
ও’শনেসি ল্যান্সেট-এ একটি নোট লিখলেন (জুন ২, ১৮৩২) – “I beg to state that the results of the practice described by Drs. Latta and Lewins exceed my most sanguine anticipations.” একজন প্রকৃত বিজ্ঞান সাধকের মতো অকপট স্বীকারোক্তি।
সেসময়ের পত্রিকায় প্রকাশিত মুমূর্ষু কলেরা রোগীর ছবি ছাপা হয়েছিল। সেরকম একটি ছবি দেখুন নীচে।

ডঃ লাট্টা এক বৃদ্ধা রোগীর ওপরে প্রথম প্রয়োগ করেন ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন – রিডের যন্ত্রের সাহায্যে। মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধার ওপরে যখন একেবারে নতুন ও অভিনব এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয় তখন লাট্টার সামনে কোনও পূর্ব প্রদর্শিত পথ ছিল না, যেমনটা ছিল না ও’শনেসির ক্ষেত্রে।
একটু ধৈর্য্য নিয়ে পাঠদের পড়তে অনুরোধ করব পৃথিবীতে প্রথমবারের জন্য কলেরার চিকিৎসায় স্যালাইন ইনফিউসন দেবার পরে লাট্টার নিজের বর্ণনায় এই রোমহর্ষক বৃত্তান্ত:
“She had apparently reached the last moments of her earthly existence, and now nothing could injure her/indeed so entirely was she reduced, that I feared I should be unable to get my apparatus ready ere she expired. Having inserted a tube into the basilic vein, cautiously, anxiously, I watched the effect; ounce after ounce was injected, but no visible change was produced. Still persevering, I thought she began to breath less laboriously; soon the sharpened features and sunken eye and fallen jaw, pale and cold, bearing the manifest impress of death’s signet, began to glow with returning animation; the pulse which had long ceased, returned to the wrist, at first small and quick, by degrees it became more and more distinct, fuller, slower and firmer, and in a short space of half an hour, when six pints had been injected, she expressed in a firm voice that she was free from all uneasiness, actually became jocular, and fancied all she needed was a little sleep; her extremities were warm, and every feature bore the aspect of comfort and health. This being my first case, I fancied my patient secure, and from my great need of a little repose, left her in charge of the hospital surgeon; but I had not been long gone, ere the vomiting and purging recurring, soon reduced her to her former state of debility. I was not apprised of the event, and she sunk in five and a half hours after I left her. As she had previously been of a sound constitution, I have no doubt the case would have issued in complete reaction, had the remedy, which already had produced such effect been repeated”.

তৎকালীন সময়ে কলেরার রোগী স্যালাইন ইনফিউসন পাবার পরে আবার স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে, পালস ফিরে এসেছে – এ একেবারেই এক অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল। পৃথিবীর চিকিৎসক সমাজ, বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার, একদম অপ্রস্তুত ছিল এরকম এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার মুখোমুখি হবার জন্য। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৮ সালে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে জন্মানো প্রথম টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া এখানকার চিকিৎসক সমাজ দেখিয়েছিল, তার সঙ্গে খানিকটা তুলনীয়। আকস্মিকতা এবং প্রথম হবার মূল্য চোকাতে হয়েছিল ও’শনেসি এবং লাট্টাকে ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের চিকিৎসকসমাজ ১৮৩০-এর দশকে এই পদ্ধতি গ্রহণ করেনি। পদ্ধতিটি পরিত্যক্ত হিসেবে রয়ে গেল। প্রায় ৭০ বছর পরে আমেরিকায় এ পদ্ধতির পুনরুজ্জীবন ঘটল। আর আমাদের এখানে বেদনাদায়ক মৃত্যু দিয়ে মূল্য চোকাতে হয়েছিল চিকিৎসক গবেষক সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে।
ডক্টরস ডায়লগে পূর্ব প্রকাশিত
ছবি সৌজন্য: জয়ন্ত ভট্টাচার্য ও Wikimedia Commons
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
পেশায় ডাক্তার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণায় নিযুক্ত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। বর্তমান ঠিকানা রায়গঞ্জ।