সৈয়দ মুজতবা আলির কথায়, ‘ইংরেজের বাড়ি, হিন্দুর শাড়ি, মুসলমানের হাঁড়ি।’
এই বাড়ি, শাড়ি আর হাঁড়ির মধ্যে কিন্তু হাঁড়ি অর্থাৎ আমাদের খাদ্যসংক্রান্ত বিষয়েই সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কিন্তু মোগলদের। এদেশে এসে স্থায়ীভাবে পাকাঘর প্রথম বাঁধেন বাবর আর তখন থেকেই এই ভারতের পাকঘরের হিন্দুস্তানি সংস্কৃতির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে মোগলাই রসনার। আর তার অন্যতম কারণ হল মোগলাই রান্নায় ব্যবহৃত মশলাপাতি আর তার সুঘ্রাণ, যা আমাদের স্বাদকোরক কে বশ করেছে অনায়াসেই। তেমনই একটি রান্না হল মাংসের রেজালা।
রেজালা শব্দটি এসেছে ‘রাজিল’ থেকে, যার অর্থ নিম্নবিত্ত। এর উৎস উর্দু ‘রাজেলা’ থেকে। মোগল আমলে কর্মচারি পর্যায়ের লোকেদের অত্যন্ত পছন্দের খাবার ছিল মাংসের এই পদ যাকে তারা বলত ‘রাজিলা’। পরে বিবর্তিত হয়ে সেই রান্নার উচ্চারণটি রেজালায় পরিণত হয়েছে।
রেজালাকে ঠিক মোগলাই খাবার না বলে আমাদের হিন্দুস্তানি সংস্কৃতির অন্যতম আমিষ রান্নাই বলা ভালো। এখানে হিন্দুস্তানি সংস্কৃতি বলতে কোনও ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বোঝাচ্ছি না। হিন্দুস্তানি সংস্কৃতি বলতে সেই সংস্কৃতিকে বোঝানো হচ্ছে যার জন্ম আগ্রা তথা বহু প্রাচীন অগ্রনগর শহর কিম্বা লখনউয়ের কোনও খানাগলি। তবে তারও আগে যাযাবর মোগলদের আগমন মঙ্গোলিয়া থেকে। তাদের মাতৃভাষা মঙ্গোলিয়ান ভাষার সমতুল। আফগানিস্তানে আসার পরে ইরানের প্রভাবে তাদের কথ্যভাষায় বেশ কিছু ফার্সি শব্দ ঢুকে যায়। মোগল সংস্কৃতি এবং সত্ত্বা অর্ধ-পারসিক ও অর্ধ-মঙ্গোলীয়, এককথায় পারসিক-মঙ্গোলিয়ানে পরিণত হয়। মোগলরা পারসিক সংস্কৃতি দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত ছিল।
যখন বাবর ভারতবর্ষের একটি অংশ দখল করে স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করতে শুরু করেন তখন ভারতবর্ষীয় আবহাওয়া বা সংস্কৃতি কোনওটাই তাঁর পছন্দ ছিল না। উত্তর ভারতীয়রা মূলত নিরামিষভোজী হওয়ায় মাংসের মজাদার খাবার সেখানে মিলত না বলে বাবর খুব কষ্ট পেতেন। বাবরনামায় রয়েছে এসব তথ্য। আখরোট, আঙুর তো দূর অস্ত। কোনও ফলপাকুড়ও নেই। এমনকি তরমুজ, ভালো মাংস, বরফ, ঠান্ডাজল এসব নেই। তখনও সমরখন্দের শৈশবস্মৃতি বাবরকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত।

ঈব্রাহিম লোদিকে পরাস্ত করলেও লোদি সাম্রাজ্য দখলের পর সেই পুরনো পাচককে বাবর নিজের হেঁশেলে নিয়োগ করলেন। তিনি অবশ্য বাবরের খাবারে বিষ মিশিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন বলে পরে বরখাস্ত হন। কিন্তু তাঁর হাত বেয়েই তুখোড় পারসিক রন্ধনশৈলী স্থায়ীভাবে ঢুকে পড়ে বাবরের পাকশালে। পরবর্তীকালে সম্রাট বাবর তাঁর অধীনে কর্মরত স্থানীয় বাবুর্চিদের পারসিক ও স্থানীয় রন্ধনশৈলীর সমন্বয়ে এক নতুন পদ্ধতিতে রান্না করার নিদান দেন। এই দুইয়ের মিশ্র রন্ধনশৈলীর কারণেই জন্ম নেয় কোর্মা, কোফতা বা রেজালার মতো খাবার, যাকে আমরা মোগলাই খানা বলেই ধরে নিই।

ওদিকে আবার পর্তুগিজ নাবিকদের কৃপায় এদেশে মশলাপাতির জয়জয়কার। তা সে মশলার গুণেই হোক কিংবা মোগলদের রসুইঘরের স্থানীয় হিন্দুস্তানি বার্বুচি আর পারস্যের পাচক উভয়ের হাতের জাদুতে মোগলদের রাজকীয় হেঁশেলের এলাহি রান্নার ছিল বিশ্বজোড়া সুখ্যাতি। উৎকর্ষ আর সৌকর্যের চূড়ান্তে ওঠা মোগল খানায় অথেন্টিক এবং বনেদি রেজালা সাদা রঙের পাতলা গ্রেভিযুক্ত। কখনওই এতে কোর্মার মতো গরগরে, লাল টকটকে কাশ্মীরি লংকার রং বা হলুদের ছোঁয়া থাকে না। অথচ টকদই, দুধ বা ক্রিম এসব উপকরণই লাগে মাংসের রেজালা বা কোর্মা বানাতে। তবে এই দুইই হল মূলত ভাত, রুটি, পোলাও বা পরোটার সঙ্গে মেইনকোর্সের গ্রেভি আইটেম।
মোগল আমলে দরবারি লোকেরা খাবারে মরিচ বা লংকার ঝাল ব্যবহার করতেন না, কোর্মাই ছিল তাদের দৈনন্দিন পছন্দের খাবারের তালিকায়। অপরদিকে কর্মচারি পর্যায়ের মানুষেরা স্থানীয় সব ঝালমশলা সহযোগে রাঁধা আমিষই বেশি পছন্দ করতেন। ফলে মোগল হেঁসেলের অন্দরে এই কোর্মাকেই মরিচ তথা ঝাল সহযোগে রাঁধার প্রচলন শুরু হল। এবং সেই খাবারটির নাম হল রাজিলা বা রেজালা। এই ভিন্ন স্বাদের ঝাল রেজালা ক্রমে ক্রমে অন্দরমহলের মহিলাদেরও নজর কাড়ল। তাঁরা ইম্প্রোভাইজ করে নিজেদের স্বাদকোরকের পছন্দ অনুযায়ী তার মধ্যে যোগ করলেন কাঁচালঙ্কা চিরে নিয়ে বীজ ফেলে দিয়ে দুধে ভেজানো সেই মরিচ। ঝালের জন্য দিলেন বীজ ছাড়া পাকা লাল শুকনোলঙ্কা।

তখন রেজালা রাঁধা হত মুরগি, গরু ও খাসির মাংস দিয়েই। পরিবেশিত হত নানারকম পোলাও, রুটি, বাখরখানি, পরোটার সঙ্গে। তদ্দিনে অবশ্য মাংসপ্রিয় মোগলরা স্থানীয় মানুষের দেখাদেখি পছন্দ করতে শুরু করেছে ইলিশ, রুই, চিতলের পেটি, কাতলা মাছের রেজালা, যা তাঁরা খেতেন সাদা পোলাওয়ের সঙ্গে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের দাওয়তে মাছের রেজালা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঝাল দিয়ে রাঁধা রাজিলা, কিংবা কাঁচালঙ্কা দিয়ে রাঁধা একটু ভিন্নস্বাদের কোর্মা কালিয়ার মতো রেজালায় কালের বিবর্তনে শুকনোলংকার ব্যবহারে রূপান্তরিত হয়েছে। এবং সেইসঙ্গে হারিয়ে গেছে রাজিলা বা রেজালার মূল রেসিপি।
মোদ্দা কথা, মুরগির মাংস দিয়ে সহজেই রেজালা বানানো যায়। কারণ অল্প আঁচে তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়। টকদইতে আদা, রসুন আর কাঁচালংকাবাটা, নুন, চিনি দিয়ে ম্যারিনেট করা মাংস মজবে ঘণ্টাদুয়েক। তারপর রিফাইন্ড তেল আর ঘিয়ের মধ্যে গোটা গোলমরিচ, শুকনোলংকা আর গরমমশলা ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ ভাঁজতে হবে। বাদামি হলে সবশুদ্ধ সেই ম্যারিনেটেড মাংসে ঢেলে দমে বসালেই তৈরি হবে সুস্বাদু রেজালা। তবে সবশেষে সুগন্ধি কেওড়ার জল বা গোলাপজল কিম্বা জাফরান বা মিঠা আতর, এসবও কিন্তু রেজালার অঙ্গ।
কলকাতার প্রথম ইসলামি রেস্তোরাঁ কী এবং কোথায়, খুঁজতে গিয়ে অরুণ চক্রবর্তীর লেখায় পেয়ে গেলাম একগুচ্ছ খাবার জায়গার নাম। আমজাদিয়া, রয়্যাল, সাবির’স, আমিনিয়া, নিজাম’স। এসব ইসলামি রেস্তোরাঁ হল সে সময়ের কলকাতার খানদানি মুসলমান খানাঘর। এইসব দেখেশুনে আমাদের মনে হতেই পারে, যে ইসলামি রেস্তোরাঁর ঐতিহ্য মোগল আমল থেকেই হয়তো প্রবাহিত হয়ে আসছে। তা কিন্তু ঠিক নয়। বিশ্বে রেস্তোরাঁ ব্যাপারটাই চালু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং প্রথম চালু হয় ফ্রান্সে। তদানীন্তন পুতুল নবাব বাহাদুর শাহ জফরের রাজত্বের মাঝামাঝি সময়ে মোগল ভারতে দূরদূরান্তের পথিকদের থাকা খাওয়ার জন্য নির্মিত হত সরাইখানা আর মকান, যেখানে মানুষ একত্রে খানাপিনা করত। এই কনসেপ্ট আজকের রেস্তোরাঁ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

আমজাদিয়া ছাড়া বাকি চারটি মুসলমানি রেস্তোরাঁই ব্রিটিশ আমলের মুসলমানদের “খানেপিনে কি দুকান”-এর আদলে তৈরি, মানে ওপেন এয়ার ধাবা স্টাইল। রাস্তা থেকে পথচারীরা দেখতে পাবে সবকিছু। এসব জায়গায় রেজালা তখনও পাওয়া যেত আর এখনও দিব্য মেলে। তবে বন্ধ হয়ে গেছে কলকাতার প্রথম ইসলামি রেস্তোরাঁ আমজাদিয়া। বাংলার প্রথম কালিনারি কলমচি বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পাক প্রণালী’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, মুসলমানদের কাছ থেকেই আমিষের কালিয়া, কোর্মা প্রভৃতি রান্নার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। আর এই কোর্মা, কালিয়া বা রেজালার অঙ্গ হল ঘি আর গরমমশলা তা বুঝতেও বাকি নেই আমাদের। কোনওটায় বেশি তো কোনওটায় কম । কালিয়ায় আলু দেওয়া হত তবে কোর্মা বা রেজালায় আলু থাকত না। আবার কালিয়া খুব ঘন হয় না কিন্তু কোর্মা, রেজালা বা কালিয়া অপেক্ষাকৃত ঘন হবে। কোর্মায় হলুদ মাস্ট কিন্তু রেজালা হবে দুধসাদা।
শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পেলাম তাঁর দিদিমার সংগ্রহের আউধ ঘরানার বিশিষ্ট এক পদ ‘নবরত্ন রেজালা’র কথা। তবে লখনউয়ের গলির এক পুরনো মুসলমান বাবুর্চির কাছ থেকে জোগাড় করা এই রেসিপির সঙ্গে প্রচলিত রেজালার কোনও মিল নেই, নাম ছাড়া। পরক্ষণে পাতা ওলটাতে গিয়ে চোখ পড়ে মাংসের ভূপালি রেজালার রেসিপি, যেখানে শুকনোলংকা আর গোলমরিচের উপস্থিতি আবারও মিলে যায় মোগলাই রেজালার সঙ্গে। অবশেষে আদ্যন্ত ফুডি, নানান রান্না নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যাঁর প্যাশন, সেই ভ্রাতৃসম জয়ন্ত দত্ত জানালেন ঘিয়েভাজা শুকনোলংকা ফোড়ন আর পেঁয়াজভাজা দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশনই হল রেজালার মাখোমাখো সুঘ্রাণের গোপন কথা।
*ছবি সৌজন্য: Goodfoodmemories, Simply Recipes, Harighotra,co.uk, Betterbutter
*ভিডিও সৌজন্য: Tanhir Pakshala, Youtube
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।