১৯৪০ সাল থেকেই বলা যায় এক ধরনের সমান্তরাল বাংলা নাটকের ধারার সূত্রপাত হল বাংলায়। যাকে বলা হল ‘গ্রুপ থিয়েটার’। বিজন ভট্টাচার্য-র ‘নবান্ন’ নাটক অবশ্যই এ ব্যাপারে পথ দেখিয়েছিল। সেই নাটকের ক্ষেত্রে ১৯৪৩-এ তৈরি হওয়া ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ'(আইপিটিএ)-র প্ল্যাটফর্মটি নিয়েছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শুধু থিয়েটারই নয়, এই সংগঠন থেকে উঠে এলেন সংগীত, সাহিত্য, চারুকলা ইত্যাদি ক্ষেত্রের একাধিক উজ্জ্বল প্রতিভা। যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই পরবর্তীকালে যুগের একেকজন প্রতীক হয়ে উঠলেন। এর পাশাপাশিই ছিল বাণিজ্যিক থিয়েটারের রমরমা। বাণিজ্যিক থিয়েটারে পুরোপুরি পেশাদারি পথে মূলত শ্যামবাজার-হাতিবাগান অঞ্চলের বিভিন্ন মঞ্চে উপস্থাপিত হচ্ছিল একটার পর একটা জনপ্রিয় নাটক। অজস্র নামকরা অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়ে সেইসব থিয়েটার, তখনকার মানুষের কাছে ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। বাংলা নাটকের জগতে এই পেশাদারি ধারা সফলভাবে শুরু হয় সেই উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে। বাংলা থিয়েটারের দুনিয়া ঘিরে শুধু অভিনয়শিল্পী নয়, একাধিক বিরাট মাপের গুণী নাট্যকার, সংগীতকার, যন্ত্রসংগীতশিল্পী, কণ্ঠশিল্পীর সমাবেশ ঘটেছে শুরু থেকেই। এর পাশাপাশি গ্রুপ থিয়েটারে দেখা গেল অন্য স্রোত। সেখানে বাণিজ্যিক ভাবনার বাইরে এসে কিছু নাট্যপাগলের ঝাঁক নবীন স্বপ্ন নিয়ে গড়ে তুলতে লাগল একেকটি দল। যাঁরা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা না ভেবে শুধুমাত্র থিয়েটার করার নেশায় আচ্ছন্ন ও প্রধানত প্রগতিবাদী চেতনাসম্পন্ন। ক্রমশ বামপন্থী রাজনৈতিক আবহের যে প্রভাব সেইসময় বাংলায় প্রকট হচ্ছিল, তারই অন্যতম ফসল ছিল এই গ্রুপ থিয়েটার ভাবনা। এর ফলে নাট্যচিন্তায় পড়ল এক ধরনের আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া, যা ভীষণভাবে প্রগতিবাদী রাজনৈতিক ভাবধারাজাত। গ্রুপ থিয়েটারের নাটকগুলিতে দেওয়া হতে লাগল স্পষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা। কলকাতা ছাড়া গ্রাম মফস্সলেও গ্রুপ থিয়েটারের আদলে তৈরি হল অজস্র নাট্যদল। এর আগে অনেক নাট্যদল বিভিন্ন জায়গায় অবশ্যই ছিল। যেখানে ছিল মূলত পূর্ণাঙ্গ নাটকের দল। এইসব নতুন দলগুলোর হাত ধরে ক্রমশ চালু হতে লাগল ‘একাঙ্ক’ নাটকের একটা নিয়মিত ধারা। যার সময়সীমা মোটামুটিভাবে এক ঘণ্টা। সারা বাংলা জুড়ে শুরু হল বিভিন্ন দলের একাঙ্ক নাটক নিয়ে ‘নাট্য প্রতিযোগিতা’। ৭০ দশকের টালমাটাল করা রাজনৈতিক আবহাওয়ায় একাঙ্ক নাটক ও তার প্রতিযোগিতার ঢল নামলো বলা যায়। যুবগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ প্রগতিশীল বোধকে আশ্রয় করে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বার্তাবাহী নাট্য উন্মাদনায় মেতে উঠল। নিজেরাই নানাভাবে অর্থসংগ্রহ করে নাটক করে চলল। নাট্য প্রতিযোগিতাগুলোর আয়োজনও হল একইভাবে। যা আজও অব্যাহত। যদিও ইদানীং অধিকাংশ জায়গায় প্রতিযোগিতা না করে, তাকে নাট্য উৎসবের চেহারা দেওয়া হয়েছে।

আমরা জানি, ১৯৯০ সালে দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটা বড় বাঁক আসে। তার ফলে গত ২৫-৩০ বছরে জীবনযাত্রার ধরনে আকস্মিক এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। তা সত্ত্বেও, আজও গ্রাম মফস্সলে অজস্র নাট্যদল একইভাবে নাট্যনেশায় মেতে রয়েছে। হয়তো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত কিছু কিছু পার্থক্য এসেছে, রাজনৈতিক ভাবনায় পড়েছে নানা বর্ণের আস্তরণ, যার প্রভাব পড়ছে প্রযোজনাগুলোতে। এছাড়া কলকাতার মতোই মফস্সলের অনেক থিয়েটার দল আজ সরকারি অনুদান পাচ্ছেন। তাতে অবশ্যই অর্থকরী দিকে সুবিধে হচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে প্রযোজনার মান কতটা বাড়ছে, তা হলফ করে বলা শক্ত। সবচেয়ে বড় কথা, এককালে যে বাণিজ্যিক থিয়েটারের একটা বিরাট জায়গা ছিল বাংলার নাট্যদুনিয়ায়, তা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে যে শুধুমাত্র তথাকথিত গ্রুপ থিয়েটারের অস্তিত্ব বজায় রইল― বাংলা থিয়েটারের নিরিখে তার সামগ্রিক সার্থকতা নিয়েও আজ মনে প্রশ্ন ওঠে। এতকিছু সত্ত্বেও বলতে হয়, আজও বরাবরের মতো মফস্সলের অধিকাংশ নাট্যকর্মীরা, পাওয়া না-পাওয়াকে সেইভাবে গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে, গ্রামেগঞ্জে থিয়েটার নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। একসঙ্গে অভিনয়শিল্পী, পরিচালক, আলোকশিল্পী, মঞ্চশিল্পী, রূপসজ্জাশিল্পী― সবাই চলেছেন তাঁদের থিয়েটারি সামগ্রী নিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাসে, ট্রেনে। কখনও কখনও ভাড়া করা গাড়িতে। ‘বিশেষজ্ঞ’দের আলোচনায় গ্রামেগঞ্জের নাটকের এই অনুশীলনের কাহিনি ততটা আসে না। সেখানে প্রাধান্য পায় কলকাতা। এখনও সামগ্রিকভাবে মফস্সলের থিয়েটারের সঙ্গে কলকাতার থিয়েটারের একটা পার্থক্য পরিষ্কার বোঝা যায়। প্রথমটিতে আজও প্রধানত আছে নির্ভেজাল নাট্য পাগলামি, আর দ্বিতীয়টি বর্তমানের বৈভবশাসিত সময়ের আলো ঝলমলে গ্ল্যামারে আচ্ছন্ন। দুটি ক্ষেত্রে অবশ্যই আছে নাট্যপ্রেম এবং এর সঙ্গে ভালো-মন্দ থিয়েটারের কোনও সম্পর্ক হয়তো নেই, তবুও মাটির কাছে ও দূরের সম্বন্ধের একটা তফাৎ নিশ্চিতভাবে আছে। এখানে মূলত পার্থক্য ঘটিয়ে দেয় দর্শকের ধরন। গ্রাম মফস্বলের থিয়েটার দলগুলোর কাছে প্রধান সম্পদ, বাংলার নানা প্রান্তে থাকা সাধারণ দর্শক। যার একটা বিরাট অংশ জুড়ে আছেন প্রান্তিক মানুষজন। সন্ধে হবার সঙ্গে সঙ্গে নাট্য প্রতিযোগিতা বা উৎসবের দর্শকাসনগুলো উপচে পড়ে মানুষে। এ যে কত বড় প্রাপ্তি, তার প্রমাণ দিতে গেলে একটা ব্যক্তিগত কাহিনি বলতে হবে। যা পড়লেই সবাই বুঝবেন কলকাতার মঞ্চে নাটক করে যতই নামধাম, অর্থে ঝুলি ভরুক না কেন, এই অমূল্য প্রাপ্তি কখনওই সম্ভব নয়।
‘বিশেষজ্ঞ’দের আলোচনায় গ্রামেগঞ্জের নাটকের এই অনুশীলনের কাহিনি ততটা আসে না। সেখানে প্রাধান্য পায় কলকাতা। এখনও সামগ্রিকভাবে মফস্সলের থিয়েটারের সঙ্গে কলকাতার থিয়েটারের একটা পার্থক্য পরিষ্কার বোঝা যায়। প্রথমটিতে আজও প্রধানত আছে নির্ভেজাল নাট্য পাগলামি, আর দ্বিতীয়টি বর্তমানের বৈভবশাসিত সময়ের আলো ঝলমলে গ্ল্যামারে আচ্ছন্ন। দুটি ক্ষেত্রে অবশ্যই আছে নাট্যপ্রেম এবং এর সঙ্গে ভালো-মন্দ থিয়েটারের কোনও সম্পর্ক হয়তো নেই, তবুও মাটির কাছে ও দূরের সম্বন্ধের একটা তফাৎ নিশ্চিতভাবে আছে।
সময়টা ২০০৬-০৭ হবে। মফস্বলের একটি নাট্যদলের একটি প্রযোজনায় অভিনয় করছি তখন। নাটকটি খুবই জনপ্রিয় হওয়ায়, রোজ পশ্চিমবঙ্গের কোনও না কোনও জায়গায় তা মঞ্চস্থ হচ্ছে। একবার নাটক করতে যাওয়া হয়েছে বর্ধমানের বড়শূল গ্রামে। অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও গ্রামবাংলা ভেঙে পড়েছে সন্ধে হতে না হতেই। যার মধ্যে তথাকথিত শহুরে তাত্ত্বিকতা বা কৃত্রিমতার ছিটেফোঁটাও নেই। আছে শুধু সরল মনের নিখাদ ভালোবাসা, যা ঠিকঠাকভাবে বোঝা আমাদের মতো প্রথাগত শিক্ষাপুষ্ট লোকেদের পক্ষে অসম্ভব। নাটক শেষ হল। একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। মানুষজন দেখতে দেখতে যাচ্ছেন। হঠাৎ কাছে এগিয়ে এলেন এক গাঁয়ের বধূ। উঁচুতে পরা শাড়ি। কোলে একটা আধন্যাংটা বাচ্চা। হাতে ধরা আরেকটি ছেলে। পোশাক-আশাক চরম দুর্দশাগ্রস্ত। প্রসঙ্গত, এসব নাট্যআয়োজনগুলি চলে শীতকাল জুড়ে (নভেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত)। তখন বাজে প্রায় রাত ৯টা। তার মধ্যে চরম দারিদ্র্যের অন্যতম জ্বলন্ত নিদর্শন এই পরিবারটি থিয়েটার দেখতে এসেছেন। হঠাৎ বউটি আমাকে বললেন, “কী ভালো নাটক করলে গো!” আমি শুধু বললাম, “হুঁ”। এরপরই বজ্রপাত―”তোমরা তো প্রতিবার আসো। গতবার করেছিলে এই নাটক, তার আগে এই, তার আগেরবার…”। এবার আমার অজ্ঞান হবার দশা! মুহূর্তে নিজেকে অশিক্ষিত মনে হল। অভাব যাঁদের ছায়াসঙ্গী, নিত্যজীবন যন্ত্রণায় জর্জরিত― থিয়েটারের প্রতি তাঁদের এই পরিমাণ ভালোবাসা আসে কোথা থেকে? যেখানে নামীদামি আর্টিস্ট বা প্রচারের রমরমা নেই! এইসব প্রান্তিক মানুষেরা অনামী দলগুলোর নাটক দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন কীসের টানে?
পরমহংসদেব যে বলেছিলেন, “থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়”, তার সার্থক রূপ বোধহয় একেই বলে। তথাকথিত পুঁথিগত পণ্ডিতি উবে যায় এসব টাটকা, সতেজ, ভেজালহীন হৃদয় থেকে উৎসারিত খাঁটি ভালোবাসার কাছে। মনে মনে সেদিন প্রণাম জানিয়েছিলাম ওই নারীকে। এই অভাবতাড়িত মানুষজন নিশ্চয়ই এমন কিছু পাচ্ছেন এসব থিয়েটার থেকে, যার জন্যে সবকিছু ভুলে তাঁরা এত সংখ্যক ভিড় জমাচ্ছেন নাটক দেখতে। কী পান তাঁরা? নিছক বিনোদন? নাকি আরও বেশি কিছু? যা-ই তাঁরা পেয়ে থাকুন, তাঁদের মঞ্চের সামনে এইভাবে কাতারে কাতারে জড়ো করা এবং ভালোবাসা পাওয়া, এটাই বোধহয় মফস্সলের থিয়েটার দলগুলোর সবচেয়ে বড় জয়!
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Needpix,
জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।