Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

প্রবাসীর নকশা: পর্ব ১০

সিদ্ধার্থ দে

জানুয়ারি ১৮, ২০২৩

Experience in Libya
Experience in Libya
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close
আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] []

লিবিয়ার কিছু টুকরো স্মৃতি

আমাদের ইস্কুলে ইংরেজি বাংলা অঙ্ক বিজ্ঞানে দুর্ধর্ষ সব মাস্টারমশায় পেয়েছিলাম। কিন্তু ইতিহাস, ভূগোল এবং অন্যান্য আর্টস বিষয়গুলি দায়সারাভাবে পড়ানো হয়েছিল। এই কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়গুলিতে কোনওরকম উত্সাহই সঞ্চারিত হয়নি স্কুলজীবনে। ডন বস্কোতে কেবল বিজ্ঞান এবং বাণিজ্য দুটি শাখা ছিল, কোনও আর্টস শাখা ছিল না— সেটাই হয়তো এই বিষয়গুলির প্রতি স্কুল প্রশাসনের বৈমাত্রেয় আচরণের সম্ভাব্য কারণ ছিল।

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরে পরেই প্রথম কয়েকমাস খুব উড়েছিলাম। মায়ের বানানো ব্রেকফাস্ট খেয়ে ব্রিফকেস হাতে গদাইলস্করি চালে শ্যামবাজার মোড়ের কাছে ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ থেকে শেয়ার ট্যাক্সি (পাঁচ সিকে ভাড়া ছিল তখন) বা মিনিবাস ধরতাম। অফিসের পর সুযোগ থাকলে প্রেমিকার সঙ্গে কিছু সময় কাটানো, বা বাড়ি ফিরে চা খেয়ে আটটা-নটা অবধি পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দেশবন্ধু পার্ক বা মোহনলাল স্ট্রিটে চ্যাটার্জিদের রোয়াকে বসে আড্ডা।

বাবা আমার জীবনযাত্রা লক্ষ করেছিলেন। একদিন হঠাৎ বললেন “দেখ, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা মানেই কিন্তু শেখার শেষ নয়। কাজ করতে করতে হাতেকলমে ইঞ্জিনিয়ারিং তো শিখবিই— কিন্তু আরও অনেক বিষয় আছে জ্ঞানার্জনের, ইকনমিক্স, ইতিহাস, রাজনীতি, বিশ্বসাহিত্য— অনেক রস আছে এই বিষয়গুলিতে। একটু নাড়াচাড়া শুরু করতে পারিস।”

বুঝতে অসুবিধা হয়নি, কথাগুলো ছিল প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের গা-আলগা জীবনযাপনের মৃদু সমালোচনা— কিছুটা ভর্ৎসনাও বটে।

Shyambazar 5 point Crossing
শ্যামবাজার মোড়ের কাছে ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ থেকে শেয়ার ট্যাক্সি বা মিনিবাস ধরতাম

একটু প্রসঙ্গান্তরে যাই। সেই খড়গপুরের দিনগুলিতে। প্রফেসরদের নিয়ে অনেক গল্প চলত। সব কলেজেই চলে অবশ্য। গপ্পোগুলির বড়জোর দশ শতাংশ সত্যি— বাকিটা অতিরঞ্জন বা জল মেশানো। যেমন বদরাগী অধ্যাপক যশপাল সিং (বছরখানেক আগে ওঁর প্রয়াণ হয়। উনি আবার আমার ফেসবুক বন্ধু ছিলেন, একটা পোস্টের পর বুঝেছিলাম একটু আধটু বাংলাও পড়তে পারেন!) নাকি একবার এক ছাত্রের বিদ্যের বহর দেখে বলে উঠেছিলেন “I will cut your balls!” আর মেকানিকালের সুরসিক অধ্যাপক ব্রজগোপাল ঘোষ মশায় নাকি এক মৌখিক পরীক্ষায় (viva) এক বিধ্বস্ত ছাত্রকে বলেছিলেন “Yes! Now I know that you know that you don’t know what you are expected to know!” সোজা বাংলায়, ছেলেটি প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে বুঝেছিল যে, তার যা জানা উচিত তার কিছুই সে জানে না।

আমার জীবনের সেই পর্যায়ে অবস্থা আরও করুণ ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বাইরের জ্ঞানভাণ্ডারটি প্রায় অজানাই ছিল। কী জানিনা, বা কী জানা উচিত সেই ধারণাটাই ছিল না। অফিস  যাওয়া-আসা, স্রোতে ভাসার দিনগুলিতে।

বাবার কথাগুলির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলাম বছর পাঁচেক পরে লিবিয়াতে গিয়ে।

***

একটা অজানা দেশে এলাম চাকরি করতে। ‘বিদেশে’ আসার আনন্দেই ডগমগ। দেশটার ভৌগোলিক এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি, আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা— কোনওকিছুর সম্বন্ধেই স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। যা জানতাম, লিবিয়া-ফেরত সহকর্মীদের মুখে শোনা। অন্ধের হাতি দেখার চেয়েও খারাপ সেই জ্ঞান।

Libya map with Old flag

অজুহাত দিতে পারি সে সময়ে ইন্টারনেট ছিল না। ছিল না গুগল। ছিল না Lonely Planet! অজুহাতটা কিছুটা সত্যি হয়তো, কিন্তু আসল সমস্যাটা ছিল জ্ঞানার্জনের স্পৃহার অভাব। দেশ ছাড়ার আগে একটু উদ্যোগ নিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল বা USIS লাইব্রেরিতে কিছু সময় ব্যয় করলে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারতাম। তথ্যগুলির প্রয়োজনীয়তাই উপলব্ধি করিনি।

শুধু প্রকৃতির শোভা দেখে, ভূমধ্যসাগরের ঢেউ-এর শব্দ শুনে, দিনার গুনে বা কারখানায় আট-দশ ঘণ্টা কাজ করে এক অদ্ভূত পরিবেশে দিন কাটানো যে কি দুঃসহ অল্প কদিনেই উপলব্ধি হল।

কদিনেই বুঝলাম একনায়কতন্ত্র ব্যাপারটা কী (এই বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে আর একটি পর্বে লিখব)। সব সময়ে একটা ভয়-ভয় ভাব। ভাষাও বুঝি না। থেকে থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার কিছু উড়ো খবর আতঙ্কটা আরও বাড়িয়ে তুলত। সবার উপরে, একটা বিজাতীয় পরিবেশ।

দীর্ঘদিন একটি অন্য দেশে অভিবাসী হিসাবে বাস করে বুঝতে পারি, দেশটির সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানুষজনের সম্পর্কে কিছুটা ধারণা জীবন কতটা সুখকর করে তোলে। যেমন সেদিন বাজারে এক প্রাক্তন শ্বেতাঙ্গ সহকর্মী এবং তাঁর স্ত্রী-র সঙ্গে মিনিট দশেক নির্ভেজাল আড্ডা দিলাম নানা বিষয়ে। লিবিয়াতে এই ব্যাপারটা অসম্ভব ছিল। একটা দেশে বাস করে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোন ছাড়, ভাবের আদানপ্রদান না করতে পারার মধ্যে একটা অসহায়তা আছে, যেটা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন।

যে কদিন ছিলাম দেশটায় কখনই স্বচ্ছন্দ হতে পারিনি। দোষটা আমারই। আর একটু অনুসন্ধিৎসু হলে থাকাটা অনেক বেশি উপভোগ করতে পারতাম হয়তো। তথ্যের অভাব বা অপ্রতুলতা যে কতটা অস্বস্তিকর, ক্ষেত্রবিশেষে ভয়াবহ হতে পারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

আজকের ঘন ঘন বিদেশে কাজ করতে যাওয়া বা স্রেফ বেড়াতে যাওয়া নবীন পাঠকদের বলব, দেশগুলিতে পা রাখার আগে অন্তত কিছুটা হোমওয়ার্ক করে যেতে। অভিজ্ঞতার ঝুলিটা অনেক সমৃদ্ধ হবে।

Libya Political unrest
থেকে থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার কিছু উড়ো খবর আতঙ্কটা আরও বাড়িয়ে তুলত

***

লিবিয়া নিয়ে অনেক কিছুই লেখার কথা মনে আসছে।

পাঠকের সুবিধার্থে দেশটির সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিচ্ছি। আয়তনের বিচারে পৃথিবীতে ১৬ নম্বর স্থানে থাকা জনবিরল দেশটির অবস্থান উত্তর আফ্রিকায়। উত্তরে ভূমধ্যসাগর। পূর্বে,পশ্চিমে ও দক্ষিণে সীমান্ত লাগোয়া ছটি দেশ। পশ্চিমের দেশগুলির একটি ২০২২ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠা মরক্কো। দেশটির দক্ষিণে সাহারা মরুভূমি। চোখে না দেখলেও গরমের দিনের তপ্ত বাতাস সেখানকার সংবাদ বয়ে আনত। আর ভূমধ্যসাগরের উত্তর প্রান্তে রহস্যময়ী ইউরোপ। 

আমাদের কারখানা ছিল Al Khums নামে ভূমধ্যসাগর ঘেঁষা একটি ছোট শহরে। শহরটির ইতিহাস তিন হাজার বছরের পুরনো।

৫৬৭৮ আমার ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়ালেই সুনীল ভূমধ্যসাগর বড় জোর একশ গজ দূরত্বে। ফ্ল্যাটটি একটা কমপ্লেক্সের অন্তর্গত ছিল। যতদূর মনে আছে চারটি লাগোয়া বাড়ি ছিল। তার মধ্যে একটিতে আমাদের কোম্পানির কয়েকজন, পাশে কিছু সপরিবার রাশিয়ান মিলিটারি অফিসার, আর বাকি দুটিতে স্থানীয় মানুষ। বাজার ছিল সমুদ্রের ধার ঘেঁষে মিনিট দশেকের হাঁটাপথে।

রাশিয়ানদের সঙ্গে ভাষার সমস্যার জন্য কথা বলা যেত না, তবে যেতে আসতে হাসি বিনিময় হত। একজন রীতিমতো সুদর্শন ছিলেন। মহিলারা তাঁর নাম দিয়েছিল জন কেনেডি। রাশিয়ান বৌগুলো মাঝে মাঝে বেলাভূমিতে রোদ পোহাতো। সেই প্রথম সিনেমার পর্দার বাইরে বিকিনি পরিহিতা মহিলা দেখা আমাদের। ফুটফুটে বাচ্চাগুলো ফ্ল্যাটের আশপাশে মনের আনন্দে কাদা মাখত। বুঝলাম শ্বেতাঙ্গরা বাচ্চাদের অনেক বেশী স্বাধীনতা দেয় মাটির সঙ্গে সখ্যতা করার।

***

দিনের আট ঘণ্টা কাটত আবাসন থেকে মাইল দশেক দূর এক সিমেন্ট কারখানায়। কর্মজীবনের প্রথম ৪ বছর ডিজাইন অফিসে কাজ করেছিলাম। এই কারখানার কাজ সম্পূর্ণ অন্যরকম। 

Roman Ruins - Libya
শহরটির ইতিহাস তিন হাজার বছরের পুরনো

তবে কর্মজীবনের বাইরেও তো একটা জীবন থাকে। স্মৃতি হাতড়ে সেই দিনগুলোর কিছু কাহিনি শোনাব।

পৃথিবীর অসভ্য দেশগুলোতে মস্তানদের রমরমা। প্রশাসন জেনেও চোখ বন্ধ করে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলির নেতাদের সমর্থনপুষ্ট মস্তানদের গল্প বর্তমান পশ্চিমবঙ্গবাসীদের বলাটা কিছুটা মায়ের কাছে মাসির গল্প শোনানোর মতো যদিও।

লিবিয়াতে ইঞ্জিনিয়ারদের এবং অন্যান্য কিছু অফিসারদের থাকার ব্যবস্থা দুটি জায়গায় ছিল। খোম্স আর সুক-আল-খামিস নামে দুটি পাড়ায়। আমার ফ্ল্যাট ছিল খোম্স-এ। ভারি সুন্দর ছিল ফ্ল্যাটগুলো। দুটি মানুষের পক্ষে যথেষ্ট বড়। আগেও বলেছি, সামনেই অনেক ইতিহাসে ঘেরা ভূমধ্যসাগর। প্রখ্যাত ফরাসি ইতিহাসবিদ ফার্নান্ড ব্রডেলের এক বিখ্যাত গ্রন্থের মুখ্য চরিত্র ছিল এই ভূমধ্যসাগর। এই সাগরের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে আপন ছন্দে ইতিহাস বয়ে গেছে হাজার তিনেক বছর ধরে।

শ্বেতাঙ্গদের যে আরবরা অন্য চোখে দেখে বুঝতে বিশেষ দেরি হয়নি। বেলাভূমিতে হ্রস্বতম বিকিনি পরিহিতা প্রতিবেশী রাশিয়ান মিলিটারি অফিসারদের স্ত্রীরা রোদ পোহাতেন। কাউকে বিরক্ত করতে দেখিনি। আমরা একদিন বিচে ফুটবল খেলছি— এক মস্তান এসে বলটা কেড়ে নিয়ে চলে গেল। 

ভাষা না বুঝলেও আন্দাজ করতাম আমাদের স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে অঞ্চলের কিছু বখাটে ছোঁড়া অশালীন মন্তব্য করছে। সবচেয়ে অস্বস্তিকর ছিল মাঝেমধ্যে আমাদের লক্ষ করে পাথর ছোড়া। এই দলের নেতা ছিল বছর চোদ্দ পনেরোর একটি লিবিয়ান ছেলে। এমনভাবে ছুড়ত যেন কারোর গায়ে না লাগে। অন্তত দু তিন হাত পাশ দিয়ে মিসাইলগুলো নিক্ষিপ্ত হত। কেউ আহত না হলেও ব্যাপারটা রীতিমত ভয়াবহ ছিল।

একদিন এই পাথর ছোড়া খেলা চলছে। সৌভাগ্যবশত (আমাদের জন্য) সেই সময়ে আবাসনে হেঁটে ঢুকছিলেন সেই পূর্বোক্ত সিনেমা নায়কোচিত চেহারার ‘কেনেডি’। একটি টুকরো তাঁর গায়ে গিয়ে লাগে। 

এর পরের ঘটনা চমকপ্রদ। আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম না, কয়েকজন প্রতিবেশী সহকর্মীর কাছে শোনা। কেনেডি অতি ক্ষিপ্রগতিতে ধাওয়া করে সেই পলায়মান ছোঁড়াকে পাকড়াও করেন, এবং অবলীলাক্রমে মাথার উপর তুলে কয়েক পাক শটপাটের মতো ঘুরিয়ে মাটিতে আছাড় মারেন।

বলাই বাহুল্য, আর কখনও আমাদের উদ্দেশ্যে পাথর ছোড়া হয়নি।

Libya beach
সামনেই অনেক ইতিহাসে ঘেরা ভূমধ্যসাগর

মানুষ বরাবরই শক্তের ভক্ত। নানা দেশে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। অনেক বড় কোম্পানির সফল CEO-ই শুনেছি Schoolyard bully ছিলেন। 

***

পরবর্তীকালে কেমন ছিল জানি না। তবে সেই ৮৩ সালে লিবিয়াতে দৈনন্দিন জীবন ছিল বেশ অন্যরকম, বিশেষ করে বাজারহাটের রকম সকম।

বাজারের আমেজটা ছিল আরব্য উপন্যাসের ছবির মতো। তখনও অবধি মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ পড়া হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে পড়ার সময়ে লিবিয়ার এই বাজারের ছবিটা কিছুটা চোখে ভেসে উঠত। কাঁচা সবজি, মাংস বিক্রেতারা সাধারণত বয়স্ক আরব মানুষ— পরিচিত জোব্বা পরা। ভাষার অসুবিধার জন্য কথাবার্তা হত না, তবে মেঠো মানুষগুলি ছিল মোটামুটি হাসিখুশি, আচরণ বন্ধুত্বপূর্ণ। দাম বুঝতে পারতাম না বলে একটু বেশি দিতাম, দোকানি হিসেব করে খুচরো ফেরত দিত (ভাষা না বুঝলেও সংখ্যাগুলি সে সময়ে মৌখিকভাবে জানতাম। একটা সংখ্যা নিয়ে আমাদের হাসাহাসি চলত— ৫৫, আরবিতে যা হল খামসা-খামসি, যা অপভ্রংশে হয়ে দাঁড়িয়েছিল খামচা-খামচি!)। যে কারণেই হোক, হয়তো শাস্তির ভয়ে, মানুষজন সৎ ছিল। কখনও ঠকেছি বলে মনে হয়নি। কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্যের, সৌহার্দ বিনিময়ের  আরবি শব্দ শিখেছিলাম। এখন আর মনে নেই সেসব কথাগুলি বিশেষ। কেনাকাটি হলে ‘সুখরান’ (ধন্যবাদ) বলাটা আদব ছিল।

অনেক অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যসামগ্রীই, বিশেষ করে Processed food আসত বিদেশ থেকে। খুবই ভালো মানের সবকিছুই। সব সময়ে আবার সব কিছু পাওয়া যেত না। হঠাৎ একদিন খবর পাওয়া যেত অমুক জিনিসটা (উদাহরণ- মাখন বা গুঁড়োদুধ) সুপার মার্কেটে (স্থানীয় নাম ছিল ‘জামারিয়া’) এসেছে। মানুষ পাগলের মত ছুটত বস্তুটা সংগ্রহ করতে। কারণ পরে আবার কবে জিনিসটা পাওয়া যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

আমাদের ফ্ল্যাটের বাড়তি ঘরটা ছিল আদতে ভাঁড়ার ঘর। টিন টিন গুঁড়ো দুধ মজুত ছিল মনে আছে। এছাড়া বিস্কুট, ময়দা, চাল, রান্নার তেল। ফ্রিজে ঠাসা মাখনের প্যাকেট।

মাঝে মাঝে আমরা ছুটির দিনে অফিসের গাড়ি নিয়ে ঘণ্টা দেড়েকের দূরত্বে ত্রিপোলিতে ঘুরতে যেতাম। দোকানপাটও করতাম। একবার একটা ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দোকানে ঢুকেছি একটা টু ইন ওয়ান কিনব বলে। একটা সেট পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু আশ্চর্য হলাম যখন দোকানি আমাকে অতি অভদ্রভাবে দেহভঙ্গিমায় জানাল যে সে আমাকে জিনিসটা বিক্রি করবে না। ভাষা বুঝিনি, তবে আন্দাজ করেছি কী বলছে।

অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেছিলাম। ঐ মনোরঞ্জনহীন দেশে একটি গানের যন্ত্র মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাই পছন্দের সেটটি কিনতে না পেরে খুব হতাশ লাগছিল।

ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি হতভম্ব পাঠককে। আমরা বিদেশি কর্মীরা মাইনে পেতাম দিনারে। অনেক দিনারই জমত। দেশে যাওয়ার সময়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে দিনারগুলি ভাঙিয়ে ডলার draft বানাতে হত। মাইনের পুরো টাকাটা অবশ্য নিয়ে যাওয়া যেত না। যতদূর মনে আছে ৮০ বা ৯০ শতাংশ যেত। এই গানের যন্ত্রগুলি লিবিয়ান সরকার ডলারে আমদানি করত। বিদেশিদের এইসব জিনিস কেনা এবং দেশে যাওয়ার সময় নিয়ে যাওয়া মানে কিছুটা চোরাপথে নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি ডলার দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া। সেইজন্যই এই নিষেধাজ্ঞা।

দোকানের বাইরে দেবদূতের মতো দেখতে এক তরুণ আমাকে চোখের ইশারায় জানালো কিছু বলতে চায়। লিবিয়ান যুবক যুবতীরা অনেকেই খুব সুন্দর দেখতে, যেন পূর্ব-পশ্চিমের মেলবন্ধনে গড়া। ওকে অনুসরণ করে একটু দূরে গেলাম। আমারই বয়সী ছেলেটি মোটামুটি ইংরেজি বলতে পারে— যেটা বেশ বিরল ছিল। আমাকে বলল, আমার হেনস্তা দেখে ওর খুব খারাপ লেগেছে। প্রস্তাব দিল আমি যদি চাই সে আমার হয়ে সেটটি কিনে আনতে পারে।

হাতে যেত চাঁদ পেলাম। কয়েক মিনিট বাদে রুপোলি রঙের আকাই কোম্পানির সুদৃশ্য সেটটি আমার হাতে এল। অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম ছেলেটিকে।

***

২৫শে জুন ১৯৮৩। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেট দল তৃতীয় বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলছে প্রথম দুবারের বিজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে।

তখন তো আর রাতে খেলা হত না, লন্ডনের সঙ্গে সময়ের পার্থক্যের জন্য খেলা শুরু হয়েছিল দুপুর বারোটা নাগাদ। সেই ‘আকাই’ সেটটা না থাকলে সেদিনের সেই শিহরণটা পেতাম না। খোম্স-এ সেদিন আবহাওয়া ভাল ছিল না— মেঘলা, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমের লর্ডস মাঠ থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ধারাবিবরণী কোনওরকমে শোনা যাচ্ছিল, প্রায় সেটে কান রেখে।

ভারত মাত্র ১৮৩ রানে আউট হয়ে গেলেও প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৪০ রানে গুঁড়িয়ে দিয়ে ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে জাতীয় পতাকা ওড়ালেন কপিল দেব। আমার তখনকার আঠাশ বছরের জীবনে খেলাধূলায় ভারতের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

সেদিন সন্ধ্যায় মনটা বড় ফুরফুরে লেগেছিল। সেই বুড়োকে স্মরণ করতে হল “রোজ কত কিছু ঘটে যাহা তাহা, এমন কেন সত্যি হয় না আহা!” অমর্ত্যবাবু নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর ওঁর বিবাহবিচ্ছিন্না স্ত্রী নবনীতাও এই কথাই বলেছিলেন।

 
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Flickr, Picryl

Author Siddhartha Dey

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

Picture of সিদ্ধার্থ দে

সিদ্ধার্থ দে

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।
Picture of সিদ্ধার্থ দে

সিদ্ধার্থ দে

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com