বাংলায় প্রথম আত্মজীবনী লেখিকা রাসসুন্দরী দেবী, আক্ষরিক অর্থেই তিনি বাংলার প্রথম স্বসাক্ষরা নারী। সকলের অগোচরে, কোনও প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়াই শুধু অক্ষর পরিচয়ই নয়, নিজে নিজে পুঁথি পাঠ করতে শিখেছিলেন। পরবর্তীকালে লিখতে শিখে লিখেছিলেন আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’।
বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬৮ সালে, তাঁর উনষাট বছর বয়সে এবং দ্বিতীয় খণ্ডটি শেষ করেন তাঁর অষ্টআশি বছর বয়সে। আর প্রথম পড়তে শিখেছিলেন কবে? তাঁর ভাষায় “পঁচিশ বছর বয়সে প্রথম গোঙাইয়া চৈতন্য ভাগবত পড়িতে শিখিলাম”। তাঁর আত্মজীবনী রচনা যেন ঘোরতর সংসারী এক নারীর অতিবাস্তব অথচ প্রায় অলৌকিক এক যাত্রাপথ।

১৮০৯ সালে রাসসুন্দরীর জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার পোতাজিয়া গ্রামের এক জমিদার পরিবারে। বাবা পদ্মলোচন রায় রাসসুন্দরীর শৈশবেই প্রয়াত হন। পিতৃহীন মেয়েটিকে সুরক্ষিত রাখতে তাঁর মা তাঁকে প্রায় পাখির ছানার মতো আগলে বাইরের জগৎ থেকে দূরে রাখতে চাইতেন। তাঁদের বাড়ির বাইরের অংশে (বাহির বাড়িতে) ছেলেদের একটা পাঠশালা বসত। সেখানেই শান্ত ভীরু লাজুক সরল রাসসুন্দরীকে তাঁর মা বসিয়ে রাখতেন। কেউ জানতে পারেনি, সেই অল্প বয়সে শুধু শ্রবণের মাধ্যমেই তাঁর মস্তিষ্কে স্থান করে নিয়েছিল বিভিন্ন অক্ষর।
এ প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন: “তখন ছেলেরা ক খ চৌত্রিশ অক্ষরের (বর্ণমালা) মাটিতে লিখিত, পরে এক নড়ি হাতে লইয়া ঐ সকল লেখা উচ্চৈঃস্বরে পড়িত। আমি সকল সময়ই থাকিতাম। আমি মনে মনে ঐ সকল পড়াই শিখিলাম।”
মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ লেখাপড়ার কিছুটা তিনি যে ‘মনে মনে’ শিখছেন, তা কেউ জানতে পারেনি। জানতে পারলে হয়তো বিধবা হওয়ার ভয়ে পাঠশালার কোণে বসে থাকা বন্ধ হয়ে যেত। ভয় কাটিয়ে নির্ভয় হওয়ার প্রথম দিশা রাসসুন্দরী পেলেন তাঁর মায়ের কাছেই। মা-ই শেখালেন যেকোনও বিপদে দেবতা ‘দয়ামাধব’কে আশ্রয় করা, সম্পূর্ণ নির্ভর করা। এই শিক্ষা তাঁকে আজীবন রক্ষা করেছে। ঈশ্বরে অচলা ভক্তি, সার্বিক আত্মসমর্পণ এবং তাঁর এই নিজস্ব বিশ্বাসের জন্য রাসসুন্দরী জীবনের সুখ-দুঃখ, সংকট সব কিছুকে স্বাভাবিক স্থৈর্যে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন।

পাখির ছানার মতো সুরক্ষার বলয়ে আগলে রাখা রাসসুন্দরীকে হয়তো সেই কারণেই বারো বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়, যা সে যুগের মেয়েদের বিবাহের পক্ষে অনেকটাই বেশি বয়স। রাসসুন্দরীর বিয়ে হল বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার প্রত্যন্ত রামদিয়া গ্রামের জমিদার সীতানাথ সরকারের সঙ্গে। তাঁরও বাবা তখন প্রয়াত। তিনটি বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, যারা পরে বিধবা হওয়ার পর পিতৃগৃহেই অবশিষ্ট জীবন কাটাবেন। বিবাহের পর ক্রন্দনরতা রাসসুন্দরীকে মায়ের মতোই কোলে টেনে নেন তাঁর স্নেহশীলা এবং কর্মঠ শাশুড়ি। সংসারের সব কাজ তিনিই করতেন, রাসসুন্দরী তৈরি করতেন শৌখিন অন্দরসজ্জা সামগ্রী ও অন্যান্য শিল্পকর্ম। রাসসুন্দরী শাশুড়িকে, এই সংসারকে ভালোবাসলেন। ‘আমার জীবন’-এ তিনি লিখলেন “কোন গাছের বাকল কোথায় লাগিল!” মেয়েদের বিবাহোত্তর জীবনে এটাই তো পরম সত্য। বারো বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর আরও ছ’বছর তিনি শুধুই আদরিণী নতুন বৌ। তবুও উদয়াস্ত পরিশ্রম করে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন “…কোন কর্ম করিলে লোকে ভালো বলিবে”! এরপর সান্নিপাতিক জ্বরে শাশুড়ি দৃষ্টিহীন হয়ে পড়লে শুরু হল প্রতিদিন দুবেলা ২৫/২৬ জনের রান্না (তাও ভাগে ভাগে), ঠাকুরের সেবা, শাশুড়ির দেখাশোনা। প্রথম সন্তানের জন্ম আঠেরো বছর বয়সে, তারপর একচল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মোট বারোটি সন্তানের জন্মদান। এদের মধ্যে সাতটি সন্তান তাঁর জীবিতকালেই প্রয়াত।
কর্তা (স্বামী)-কে এতটাই সমীহ করতেন যে কর্তার ঘোড়া জয়হরি একবার সামনে এসে পড়ায় তিনি সভয়ে লুকিয়ে পড়েছিলেন। পরে উপলব্ধি করলেন “এটা ভয় নয়, লজ্জা এবং মনুষ্যেতর একটি জীবকে লজ্জা করা মানুষের অনুচিত।”
বিবাহের পর ক্রন্দনরতা রাসসুন্দরীকে মায়ের মতোই কোলে টেনে নেন তাঁর স্নেহশীলা এবং কর্মঠ শাশুড়ি। সংসারের সব কাজ তিনিই করতেন, রাসসুন্দরী তৈরি করতেন শৌখিন অন্দরসজ্জা সামগ্রী ও অন্যান্য শিল্পকর্ম। রাসসুন্দরী শাশুড়িকে, এই সংসারকে ভালোবাসলেন। ‘আমার জীবন’-এ তিনি লিখলেন “কোন গাছের বাকল কোথায় লাগিল!” মেয়েদের বিবাহোত্তর জীবনে এটাই তো পরম সত্য।
এহেন ভীরু, লাজুক রাসসুন্দরী নিত্যনৈমিত্তিক উদয়াস্ত পরিশ্রমের পরও একটি গোপন অদম্য ইচ্ছা লালন করতেন, বই পড়ার ইচ্ছে। এমনকি স্বপ্নেও দেখেন যে তিনি তাঁর ঈশ্বরের পুঁথি চৈতন্য ভাগবত পড়ছেন। কিন্তু তাঁর তো অক্ষর পরিচয়ই নেই! তাছাড়া সারাদিনে সময় কোথায়? সারাদিন, এমনকি অনেক রাত অবধি রান্নাবান্নার পাট, তারপরও কি আর অবকাশ মেলে? “তখন তো ছেলেপুলের জেগে ওঠার পালা। তখন কেহ বলে ‘মা মুতিব,’ কেহ বলে ‘মা ক্ষিদে পেয়েছে’, কেহ বলে ‘মা কোলে নে’, কেহ বা জাগিয়া কান্না আরম্ভ করে। তখন তো ঐ সকলকে সান্ত্বনা করিতে হয়। ইহার পরে রাত্রিও অধিক হয়, নিদ্রা আসিয়া চাপে, তখন লেখাপড়া করিবার আর সময় থাকে না… সুতরাং ঐ লেখা পাতাটি আমি কেমন করিয়া পড়িব? …অধিকন্তু কেহ দেখিবে বলিয়া সর্বদাই ভয়।” কিন্তু রান্নাঘরে ওই দেড়হাত ঘোমটা ঢাকা মোটা শাড়ি পরা অবস্থানই তাঁর কাছে সুযোগ হয়ে দেখা দিল। ঐ ঘোমটার আড়ালেই রাখলেন লুকিয়ে সংগ্রহ করা স্বামীর চৈতন্য ভাগবত পুঁথির একটি পাতা, ছেলের অ আ ক খ মকশো করার একটি তালপাতা আর ছোটবেলার স্মৃতিতে ধরে রাখা অ আ ক খ উচ্চারণ। কিন্তু সেও তো এগারো বারো তেরো বছর বয়সের স্মৃতি। সেই স্মৃতির পাতাটি তিনি পুঁথির পাতা আর ছেলের তালপাতার পাশাপাশি রাখার চেষ্টা করেন, চারপাশের লোকজনের কথাবার্তার সঙ্গে মেলান। তাঁর কথায় “ঐ তালপাতাটি (ছেলের) একবার দেখি, আবার ঐ পুস্তকের পাতাটিও দেখি, আর আমার মনের অক্ষরের সঙ্গে যোগ করিয়া দেখি, আবার সকল লোকের কথার সঙ্গে মিলাইয়া মিলাইয়া দেখি”… এই অনুশীলন চলত মনে মনে, সারাদিন ধরে। তিনি লিখছেন “আমি অনেক দিবসে, অনেক পরিশ্রমে, অনেক যত্নে এবং অনেক কষ্ট করিয়া ঐ চৈতন্যভাগবত পুস্তকখানি গোঙ্গাইয়া পড়িতে শিখিলাম।”

রাসসুন্দরী পড়তে শিখলেন কিন্তু তা গোপন রাখতে হল। তাঁর ধারণা পিতৃগৃহে থাকা তাঁর তিন বিধবা ননদিনী পুঁথি পড়ার কথা জানতে পারলে রক্ষা থাকবে না
তিনি ননদিনীদের বৃথাই ভুল বুঝেছিলেন। তাঁরা রাসসুন্দরীর পড়তে শেখার খবর পেয়ে ভারী আহ্লাদিত হলেন। একে একে রাসসুন্দরী তাঁর বাড়ির সব পুঁথি নির্ভয়ে পড়ে ফেললেন। চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত আঠারো পর্ব জৈমিনি ভারত, গোবিন্দলীলামৃত, বিদগ্ধমাধব, প্রেমভক্তি চন্দ্রিকা, বাল্মিকী পুরাণ (শুধু আদিকাণ্ড)। এখন তিনি পুঁথি পাঠে দক্ষ। কিন্তু এখনও শেখেননি লিখতে। লিখতে না পারলে কী করে লিখবেন ‘আমার জীবন’, বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম আত্মজীবনী।
আরও পড়ুন: মেয়েদের পাহাড় চড়ার সেকাল একাল
আবার তিনি পরমেশ্বরের শরণাপন্ন। “তুমি আমাকে লিখিতে শিখাও।” ছেলেমেয়েরা এখন জানে মা পড়তে শিখেছেন ফলে কলকাতায় পাঠরত পুত্র কিশোরীলাল মাকে পত্র লেখে। আশা করি মা পত্রের উত্তর দেবেন। তাই মায়ের কাছে রেখে যায় লেখার সরঞ্জাম— কাগজ, কলম, দোয়াত, কালি। পড়তে শিখেছেন জ্বলন্ত উনুনে রান্না চড়িয়ে ঘোমটার আড়ালে পুঁথি লুকিয়ে। লেখা তো রান্না করতে করতে হবে না। কাগজ, কলম, দোয়াত রাখার জায়গা দরকার, লিখতে শেখার ও লেখার অবকাশ দরকার। “আমি একে তো মেয়ে, তাহাতে বউ মানুষ, মেয়েমানুষকে লেখাপড়া শিখিতেই নাই। এটি স্ত্রীজাতির পক্ষে প্রধান দোষ বলিয়া সকলে সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছেন। সে স্থলে আমি এ প্রকার সাজিয়া লিখিতে বসিলে লোকে আমাকে দেখিয়া কি বলিবে।” কিন্তু সুযোগ এল অন্যভাবে। তাঁর স্বামীর চোখের চিকিৎসা করাতে দুজনে গেলেন পঞ্চম পুত্র দ্বারকানাথের কর্মস্থলে। সেখানে সাংসারিক কাজ কম থাকায় তিনি লিখতে শিখলেন, হলেন যথার্থ জিতাক্ষর। শুধু শিখলেনই না, লিখলেন আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’। তাঁর অষ্টআশি বছর বয়সে দ্বিতীয় ও শেষ খণ্ড প্রকাশের সময় তিনি লিখছেন “১২১৬ সালে চৈত্র মাসে আমার জন্ম হইয়াছে, আর এই বহি ১২৭৫ সালে যখন প্রথম ছাপা হয় তখন আমার বয়ঃক্রম উনাষাইট বৎসর ছিল। এই ১৩০৪ সালে আমার বয়স অষ্টাশী বছর।” প্রথমে ১২৭৫-এ লিখেছিলেন ১৬ টি রচনা সমৃদ্ধ প্রথম খণ্ড, ১৩০৪ বঙ্গাব্দে দ্বিতীয় খণ্ড সমাপ্ত হয়। রাসসুন্দরী প্রয়াত হন ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে।
তিনি ননদিনীদের বৃথাই ভুল বুঝেছিলেন। তাঁরা রাসসুন্দরীর পড়তে শেখার খবর পেয়ে ভারী আহ্লাদিত হলেন। একে একে রাসসুন্দরী তাঁর বাড়ির সব পুঁথি নির্ভয়ে পড়ে ফেললেন। চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত আঠারো পর্ব জৈমিনি ভারত, গোবিন্দলীলামৃত, বিদগ্ধমাধব, প্রেমভক্তি চন্দ্রিকা, বাল্মিকী পুরাণ (শুধু আদিকাণ্ড)।
তাঁর কথায়—
আমার সেকালেতে মেয়েছেলেদের লেখাপড়া শিক্ষা করা নিয়ম ছিল না মেয়েছেলে লেখাপড়া করিলে বড় দোষ। মেয়েছেলে লেখা শিখিলে সর্বনাশ হয়, মেয়েছেলের কাগজ কলম হাতে করিতে নাই।” কোনো সমাজ সংস্কারকের কাছে শেখা নয়, এ তাঁর নিজের উচ্চারণ।
রাসসুন্দরী আপন অন্তরের অনির্বাণ শিখাটি সম্বল করে একাকী স্বশিক্ষার পথ খনন করেছেন। শিক্ষালাভ, অক্ষর পরিচয়ে বঞ্চিত অসহায় মেয়েদের কথা অকপটে লিখেছেন তার আত্মজীবনীতে। জিতাক্ষরা স্বশিক্ষিত রাসসুন্দরীর “আমার জীবন” মেয়েদের শিক্ষার সূচনাপর্বের এক অসাধারণ দলিল।
ছবি সৌজন্য: The Indian Express, Wikisource,
ড. সুমিত্রা চৌধুরী বিজ্ঞানমনস্ক ও শিক্ষাব্রতী মানুষ। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা, প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। কর্মজীবনে ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলেছেন। এছাড়া বর্তমানে তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি এবং প্রফেশন অসীমা চ্যাটার্জি ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি। বোর্ড মেম্বার হিসাবে যুক্ত আছেন আরও একাধিক বিজ্ঞান সংস্থার সঙ্গে...