লাভ অ্যাট ফার্স্ট বাইট
ছোট শহরে জন্ম, বড় হওয়া আমি, আমাদের সেই সব খাবারের সঙ্গে খুব একটা পরিচয় ছিল না যা কিনা বিশ্বভ্রমণ করে আর পৌঁছে যায় রসিকের অন্দরমহলে। সেই সময় বা হয়তো তারও আরও অনেক আগে থেকেই হালিম লোকপ্রিয় হতে শুরু করেছিল, পৌঁছে গিয়েছিল খাদ্যরসিকের ঘরে ঘরে, শুধু আমার সঙ্গেই তার পরিচয় হওয়া বাকি ছিল।
৮০র দশকের গোড়ার দিক। ঢাকা। রোজার মাস। একদিন বিকেলবেলা খোকনকাকা মেটে হাঁড়িতে করে একটা খাবার নিয়ে এল, যেমন হাঁড়িতে আসে মরণচাঁদের দই। মোটা কাগজ দিয়ে হাঁড়ির মুখ ঢাকা, রানিরঙা সরু ফিতে দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আঁট করে বাঁধা সেই হাঁড়ির মুখ। খড় দিয়ে পাকানো বিড়ের উপর বসানো সেই হাঁড়ি আর ফিতের ফাঁস আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে হাঁড়ির সঙ্গে বিড়েকে।
মিষ্টি দই ভেবে হাঁড়ি খুলতে গিয়ে আগুন গরম ছোঁয়া পেলাম হাতে। দই তো গরম হওয়ার কথা নয়! মুখঢাকা হাঁড়ি থেকেই একটা গন্ধ আসছিল, ধনেপাতা-কাঁচামরিচের টাটকা সুবাসের সঙ্গে মোগলাই খাবারের মিশ্র গন্ধ! কাকা বলল, এখন খুলিস না, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, ইফতারে দিস। কী আছে জানতে চাইলে বলল, ‘হালিম’। ঢাকা খুললে দেখা গেল, থকথকে ঘন এক ডাল, যার উপর মোটা তেলের আস্তরণ আর সেই তেলের উপর ছড়ানো আছে এন্তার বেরেস্তা আর ধনেপাতা-কাঁচামরিচের মিহি কুচি। সুগন্ধে ভুরভুর করতে লাগল গোটা বাড়ি। খেতে গিয়ে দেখা গেলে মিশ্র সেই ঘন ডালের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে খণ্ড খণ্ড খাসির মাংস যা কিনা সুসিদ্ধ কিন্তু ভেঙে যায়নি একটুও। কাকা বলল, আরবি খানা, রমজান স্পেশাল খানা। রোজার মাসে সারা পৃথিবীর মানুষ খায়।

সেদিন আমি প্রথম দেখেছিলাম হালিম, স্বাদ নিয়েছিলাম তার। সমস্ত দিনের উপবাসভঙ্গের পর এ এক আদর্শ খাবার যাতে অপূর্ব স্বাদের সঙ্গে রয়েছে ভরপুর খাদ্যগুণ। এর পর প্রতিদিনই সন্ধেয় বাড়িতে আসতে লাগল মেটে হাঁড়িতে রানিরঙা ফিতেয় বাঁধা এক হাঁড়ি করে আগুনগরম হালিম।
হালিম বিচার
কলকাতায় হালিমের সঙ্গে প্রথম দেখা পার্ক সার্কাস ময়দানের বাইরে। ট্রলিতে করে লাল শালুতে ঢাকা হাঁড়ি আর তাতে গরম গরম ভাপ ওড়া হালিম। ছোট প্লাস্টিকের বাটিতে করে দোকানি পরিবেশন করেন হালিম, উপরে ছড়িয়ে দেন ধনেপাতা-কাঁচামরিচের কুচি আর ছোট্ট এক টুকরো লেবু। এই হালিম একেবারেই অন্যরকম। এর স্বাদ- গন্ধ ভিন্নতর। ছাঁট মাংস দিয়ে তৈরি এই হালিম অনেক বেশি তরল।হালের ফ্যাশান হয়েছে তাকে দালিম বলে ডাকার। ব্লক আর সোশ্যাল মিডিয়া উপচে পড়ছে, কার আলিম আর দালিম সেই বিচারে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যাকে অমর করে দিয়েছেন সেই কলকাতার দিনরাত্রির ‘রেগান জুস’ এদের ডালতুতো জ্ঞাতি। পাওয়া যায় অধুনা লুপ্ত ‘দ্য স্টেটসম্যান’ অফিসের গাঁ ঘেঁষে।
আরসালান নামের চেন রেস্তোরাঁর সে ছিল শুরুর দিন। তখন কোনও চেন ছিল না। পার্ক সার্কাস মোড়ে পুরনো দোকান। সার্বক্ষণিক ভিড় সেথায়। আমার পছন্দ ছিল জিশান। ঈদের কেনাকাটা সেরে সন্ধেবেলায় সেখানে পৌছে গিয়ে হালিম নিয়ে বসলে ইফতারের অন্য উপকরণ এমনিই দিতেন তাঁরা। পয়সা দিতে চাইলেও নিতেন না।
রোজার মাসে একটা প্রথা চলে প্রতিবেশীদের খাওয়ানোর, ইফতার পাঠানোর। রেকাবি ভরে বিভিন্ন রকম ফল, ভাজাভুজি, পিঠেপুলি, মিষ্টি আর ভাঁড়ে করে হালিম আসে প্রতিবেশীর ঘর থেকে। মুসলমান প্রধান ফ্ল্যাটবাড়ি হলে প্রতিদিনই কোনও না কোনও প্রতিবেশী ইফতার পাঠান, এভাবেই ইফতার যায় আত্মীয়-কুটুম্ববাড়ি, মসজিদ, এতিমখানা ও অন্যান্য জায়গায়।

এই ইফতারের সঙ্গেই এক প্রতিবেশী পাঠান জ্যাকারিয়া স্ট্রিটের সুফিয়ার হালিম। আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও ভোরবেলায় গিয়ে লাইন দিয়ে টোকেন নিতে হত হালিমের। ভোরে গিয়ে টোকেন নেওয়া, বিকেলে গিয়ে ভাপ ওড়া গরম হালিম নিয়ে আসা। আমার তখনকার আবাস মারকুস লেন থেকে জ্যাকারিয়া স্ট্রিটের নাখোদা মসজিদের দূরত্ব কম নয় আর স্যুইগি, জোম্যাটো আসবে তারও আরও বছর কুড়ি বাদে কিন্তু রসিকজন কবে আর দূরত্বের পরোয়া করেছেন।
রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড থেকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট যেতে হাতের বাঁদিকে এক ছোট্ট দোকান খোলে, যার নাম দাওয়াত। রোল, কাবাব, রুটি-পরোটা দিয়ে দোকান শুরু হয় আর রমজানে থাকে হালিম। মাটন হালিম। কদাচিৎ আমি নিয়ে আসি সেই হালিম। এই হালিমও তরল। ছাঁট মাংস। রমজানে লাইন পড়ে হালিমের। দোকান বড় হয়। দোকানের কৌলিন্যে তার ডালের সুরুয়া ‘হালিম’ থাকে ব্লগার-রসিকদের কাছে। মশলার সুক্ষ্ম তারতম্য ধরার কায়দা তাদের জানা নেই। এখন বাজারে কিনতে পাওয়া যায় প্যাকেট জাত হালিম মিক্স মশলা। গঙ্গা আর পদ্মার ইলিশের তারতম্য বোঝা যেমন দুরূহ তেমন হালিমের মতো সংস্কৃতিতে নতুন আমদানি হওয়া স্বাদচেতনা বোঝা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে যুধিষ্ঠির দত্তদের উত্তরসূরিদের দৌলতে। সবই এখন ইনস্ট্যান্ট আর রেডিমিক্স। কাজেই কে সেরা নিউ আলিয়া না সুফিয়া সেসব নিয়ে তর্ক করা বাতুলতা।
পছন্দের খাবার কিনে খাওয়া খুব বেশিদিন পোষাল না। উপায়? তখন ইউটিউবেরও যুগ নয় যে একটা ক্লিক করলাম আর ১০রকম রন্ধনপ্রণালী হাজির হল হাতের মুঠোয়। হয়তো ইউটিউব ছিল কিন্তু তার আ্যকসেস এত সহজলভ্য ছিল না। হাতের কাছে কোনও রেসিপি নেই তাই বলে কি রান্না হবে না! খাবারের স্বাদ-গন্ধ বলে দেয় কোন কোন মশলার উপস্থিতি রয়েছে। ট্রায়াল আ্যন্ড এরর পদ্ধতিতে রোজ রান্না হল হালিম, যতক্ষণ না স্বাদ পছন্দ হল নিজের।
আমি যেভাবে হালিম রাঁধি
বাজারে যতরকম ডাল পাওয়া যায় (খোসা সমেত এবং খোসা ছাড়া) সমস্ত রকম ডাল মিশিয়ে তৈরি করতে হয় একটা মিশ্র ডাল। পরিমাণটা এরকম— ৫০ বা ১০০গ্রাম করে বা একমুঠো করে নিলাম সবরকম ডাল। সঙ্গে একমুঠো গোবিন্দভোগের সুগন্ধী চাল। এই মিশ্র ডালের থেকে এক কাপ বা আধ কাপ ডাল ধুয়ে পরিষ্কার জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে আগের রাতে।
মাংস— মাটন নিতে হবে রান বা পুট থেকে। ডাল এক কাপ নিলে মাংসও নিন এক কাপ। ছোট ছোট করে কেটে রান্না করে ফেলুন, ঠিক যেমনটা আপনি রাঁধেন। মাংসের সব মশলা দিন, কষিয়ে রাঁধুন গরগরে করে। ঝোল শুকিয়ে ফেলুন। মাংস এমনভাবে সেদ্ধ করুন, যাতে নরম হয় কিন্তু হাতা দিলেই ভেঙে যাবে না।
খোলায় আলতো গরম করুন সবুজ এলাচ, কালো এলাচ, দারুচিনি, জায়ফল, জয়িত্রী আর মৌরি। সঙ্গে দিন সামান্য শাহজিরে। মিক্সিতে গুঁড়ো করুন এই গরম মশলা। চায়ের চামচে দেড়-দু চামচ নিয়ে ছড়িয়ে দিন ঝোল শুকিয়ে আসা মাংসে। আর ঢাকা দিন। কোনও রকম সুগন্ধি যেমন মিষ্টি আতর, কেওড়ার জল, নৈব নৈব চ।
মাটন নিতে হবে রান বা পুট থেকে। ডাল এক কাপ নিলে মাংসও নিন এক কাপ। ছোট ছোট করে কেটে রান্না করে ফেলুন, ঠিক যেমনটা আপনি রাঁধেন। মাংসের সব মশলা দিন, কষিয়ে রাঁধুন গরগরে করে। ঝোল শুকিয়ে ফেলুন। মাংস এমনভাবে সেদ্ধ করুন, যাতে নরম হয় কিন্তু হাতা দিলেই ভেঙে যাবে না।
কয়েকটা শুকনো গোলাপের পাপড়ি নিন। হাতের তালুতে নিয়ে আঙুলের চাপে গুঁড়ো করুন গোলাপের পাপড়ি আর তুলে রাখুন পাশে। গোলাপের পাপড়ি দরকার পড়বে একদম শেষ পর্যায়ে।
আগের রাতে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখা ডাল ও চালের মিশ্রণ প্রেশার কুকারে দিন। নুন-হলুদ, আদাবাটা, জিরেবাটা, ধনেবাটা, এক চা চামচ সর্ষের তেল, আধ চা চামচ চিনি আর দুটো তেজপাতা দিয়ে জল দিন ডালের দুইগুণ। কুকার হুইসেল দেওয়া অবধি ফুল ফ্লেম রাখুন তারপর মাঝারি আঁচে ৬-৭ বার হুইসেল বাজতে দিন। গ্যাস বন্ধ করে দিয়ে নিজে থেকে ঠাণ্ডা হতে দিন।
বিশ্বজয়ের চুড়ান্ত পর্ব
মাঝারি আকারের খান তিন-চার পেঁয়াজ নিয়ে ঝিরিঝিরি কেটে ফেলুন। কড়ায় তেল গরম করুন চড়া আঁচে। পেঁয়াজ ভাজুন সোনালি করে। ভাজা পেঁয়াজ তেল থেকে নামিয়ে ফেলুন ঝাঁঝরি হাতায় করে
প্রেশার কুকারের ঢাকনা খুলুন। আগে থেকে গরম করে রাখা জল নিন এক কাপ আর ডালে সেটা মিশিয়ে দিন আলতো হাতায় নেড়ে। মাংস ঢেলে দিন ডালে। ফুটতে দিন। খেয়াল রাখতে হবে ডাল যেন তলায় ধরে না যায়। ভাল করে ফুটে ডালেমাংসে মিলমিশ হলে গ্যাস বন্ধ করুন।
ফোড়নের কড়ায় তেল গরম করুন। শাহজিরে ফোড়ন দিন। গ্যাস বন্ধ করে ফুটন্ত তেলে দিন আধ চা চামচ কাশ্মীরি লংকার গুঁড়ো। লংকাগুঁড়ো খুব তাড়াতাড়ি পুড়ে যায় কারণ তেল ফুটন্ত। ঝপ করে কড়াই ধরে ফোড়ন ঢেলে দিন ডাল-মাংসের মিশ্রণে। ভেজে রাখা সোনালি রঙের পেঁয়াজ-বেরেস্তা ছড়িয়ে দিন ডালের উপরে। যে গরম মশলা গুঁড়ো করেছেন, তার খানিকটা আবার ছড়িয়ে দিন ডালের উপর। সব শেষে দিন গুঁড়ো করে রাখা গোলাপের পাপড়ি এবং ঢাকা দিন। তৈরি হল হালিম।
কুচি করে কাটুন টাটকা ধনেপাতা, কাঁচালংকা। টুকরো করে কাটুন লেবু। ডাবু হাতায় করে স্যুপ প্লেটে গরম গরম সার্ভ করুন হালিম। ছড়িয়ে দিন ধনেপাতা-কাঁচামরিচের কুচি। প্লেটের পাশে রাখুন টুকরো লেবু আর স্বাদ নিন বিশ্বজয়ি হালিমের।
ছবি সৌজন্য: Wikipedia
জন্ম সিলেটে এবং বড় হওয়া বাংলাদেশে। ১৯৮৬ সাল থেকে ভারতের বাসিন্দা। হেঁশেলই তাঁর হাতিয়ার, আশ্রয়। হেঁশেল ঘিরেই তাঁর লেখালেখি। 'অতঃপর অন্তঃপুরে' এবং 'স্বাদ সঞ্চয়িতা' তাঁর প্রকাশিত বই।