বাংলার সাহিত্যজগতে কাজী নজরুল ইসলাম তখন নিতান্তই তরুণ তাঁর সাহিত্যচর্চার বয়স তখন সবেমাত্র বছর তিনেক। আর রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে মুক্ত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তখন বাংলার সাহিত্যজগতে খ্যাতির শীর্ষে। ‘শাত্-ইল-আরব’-এর কবির কাব্য-প্রতিভায় মুগ্ধ ছন্দের জাদুকর। তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে রীতিমতো আগ্রহী তিনি।
পল্টনে থাকতে থাকতেই ১৯১৯-এর মাঝামাঝি করাচি সেনানিবাস থেকে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় কবিতা পাঠিয়েছিলেন নজরুল। ‘মুক্তি’ শিরোনামের সেই কবিতা পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। এটিই ছিল কোনও পত্রিকায় ছাপানো নজরুলের প্রথম কবিতা। এর পর ওই পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯২০-এর মার্চে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে নজরুল চলে আসেন কলকাতায়। তিন-চার দিন বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বোর্ডিং হাউজে কাটানোর পর চলে আসেন ৩২ কলেজস্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। থাকতে শুরু করেন মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে। তাঁর লেখা গল্প, কবিতা তখন প্রকাশিত হচ্ছে ‘সওগাত’, ‘প্রবাসী’, ‘মোসলেম ভারত’ প্রভৃতি পত্রিকাতে। পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করেছেন ‘নবযুগ’, ‘সেবক’ ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায়।

‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় নজরুলের কবিতা পড়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, পত্রিকা-কর্তৃপক্ষ ভালোবেসে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকা পাঠান বলে যে তিনি তা নিয়মিত পড়েন তা নয়, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাগুলো তাঁকে টানে। ওঁর কবিতা পড়ার আশাতেই তিনি ‘মোসলেম ভারত’-এর পথ চেয়ে বসে থাকেন।
কিন্তু কেন তাঁকে নজরুলের কবিতা এত টানে? সত্যেন্দ্রনাথের কথাতেই তার জবাব আছে—“কি অনবদ্য মিল ও ছন্দ, অথচ কত আরবী পারশি শব্দ নিয়ে সে ছন্দমিলকে গাঁথতে হয়েছে।…অদ্ভুত ক্ষমতা ছোকরার। আর কি জোরালো দৃষ্টিভঙ্গি!”
নজরুলের সঙ্গে আলাপ করার জন্য ছটফট করতে থাকেন সত্যেন্দ্রনাথ। বিবেকানন্দ রোডের মোড়ের কাছেই ৩৮ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে (অধুনা বিধান সরণি) থাকতেন গজেন্দ্রকুমার ঘোষ। কবি-সাহিত্যিক মহলে তিনি পরিচিত ছিলেন গজেন, গজেনদা, বা গজেনবাবু হিসাবে। সেই বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডা বসত কবি-সাহিত্যিকদের। কে আসতেন না সেই আড্ডায়— প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নরেন্দ্র দেব, মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখ! সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কিন্তু কবি-সাহিত্যিকদের অন্য আড্ডায় খুব একটা যেতেন না। এই গজেনদার বাড়িতেই এক সন্ধ্যায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে আলাপ হল নজরুলের এবং আলাপটা হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথের আগ্রহেই।

তার আগের দিনই গজেনদার বাড়িতে আড্ডা জমিয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কিছুক্ষণ পর সেখানে হাজির পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। পবিত্র যে নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেটা জানতেন সত্যেন্দ্রনাথ। পবিত্রকে দেখেই সত্যেন্দ্রনাথ ‘শাত্-ইল-আরব’-এর কবি কোথায়, তা জানতে চাইলেন। তিনি যে আলাপ করার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছেন! পরের দিনই নজরুলকে গজেনদার বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য পবিত্রকে অনুরোধ করলেন সত্যেন্দ্রনাথ।
কবি সত্যেন দত্ত আলাপ করতে চেয়েছেন, পবিত্রর কাছে এ কথা শুনে বিশ্বাসই হচ্ছিল না নজরুলের। পরের দিন গজেনদার বাড়িতে নজরুলকে নিয়ে গেলেন পবিত্র। একটু পরে এলেন বুড়োদা তথা প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। কিছুক্ষণ পরে এলেন সত্যেন দত্ত। পবিত্র তাঁর সঙ্গে বন্ধুর আলাপ করিয়ে দিতেই উচ্ছ্বসিত নজরুল সত্যেন দত্তের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলেন। নজরুলকে দু’হাতে বুকে টেনে নিলেন কবি সত্যেন দত্ত। বললেন, “তুমি ভাই নতুন ঢেউ এনেছ। আমরা ত নগণ্য, গুরুদেবকে পর্যন্ত বিস্মিত করেছ তুমি।”
গুরুদেব তাঁর লেখা পড়েছেন শুনে বিহ্বল নজরুল। সত্যেন দত্ত জানালেন, আসলে গুরুদেবই তাঁর কাছে একদিন জানতে চেয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়েছি কিনা। গুরুদেব বলেছেন, ভাবের সংস্কৃতি-সমন্বয়ের সাধনায় নজরুল এক নতুন অবদান আনছেন।
গুরুদেব এ কথা বলেছেন শুনে আনন্দের আতিশয্যে নজরুলের মুখে কোনও কথা সরছে না তখন। শুধু ‘পবিত্র’ বলে ডেকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের দিকে।

বুড়োদা জানতে চাইলেন, কোথায় লেখেন নজরুল! সত্যেন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, ‘মোসলেম ভারত’-এ। তিনি এও জানাতে ভুললেন না যে গুরুদেব নিয়মিত পড়েন ‘মোসলেম ভারত’।
সে দিন সত্যেন্দ্রনাথ আসার আগেই গজেনদার ঘরে রাখা একটা অকেজো অর্গান সারিয়ে নজরুল গান গেয়েছিলেন— “সে কোন্ বনের হরিণ ছিল আমার মনে/কে তারে বাঁধলে অকারণে—”।
গজেনদা বললেন, সমন্বয়, অবদান এসব তিনি বোঝেন না। তবে যিনি এমন প্রাণ খুলে গাইতে পারেন তাঁকে পেয়ে তাঁর আনন্দের খোরাক অনেক বেড়ে গেল।
নজরুল জানিয়ে দিলেন, গান তাঁর বাতিক। কেমন গান গাইছেন, এ সব সাত-পাঁচ না ভেবে গলা ছেড়ে গান গেয়ে যান তিনি।
আরও পড়ুন: মানবমিলনের প্রতীক কাজী নজরুল ইসলাম
এ প্রসঙ্গেই চলে এল লেটো বা লেটুর দলে গান গাওয়ার কথা। “সে আবার কী?”— সত্যেন্দ্রনাথের এই প্রশ্নে নজরুল জানালেন, বর্ধমান-বীরভূমের পাড়াগাঁয়ে কবিগানেরই এক রকমফের এই ‘লেটু’। ছেলেবেলায় গান গাওয়ার নেশায় তাদেরই দলে ভিড়েছিলেন নজরুল। তবে সেখানে গান গাওয়ার চেয়ে গান লেখাই বড় কাজ হয়ে গেল। সেই লেটুর দলের গান-লিখিয়ের কবিতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন, এ-কথা ভেবেই বিহ্বল কাজী।
সত্যেন্দ্রনাথ জানিয়ে দিলেন, “বস্তু আছে বলেই তো পড়ছেন, বাজে জিনিসকে মূল্য দেন না গুরুদেব।

শরীর বিশেষ ভালো ছিল না সত্যেন্দ্রনাথের। চোখ নিয়ে খুব ভুগছিলেন। চোখের খুব সরু নাড়িগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল। খুব ঝাপসা দেখছিলেন। দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারানোর আশঙ্কা। এই সময়ে মনের দুঃখে ‘খাঁচার পাখী’ কবিতাটি লেখেন সত্যেন্দ্রনাথ। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যা (আগস্ট ১৯২১) ‘মোসলেম ভারত পত্রিকা’য় কবিতাটি ছাপা হয় –
“আজ কি আবার ফুল ধ’রেছে
ডালিম গাছের ডালটীতে?
উতল হাওয়ায় পালট লাগে
ভরা বুকের পালটীতে!
তোতা সে আজ আতা গাছের
পাতায় পাতায় ফিরছে কি
সবুজ শিখার দীপান্বিতা
সকল শাখা ঘিরছে কি?
ঘেরা-টোপের অন্ধকারে
বন্দী আছি সঙ্গী নেই,
ব্যথার ডালি ব্যর্থ জীবন
ডুবিয়ে দিয়ে সঙ্গীতেই।…
…চোখে আমি ঝাপসা দেখি
আফ্সে মরি আফ্সোসে,
বল্গো তোরা বসন্ত কি
জাগল ধরার হৃদ কোষে?
কান্না-কোলে কাঁপছে গলা
কণ্ঠে কেঁপে যাচ্ছে তান,
বল্গো তোরা বকুল চাঁপায়
বসন্ত কি মূর্তিমান?”

ছন্দের জাদুকরের ‘খাঁচার পাখী’ কবিতাটি পড়ে নজরুলের মন ব্যথায় ভরে উঠল। তিনি লিখলেন ‘দিল দরদী’। এটি পড়লেই বোঝা যায়, এই কবিতা পুরোপুরিই ‘খাঁচার পাখী’র অনুসারী। পরের মাসে অর্থাৎ আশ্বিন মাসের ‘মোসলেম ভারত পত্রিকা’য় সেই কবিতাও ছাপা হল—
“কে ভাই তুমি সজল গলায় গাইলে গজল আফ্সোসের?
ফাগুন বনের নিবল আগুন লাগ্ল সেথা ছাপ পোষের
দর্দ-আলুদা কান্না-কাতর ছিন্ন তোমার স্বর শুনে
ইরান মুলুক বিরান হ’ল এমন বাহার মরসুমে।…
বাদশা-কবি! সালাম জানায় বুনো তোমার ছোট্ট ভাই!—
কইতে গিয়ে অশ্রুতে মোর যায় ডুবে হায় সব কথাই।”
পরে ‘ফণি-মনসা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নজরুল নিজেই শেষ দুই পংক্তি পালটে লিখেছিলেন—
বাদশা কবি! সালাম জানায়
ভক্ত তোমার অ-কবি,
কইতে গিয়ে অশ্রুতে মোর
কথা ডুবে যায় সবি!”
মুজফ্ফর আহমদ আর কাজী নজরুল ইসলাম তখন ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাসায় থাকতেন। নজরুলের ‘দিল দরদী’ কবিতা পড়ে সত্যেন্দ্রনাথের এত ভালো লেগে গেল তিনি চলে এলেন তালতলা লেনের বাসায়। কিন্তু নজরুলের সঙ্গে দেখা হল না।

১৯২২ সালের ২৫ জুন মারা গেলেন সত্যেন দত্ত, মাত্র ৪০ বছর বয়সে। পরের দিন মওলানা মুহম্মদ আকরম খানের কাগজ দৈনিক ‘সেবক’ পত্রিকায় একটা ভাবপ্রবণ সম্পাদকীয় লিখলেন নজরুল। এখানেই শেষ নয়। পরের দিনই একটা গান রচনা করলেন। সেই সন্ধ্যাতেই সত্যেন দত্তের স্মৃতিতে এক শোকসভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় নজরুল তার রচিত গানটি গাইলেন–
“চল-চঞ্চল বাণীর দুলাল এসেছিল পথ ভুলে,
ওগো এই গঙ্গার কূলে।
দিশাহারা মাতা দিশা পেয়ে তাই নিয়ে গেছে কোলে তুলে
ওগো এই গঙ্গার কূলে।।…”
প্রিয় কবি সত্যেন দত্তের স্মরণে ‘সত্য-কবি’ শিরোনাম দিয়ে আর-একটি কবিতা লিখেছিলেন নজরুল–
“অসত্য যত রহিল পড়িয়া, সত্য সে গেল চ’লে
বীরের মতন মরণ-কারারে চরণের তলে দ’লে।…”
চিন্তাভাবনায়, দর্শনে দুই কবির মধ্যে প্রচুর মিল ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ যখন লিখছেন, “মানি না গির্জা, মঠ, মন্দির, কল্কি, পেগম্বর/দেবতা মোদের সাম্য-দেবতা অন্তরে তাঁর ঘর।”, ঠিক সেই সুরে সুর মিলিয়ে নজরুল লিখছেন, “এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।”
শেষ করি সত্যেন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্কে ড. সুশীলকুমার গুপ্তের পর্যবেক্ষণ দিয়ে– “সত্যেন্দ্রনাথের যদি কেউ সার্থক উত্তরাধিকারী থেকে থাকেন, তবে সর্ব দিক দিয়ে বিচার করলে তিনি কাজী নজরুল। যতীন্দ্রনাথ ও মোহিতলালের উপরও সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের চারণ-কবির ভূমিকাটি একমাত্র নজরুল ছাড়া আর কেউ গ্রহণ করতে পারেননি। সত্যেন্দ্রনাথের বিদ্রোহের সুরকে নজরুলই জাতির মর্মমূলে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের বাস্তবতা নজরুল-সাহিত্যে আরও প্রখর ও দ্যুতিমান হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পরশমণির স্পর্শে। বাংলা ভাষায় ঘরোয়া শব্দের প্রচলন করে ও আরবী-ফারসী শব্দকে প্রবেশাধিকার দিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর যে উত্তরসূরীদের অজস্র ঋণজালে আবদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে নজরুল ইসলাম অন্যতম।”
তথ্যসূত্র:
১। কাজী নজরুল ইস্লাম স্মৃতিকথা – মুজফ্ফর আহমদ
২। চলমান জীবন (২য় পর্ব) – পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়
৩। নজরুল চরিত মানস – ডক্টর সুশীলকুমার গুপ্ত
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Wikimedia Commons, Britannica,
পেশায় সাংবাদিক। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন ডেপুটি নিউজ এডিটর। বর্তমানে খবর অনলাইন ও ভ্রমণ অনলাইনের অন্যতম কর্ণধার। ক্যালকাটা জার্নালিস্টস ক্লাবের মুখপত্র ‘সাংবাদিক’-এর মুখ্য সম্পাদক।
4 Responses
একটি নিটোল নিখাদ ইতিহাসের মিশ্রন।উদাসী করে দেয়।
অপূর্ব স্মৃতিচারণ! বাংলার দুই স্মরণীয় কবিকে নিয়ে এমন একটি আলোচনা আজকের বড় প্রাপ্তি। শম্ভুকে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ বাংলালাইভকেও।
শম্ভু, অনেক কিছু জানলাম। সাবলীল তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।
শম্ভু, চমৎকার লেখা। তর তর করে এগিয়ে গেছে তোমার কলম।