হান্স কার্ল আর্টমান (H. C. Artmann) পরিচিত ছিলেন আই বি হানসেন নামে। জন্মেছিলেন অস্ট্রিয়ায়। তিনি ছিলেন একাধারে কবি ও লেখক। তাঁর প্রথম দিকের কবিতাগুলি লেখা ভিয়েনিজ ভাষায়। তার পরে অবশ্য তিনি আর সে ভাষায় লেখেননি। ১৯২১ সালে ভিয়েনায় তাঁর জন্ম। পড়াশুনো ভিয়েনাতেই। ৪০-এ তিনি একটি অফিসে ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁকে পানিশমেন্ট ব্যাটেলিয়নে পাঠানো হয়। সেখানে ৪১ সালে যুদ্ধে আহত হন তিনি। ১৯৪৭ সালে রেডিওতে একটি স্ক্রিপ্ট লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। ৫১ সালে যোগ দেন আর্ট ক্লাবে। সেই সময় থেকেই তাঁর কবিতা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ৫২ সালে তিনি একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, যা ছিল মূলত আভাগাঁর্দের গ্রুপ। তিনি নিজেই সে গ্রুপ ছেড়ে দেন ৫৮ সালে। এর পর তিনি সমগ্র ইউরোপ ভ্রমণ করেন। ৬১ থেকে ৮৫ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সুইডেনের স্টকহোমে। তার পর বার্লিনে ছিলেন ৬৯ পর্যন্ত। সলজবুর্গে এর পর তিনি পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন। লেখালেখির জন্য তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম ৭৪ সালের গ্র্যান্ড অস্ট্রিয়ান স্টেট প্রাইজ, ৯১ সালে সলজবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট এবং ৯৭ সালে জর্জ বাকনার প্রাইজ। কবিতা ছাড়াও বেশ কিছু উপন্যাস, গল্প এবং ব্যঙ্গাত্মক গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। অ্যাস্টেরিক্স-এর সিরিজের অস্ট্রিয়ান এবং জার্মান অনুবাদক তিনিই। ভিয়েনায় ৪ ডিসেম্বর ২০০০ সালে হার্ট অ্যাটাকে তিনি মারা যান। তাঁর কবিতা মূলত অস্তিত্ববাদী এবং নবতরঙ্গের ভাবনাকে বহন করে চলে। আধুনিক জার্মান এবং অস্ট্রিয়ান কবিতার তিনি অন্যতম প্রাণপুরুষ (H. C. Artmann)।

উত্তরের আলো
শীত নেমে আসে রাজকীয়ভাবে
আমি সুতো বাঁধি
একটি দীর্ঘতম রাস্তা ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে
তোমার আমার মধ্যে
এতদিন যেন পুতুলখেলা চলছিল
কেউ সুতোয়
আমাদের আটকে রেখে বলেছিল
তোমরা নিজেদের ভুলে যাও
যেভাবে শৈশবের ড্রইং খাতা ভুলে গিয়ে
ক্যানভাসের খোঁজে
পাগল হয়ে যায় যৌবন
শীতের ড্রইং বোর্ড
শীতের একটি ড্রইং বোর্ড
প্রতিটি বস্তুই
সন্ধ্যা ডেকে আনে
আমার যদি স্বচ্ছ একটি চোখ
আর নক্ষত্রের সম্পর্কে ধারণা থাকত…
চল্লিশ বছর বয়স হল আমার
আমার পা এখন সেঁদিয়ে গেছে
একটি বুটেই
যারা দৌড়ে যায় তাদের মধ্যে
আমি শুধু এখন
লাফিয়ে লাফিয়ে চলি

দেহ
আমি কোনও ভালোবাসার কথা বুঝি না
কোনও ঈশ্বরের কথাও বুঝিনি বহুদিন
আমার উপর সাদা একটা চাদর বিছিয়ে দেয়
এলাকার সবচেয়ে মহান পাদ্রী
আমি তাকে ভালো করে চিনি না
সেও আমাকে ভালো করে চেনে না
শুধু জানে, আমি মাটিতে মিশে যাব
মাটির নীচে গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে পৌঁছে যাব নরকে
সেখানেও ভোরবেলা হবে
আর আমি ঘুম থেকে উঠব না আর
সতর্কতা
লাল নীল সবুজ কিছু রঙের ভিতর
হামাগুড়ি দিতে দিতে হারিয়ে গেছি আমি
দেখি তোমায়, কী নিশ্চিন্তে
বলতে পারছ, তোমার অতীত, আমার ভবিষ্যৎ
শুনেছি এ বছর ভারী তুষারপাত হবে
ঢেকে যাবে আমার বাগান
ও গাছ গাছের ফুল, তোমরা নিজেদের
গোপন করে রাখো
বরফ জলের কেউ নয়

বিবর্তন
বজ্রপাত হলে কিংবা ধস নামলে আমি টের পাই
আমাদের পৃথিবী মাঝেমাঝেই বিরক্ত হয়ে পড়ে
পোড়া মাংসের গন্ধ পেয়ে চলে এসেছে লোমশ কুকুর
ওপারে নেকড়ের কান্না শোনা যাচ্ছে
আমি মানতে পারি না, মানুষ মানুষের চেয়ে
আরও উন্নত হতে পারে
যদি হয়, তবে কি সে আরও হিংস্র হবে? না কি আর কবিতা লিখবে না?
মুখ
ছায়ার মতো কিছু কিছু শব্দের সঙ্গে আমার দূরত্বের সম্পর্ক নয়
মনে হয় আমারই পিছু পিছু ঘোরে
সাইরেন বাজে কাছে দূরে
মানুষের মধ্য থেকে মানুষের ছায়া যায় ফেব্রুয়ারি মাসের মতো একা
তুমি কথা বোল না আর, কথায় কিছু নেই
উষ্ণতা
দুঃখের কাছে, হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছে দেব আমাদের বাইবেল
পড়বেন তিনি, দুঃখ, যার সমস্ত শরীর থেকে পবিত্র এক গন্ধ বেরোয়
শিশুসন্তানের মতো, দুঃখ, একা থাকে, – ভাবে,
কেউ তাকে কোলে তুলে নেবে
যখন টানতে টানতে এই সময়গুলোকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সহিস
তখন, দুঃখ, বলে ওঠে, ওকে ছেড়ে দাও
সময় ক্লান্ত, রাস্তা ক্লান্ত, শুধু কিছু বিবাহ আজও বেড়াতে যাচ্ছে

প্রেমের কবিতা
তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি, তোমার ঠোঁটে, স্তনে, জঙ্ঘায় যোনিতে
আমি জানি, অন্য কেউ থাকে
তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি তাই
আমি ভালোবাসি তাকেও, যে তোমার ঠোঁটে, স্তনে, জঙ্ঘায়, যোনিতে
থেকে যায়।
তুমি আমাকে চিনতে পারো না
তুমি আমায় জানতে পারো না
আমি স্বপ্নের ভিতর দিয়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়ি
এক ভাইরাসের মতো
আর আদর করি তোমায়
যতক্ষণ,
আদর করা যায়
যৌনতা
না-ই বা হল, আমার ভাঙা দেহটাকে নিয়ে এই আগুন আগুন খেলা
এই মাটি মাটি খেলা এই বাইবেল চার্চ বরফ এবং নেকড়ে
নাই বা হল আমার চোখ কোনও উচ্চতায় পাখি
নাই বা হল পচনশীল দেহে পোকাদের বাড়িঘর
নাই বা হল তোমার সন্তান
আমি চাই, তুমি আমাকে খেয়ে নাও
যেমন মৃত্যু খায় জীবনকে
ঈশ্বর
লাশ গুনতে গুনতে ক্লান্ত হয়ে মানুষ আকাশের দিকে তাকালেই
আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল, একটিও তারা নেই
একটিও গ্রহ নেই
আমাদের পৃথিবী শূন্যে আকর্ষণহীন
ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে যাচ্ছে তোমার দিকেই
আর তুমি
নিস্পৃহভাবে দেখছ
আলো নেই, ঘরের ভিতর কেউ নেই, অন্ধকারও নেই

তথ্যসূত্র
- Achtundachtzig: Ausgewählte Gedichte (1996) ISBN 3-7017-1009-0
- Der aeronautische Sindtbart: oder, Seltsame Luftreise von Niedercalifornien nach Crain (1975) ISBN 3-423-01067-3
- Allerleirausch: neue schöne Kinderreime (1978) ISBN 3-921499-22-4
- Angus; English version by Olive Jones (1974) ISBN 0-416-80470-5
- Artmann, H.C., Dichter: Ein Album mit alten Bildern und neuen Texten; edited by Jochen Jung (1986) ISBN 3-7017-0455-4
- The Best of H.C. Artmann; edited by Klaus Reichert (1975) ISBN 3-518-36775-7
হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।
One Response
দারুণ! মুগ্ধ।