আলো দত্তর ডিজাইন ছিল মোটা রেখায়– এটাই তার বৈশিষ্ট্য। তখন কলকাতায় ডিজাইন নিয়ে নানা পরীক্ষা চলছে। ওর স্ত্রী শর্বরী দত্ত তিনি আবার ফ্যাশনে অন্য ভাবে ভাবছেন। আলো দত্তর সঙ্গে যখনই দেখা হত জড়িয়ে ধরে বলতো তোমার ডিজাইন আমায় মুগ্ধ করে। জানি এটা ওর বিনয়। ওর জোরাজুরিতে ওর বাড়িতে গিয়ে দেখেছি ওর ভবিষ্যৎ ভাবনার সব নকশা। আমি ইতিমধ্যে এসব করে ফেলেছি। আমি আক্ষেপ করে বলতাম কাঠের ভাল কাজ জানা কারিগরদের অভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আলো দা বললেন সেই জন্য আমি আমার পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলছি। আলো দার কথায় আমি নিজেও ভয় পাচ্ছি।
দক্ষিণ ভারতের কলমকারি ডিজাইন (art of block printing) মুগ্ধ করে, ওদের রং ও নকশা হাজার বছরের প্রচলিত ধারায় চলে আসছে। আগেই উল্লেখ করেছি এই শিল্প আমার গন্তব্য ছিল না, তবে এর ভূগোল ইতিহাস আয়ত্ত না করা অবধি শান্তি ছিল না।
যে সমস্ত কারিগর ব্লক বানাবার জন্য রাতদিন খেটে চলেছে তাদের প্রতি তেমন কারও নজর ছিল না। নিত্য দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে এই বিশেষ দক্ষতার কাজটি তারা করে যেত, যদি পরবর্তী কেউ এগিয়ে আসে তবে তার সংসারের হাল ধরবে যা সবসময় সবার কপালে জোটে না। এর ফলে কিছুটা তঞ্চকতার আশ্রয় তাদেরকে নিতেই হত।
আমার কাছে মোহাম্মদ সাবির নামের এক কারিগর কাজ করতে আসত। রোগা ছিপছিপে চেহারা। মুখে সবসময় পান। আমি অনেক পরে আবিষ্কার করি পেটের খিদে যাতে ওকে বিব্রত না করে তার জন্য পানের সহায়তা নিত, তাছাড়া দেশি পানীয় পেটে ঢেলে এসে আমাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখত। ও কলকাতার আর এক বিশেষ পরিচিত ব্যক্তির কাজ করে দিত। ওর বিশেষত্ব হলো যত কমপ্লিকেটেড কাজ হোক না কেন ও মাথা ঠাণ্ডা করে ঠিক ঠিক মাপে নকশাটি কাঠে কেটে দিতে পারত। আমি প্রায় আট কি নয় রঙের ডিজাইন দিয়েছি বেশ বড় মাপের একটা ডিজাইন পুরো ছাপতে প্রায় ২৭টা ব্লকের দরকার। ও ঠিক ভাবে ব্যাপারটা সামাল দিতে পারত। সাবির ডিজাইন নিয়ে যেত; সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাঠ দিয়ে দিতাম আর কিছু অগ্রিম। এক সপ্তাহ সময় নিলেও কবে আসবে তার নিশ্চয়তা থাকত না। সেটা দু’সপ্তাহ হতে পারে অথবা মাস ঘুরে যেতে পারে। ওর উপর প্রথম প্রথম রাগ হত ঠিকই কিন্তু ওকে বাদ দেবার কথা কখনওই ভাবতাম না। ওর চেহারা দেখলে কষ্ট হত যেন কতদিন খায় নি। অনেক সময় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি টাকা দিয়ে দিতাম অগ্রিম হিসেবে, নিজেই বলত কাজ করে শোধ করে দেবে। স্বভাবে খুবই ভদ্র।

একবার এরকমই কিছু জরুরি ডিজাইন ওকে দিয়েছিলাম দিন পনেরোর মধ্যে করে দিতে, প্রায় দু’মাস হয়ে যেতে বসল, ওর দেখা নেই। চিন্তায় পড়লাম, ও ঠিক কোথায় থাকে কোনওদিন জানার চেষ্টা করিনি, কেবল জানি ও আসত বন্ডেল গেট অঞ্চল থেকে। আমি কোথায় এই জনারণ্যে ওকে খুঁজব? তবুও মরিয়া হয়ে একদিন সেই অঞ্চলে গেলাম। কেউই বলতে পারছে না। রাস্তায় কিছু উদোম গায়ে শিশু ধুলো মেখে আপন মনে খেলছে। আমি জনে জনে জিজ্ঞেস করছি, এদের মধ্যে কেউ একজন ওই বাচ্চাদের দেখিয়ে বললো ‘আপ বাচ্চা লোগোকো পুছিয়ে কুছ মিল সেকতা ‘ আমি এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে ওদের কাছেই গেলাম, বিস্কুট সাধলাম ওরা প্রত্যাখ্যান করল। এবার সাবিরের কথা জিজ্ঞেস করতে ওরাই আঙুল তুলে কাছের একটা ভাঙা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘উপর রহতা হ্যায়’। আমি হাতে চাঁদ পেলাম যেন। প্রায় অন্ধকারে থাকা সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম, একটা ঘুপচি অন্ধকার ইট বের করা ঘরে ততোধিক শীর্ণকায় এক মহিলা আর কিছু শীর্ণকায় সন্তানদের নিয়ে শুয়ে আছেন, সাবিরের কথা বলতে এক গাদা কথা বেরিয়ে এল, বুঝলাম প্রচুর রাগ অভিমান আর খিদের যন্ত্রণা আর শরীরে বাসা বাঁধা রোগকে নিয়ে বয়ে চলা এই নারী হলো সাবিরের ঘরণী। আমার চোখ ছল ছল করছে। দম যেন গলায় আটকে আছে। সঙ্গে এমন কিছু টাকা নেই কিন্তু ওদের ছেড়ে আসতে মন চাইছে না। এত অভাবেও ও কোনওদিন আমায় ঠকায় নি, ভদ্র ভাবে বাঁচতে চেয়েছে, ওর প্রতিভা বেচে বাঁচতে চেয়েছে।
সাবিরের সঙ্গে দেখা হল না। ঘরের বাচ্চাদের জন্য নিয়ে আসা বিস্কিটের প্যাকেট দিয়ে দিলাম। কিছু টাকা ওর ঘরণীর হাতে গুঁজে দিয়ে চলে এসেছি। বলেছি আবার আসব। নীচে যারা খেলছিল তারাও সাবিরের সন্তান। অচেনা মানুষের দেওয়া খাবার প্রত্যাখ্যান করা সেই সব দরিদ্র সন্তান।
আমি ওর বাড়িতে গেছি জানতে পেরে ও তড়িঘড়ি চলে এসেছিল বাড়িতে। ওর কাছে থাকা কাজগুলো সবকটাই কেটে দিয়ে গেছে। আমি নিজে ওর কাছে কেমন অপরাধীর মতো কথা বলতে থাকলাম। ওর ঘরের ব্যক্তিগত পরিসরে আমি অজান্তেই উঁকি দিয়ে ফেললাম। এটা যদি অপরাধ হয় এরকম অপরাধ বার বার করতে রাজি আছি আমি, এবার যতদিন পেরেছি ওর প্রাপ্য টাকার অতিরিক্ত দিয়ে বলেছি এগুলো শোধ করার জন্য দিইনি তুমি ভাবিকে ভাল করে চিকিৎসা করাও; নিজে খাও আর বাচ্চাগুলোকে পেট ভরে খেতে দাও। ও সংকোচে মাথা নিচু করে বসে থাকত। জানি আমার এই সামান্য অর্থ সাবিরের অভাবের মরুভূমিতে এক বিন্দু জল ছাড়া কিছু না।

ধীরে ধীরে সাবিরের যাতায়াত কমে এল। ও এখন আর পান খায় না, শরীর নুইয়ে পড়েছে। কাজ করার ক্ষমতা ক্রমে হারিয়ে ফেলছে। কাঠের উপর বাটালি চালাবার শক্তি কমে এসেছে। একদিন শুনলাম ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, ওর বাড়ি চলে গেলাম শুনলাম যক্ষ্মা রোগের শিকার হয়েছে। বুঝলাম এদেরও খুব শিগগিরি ওই রোগের সঙ্গে লড়তে হবে। যতদিন পেরেছি সাধ্য অনুযায়ী কিছু অর্থ দিয়েছি মাত্র কিন্তু সে তো সমুদ্রে এক অঞ্জলী জলের মতো।
এই সাবির আমায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলো এক একটা নকশার পেছনে কতটা রক্ত লেগে থাকে। কেউ সেটা আর দেখে না বা কোনওদিন দেখবেও না। আমি ওর করা সব ব্লক যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এরপর সাবির আর বেশিদিন থাকে নি। জানি না ওর পরিবারের হাল। আমি নিজের ক্ষমতার পরিধি জানি। সাবিরের জায়গা কেউ নিতে না পারলেও জগৎ থেমে নেই, কাজ করে দেবার জন্য আরও কেউ কেউ এসে গেছে। এইসব কাঠ খোদাই শিল্পীদের কথা কেউ জানবে না কোনওদিন। যেমন জানে না উনিশ শতকের শিল্পীদের কথা। আমার মানসিকতার মধ্যে ব্যবসা ছিল না– মূলত শিল্প অনুসন্ধান ছিল। ব্যবসা যারা করে তাদের এত দরদী হলে চলে না।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক
জন্ম কলকাতায় ১৯৫০ সালে। নিজে শিল্পী, বহু শিল্প বিষয়ক ইতিহাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দীর্ঘ বছর যাবত উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বই Woodcut prints of nineteenth century Calcutta (১৯৮২), উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই শিল্পী প্রিয় গোপাল দাস (২০১৩), আদি পঞ্জিকা দর্পণ (২০১৮, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত), কলকাতার কাঠ খোদাই ( ২০২২) রাজ্য সরকারের বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ২০২২।