Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বুড়ি! থুড়ি থুড়ি: বেড়ু বেড়ু

মন্দার মুখোপাধ্যায়

ডিসেম্বর ২১, ২০২৩

senior citizen travel groups
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

শীত তেমন পড়েছে কি পড়েনি, উসখুস করে উঠল মন। ঘর ছেড়ে পালাতে হবে কাছে বা দূরে – বাড়ির বাইরে যে কোনও জায়গায়। তা না হলে ভাদ্রমাসের রোদে সেঁকে মুচমুচে করা সিল্কের শাড়ি, শাল, মাফলার, মোজা এবং টুপিগুলোর সদ্বব্যবহার হবে কীভাবে! কাপড় জামার সঙ্গে সঙ্গে স্যুটকেস ব্যাকপ্যাকগুলোও তো মুছে রাখা হয়েছে। অপেক্ষা শুধু টাকা পয়সার হিসেব কষে, পছন্দমতো জায়গা বেছে বেরিয়ে পড়ার। এখনকার সংসারে তেমন বুড়িদের আর দরকার নেই যে অঘ্রাণে বড়ির বিয়ে দিয়ে আর পৌষে পিঠেপুলি রেঁধে, ডেকে হেঁকে শীতের মোচ্ছব জমাবে। আর কাদের জন্যই বা বানাবে? ঘরে তো আছে বলতে নিজেরই এককুচি ছায়া এবং দু’একটি পরিচারিকা। তা ছাড়াও দোকানে দোকানে আজকাল এত ভাল এ সব পাওয়া যায় যে, শেষ বয়সের শক্তিটুকু অযথা খরচ না করাই ভাল। তাই আচার, বড়ি, জ্যাম, জেলি বানানোর তোড়জোড় এবং উলবোনার কাঁটা-ক্রুশ, রঙবাহারি নতুন ও পুরনো উলের গোলা– এ সব ‘বাড়ি-বাড়ি খেলা’ একপাশে সরিয়ে রেখে, তাঁরাই এখন বেজায় ব্যস্ত নেট সার্ফিং করতে। ইদানিং তো খাতির করে শুধু তাঁদেরই বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য হামেহাল হাজির রাশি রাশি সংগঠন এবং দুর্দান্ত সব ‘প্যাকেজ’-এর হাতছানি। আগের থেকে কত যে বদলে গেছে সব! এককালে ভ্রমণ ছিল অল্প কিছু মানুষের নেশা; ক্রমে তা হল দল বেঁধে প্রমোদ এবং ইচ্ছে ভ্রমণ। আর ক্রমে ক্রমে তা এক বেশ জাঁকানো পেশা এবং রুজি রোজগারের পথও। আর সম্প্রতি এতে যোগ হয়েছে আরও কিছু আদরের শব্দ– ‘workshop’, ‘therapy’, ‘destination’ ‘healing’ ‘me-time’ এই সবও।

senior citizen travel groups
বুড়োবুড়িদের বেড়ানো এখন হাতের মুঠোয়

লিখব কী! আমি তো শুধু এই সাইটগুলো পড়তে পড়তেই মাস কাবার করে ফেললাম! আমাদের ছোটবেলায় বয়স্ক মানুষেরা বিশেষত বিধবা ঠাকুমা-দিদিমা-পিসি-মাসি-কাকিমা-জেঠিমা এঁরাই তো দল বেঁধে তীর্থে যেতেন। বাঙালিদের পছন্দের ছিল শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধাম। সেই যে তপন সিংহের সিনেমা ‘নির্জন সৈকতে’! কালকূটের (সমরেশ বসু) লেখা, আর ছায়াদেবী, ভারতীদেবী, রেণুকা রায় ও রুমা গুহঠাকুরতা–সেই চারবুড়ির অভিনয়! এতটুকু বানানো নয়। শুনেছি যে আমার ঠাকুরদা ওড়িশা পুলিশে চাকরি করার সময়, নানা জায়গা ঘুরে পুরীতে পোস্টিং পেলে, খড়দা থেকে দলে দলে বুড়িরা ‘বিশু-পিলুর’ সংসারে থাকতে যেতেন, জগন্নাথ দেখবেন বলে। হাওড়া থেকে রাতের ট্রেনে উঠে ঘুমিয়ে পড়লেই, ভোরবেলা সমুদ্র-গর্জনে পুরী। অনেক পরে আমার বিধবা ঠাকুমাকেও দেখেছি, নিজের তিন বিধবা জা এবং পাড়ার অন্যান্য বিধবা বুড়িদের সঙ্গে মিলে মাঘী-পূর্ণিমার দিন দল বেঁধে ‘তিন-ধাম’ দর্শনে যেতে। রাসখোলা-শ্যামেরঘাট থেকে নৌকো পার হয়ে শ্রীরামপুরের মাহেশ; এই উপলক্ষে স্পেশাল নৌকো-ট্রিপও হত। আবার নৌকোতেই রাসখোলায় ফিরে, শ্যামসুন্দরকে প্রণাম করতেন। ওই মন্দিরের কাছেই শিবনাথ ইস্কুল চত্বর থেকে সবাই মিলে লরিতে উঠে যেতেন ব্যারাকপুর ছাড়িয়ে, নীলগঞ্জের সাঁইবোনায় নন্দদুলাল দর্শন করতে। এতসব দর্শন শেষে বাড়ি ফিরেই অবশ্য কুপোকাত। সেই যে ‘নো মিল’ বলে শুয়ে পড়লেন, পরের দিনও দেখা গেল পেটখারাপ আর গা জ্বর জ্বর।

Still from Nirjan Saikate
আগে বেড়ানো মানে ছিল তীর্থ করতে পুরী

আর একটু ডাকাবুকো ছিলেন তাঁদের এক জেঠশাশুড়ি-অন্নপূর্ণা। দেওরঝির বর মানে আমাদের এক পিসেমশাই রেল-কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে তিনি তাঁর বিধবা মা এবং আমাদের এই বিধবা বঠ-ঠাকুমাকে রামেশ্বরম যাত্রার দু’টি টিকিট কেটে রওনা করিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে পৌছনোর আগেই, যাওয়ার পথেই দুর্ঘটনা। ওই ট্রেনের কয়েকটি কামরা ব্রিজ থেকে ভেঙে পড়ে সমুদ্রতটে। তখন তো দূর ছিল আসলে সুদূর; ফলে যে কোনও দূরত্ব পার হওয়াই ছিল বড় বেশি আয়ত্তের বাইরে; যথেষ্ট সময় ও খরচ সাপেক্ষ। তাই খবর পেয়ে দশদিনের মাথায় বাড়ির লোকজন পৌছনোর আগেই রাশি রাশি মৃতদেহের সঙ্গে তাঁদেরও দাহ করে ফেলা হয়। আমি তাঁকে দেখেছি দেওয়ালে টাঙানো সাদা-কালো ফটোতে। কিন্তু আমাদের অরুণদার আজও স্পষ্ট মনে আছে তাঁর সেই তীর্থে যাওয়ার দিনটি, যখন সে নিতান্ত বালক। অনেক পরে বেড়াতে গিয়ে, সে নিজে যখন ওই সেতু পার হয়েছে, সমানেই তার মনে পড়েছে তাদের সেই বঠ-ঠাকুমা অন্নপূর্ণার কথা।

আর এই বুড়িরা যখন বেড়িয়ে ফিরতেন, তখন তাঁদের পুঁটলি আর ব্যাগগুলো হয়ে যেত বোঁচকা। আলুর-ঝালুর কত কী যে বেরত তা থেকে! বিশেষত কাশীর সেই কালো আর বেলে পাথরের থালাবাটি; আর আসত ‘পুরীর স্মৃতি’ লেখা পেতলের পুজোর থালা। এ ছাড়াও আনতেন পুরীর ছড়ি, হাঁড়ি আর তালপাতার পাটি। তীর্থে গিয়েও তাঁদের মন কিন্তু পড়ে থাকত সংসারের আনাচকানাচে। নিজেদের জন্য না কিনতেন কটকি বা সম্বলপুরী শাড়ি-চাদর, না খেতেন রেস্তোরাঁ হোটেলে। জগন্নাথধামে ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবারাও দু’টি বেলা ভাত খেতে পারতেন; তাই ওই অন্ন-প্রসাদটুকু মুখে দিয়েই সুখ। রেল-কোম্পানিতে চাকরি করা চেনাজানা মানুষ আর চাকরির সূত্রে প্রবাসে থাকা আত্মীয়স্বজন– এটুকু ভরসাতেই জমে উঠত ভ্রমণ। কয়লার ট্রেনে চড়ে, বাড়ির রান্না মানে কুঁজো সমেত পানীয়-জল ও খাবার বোঁচকায় বেঁধে, হোল্ড-অল অথবা শতরঞ্চিতে বিছানা গুছিয়ে যখন সেই মহাযাত্রা শুরু হতো, মনে হত সংসারের একটা টুকরোও যেন বেড়াতে বেরল। আর সে-ও বা কজন! সংসার ফেলে রেখে যাবেন এ যেন ভাবতেই পারতেন না বাকিরা! ফলে তীর্থদর্শনই ছিল সেকেলে বুড়িদের একমাত্র ভ্রমণ বা বৈধব্যের কম্পেনসেশন।

senior citizen travel group
প্রবাসী সন্তানদের সুবাদে বিদেশ সফরও জলভাত এখন

যৌথ জীবন ভাঙতে ভাঙতে আমরা যখন পুরোপুরি লায়েক হয়ে উঠলাম কুচো কুচো সংসারে, তখন ভরসায় এল ‘কুণ্ডু স্পেশাল’। ভ্রমণ ব্যবসায় মস্ত আস্থা নিয়ে এগিয়ে এলেন তাঁরা, আমাদের কাকু-মামা-পিসেমশাই ও বড়দাদা হয়ে। বয়স্করা তখনও সংসারে পুরো বাতিল হয়ে যাননি। সেই প্রথম আমরা শিখলাম যে বেড়াতে গিয়ে অসুস্থ হলে বা অন্য কিছু ঘটলেও তাঁরাই পাশে দাঁড়াবেন। সামর্থ্য অনুযায়ী শুরু হল ইচ্ছে-ভ্রমণও। এরই মধ্যে কবে যেন সংসার থেকে ধীরে ধীরে লোপাট হয়ে গেলেন বয়স্করা। ব্যবস্থায় এল, হয় বৃদ্ধাশ্রম না হয়তো নিজের কোটরে একা একা থাকা। ছেলেমেয়েরা বাড়ি ছাড়তে লাগল হয় উচ্চ-শিক্ষার অন্বেষণে, না হয়তো চাকরি বা ব্যবসার কারণে। উচ্চফলনশীল শস্যে ভরে উঠল জীবন; কিন্তু কে খাবে সে সব! কার জন্যই বা আয়োজন করে সংসার! ফলে নিত্য সঙ্গী হল একাকীত্ব, অবসাদ এমনকী আত্মহননও। তবে এ সবের মধ্যেও যা খানিক সুসার নিয়ে এল, তা হল অবসর নেওয়ার পরে পেনশন এবং অবসরকালীন বেনিফিট হিসেবে মোটা অঙ্কের খানিকটা টাকা হাতে আসা। স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রীরাও পেতে লাগলেন অর্ধেক পেনশন যা আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের কেউই পাননি। এ ছাড়াও যবে থেকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের রোজগারের চল হয়েছে, তখন থেকে সংসারের আয়ও বেড়েছে; আরও সুবিধে হয়েছে সেই সব সংসারে, যেখানে বাড়ির ছেলে বা মেয়েদের আয় তাদের বাবা-মায়ের আয়ের থেকে কয়েকগুণ বেশি হয়ে গেছে; যখন আর্থিক ব্যাপারে তারা আর পরিবারের মুখাপেক্ষী নয়। অন্যদিকে জীবনদায়ী ওষুধ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার ফলে এরই সঙ্গে বেড়েছে গড় আয়ু। রোগভোগ সামলেও সকলেই ভাবতে চাইছে ‘বয়স একটা সংখ্যামাত্র’ (age is just a number)।

আর এই মনোভাবকে স্বাগত জানাচ্ছে একদিকে যেমন সরকার, অন্যদিকে তেমন নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। ‘সিনিয়র সিটিজেন’ (senior citizen) সরকারি এই নামের আওতায় এলেই মেলা সুবিধে। শুধু যে হুইলচেয়ার বা রিসার্ভ-সিট এমন নয়; ব্যাংক, পোস্ট-অফিস সর্বত্রই সিনিয়র সিটিজেনদের আমানতের ওপর সুদ বেশি। বিবিধ ইনসিওরেন্স সহ নানা স্কিমে এঁদের তা পাবার ব্যবস্থাও। সু-পেনশনি বুড়ো-বুড়িদের ঘিরে এই আর্থিক নিরাপত্তাই এখন অন্যান্য সংঠনের কাছেও এক বড় আকর্ষণ। ফলে বৃদ্ধাশ্রম ও ‘Elderly Care’– এর সঙ্গে হুড়মুড় করে গজিয়ে উঠছে পর্যটন সংস্থাগুলিও। বৃদ্ধবয়সের বিপন্নতার পাশাপাশি ভাবা হচ্ছে কী ভাবে আনন্দেও রাখা যায় তাঁদের! বুড়ো-বুড়িদের ঝলমলে সব ফটো দিয়ে বিশেষ ভাবে বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে ‘Tour packages for senior citizens’, ‘Small Group Tour’, ‘Senior Citizen travel groups’, ‘Customised Holiday’, ‘Senior Citizens Personalised Holiday’, ‘Revisiting Ancestors House/Homeland/School/College/Universities’, ‘Revisit your Honeymoon Destination’ ইত্যাদি। আরও একটু অভিনব করতে এ সবও –-‘Travel with Destination Workshop’, ‘Travel for Local Food and Festivals’, ‘Travel for Safe Adventure’, এমন অনেক কিছু।

অধিক সংখ্যক বয়স্কদের ভ্রমণমুখো করতে এছাড়াও লেখা হচ্ছে বৃদ্ধবয়সে ভ্রমণ জরুরি কারণ-

  • নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে
  • দেহমন সচল রাখতে
  • সামাজিক লেনদেনের মাধ্যমে নিজেকে চাঙ্গা রাখতে
  • স্মৃতিশক্তি অটুট রাখতে
  • স্ট্রেস কমাতে এবং মন ভাল রাখতে
senior citizen travel groups
নাতি নাতনিদের টানে বুড়োবুড়িরা এখন হামেশাই বিদেশভ্রমণ করছেন


এ সবের সঙ্গেই আরও এক তালিকায় জানানো হচ্ছে বিবিধ রকমের ‘Special Offer’ বা ‘Travel Friendly Benefits’। আসলে নানা রকম অপব্যবহারে ‘প্যাকেজ’ কথাটি বোধহয় আর তেমন লাগসই হচ্ছে না। এখন একেবারে সরাসরি তাই ‘List of Benefits’ ঘোষণায় – ‘Travel Insurance’, ‘Transparent Services’, ‘Travel-Friendly Destinations’, ‘Medical Support’, ‘Safe and Secured Journey’, ‘Pre-Travel Counselling’……….। আর আছে ‘ডিসকাউন্ট’ ও ‘গিফট’- এর প্রতিশ্রুতি। বুড়ো-বুড়িদের এই ভ্রমণ-সংগঠনে খুব বড় ভূমিকা নিয়েছে ‘ফেসবুক’, ‘ইন্সটাগ্রাম’, ‘ব্লগ’ এবং ‘হোয়াটস্যাপ গ্রুপ’গুলিও। পাতা খুলে সার্চ দিলেই অমুক-তুমুক Travel Club -এর অন্ত নেই। এখানেই দেখলাম যে বৃদ্ধ বয়সকে বলা হচ্ছে সোনালি সময় (‘Golden Age’)। একজন মনোবিদের কথাটা ভারী মনে ধরেছে। তিনি লিখছেন যে এ হল- ‘Age of Recycling’।

এ সবের মধ্যেও যা খানিক সুসার নিয়ে এল, তা হল অবসর নেওয়ার পরে পেনশন এবং অবসরকালীন বেনিফিট হিসেবে মোটা অঙ্কের খানিকটা টাকা হাতে আসা। স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রীরাও পেতে লাগলেন অর্ধেক পেনশন যা আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের কেউই পাননি। এ ছাড়াও যবে থেকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের রোজগারের চল হয়েছে, তখন থেকে সংসারের আয়ও বেড়েছে; আরও সুবিধে হয়েছে সেই সব সংসারে, যেখানে বাড়ির ছেলে বা মেয়েদের আয় তাদের বাবা-মায়ের আয়ের থেকে কয়েকগুণ বেশি হয়ে গেছে; যখন আর্থিক ব্যাপারে তারা আর পরিবারের মুখাপেক্ষী নয়।

ফলে দৃষ্টিভঙ্গির এই যে পরিবর্তন তা প্রায় এখন বিশ্বব্যাপী। প্রথম প্রথম বৃদ্ধাবাস থেকে যখন বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হত, তখনও তাঁরা কাতর হয়ে ভাবতেন যে বাড়ির সকলের সঙ্গে সেই সব বেড়ানো কত মধুর ছিল; বা নাতি নাতনি যদি সঙ্গে থাকত……! ক্রমে তাঁরা বুঝলেন যে ওখানে না গেলে তিনি জানতেও পারতেন না যে, এতসব জায়গায় তিনি নিজের অর্থেই ঘুরে আসতে পারছেন। বাড়ি পাহারা দেওয়া এবং ছেলেমেয়েদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষার বাইরেও আনন্দ পাবার যে এমনও এক পরিসর আছে! আছে আয়া এবং ডাক্তার- ওষুধের খরচ মিটিয়েও নতুন এক খাতে অর্থ ব্যয় করবার সুযোগও। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ভ্রমণ কাহিনি ও বেড়ানোর অভিজ্ঞতা পড়তে পড়তে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে আনন্দ পাওয়ার বদলে এই যে সরাসরি ভ্রমণের স্বাদ, এ কি কম কথা! আর এই যে গুরুত্ব পাওয়া! মানে লম্বা ফিরিস্তিতে সচেতন করে দেওয়া যে কী কী সঙ্গে নিতে হবে, কেমন পোশাক আরামদায়ক, কেমন ব্যাগ বা স্যুটকেস সুবিধেজনক এই সব খুঁটিনাটি! সাগ্রহে এতো এতো টিপস! নস্টালজিয়া আক্রান্ত হয়ে , একটেরে বসে থাকার থেকেও তো মুক্তি! সংসার উদ্বৃত্ত ‘sorry figure’ না হয়ে, একেবারে সমকালীন হয়ে আনন্দে বাঁচা!

লিখতে বসে মনে পড়ছে শুদ্ধদেব আর নন্দিনীর কথা; এরা বয়স্কদের বেড়াতে নিয়ে যায় সাগ্রহে। মনে পড়ছে নিনির কথা; সেও তো বিশেষ আদর-যত্নে পৃথিবী ভ্রমণে নিয়ে যায় দাদু-দিদাদের। শর্মিলা বসুঠাকুরের ‘ট্রাভেল-ওয়ালা’ সংস্থাও খুব অভিনব। এই শহরের কাছেপিঠে যে সব খোলামেলা বাগানবাড়িতে সে বয়স্কদের বেড়াতে নিয়ে যায়, সেখানে গিয়ে সে নিজেও দু-পদ রান্না করে। সেই রান্নায় তার সঙ্গে যোগ দিতে পারে ভ্রমণ-সাথীরাও। কখনও আবার তার বুটিক থেকে এই বেড়ানো উপলক্ষে বানিয়ে দেয় ‘থিম’ পোশাকও। মনে পড়ছিল একদল সেই জাপানি বুড়িদের কথা, যারা ভারত-দর্শনে এসে আনন্দে মাতোয়ারা। মুম্বই এয়ারপোর্টে বসে আছি; হঠাৎই এক সুবেশা বুড়ি এগিয়ে এসে, আমার কুর্তিতে হাত বুলিয়ে, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলছে ‘same pinch’! একেবারে ঠিক আমার কুর্তির মতো খাদি কাপড়ের র‍্যাপ অ্যারাউন্ড স্কার্ট পরে তার সে কী আনন্দ! ওই সামান্য সময়ে গপ্পো করে জানলাম যে তারা সবাই সত্তর পার করেছে; একমাস ধরে ভারত ভ্রমণ করে, টেগোরের বিশ্বভারতী এবং ‘নিপ্পন ভবন’ দেখে দেশে ফিরবে।

দেশে বিদেশে সর্বত্রই এখন সিনিয়র সিটিজেনদের বেড়ানোর রমরমা

মেঘালয় বেড়াতে গিয়ে শুনলাম যে সেখানের চেরি-ফুল ফোটা দেখতেও নাকি দলে দলে ট্যুরিস্ট আসে Cherry-Blossoms Festival-এ যোগ দিতে। মাঝে মাঝেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এখন প্রায়ই নিজেকে দেখি আর সাজাই– ডেনিম প্যান্ট, হাওয়াইয়ান টপ, গলায় চান্দেরি স্কার্ফ, পায়ে আ্যডিডাস আর চোখে একটা নীল ডাঁটির ফোটোক্রোমাটিক ডার্ক-গ্লাস। কিশোর-কিশোরীদের যে ফ্রক এবং হাফ প্যান্ট সেই ক্লাস এইটেই গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয়েছিল, সেইগুলো আবার অনায়াসে কেমন গায়ে চড়ছে! ইসকুলের ফ্যান্সি ড্রেসে ট্যুরিস্ট সাজলেও, যে সব পোশাক পরে কখনও সাজিনি, এখন পাঁচজনের সঙ্গে তাই পরে কত নির্ভার হয়ে বেড়াতে চলেছি! এখন তাই কুম্ভমেলা বা গঙ্গাসাগর মেলায় যাওয়াটাও এভাবেই হতে পারে। বয়স্কদের বেড়ুতে বেড়ুতে ভারি সুন্দর এক পল্লবিত ‘দুনিয়া ডট কম’।

‘ট্রাভেল’ এখন আসলে এক নতুন বিশ্ব। না হলে আর ইস্কুল বন্ধু স্নিগ্ধা বা প্রতিমা এরা স-বর লাফাতে লাফাতে চলে যায় আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় থাকা ছেলেদের কাছে! আঠারো ঘণ্টা বা বারো ঘন্টার উড়ান কি আর কোনও ব্যাপার? লক ডাউনের পরেও ভিসা না পাওয়ায় জয়শ্রী আর সুব্রতদা তাদের একমাত্র মেয়ের বিয়েতে আমেরিকায় গিয়ে উঠতে না পারলেও, বিবাহবার্ষিকীতে তো ঠিকঠাক পৌঁছে গেল! লঙ কোট, টুপি আর দস্তানায় গা ঢেকে তাদের কত কত ছবি! অভিব্যক্তিতে নতুন সুখ; দূরত্ব পারাপারে দিগ্বিজয়ীর হাসি আর নিজেদের সক্ষমতা প্রকাশের তৃপ্তি। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে লেপ্টে থাকার বদলে, সময় মেপে এই বেড়িয়ে আসাটা বোধহয় বেশি আনন্দের।

ফলে দুনিয়ার সংবাদ মাথায় পুরে বুড়োটে কুটুরে পেঁচার মতো ‘Age of Wisdom’- এর প্রতীক না হয়ে বরং ‘Age of Recycling’ হওয়া ঢের ভাল। ‘সঙ্গে যাবে কে’ না ভেবে, সঙ্গীর অভাবে হুলো বেড়ালকে না নিয়ে, বিন্দুমাত্র অপরাধবোধে না ভুগে, সুগার-প্রেসার-পায়ে ব্যথা এই সব শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে মেনে নেওয়াই ভাল—
‘হ্যাঁ ভাই আমার পায়ের তলায় সর্ষে’!

ছবি সৌজন্য: মন্দার মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর বন্ধুরা

Author Mondar Mukherjee

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Picture of মন্দার মুখোপাধ্যায়

মন্দার মুখোপাধ্যায়

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে। লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
Picture of মন্দার মুখোপাধ্যায়

মন্দার মুখোপাধ্যায়

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে। লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com