Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বুড়ি! থুড়ি থুড়ি: জন্মদিন

মন্দার মুখোপাধ্যায়

জানুয়ারি ৩১, ২০২৪

Life of senior citizen and Birthday memories
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

নিজের চাকরি বা কর্তাটির চাকরির সূত্রে জন্মদিনটা (Birthday) ভোলে কার সাধ্য! ভবিষ্যতের কালেন্ডারে তা তো একেবারে জ্বলজ্বল করে। জন্মের পর মৃত্যু যে কবে তা কেউ না জানলেও, চাকরি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে যায় চাকরি শেষ করার দিনটিও। ফলে জন্মদিনের জোরদার উৎসবে, ফুল-কার্ড-উপহারের সঙ্গে, থেকে থেকেই মনে পড়ে যাবে যে চাকরির মেয়াদ আরও এক বছর কমল। জন্মদিন ব্যাপারটা তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ জটিল হয়ে ওঠে। যে বছরটা অবসরের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে, সেই বছরে জন্ম-মাসটা যেই না পড়ল, শুরু হল জন্মদিন পালন এবং একই সঙ্গে ফেয়ারওয়েলের প্রস্তুতিও। সমস্ত কর্মকাল জুড়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কারণে বা অকারণে কত না বিরোধ, কত রকমেরই না দলবদল! কিন্তু এই শেষ জন্মদিনটায় সব যেন মিলেমিশে, ভালবাসায় এক হয়ে গেল! ফেয়ারওয়েলের আগেই উপহার আর আদরে ঘরের সঙ্গে মনটাও যেন উপচে এল আহ্লাদে। সিনিয়র-মোস্টকে শুভেচ্ছা জানাতে এগিয়ে এসেছে জুনিয়র-মোস্ট সহকর্মীটিও— এমনকী যে হয়তো সবে চিনেছে আমাকে। এ হল সেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জন্মদিন (Birthday) পালন করে বুঝিয়ে দেওয়া যে ‘যাবার সময় হল, বিহঙ্গের’ বা এবার তবে এসো বাছাধন! এমনটা এ জীবনে ওই একবারই ঘটে, যারা চাকরি বাকরি করে তাদের ক্ষেত্রে। 

birthday cake

জন্মদিন পালন কিন্তু এর বাইরেও, তবুও থেকেই যায়; আত্মীয়-স্বজন, ছেলেমেয়ে এবং বন্ধু— এদের ভালবাসায় এবং উচ্ছ্বাসে। শিশুকালে ভাবতাম যে জন্মদিন শুধু বুঝি ছোটদেরই হয়; তাদের জন্মদিনে বাড়ির ‘গুরুজনদের’ পা ছুঁয়ে প্রণাম ক’রে এক বাটি পায়েস খায়। আরও একটু বড় হলে, পায়েস খাওয়া এবং বড়দের পা ছুঁয়ে প্রণামের সঙ্গে যোগ হল, প্রিয় বন্ধুদের কাছ থেকে হাতে আঁকা বা ছবি-সাঁটা কার্ড পাওয়া; তার মধ্যে কখনও আবার বন্ধুর দাদার দেওয়া কার্ডও। ডাকবাক্সে ফেলে যাওয়া ডাকটিকিট-বিহীন এবং পরিচিতি ছাড়া সেই সব খাম-বন্দি জন্মদিন-পত্রও। শুরু হল গোপনীয়তা। অপরিচিত ছেলেরা— পাড়া বা বেপাড়া যেখানকারই হোক না কেন, কিশোরীদের নাম জেনে ফেলা মানেই বাড়ির বড়দের কাছে অপরাধ। অপরাধ, বয়সে সেই অল্পই বড় দাদাদের কাছেও। তক্ষুনি মন্তব্য যে, মেয়ের স্বভাব কিন্তু বাচাল! পথেঘাটে সখি-সঙ্গে নাম ধরে হাঁকাহাঁকি আর হুলুহুলু কুলুকুলুর ফল। কচি বয়স থেকেই বোধহয় এই জন্যেই মেয়েদের ‘নাম-পাতাপাতি’ খেলাটা শেখানো হয়।

তবে ছেলেদের বিপদও কম ছিল না। মেয়েদের নাম মুখে আনলেই আওয়াজ এবং ‘প্যাঁদানি’। বন্ধুদের কাছে এত কিছু বলাও এক মস্ত বিপদ; গঞ্জনার ভয়ে, রাজসাক্ষী হতেই বা কতক্ষণ! ফলে, বইয়ের পাতার ভাঁজ ছাড়া আর কোনও কুঠুরি কোথায়! স্বভাবে একটু গুরু-গম্ভীর ভাব দেখা দিলেই শুরু হয় উপহারের মোড়কে সাহিত্য এবং শিল্পবোধ জাগানো ওই-সব ছদ্ম-উপহারে, বড়দের পছন্দের বই পাওয়াও। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’, ‘আরণ্যক’, ‘জাগরী’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, আধুনিক কবিদের লেখা নানা কবিতার বই, Painting-Prints, Hemingway, Erich Maria Remarque ইত্যাদি। বিশেষ করে ছোটপিসিমা, সোমনাথদা, বড়মামি এবং গৃহ-শিক্ষক চিরপ্রিয় মাস্টারমশাই— এঁদের উপহারে।

Handmade Card1
প্রিয় বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া হাতে আঁকা বা ছবি-সাঁটা কার্ড

বিয়ের পর অবশ্য বিবাহবার্ষিকীর চাপে জন্মদিনটা হয়ে গেল উৎসাহী বর বা বউয়ের হেফাজতে চলে যাওয়া একটা বন্দি-দিন। চুপিসাড়ে, নিভৃত উপহারে শাড়ি-শার্ট-কানের ফুল-পায়ের আঙোট–ব্যাগ; এবং এসবের প্রমাণে ‘ভুলে যায়নি’ বা ‘মনে রেখেছি কিন্তু’ অথবা ‘আমি ছাড়া আর কে আছে’— এমন সব ব্যাপারও ঠারেঠোরে বোঝানো। ততদিনে বন্ধুদেরও ঠিকানা বদল হতে হতে প্রায় নিশ্চিহ্ন। ঠিকানা বদলে গেলে আর কোথায় কে কাকে খুঁজে পাবে! আর শ্বশুরবাড়ির ডাকবাক্সে আসা চিঠির গোছা? সে তো প্রথমেই যাবে, শাশুড়ি-মায়ের হাতে; সেখান থেকে শ্বশুরমশায়ের টেবিলে। ফলে জন্মদিনে পাওয়া সেইসব মন্দ-মধুর চিঠি বা কার্ডের দিন শেষ। পরে যখন ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে নিজেদের বন্ধুদের জন্য কার্ড বানাতে শিখল, তখন আবার নতুন করে তাদের কাছ থেকেই শুরু হল কার্ড এবং নানা রকম উপহার পাওয়া। ততদিনে ‘বন্ধু’ উপাধি-প্রাপ্ত পরিশীলিত বাবা-মায়েরাও প্রবল ঔৎসুক্য চেপে শিখে গেছে যে, অন্যের নামে আসা চিঠি দুরন্ত হাত নিশপিশ সত্ত্বেও খুলতে তো নেই; এমনকী জানতে চাওয়াও ভুল হবে যে কার চিঠি বা কোথা থেকে এল!

তখনও খামে বন্ধ হাতে লেখা চিঠির যুগ নিশ্চিহ্ন হয়ে এমন ই-মেল সর্বস্বতা গ্রাস করেনি আমাদের। তবে ওদের কাছেই তো নতুন করে শিখলাম যে, বুড়ো হয়ে যাওয়া বাবা-মাকে শুধু নতুন স্বাদের বইই নয়, সেই সঙ্গে সুগন্ধি চা-পাতা, একবাক্স চুরুট, রসুনের ব্র্যান্ডেড আচার, প্রিয় কিছু ফুল, ডিভাইন-ডিফ্যুসার আর শাড়ি-পাঞ্জাবিও উপহার দেওয়া। আশি ছুঁই ছুঁই রাশভারি ভালোদা তো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, মেয়ে জামাইয়ের কাছ থেকে পছন্দের চা-পাতা আর বিশেষ ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পেলে। জন্মদিনে এক সিন্দুক উপহার পেয়েও সুনীলদা অপেক্ষা করতেন, কখন আসবে মল্লিকা, তাঁর জন্য সেই বিশেষ পাঞ্জাবিটি নিয়ে! প্রতিবছর সেই পাঞ্জাবির বুকের কাছে একটা কিছু নতুন ছবি এঁকে দিত মল্লিকা। সুনীলদা খুশি হতেন রসুনের আচার পেয়েও।

আমার মা খুব খুশি হতেন জন্মদিনের উপহারে টেম্পল পাড় তসর-শাড়ি আর কটকি বা মণিপুরি স্কার্ফ পেয়ে। লজ্জা পেলেও অভিমানে বলতেন, ‘তোর বাবার জন্মদিনে তো শুধু আঁকার বইই দিতে হত; আবার আমার জন্মদিনেও সেই আঁকার বইই!’ অনেক বাটিক শাড়ি বাবা বানিয়ে দিলেও জন্মদিনে বউকে আঁকার বই দেওয়াটা মোটেই সহ্য হত না মনে হয়। বইতে আপত্তি ছিল না। অভিমান ছিল, নিজের পছন্দের আর্ট প্লেট দেওয়া বইগুলো মাকে উপহার দেওয়ায়; তাতে অবশ্য ব্রাউন কালিতে টানা হাতের লেখায় লিখে দিতেন, ‘for Buccan’; বুকান— মায়ের ডাক নাম।

Handmade Card2
জন্মদিনে পাওয়া সেইসব মন্দ-মধুর চিঠি বা কার্ডের দিন কি সত্যিই শেষ?

আজ লিখতে বসে ভাবছি ঠাকুমা, দিদিমা, বড়মা, কাকিমা বা মামি-মাসিদের জন্মদিন কবে ছিল! দাদু, জ্যাঠা, কাকাদেরও তো একই দশা! একঘর ছেলেপুলে, তায় আবার জন্ম-সার্টিফিকেট ছাড়া! খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, আগুন-লাগা, তীর্থযাত্রা বা এরকম বিশিষ্ট কিছু দিয়ে বছর মনে থাকলেও দিন মনে রাখা সহজ হত না। তুলনায় অনেক সহজ ছিল বড়দিন, জন্মাষ্টমী, পঁচিশে বৈশাখ বা কল্পতরু উৎসব মনে রাখা। ফলে যে কোনও শুভদিনে, পরপারে চলে যাওয়া, দেওয়ালে টাঙানো মৃত মানুষদের ছবিতেও মালা দেওয়া হত। সংসারে সবাই জন্মেই থাকত; মৃত্যু আর ছুঁতে পারত কোথায়! আমার ঠাকুরদার এক মেসোমশাই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন; দীর্ঘায়ু এই মানুষটি বছরের পর বছর যেমন বিষয়-সম্পত্তির হিসেব লিখেছেন, তেমনই নথিভুক্ত করে গেছেন জন্ম-মৃত্যু ও বিবাহের দিন-ক্ষণ-মাস এবং বছরও; এমনকী স্থান সমেত। এই প্রাচীন নথিটিই পারিবারিক সূত্রে পাওয়া এক মরকত-উপহার।

Handmade Card4

এখন এক অনবদ্য সময়ে বাস করছি আমরা; তার কারণ সরকারি দিবস পালন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সংযোগ। আমার নাতিবাবু ‘ভিভেক-দিবস’ জানে; কিন্তু কার সাধ্য ওকে বোঝায় যে এ দিনটা আসলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত বলে একজনের জন্মদিন! আমোদ-দিবস, প্রমোদ-দিবস বা প্রতিবাদ-দিবস যাই হোক না কেন— এ সবের অন্তরালে জন্মদিবসটা আড়ালে মুখ লুকোলেও আমাদের মতো গড়পড়তা-জনেদের জন্মদিনটা কিন্তু বেশ জম্পেশ করেই হাজির হচ্ছে। রাত বারোটা বাজতেই ফেসবুক নোটিফিকেশন; সারাদিন ধরে তা আমার page-পাতায় জ্বলজ্বল করবে; মেল আইডি দেওয়া থাকলে সেখানেও দফায় দফায়— ‘দেখ’ ‘দেখ’ ‘দেখ’। আজকাল আবার অনেকে নিজেরাই আগাম জানান দিয়ে শাসাতে থাকেন, এই জন্মালাম বলে… সেই মওকায় ফেসবুকও চোখের ওপর থরে থরে সাজাতে থাকে কেক-ফুল-মোমবাতির আয়োজন; এমনকী লম্ফঝম্প করে তাধেই-মাধেই নাচও; মানুষ, কুকুর, বেড়াল, পাখি –– প্রত্যেকের জন্মদিনে সে এক ব্যাকুল নাচের আয়োজন। এর অন্য পিঠও আছে। সেখানে কেউ কেউ আবার ওই গণ-শুভেচ্ছা এড়াতে ‘Post’ option সরিয়ে দিয়ে ‘message’ option করে রেখেছেন। আবার এ দিকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে, হয় তাতে তখন-তখনই লাইক বা লাভ সাইন টিপে জানানো (যার ভাবখানা হল, ‘marked you as present’); না হয়তো পরদিন, এক লাইনে গণ-ধন্যবাদ। তবে দিনের-দিন যে মিটেও যাবে সব এমনও নয়। ‘belated’ না লিখেও, শুভেচ্ছা জানানো চলতেই থাকবে প্রায় মাসাধিক কাল জুড়ে; যার যেমন চোখে পড়েছে আর কী! ফলে মনে রাখা বা ‘ভাবা প্র্যাকটিস করা’— আদরের এই স্বেচ্ছা-শ্রমটুকু থেকেও রেহাই ঘটেছে। আর শুধু কি ফেসবুক! আমার এক মামাতো ভাই তো ফেসবুকে নেই; কিন্তু সে আবার কী এক কায়দা করেছে যে তার নিজের জন্মদিন ছাড়াও ছেলে, মেয়ে, দিদি এবং মা সকলের জন্মদিনের আগাম নোটিশ আসতে থাকবে প্রায় সাতদিন ধরে।

Handmade Card
আমাদের মতো গড়পড়তা-জনেদের জন্মদিনটা কিন্তু বেশ জম্পেশ করেই হাজির হচ্ছে

কিন্তু সুবিধে হয়েছে বটে ফুল, কেক এবং উপহার পাঠানোর; কাছে কি দূরে এবং দেশে কি বিদেশে! এমনকী একই ছাদের তলাতেও। না, না! মোটেই ভার্চুয়াল নয় সব একেবারে ‘একচুয়াল’ আর জ্যান্ত মানে ‘রিয়েল’। বুড়ো বয়সে কী ভালোই না লাগে উপহার পেতে! দাঁড়ে বসা পাখি দিয়ে সাজানো মাটির ল্যাম্পশেড, পছন্দের গাছ, নানা বয়সের ছবি দিয়ে বানানো ক্যালেন্ডার, টেবিল রানার, আঁকা ছবির প্রিন্ট, পায়া লাগানো তামার থালা, সিরামিকের কোস্টার, খোঁপায় লাগাবার বাহারি কাঁটা, কফি মাগ, বুক মার্ক— সে এক মস্ত লিস্টি! আর একটু বাড়তি দিলেই কী সুন্দর সব Gift Pack এবং  Personal Note লেখা একটা Card-ও। ক্বচিৎ কখনও একখান শাড়িও আসে। এইসব পরিচিত ঠিকানা ছাড়াও— সেই তাদের কাছ থেকে; কিশোরীবেলায় যাদের পাঠানো ফুলের পাপড়ি বা দু’চ্ছত্রে জীবনানন্দ আজও খুঁজলে পাওয়া যাবে। সে সময় ইস্কুলের প্রাইজে পাওয়া বইগুলোর দু’পাতার ভাঁজে; আজ আর কে আছে যে শাসন করে পুলিশি তদারকি করবে! এ সব উপহার চিরকালের মতো আজও আসে অদৃশ্য- জনদের কাছ থেকেই। আয়নার দিকে চোখ পড়লেই বুঝি যে, এখনও যেন দ্বিধা আর লজ্জায় রাঙা হয়ে গেছি!

Handmade Card3
বুড়ো বয়সে কী ভালোই না লাগে উপহার পেতে!

তবে বিপত্তিও কি কম! সেবার তো এক বুড়ি, বিদেশ থেকে পাঠানো একগোছা দামি গোলাপ তার জন্মদিনে ভোরবেলা পেয়ে, আহ্লাদে প্রায় মরে আর কি! WA এবং Facebook চষে হৈ হৈ করে জানতে চাইল— ‘কে… কে… কে-গো! আমাকে প্রেম জানাতে এমন ফুল্ল উৎসব!’ বেলা বাড়তে তার বউমা আলাদা করে আবার একটি বিশিষ্ট কেক পাঠিয়ে জানতে চাইল যে, ছেলে নিজের নাম-ঠিকানা গোপন করে, যে Surprise-Bouquet টি পাঠিয়েছে, সেটি কি শাশুড়ি-মা পেয়েছেন! হায় রে! প্রেমিকের বদলে ছেলে! ‘নিকুচি’ করেছে ছেলের— এই বলে সেই যে ঠাকরুন মুখ ঘোরালেন, সেদিন আর প্রকাশ্যই হলেন না! এ ভার তিনি রাখেন কোথায়! দেহভারের সঙ্গে এবার যোগ হল তাঁর মন-ভারও!
আর এক মাসিকে তার বোন-পো এরকমই একটি Surprise-Cake পাঠালে, দরজা খুলে, ভালো করে কিছু না শুনেই তাকে বিদায় করে দিলেন। এক ধমকে জানিয়ে দিলেন যে ‘নেহি চাইয়ে। আমি কোনও অর্ডার দিইনি’। সেই সুইগি-বেচারা দু’চারবার মিউ মিউ করে বোনপোকে ফোন করতে লাগল; তুমুল ব্যস্ততায় বোনপোও ফোন তুলল না, অচেনা নম্বর দেখে। পরে হঠাৎ খেয়াল হল যে, ‘delivered’ মেসেজ? সেটি কই! অত দেরি করে, আর কোথায়? ‘Refused to receive’ সেই বাক্স তখন ‘কেক তুমি কার/ যে পায় তার’! ফোনাফুনিতে পরে সব জানাজানি হতেই, মাসি-বোনপো দুজনেরই সে কী হায় হায়!
আর এক বিপত্তি হল এই যে, বেশ কিছু বুড়োবুড়ি আবার একেবারে স্থির সিদ্ধান্তে অটল যে, এই ফুল, কেক বা অন্যান্য মিষ্টি— সবই নাকি ‘ডাইরেক্ট’ এসেছে ছেলে-মেয়ে থাকা সেই বিদেশ থেকে; মানে আমেরিকা-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ফ্রান্স বা সিঙ্গাপুর থেকে। হাতে ধরে তাঁরা কিন্তু দেখছেন যে বাক্সের ওপর লেখা ‘হরগৌরী’ বা ‘কল্পনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ বা ‘মুখরোচক’— তবু সেই এক তক্ক! আর এঁদের কথা অনুযায়ী, সেসব বাড়ির পরিচারিকারাও জানান দিতে থাকে, কোন কোন বাড়ির মাসিমা বা মেসোমশাইয়ের জন্মদিনে দাদা/দিদি ‘আম্রিকা’ থেকে কেক পাঠায়সে; বড় বড় চোখে বলেও চলে, ‘তখন কিন্তু অখানে মাজরাত, কেক তবু আইস্যা পরল…’!

free-photo-of-roses-in-bouquet
বিদেশ থেকে পাঠানো একগোছা দামি গোলাপ

এ সবের মধ্যে আরও কিছু জিনিস শিখে নিয়েছি—

  • বিশেষ বিশেষ সময়ে online discount দিলেই, টুকিটাকি উপহার আগাম কিনে, খেয়াল করে আনিয়ে রাখা। কারণ পা-ছুঁয়ে প্রণাম বা কপালে-চুমুর সেই জন্মদিন, একেবারেই যে লোপাট হয়ে গেছে এমন তো নয়!
  • পছন্দের সাইটগুলিতে আগাম গিয়ে, রেস্ত বুঝে বেশ কিছু জিনিস Add to Cart করে রাখা; সময়মতো আরও একটু ঝেড়ে-বেছে এবং দেখে-শুনে কেনার জন্য। 
  • তাছাড়াও কেক-সমেত ফুল বা প্ল্যান্ট-পট সমেত গাছ একবার পাঠালেই হল! প্রতি বছর ওই সময়ে, সেই সব কোম্পানির নোটিশ আসতেই থাকবে আমাদের মনে করিয়ে দিতে।
  • নমিতা বা মঙ্গলা কেউ না রাজি হলেও, নিজের জন্মদিনে খুব পছন্দের কয়েকজনকে তো টুক করে ডাকাই যায়! নানারকম খাবার, কাগজের প্লেট, এমনকী চা এবং পান— সবই আনিয়ে নেওয়া যায় থরে থরে। ঘরে ক্যাশ না থাকলেও ভাবনা নেই। সেখানেও online payment। আহ হা! কী ব্যাপক স্বাধীনতায় ‘মো-মো’, ‘কাবাব’, ‘আফগানী রোল’ বা ‘মটন-কষা’…
  • শুধু কি বন্ধু -স্বজন! উপায়ান্তর না পেয়ে আমাদের ‘রাধাকান্ত জিউ’-এর জন্মদিনেও পছন্দের ফুল-মালা-ধুতি-উড়নিও পাঠালাম; সঙ্গে রাধারাণীর শাড়িখানিও। তবে এসব ঠিক উপহার নয়; প্রণামী। মেয়ের কাছ থেকে শিখে এমন একখানি জম্পেশ ‘app’ পেলাম যে ‘Pickup’ এবং ‘Drop’ দিলেই কার্য-সমাধা; মাইল কষে হিসেব করে যে চার্জ তারা বলে দেবে, সেটা তো তেল পোড়ানো, গাড়ি-খরচ এবং সময়ের খয়রাতির কাছে একেবারেই নগণ্য। ইচ্ছে আছে অমরকণ্টকের নর্মদা-মন্দিরের নীলু পুরোহিতের নামেও এভাবেই প্রণামী- উপহার পাঠানোর; মা-নর্মদার জন্মদিন পালন করা হয় প্রতি বছর সরস্বতী পুজোর দিন।  
  • আর ‘অধিকন্তু ন দোষায়’— এই বয়সে এসে এটাও শিখেছি মন দিয়ে যে, বাবা মায়ের Shipping Address এবং ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনির Delivery Address মোটেই আর এক নয়। হোক তা পাশের ফ্ল্যাট বা দূরদেশে বিদেশ-বাড়ি!    
Cake and gifts
অনলাইনে কেক, উপহার দুই-ই

তবে জন্মদিন ব্যাপারটা একেবারে মোহময় করে তুলেছে, আমাদের ইস্কুল বন্ধুদের WA Group-য়ে জয়শ্রী । নয়ডাবাসী এই জয়শ্রী ইস্কুলে থাকতেই দারুণ ছবি আঁকত এবং গান গাইত। কালক্রমে দিল্লির একটি ইস্কুলের একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত হেডমিস্ট্রেস হয়ে, গলা থেকে সেই ‘বৃন্দাবনের কালো কোকিল রে, (ডাকিস নে ডাকিস নে আর)’ পালিয়ে গেলেও রং তুলি তাকে ছাড়েনি। দিল্লিতে সেই কর্মস্থল মানে ইস্কুল-চত্বরে তার দেওয়া আল্পনার ছবিতে তো ছয়-লাফ। আর অবসর নিয়েই সে এক দারুণ ব্যাপার শুরু করেছে। আমাদের তিরিশ জনের গ্রুপে, প্রত্যেকের জন্মদিনে আলাদা আলাদা কার্ড এঁকে ভোর না হতেই সে আপলোড করে দেয়। ফলে সকলের জন্মদিনটাই হয়ে ওঠে বিশিষ্ট এবং বড় আদরের। আমরা অপেক্ষা করি, ঝগড়া বাধাই যে আজ কার জন্মদিন বা কোন কার্ডটা সবচেয়ে ভালো হল। জয়শ্রীর অনুপ্রেরণাতেই সঙ্ঘমিত্রা বীণা, সুপ্রিয়া, শ্রাবন্তী পাঠায় তাদের বাড়ির বাগানে নানা সময়ে ফোটা অপূর্ব সব ফুলের ফটো। দু-চার অক্ষরে আমিও লিখে পাঠাই ওই birthday g’ টি কেমন ছিল আমাদের সেই ইস্কুলবেলায়। গত তিন-বছর ধরে একই রকম আনন্দে, বারোমাসে ডজনাধিক ছবি এঁকেও জয়শ্রী কিন্তু অক্লান্ত এবং আক্ষেপহীন; কারণ তার জন্মদিনে তো আর আমরা ওরকম এঁকে পাঠাতে পারি না। জয়শ্রীর এই innovative-administration জারি থাকায়, ফেসবুকে একরকম এবং আসলে অন্যদিন (কোনও এক অজ্ঞাত কারণে) একই বছরে যাদের দুটো ভিন্ন ভিন্ন দিনে জন্মদিন ছিল, সেসবও শুধরে নেওয়া গেছে; সেই সঙ্গে এও ধরা পড়েছে যে অদিতি মিটিমিটি হেসেও তার জন্মদিনটি জানায়নি। ফলে আমরা ঠিক করেছি যে, যে কোনও একজন অবতার বা মহাপুরুষের জন্মদিনটি সর্বসম্মতিক্রমে বেছে নিয়ে সেটাই পালন করব। আমার ইচ্ছে অবশ্য ফ্রয়েড, মার্কস, আইনস্টাইন, লর্ড ক্লাইভ বা রামদেব বাবা— এমন কারও সঙ্গে অদিতির জন্মদিনটা শেয়ার করা; দেখা যাক লোকজন কী বলে! আর ইচ্ছে আছে যে একে একে চোখ বুজিয়ে ফেলা ওই গৌরী, শকুন্তলা আর দেবযানীর জন্মদিনেও জয়শ্রী ছবি আঁকুক না! এদের ছেলে-মেয়েরাও তো জানবে যে এই তিনজন কতখানি সজীব আমাদের মনে!  

আজ তাই এই শুভেচ্ছাই ঝরে পড়ুক আমার এই অক্ষর-বিলাসে যে, জন্মদিনই যেন হয়ে ওঠে সর্বোত্তম এক শুভেচ্ছা-দিনও; আর তা কী সত্যি নয় যে ‘…অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে’!

ছবি সৌজন্য: Pexels, Wikimedia Commons

অলংকরণ সৌজন্য ও বিশেষ ধন্যবাদ- লেখিকার নয়ডা নিবাসী বন্ধু জয়শ্রী বসু

Author Mondar Mukherjee

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Picture of মন্দার মুখোপাধ্যায়

মন্দার মুখোপাধ্যায়

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে। লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
Picture of মন্দার মুখোপাধ্যায়

মন্দার মুখোপাধ্যায়

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে। লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস