একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ‘ভাষা দিবস’ নিয়ে কিছু বিশেষ লেখা প্রকাশ পায়। দক্ষিণারঞ্জন বসুর লেখা এই নিবন্ধটি যুগান্তর পত্রিকার পাতার প্রকাশ পেয়েছিল সেই বিশেষ দিনে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিবন্ধটি বাংলালাইভের পাতায় পুনঃপ্রকাশিত হল। তথ্যঋণ- ফাল্গুনি দত্ত রায়।
দক্ষিণারঞ্জন বসু
এখন বসন্ত। বাঙলার মুখ এখন লালে লাল। কৃষ্ণচূড়ায় পলাশে শিমূলে রক্ত-হাসির এখন ছড়াছড়ি। তার সঙ্গে বিগত বিশ বছরের ইতিহাস জড়িয়ে গিয়ে বাঙলার বসন্তকে করেছে আরো মহিমান্বিত।
মাতৃভাষার সৌরভে আমি ডুবে আছি। প্রস্ফুটিত গোলাপের সুমধুর গন্ধের চেয়েও অনেক বেশি প্রাণ আকুল করা সৌরভ আমার বাংলা ভাষার, বাংলা সাহিত্যের। সে গন্ধকে, সে সৌরভকে নতুন যুগে নতুন করে যাঁরা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে শ্রদ্ধানত চিত্তে সেই ভাষা-শহীদদের আজ প্রথমেই স্মরণ করি।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ স্মরণ দিবস। মাতৃভাষার মুক্তি দিবস। বাঙালী জীবনে এমন পবিত্র দিন এমন স্মরণীয় দিন আর দ্বিতীয়টি নেই।
না, একুশে ফেব্রুয়ারী আজ আর একটি দিনমাত্র নয়, এ এক পবিত্র শপথের দলিল, বাংলা ভাষায় মুক্তির এবং বাঙালী জাতির মুক্তির এই দিনটি হলো প্রথম মাইল পোস্ট।
বাঙালী তার জাতীয়তাবাদকে হারিয়ে ফেলেছিল সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের ভেদনীতির পৈশাচিকতায়। কিন্তু সেই সাম্প্রদায়িক জিগির ভুলে পাকিস্থানের লীগশাহী যেদিন বাঙালীর মাতৃভাষার ওপর চরম আঘাত হানতে উদ্যত হলো বাঙালীর জাতীয় ভাবাবেগ সেদিন দুর্বার হয়ে ফেটে পড়লো।
জাতীয় চেতনার নব-উন্মেষের সেই কাল নতুন যুগের বাঙালীর মুক্তি আন্দোলনের ঊষা-কাল। সাম্প্রদায়িকতার পাপ-পঙ্কিলতা থেকে তরুণ বাঙালী জনতা বঙ্গজননীর চরণযুগল তুলে ধরলো, বুকের রুধিরে ধুইয়ে দিল সে চরণ। বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আত্মাহুতি দিয়ে অমরত্বের মুকুট পরালেন বরকত-সালাম-রফিক-জব্বার।

বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী থেকে বাঙলার আকাশে সূর্য যেন আরো অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিতে লাগলো। বাস্তবিকই ঐ দিন থেকেই পূর্ব বাঙলার ঘরে ঘরে নব জাগরণের সাড়া পড়ে গেল— বাঙালী তার সব অধিকার কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নেবে, বাঙালী আর কিছুতেই নিজেকে শোষিত হতে দেবে না— এই হলো তার শপথ।
কুড়ি বছর আগে বাঙালী তার প্রথম গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে পাকিস্থানের অনিচ্ছুক হাত থেকে। সেদিন বাঙালীর জনমানসে জাতীয় চেতনার ও গণতান্ত্রিক চেতনার যে দুর্বার বেগ সৃষ্টি হয়েছিল সেই বেগ-তরঙ্গই স্বাধীনতার বিজয় তোরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল গোটা জাতিকে।
সোনার বাঙলা যখন বিভক্ত হলো অনেক সুস্থ বাঙালী মুসলমানের মনেই তখন এ প্রশ্ন জেগেছে, একই দেশে একই ভাষায় যারা কথা বলে ও একই সাংস্কৃতিক পরিবেশে যাদের জন্ম এবং যারা লালিত তারা কি কখনো পৃথক জাতি হতে পারে শুধুমাত্র ধর্মের নামে?
ভাষাই হলো সবচেয়ে শক্ত জাতীয় বন্ধন, সেই ভাষ্যকে উপেক্ষিত ও অবমানিত রেখে ধর্মীয় গোঁড়ামি দ্বারা চালিত হওয়া এই বিংশ শতাব্দীতে কখনো সম্ভব হতে পারে না, পূর্ব বাঙলার যুবশক্তি তা সগৌরবে সপ্রমাণ করলেন। তাঁদের আত্মদানের ও রক্তদানের মহিমায় শুধুমাত্র ভাষা জননীর মর্যাদাই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বাঙলা- দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্যের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত সেদিন ধরতে পারা গিয়েছিল।
বাস্তবিক পক্ষে ভাষা আন্দোলনের রক্ত-স্নানে শোষিত হয়ে সেদিন পূর্ববঙ্গের মানুষ অসাম্প্রদায়িকতার মনোভাব এমনভাবে ব্যাপ্ত করে দিয়েছে যে পাকিস্থানের পাপ নামটি পর্যন্ত তারা বাঙলার মানচিত্র থেকে ধুয়ে মুছে ফেলতে কৃত-সংকল্প হয়েছে এবং সে সংকল্প তারা লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এবং অভূতপূর্ব ত্যাগ ও নির্যাতন বরণের মধ্য দিয়ে পূর্ণ করেছে।

ভাষা আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে বদরুদ্দিন উমর সাহেব লিখেছেন, ‘…সাম্প্রদায়িকতার আবর্তের মধ্যে পূর্ব বাঙলার জনসাধারণকে নিক্ষেপ করে মুসলিম লীগ সরকার তাদের জিহ্বা ছেদনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে যা সম্ভব হয়েছিলো, জবানের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। তার কারণ, জিহ্বা ও খাদ্যের সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ, ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে সমগ্র আর্থিক জীবনের সম্পর্ক তেমনি গভীর— এই সত্যের উপলব্ধি তাদের মধ্যে এসেছিল, কাজেই শেষ পর্যন্ত ইসলামী তমদ্দুনের নামে উর্দুকে বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর চাপানোর সাম্প্রদায়িক প্রচেষ্টা এদেশে ব্যর্থ হলো। রাষ্ট্র-ভাষা আন্দোলনের এখানেই অপরিসীম গুরুত্ব। এর মাধ্যমে পূর্ব বাঙলার মুসলমান মধ্যবিত্তরা সর্বপ্রথম লাভ করল একটা নোতুন পরিপ্রেক্ষিত এবং তাদের মধ্যে এলো অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চার এক নোতুন অভূতপূর্ব প্রেরণা।’
বাস্তবিক পক্ষে এখান থেকেই সূত্রপাত হলো বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের। বঙ্গালীত্বের চেতনাই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ব বাঙলার মানুষের ঐক্যের শক্ত বনিয়াদ গড়ে তুলেছে এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালীর সংস্কৃতিবোধই সেই বাঙালীত্বের মূল ভিত্তি। আর এ ভিত্তি এতই দৃঢ় যে, তার ওপর নির্ভর করেই বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিব পাকিস্থানের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হবার কিছুদিন আগে তাঁর বাড়িতে বসে বিদেশী সাংবাদিকদের বলতে পেরেছিলেন, ‘আপনারা কি মনে করেন মেসিনগান দিয়ে এই ঐক্যে ফাটল ধরানো কিংবা স্বাধীনতার এই দুর্বার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করা সম্ভব? কখনো তা সম্ভব হতে পারে না।’

শেখ মুজিবের সে মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছ। বিজয়ী বাঙালীর প্রতিটি পদক্ষেপ আমরা সাগ্রহে লক্ষ্য করছিলাম। দেখলাম, কী দুর্মর আবেগে সমস্ত প্রতিরোধ চূর্ণ করে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করলো,
স্বীকৃতি পেলো বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য এবং পরিপূর্ণ গৌরবে বাঙলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলেন রবীন্দ্রনাথ আর স্বীকৃতি পেলো পয়লা বৈশাখ। এমনি করেই বঙ্গ সংস্কৃতির জয়জয়কার ঘোষিত হয়ে চললো। বাঙলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এই পর্যায়কে সুপণ্ডিত বদরুদ্দীন উমর সাহেব ‘মুসলমান বাঙালী মধ্যবিত্তের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ বলে অভিহিত করেছেন। এরই প্রথম সাফল্য যেমন অর্জিত হয়েছে মাতৃভাষার মুক্তিতে তার সফল পরিণতিও বিশ্ববাসী মুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে বাঙলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতায়।
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্যে কোনো জাতি যে নিজ অস্তিত্ত্বকে এমনভাবে উৎসর্গ করতে পারে পৃথিবীর ইতিহাসে তেমন কোনো নজীর নেই। সে আত্মদান আজ সম্পূর্ণ সার্থক। তবু-পবিত্র একুশে ফেব্রুয়ারী প্রতি বছর অসবে, এই দিনে অমর শহীদদের নামে শপথ নেওয়া হবে— মাতৃভাষা, মাতৃভূমি-এই দুই মায়ের চরণ চুমি, মাটির দেহে জীবন যতদিন।’
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।