আমি একটা খুব priviledged family-তে বড় হয়েছি। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, তার সঙ্গে উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সংমিশ্রণ, তখন বুঝিনি। এখন বুঝি কী ভীষণ blessed আমি। আমার মা ভারী উদ্যমী মানুষ ছিলেন। রাজনীতি, বাংলা সংস্কৃতি এবং সরকারি দায়িত্ব পদ— সবই একাধারে, একহাতে সামলাতেন। তার সঙ্গে সংসার।
ভাইবোনেদের জীবনে সমাজের নানারকম এক্সপোজার মূলত মা’র হাত ধরেই। আজ সুনীলদা— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sunil Gangopadhyay) কথা বলি। আমারও সুনীলদা। মা’রও সুনীলদা।
সুনীলদাকে যখন প্রথম দেখি তখন আমি নেহাতই কিশোরী। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে তখন অনাবিল স্বাধীনতা, একটানা তিন মাসের। বলতে গেলে সেটাই ছিল প্রথম নিজেকে চেনা, জানা এবং বোঝার বয়স এবং অবসর।
সাধাসিধে মেয়েটাকে স্মার্ট করতে হবে— মা-বাবার এহেন ডিসিশনে মায়ের হাত ধরে যত্রতত্র যাওয়ার পাসপোর্ট তখন আমার জোব্বায়।

আমাদের সাহিত্য পত্রিকা ‘রূপসা’ ছাপা হত আমাদের নিজস্ব প্রেসে এবং আমার মা গীতা মুখোপাধ্যায় তার সম্পাদনা করতেন। সেই সূত্রে তাবৎ লেখকদের আনাগোনা ছিল আমাদের বাড়িতে। আমার কর্তা শংকরলালও তখন সেই দলের একজন নেহাতই নবীন লেখক। গীতাদির হাতের ছানার চপ খেতে প্রায়শই আমাদের লিভিং রুমে পদার্পণ। যাকগে, সে তো অন্য কথা। এ পর্ব এখন থাক।
সুনীলদা (Sunil Gangopadhyay) খুব সুন্দর করে কথা বলতেন। হাসতেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে লেখার কাজটাও করে যেতেন। ওঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সামনে বসা যে কোনও মানুষকে আস্তে আস্তে আক্রান্ত করত। সময় জলের মতো বয়ে যেত, টেরই পেতাম না। তবে একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। সুনীলদার মাথায় কালো ভরাট চুল, পাটপাট করে ব্যাকব্রাশ করা; কিন্তু, জুলপি কেন সাদা? এর উত্তর অনেকদিন পরে পেয়েছি, ততদিনে জুলপি অদৃশ্য।

ছেলেবেলার নরম, পবিত্র. রোমান্টিক মনে সুনীল, শক্তি, পূর্ণেন্দুর কবিতা রামধনুর মতো রং ছড়াত। অনেক কিছু বুঝতাম, আবার বুঝতামও না। এখন এই পরিণত বয়সে, কঠিন বাস্তবের সামনাসামনি হওয়ার শক্তি কিন্তু সেই কিশোরী নরম মনের ইন্দ্রাণীর হাত ধরেই আসে। এখনও আমি পরিষ্কার দেখতে পাই, আমার মায়ের হাত ধরা সেই কিশোরী ইন্দ্রাণীকে, যে কিনা বিস্ফারিত বিস্ময়ে সামনে বসা সুনীলদার পিঁপড়ের সারির মতো হাতের লেখায় ‘রোমিও জুলিয়ট’-এর অনুবাদ দেখছে। এটাই তো ছাপা হবে ‘রূপসা’ পত্রিকার আগামী সংখ্যায়। লেখা শেষ করে সুনীলদা খুব মিষ্টি লাজুক হেসে বললেন— “এবারের মতো এতটাই পারলাম; … গীতা তোমার মেয়েকে বলো না কবিতা লিখতে; ভারী সুন্দরী তোমার মেয়ে।”
আমি ভীষণ লজ্জায়, অস্বস্তিতে বলে উঠলাম— “আমি তো ওসব পারি না।”
— “লেখো, ঠিক পারবে”, বলে হেসে ঘরে চলে গেলেন।

স্বাতীদি— কী মিষ্টি মানুষ একজন। নরম হেসে মায়ের দিকে এককাপ চা বাড়িয়ে কোঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে বললেন— ‘ওমা! এটা কে?’
আমি মুগ্ধ হয়ে ভাবলাম, সুনীলদার বউ কী সুন্দরী!
এরপর ঢাকুরিয়া ব্রিজের নীচে সুনীলদা-বৌদির ভাড়া ফ্ল্যাটে অনেকবার গেছি। কখনও খালি হাতে ফিরিনি। আর আশ্চর্য! কোনওদিন লেখার জন্য কোনও পারিশ্রমিকও চাননি সুনীলদা। মা সামান্য কিছু অবশ্যই দিতেন। ভীষণ লজ্জার সঙ্গে সুনীলদা হেসে হাত বাড়াতেন।
আমি কোনওদিন সুনীলদার ছেলেকে দেখিনি। সত্যি কথা বলতে কি অনেকদিন জানতামই না ওঁদের কোনও সন্তান আছে। দেখলাম এক্কেবারে তার বিয়ের সময়, এবং ততদিনে সে আমেরিকা প্রবাসী। এভাবেই সংসারকে সুনীলদা সবসময় অন্দরে রেখেছেন, পাবলিক করেননি।

সুনীলদার সঙ্গে মেদিনীপুর যাচ্ছি। সঙ্গে মা, শংকর, আরও কেউ কেউ। অ্যাম্বাসাডর ছুটছে, প্রোগ্রাম আছে। হঠাৎ সুনীলদা বললেন— ‘ইন্দ্রাণী গান ধরো।’ আমি চুপ। মুড না থাকলে আমি বরাবরই গাইতে চাই না। সবাই চাপাচাপি করতে থাকে। আমি বেশি কথা কোনওদিনই বলি না। বিশেষ করে বাইরের লোকের সামনে। কিছুই বললাম না। গানও গাইলাম না। হঠাৎ সুনীলদা গান ধরলেন— ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’ সঞ্চারীতে যেতেই অস্থির হয়ে বললাম, ‘নাঃ। সুর হচ্ছে না।’ এবং আমি পুরো গানটা গাইলাম। গান শেষ হতে সুনীলদা বললেন— ‘দেখেছ! কেন ভুল সুর করেছিলাম?’ সবাই জোরে হেসে উঠল। আমি বেকুব। তবে ততক্ষণে আমার মুড এসে গেছে। মনে আছে, সারা রাস্তা ধরে পুরো চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের গান আমি একাই গেয়েছিলাম। মাঝে মাঝে অর্জুন— সুনীলদা।
সুনীলদা নেই! সত্যিই তাই? নাঃ, হতেই পারে না। টরন্টোতে বসে খবর পেলাম। প্রথমে খুব রাগ হল। সুনীলদার এত তাড়া কিসের? আমরা কি কেউ না? কেউ কথা রাখে না। আপনিও রাখলেন না! কানাডা আসার আগে যখন দেখা হল, বরাবরের মতো আমার ডান হাতটা ধরে বলেছিলেন, ‘ফিরে এসো, তোমার বাড়িতে বসে অনেক গান শুনব। একটা গান অবশ্যই গাইবে— ‘সহে না যাতনা/দিবস গণিয়া বিরলে/বসে আছি পথ চেয়ে/সখা হে এলে না…’।
সুনীলদা কেউ কথা রাখেনি। আপনিও না।
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব