(১)
শপিংমলে সেদিন অনেককিছুই নেওয়ার আছে রজতের। সামনের উইকেন্ডে তাদের বাড়িতে মস্ত খানাপিনা। বন্ধুবান্ধবদের ডেকেছে সে। রজতের গিন্নী অনুরূপা সেখানে ঢুকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রজতের থেকে। প্রতিবারের মতোই। মেয়েকে নিয়ে সোজা চলে গেল সে যান্ত্রিক সিঁড়ি বেয়ে সড়সড় করে, ওপর তলায় কুর্তা-কেপরি-স্কার্টের থরেথরে সাজানো মহলে। তার ওপরে কিচেন অ্যাকসেসারিজ। মা মেয়ের ওখানেই ইন্টারেস্ট বেশি। যার যা ভাললাগে।(Short Story)
রজত প্রতিবারের মতো হাজির হয়েছিল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে তার অতি পছন্দের লিকার কর্নারে। শপিং মলের এই জায়গাটায় আম আদমি যায় না। মদিরা পিপাসুরা যায় কেবল। ফাঁকাই থাকে বেশ। হরেক কিসিমের দিশি, বিদেশি লিকারের সম্ভার। থরে থরে সাজানো। রজত ভাবে, বাব্বা! বাঁচা গেছে। আর এখন পাড়ার রাস্তার দোকানে লাইন দিয়ে দেহাতি রিকশাওয়ালার সঙ্গে দাঁড়িয়ে মদ কিনতে হয় না। লোহার গ্রিলের বাইরে দাঁড়িয়ে কেনাবেচা সেখানে। শপিং মলে নিজে হাতে দেখে শুনে, দাম পরখ করে, পছন্দের ব্র্যান্ড কেনা যায়। কী সফিস্টিকেশন এইসব মদ ব্যবসায়। শহরের উন্নতি হয়েছে বটে!
ভাগ্যিস! অনুরূপা মেয়েকে নিয়ে ওপরের তলায় ফ্যাশন সেকশনে চলে গেছে। নয়তো এখনই ট্যাক্স বসত রজতের কেনাকাটায়। কথার ফুলঝুরি শুরু হয়ে যেত।
রজত বাপমায়ের একমাত্র ছেলে। মায়ের সংসারে মদ নিয়ে বসার জো ছিল না। মায়ের এসবে ঘোর আপত্তি। রজতের বাবা সরকারী কেরানি ছিলেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল ছেলেটা যাতে মানুষের মতো মানুষ হয়। বাবা ছোট থেকেই শিখিয়েছিলেন প্লেন লিভিং, হাই থিংকিং। মাথা উঁচু করে হাঁটবে তবেই না তোমার মনুষ্যত্ব। রজতকে অবিশ্যি তিনি এসব মাথায় ঢোকাতে পারেননি আলটিমেটলি। মা বলেছিলেন কপালে যা থাকে সেটাই হয়। অতএব তিনি রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন। বাবা গত হয়েছেন। সেটাই রক্ষে।
রজত আজ কপাল জোরে প্রতিষ্ঠিত মস্ত ইঞ্জিনিয়র। দামি কর্পোরেট। ব্যাস্! সে মগ্ন তার চাকরি আর সংসার নিয়ে। অনুরূপা রজত আর তাদের কন্যা পৌষালী। কিন্তু অনুরূপার মনে খচখচ করে। সে মা হবার পর আরও বেশি করে টের পায় সন্তানের বন্ধনের ব্যাপরটা কত মজবুত হয়। তাহলে না জানি তার শাশুড়ি কত কষ্ট পান ছেলের জন্য। একই শহরে থাকে তারা। ভিন্ন বাড়ি। আলাদা হাঁড়ি। অথচ তার শাশুড়ির সঙ্গে রজতের নাড়ির টান কি করে অস্বীকার করা যায়? কিন্তু রজত একদম থাকতে চায় না মায়ের সঙ্গে। এ এক আজব কিসসা। অদ্ভুত এক ট্রেন্ড আজকালকার।
ছেলের বৌ শাশুড়ির সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না। ছেলেরও সম্মতি আছে তাতে। ঘর ঘর কি কাহানি। এমনি আকচার শোনা যায়। তাই বলে ছেলে নিজে থেকে এমন বলবে? যদিও তাদের ছোট্ট বাড়িতে সকলে মিলে থাকাটাও একটু কষ্টের। স্থানাভাব। তাই বলে একই শহরে আলাদা হবে কেন? অনুরূপা বলেছিল, তার চেয়ে বাড়িটা বিক্রি করে একটা বড় ফ্ল্যাট কিনে বাবা মা’কে নিয়েই না হয় থাকবে তারা। রজত বলেছিল, অসম্ভব। তাদের মেয়ের বার্থডে পার্টি হয়। রজতের অফিস কলিগরা আসে প্রায়শই। জমিয়ে মধ্যরাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যায় মদের ফোয়ারায়। নিজেরাও যায় তাদের বাড়িতে। মায়ের সঙ্গে থাকলে এসব অসম্ভব। জীবন তো একটাই। রজতের জব প্রেশারও প্রচুর। অতএব স্বস্তির জন্য চাপমুক্ত হতে গেলে বাঁচার অনুষঙ্গ হিসেবে এসব চাই। “তাছাড়া তোমারও তো মায়ের সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকাটায় বেশ চাপ, তাই না?”

অনুরূপা বলেছিল, সে আমি সামলে নিতে পারি।
আর তোমারই বা এত অজুহাত দেখানোর কী আছে?
অনুরূপা ভাবে। মদ খাবে খাও। ফুর্তি কর। সেই সঙ্গে সংসারের উচিত অনুচিতটাও…
মানে মা’কেও দেখো। আমাকেও দেখো। মায়েরও তো একটাই জীবন। বেচারার কী হাল কে জানে। একদিন তো বয়স হবে মায়ের।
আলাদা হওয়ার পরে অনুরূপা যদিও মেয়েকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে গিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করে আসত। টুকটাক কিনে কেটে দিয়ে আসত তাঁর প্রয়োজনে। তারপর উনি নিজেই তলেতলে সব ঠিক করে বসলেন। একদিন তাঁর সব জমানো টাকাপয়সাগুলো দিয়ে শান্তিনীড়ে চলে গেলেন। নিজের নামে রজতের বাবার বানানো ছোট্ট বাড়িটাও বন্ধ করে দিয়ে গেলেন। বাড়ি ওঁর নামে। শান্তিনীড় বয়স্ক মহিলাদের আবাস। কলকাতার উপকণ্ঠে। বেশ দূরে। সহজে কেউ যেতে পারবে না সেখানে। সেই ভেবেই হয়তো।
সেখানে আবাসিক মহিলারা হাতের কাজ শেখান দুঃস্থ গ্রামের মেয়েদের। যে যেটা পারেন। কেউ সফট টয়, কেউ ছবি, কেউ শেখান সেলাই বা আলপনা দেওয়া। কেউ আচার, জ্যাম জেলি বানিয়ে দেখান। রজতের মা সুধা এক্সপার্ট মেদিনীপুরের বিখ্যাত গয়নাবড়ি দিতে। তাঁর সিগনেচার আর্ট ওটা। প্রচুর প্রদর্শনীতে দিতেন একসময়। সংসারের জোয়াল রজতের বাবার কাঁধে থাকলেও নিজেও চেষ্টা করতেন উপার্জনের। হাতখরচটা তো ওঠে।
শান্তিনীড়ের লোকজন সেকথা জানতে পাওয়া মাত্রই অঘ্রাণ মাস পড়তে না পড়তেই তোড়জোড় করে ফেলেছিল। নতুন বিউলির ডাল এনে সুধাদেবীকে বলেছিল, “মাসিমা, আগামীকাল অঘ্রাণের শুক্লপক্ষে বড়িহাত করবেন আপনি।” সুধা উদ্বেল আনন্দে। এসব স্ত্রী আচারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। ধান দুব্বো, সিঁদুর সব রেডি করতে বলেছিলেন শান্তিনীড়ের আশ্রমিক মেয়েদের। তারপর বেতের কুলোয় নরম কাপড় বিছিয়ে প্রথমে বড় বড় দুটো বড়ি দিয়েছিলেন। ঠিক যেমন নিজের বাড়িতে দিতেন। ডালবাটার মধ্যে চালকুমড়ো কোরা, আদা, মৌরী বাটা, এক টুসকি হিং দিয়ে বড় বড় বুড়ো আর বুড়ি গড়ে দিয়েছিলেন। বুড়ি বড়ির মাথায় গুচ্ছের সিঁদুর দিয়েছিল এক এয়োস্ত্রী বৃদ্ধা আশ্রমিক। ধান-দুব্বো দিয়ে আশীর্বাদ করে সুধা শাঁখ বাজিয়ে উলু দিতে বলেছিলেন অল্পবয়সীদের। নিজের বাড়িতে বড়ির বুড়োবুড়ির বিয়ে দেবার সময় পাঁচ এয়োস্ত্রীর হাতে পান, কপালে সিঁদুর ছুঁইয়ে দিতেন। সব মনে পড়ে গেল। শান্তিনীড়ে সবাই বন্ধু। সেখানে তারা নিজেদের খুশিতে পুজোআচ্চা, বারব্রত নিয়ে ভুলে থাকে। যে যার মতো নিজেদের ঘরে টাঙানো বাংলা ক্যালেন্ডার দেখে এ ওকে মনে করিয়ে দেয়। নিজেদের মতো করে তাদের সম্বচ্ছরি ঋতুরঙ্গ ওরা পালন করে।

সেবার বড়ির বিয়ে দেওয়ার পরে সেই ডালবাটা দিয়ে রেকাবে তেল মাখিয়ে পোস্তদানা ছড়িয়ে সুধা তাক লাগিয়েছিলেন সবাইকে। বড়ির সীতাহার, মুকুট, কানের দুল এইসব বানিয়ে। দুধের প্লাস্টিকের প্যাকেট ছেঁদা করে বড়ির ডালবাটা নিয়ে সুচারু হাতে একের পর এক গয়নাবড়ির আলপনা দেওয়া দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়েছিল। বাকিরা জানে হিং দিয়ে বড়ি দেওয়া। অথবা কালোজিরে, পোস্ত দানা ছড়িয়ে ছোট্ট ছোট্ট ভাজা বড়ি বানানো। বড়ির মাথা যত তীক্ষ্ণ হবে ছেলের বউয়ের নাক নাকি ততই টিকালো হয়। হায় পোড়া কপাল! সুধার ক্ষেত্রে তা মেলেনি মোটেও। একমাত্র বৌমা অনুরূপার নাক সেই অর্থে মোটেও টিকালো নয় বরং একটু মাটাই। তবে তা নিয়ে তাঁর কোনও দুঃখ ছিল না। মেয়েটা কোনোদিন তাঁর অযত্ন করেনি। পরের মেয়ের নামে দোষ দেননি তিনি কখনও। একটাই তো ছেলের বউ তাঁর।
বড়ি দিতে দিতে সুধা ভাবেন স্নান সেরে অঘ্রাণের মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে ছাদে গিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে বড়ি দেওয়ার কথা। কতরকমের বড়ি দিতেন তখন! ঝোলে খাবার বড় বড়ি, ছোট্ট ছোট্ট ভাজাবড়ি, সুক্তোর জন্য মাঝারি বড়ি। গয়নাবড়ি দিতেন আলাদা একটা দিনে। সে এক দেখবার মতো শিল্প। সুধার শ্বশুরবাড়িতে খুব নাম। এই বড়ি দেওয়ায় এক্সপার্ট তিনি। শিখেছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছে। গরম ভাতের সঙ্গে ডাল মেখে হাপুসহুপুস করে সাপটে খেয়ে নিত রজত। এই গয়নাবড়ি ভেজে দিলে। সোনা হেন মুখে খেয়ে নিয়ে ইশকুল যেত।
নাহ! চোখের জল সব শুকিয়ে গেছে তাঁর। সবাই সুস্থভাবে বেঁচে থাকুক। এই চান মনে মনে। সবার ভাল হোক। যে যেখানে আছে শান্তিতে থাক। ব্যাস! ঈশ্বরের কাছে এইটুকুনিই চাওয়া তাঁর।
অনুরূপা বুঝতে পারে তার শাশুড়িমায়ের অভিমানের জায়গাটা। কোনও অভিযোগ নেই সুধার। নিজের পেটের শত্তুর রজত কেমন বদলে গেছে একটা বড় মাইনের চাকরি পেয়েই। ভাবখানা কী না হনু! সামান্য ঘর থেকে উঠে আসা রজত আজ সত্যিই কেউকেটা। ছেলে বদলে গেছে বলে অনুরূপার দোষ নেই। তিনি জানেন এ হল যুগধর্ম। আবার ছেলে বড় হয়েছে বলেও ক্রেডিট নিতে চান না তিনি। ছেলেকে তিনি বিলক্ষণ চেনেন। রজতের প্রতি তার মায়ের এই অভিমানের জায়গাটাও অত্যন্ত একটা সংবেদনশীল ইস্যু। ঘাঁটাতে চায় না অনুরূপা। তার অবস্থা শ্যাম রাখি না কুল রাখি? একদিকে স্বামী আর মেয়ে অন্যদিকে শাশুড়ি। রজতের বাবা কিছুটা অভিমান নিয়েই যেন চুপিচুপি চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। সে কী আর বোঝে না রজত? সব বোঝে। এখন বুঝলেই বা কী? তবে মায়ের কথা একটিবার ভাবতেই পারত সে। কিন্তু মা ছেলের চিরকালই খাঁড়ায় বালি। বিয়ে হয়ে অবধি লক্ষ্য করেছে অনুরূপা। তাঁর প্রতিও করুণা হয়। অল সেড এন্ড ডান আজ অনুরূপার সংসারের সব লপচপানি তার একমাত্র শাশুড়ি নামের ভিনগ্রহের জীবটির জন্যেই। তাছাড়া লেবার পেন কী জিনিস তা বুঝেছে অনুরূপা। পৌষালী হবার সময়। তার নিজের মা মাথার ওপর হাত রেখে বলেছিলেন মা হওয়া কি মুখের কথা? সবুর কর একটু। সন্তান হল মায়ের বত্রিশ নাড়িছেঁড়া আদরের ধন। একটু কষ্ট তো করতেই হবে মা।
শাশুড়ির জন্য করুণা হয় তার কিন্তু তিনি করুণার পাত্রী হয়ে থাকতে চান না। আর সত্যিই তো। আজ রজতকে না পেলে কোথায় অনুরূপার সোশ্যাল স্টেটাস? আর কোথায় নিত্যনতুন হিরের কুঁচি বসানো গয়না কিম্বা নামি রেস্তোঁরায় খাওয়াদাওয়া? মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাওয়া। কে আর চিনত পুরুলিয়ার ইস্কুলের দুই বিনুনি অনুরূপা রায়কে? সাদামাটা ইস্কুলের মেধাবী অনুরূপার নরম চেহারা আর ভাল রেজাল্ট দেখে রজতের মা সেদিন পছন্দ করে ঘরে এনেছিলেন তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য। তাই শাশুড়ির প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতাও জন্মেছিল মেয়েটার। জীবনটাই তার আমূল বদলে গেছে শহরে এসে, বিয়ের পরে। আর এই মানুষটার জন্য তার বরের এতটুকুনি কৃতজ্ঞতাবোধও নেই। এগুলো ভেবে নিজের ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যায় অনুরূপা। মন মানে না তার। আর এইসব ভাবতে ভাবতেই সুধা নিজের জীবনের পথ দেখলেন একদিন। সেটায় আরও দুঃখ পেল অনুরূপা কিন্তু রজতের তবুও কোনও হেলদোল নেই।
বরং সেই ঘটনায় রজতের বহিঃপ্রকাশ দেখে অবাক হয় অনুরূপা। সে বউকে বলে, আমাকে শায়েস্তা করছে, বুঝেছ? আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব জানবে, বুঝবে কেমন কুলাঙ্গার পুত্রের মা হয়েছেন তিনি। সে আরও বলেছে অনুরূপাকে। আমার জেদি মা ভাঙবে তবু মচকাবে না। যদিও অনুরূপা নিজে মেয়ে হয়ে এতে খারাপ কিছু দেখে না। মায়ের দিকে বৌ ঝোল টেনে কথা বললে সেটাতেও রজতের রাগ হয় মাঝেমাঝে। কথা বাড়ায় না শান্তিপ্রিয় অনুরূপা। অনুরূপা ভাবে ঠিকই তো। মায়ের জমানো টাকাতে মা আজ স্বাধীন। বাড়িখানাও আছে এখনও তাঁর নামে। তিনি কোনোদিন কারুর কাছে হাত পাতেননি। কারুর হাততোলা হয়ে থাকবেনই বা কেন তিনি?
(২)
সামনের উইকেন্ডে নিজের ফ্ল্যাটে পার্টি দেবে রজত আর অনুরূপা। তাই সেদিন শপিংমলের লিকার কর্নারে জমিয়ে বাজার করতে ব্যস্ত তারা। বাসকেট ভরে রজত নিয়েছে হরেক কিসিমের আইটেম। সিঙ্গলমল্ট স্কচ হুইস্কির আকাশছোঁয়া দাম। তবুও নিজের স্টেটাস রাখতে এক বোতল নিয়েই ফেলেছে দিশি ব্র্যান্ডের সঙ্গে। এছাড়াও সস্তার ভদকা, বিলিতি জিন, মেয়েদের জন্যে ওয়াইন। শিশির গায়ে দাম দেখতে দেখতে ভাবে রজত। ঢঙিরা সব আকণ্ঠ মদ্যপান করবে আর মুখে না, না বলতে বলতে ভার্জিন মোহিতো ছেড়ে কখন বলবে একটু ওয়াইন চেখে দেখি। পিনাকোলাডা, ব্লাডিমেরি এসবের জোগাড় না রাখলেও স্টেটাস রাখা দায়। তাই জ্যুস কর্নারে কিছু ফ্রুট জুসের আয়োজন করবে অনুরূপা। বলা আছে তাকে। লিস্ট করে দিয়েছে রজত।

কিছু লোকজন আবার হেলথ রুল মেনে ডাক্তারের বাণী আওড়াবে। তাদের মতে রেড ওয়াইনে হার্ট ভাল থাকে। কোনও সুগারের রোগী আবার বলবে হোয়াইট ওয়াইন নেই? ওটা মিষ্টি কম যে। আগের বারে দিতে পারেনি রজত। একজন চেয়েছিল । তাই মনে করে এবার সুদৃশ্য কাটগ্লাসের ওয়াইন গ্লাসও কিনে ফেলেছে সেদিন। মান থাকে না নয়তো। বন্ধুদের বৌয়েরা এলিট সোশ্যাইটিতে মিশে সব রপ্ত করেছে। এছাড়াও আছে। এক বোতল হোয়াইট রাম। রজত ককটেল বানাতে ওস্তাদ। সেবার পার্টিতে আনারসের জ্যুস দিয়ে হোয়াইট রামের প্রগাঢ় রসায়নে সে জমিয়ে দিয়েছিল পার্টি। পিনাকোলাডা বানিয়ে কেরামতি দেখিয়েছিল বন্ধুদের। এবার সে সকলকে স্টান্ট দেবে ব্লাডিমেরি বানিয়ে। সঙ্গে থাকবে রজতের নিজের পছন্দের চিলি ভদকা। ফুলো ফুলো কাঁচালঙ্কা আনবে পার্টির দিন বাজার থেকে। ভিজিয়ে রাখবে ভদকার মধ্যে। লঙ্কার গন্ধটা পুরো চলে যায় ড্রিংকের মধ্যে। অল্পেই সবচাইতে ভাল নেশা হয় ভদকায়।
অনুরূপা এতক্ষণে নিশ্চয়ই জ্যুস কর্নার থেকে ট্যোম্যাটো, উস্টারসায়ার সস, অরেঞ্জ জ্যুস, পাইন্যাপল জ্যুস সব নিয়েছে মনে করে। ক্রেডিট কার্ডে মস্ত বিল হবে যদিও। কুছ পরোয়া নেই। এ মাসের স্যালারি ঢুকল বলে।
এদিকে ততক্ষণে লম্বা লাইন রজতের লিকার শপে। লোকজন কী একটু বেশিই মদ্যপান করছে আজকাল? ভাবতে থাকে রজত। তা খাচ্ছে খাক। মনেমনে নিজেকে প্রবোধ দেয় সে। তবে এমন লম্বা লাইন গ্রোসারি সেকশানে বা ফ্যাশন স্টোরে নেই। অধৈর্য হয়ে ওঠে রজত। শালা মেয়েরাও আজকাল মদ কিনছে দাঁড়িয়ে। কালে কালে কতই হল, পুলিপিঠের ন্যাজ গজালো। মা বলত এসব ছড়া। মায়ের কথা মনে পড়লেও নিজেকে আস্কারা দেয় না রজত। ভুলতে চায়। যেন আপদ বিদেয় হয়েছে বাড়ি থেকে।
বাইরে কাচের দরজায় পৌষালী হাত নেড়ে বাবাকে ডাকে। আর তার ভাল লাগছে না। তার দরকারি, অদরকারি সব জিনিস নেওয়া হয়ে গেছে।
অনুরূপাও থকে যাচ্ছে এবার। রজত আর বেরোয় না লিকার শপ থেকে। সংসারের সব টুকিটাকি তো আছেই। তার সঙ্গে এবারে মনে করে পার্টির জন্য রজতের হুকুম মোতাবেক হরেক কিসিমের জ্যুস, স্যস নিয়েছে ট্রলি ভরে। বাড়ি ফিরেই আবার সব গুছিয়ে রাখতে হবে তাকে।
কাচের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে রজতকে। ইশারা করল একবার। নট নড়নচড়ন তার। এত লাইন লিকার কর্নারে?
– সামনেই লঙ উইকেন্ড ম্যাম। তাই আবার শহরে নতুন শীত এসেছে। একজন সেলসম্যান বলে গেল। সবার ঘরে পার্টি যে।
রজতের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ চলে যায় লিকার শপের ক্যাশ কাউন্টারে। একটি আবেদনে আচমকা চোখ পড়ে যায় তার।
কোনও এক এনজিওর আবেদন মদ-ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে। একটি ঢাউস প্ল্যাস্টিকের বাক্সে সাঁটানো সেই আবেদন। প্রতিনিয়ত ফান্ড রেইজ করতে হয় তাদের। রজত পড়ে ভাবে, ঝোপ বুঝে কোপ মারো বাপু। মদ যারা কেনে তারা সবাই রাঘব বোয়াল। মালদার পার্টি। অতএব দান করো কিছু। নিকুচি করেছে। আর সেই দান গ্রহণ করছে ক্যাশ কাউন্টার। সেই সঙ্গে মদ কিনে বিল দেবার সময় কার্ড সোয়াইপ করতে গিয়ে কার ক্রেডিটকার্ড আটকে গেছে তাদের মেশিনে। সে এক বিপত্তি! কে পাইট মদ কিনবে খুচরো দিতে না পারার বিপত্তি। এসব নিয়ে সামান্য বচসা। সব মিলিয়ে ঘেঁটে ঘ এক্কেবারে। এর চেয়ে পাড়ার দোকান দিব্য ছিল। রজত ভাবে।
কিন্তু সেই ফাঁকে কোনও এক অনামা এনজিওর আবেদনে সাদা কাগজের বাক্সের গায়ে সাঁটা এক মহিলার রঙিন ছবিতে গিয়ে চোখ আটকে গেল রজতের। ভাল করে নিজের চশমা মুছে নেয় সে। ঠিক দেখছে তো? আবারো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ভালকরে খেয়াল করে। হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছে রজত। তার ওয়ান এন্ড ওনলি গর্ভধারিণীর ছবি সাঁটা সেই বাক্সের গায়ে। ছবিতে মায়ের মাথার পাকাচুল। মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণায়। সামান্য বেশভূষা। কপালে টিপ। যেমন থাকত আগেও। তবুও লাইনের অত লোকজনের মধ্যে থেকেও নজর কেড়ে নিয়েছে ছেলের। রজতের মা তবে সেখানে কিসের আবেদন জানাচ্ছে? ছিঃ মা তুমি ভিক্ষে করছ এভাবে? নাহ! মা কেন চাইবে? সেই এনজিও বোধহয় চাইছে সামান্য হলেও কিছু দান।

লাইন কমে আসছে এবার দ্রুত। ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রজত ধীরে ধীরে। হাতে মদিরা পূর্ণ ভারী বাসকেট। কিন্তু চোখ তার স্থির সেই ছবিতে। তার মা তবে কী করছে সেখানে? জানতেই হবে। সামনে পৌঁছে বিলডেস্কে ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দেয়। এবার পাসওয়ার্ড পাঞ্চ করার পালা। আগে পার্স ভর্তি সব কার্ডের পাসওয়ার্ডে থাকত তার মায়ের নাম, মায়ের ডেট অফ বার্থ। তারপর বীতশ্রদ্ধ হয়েছে। মাতৃবিরূপতা রোগে ভুগছে রজত বহুদিন। মেয়ের নাম, বৌয়ের নাম বদলে বদলে পাসওয়ার্ড দেয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে মায়ের ছবি দেখার পর কেমন যেন সব ওলটপালট। মনে পড়ছে না কার্ডের পাসওয়ার্ড। ডিক্লাইন হল দু’দুবার তার ক্রেডিট কার্ড। তবে কী এই কার্ডটা পুরোনো? ভাবতে ভাবতে পার্স খুলে দেখে নেয় চট করে কত টাকা আছে। নাহ্! অত খরিদ্দারির টাকা নেই তার পকেটে। বেশ ফ্যাটি বিল হয়েছে এবার। অতএব ক্রেডিট কার্ডই ভরসা। কিন্তু পাসওয়ার্ড? আরেকটা কার্ড বের করে সে। অতঃপর পাসওয়ার্ডে মায়ের জন্মতারিখ দিতেই টাকা ঝাঁ করে চলে গেল অ্যাকাউন্ট থেকে। মেসেজ এল মোবাইলে টুং করে। এবার পার্স থেকে একটা দু’ হাজার টাকার নোট বের করে আবেদন বাক্সে ফেলে রজত।
রজতের মা সুধা দেবী অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সেই এনজিও থেকে। এই বয়সে রেকর্ড কাজের নজির সৃষ্টি করেছেন তিনি। তাই তাঁর ছবি দিয়ে সেই স্বতঃস্ফূর্ত আবেদন নাগরিকদের উদ্দেশ্যে।
সেখানে বাক্সের গায়ে সাঁটা সাদা কাগজে বড় বড় অক্ষরে যত্নে লেখা আছে
“Our country is full of needy elders. You have the power to help one today”
মোচড় দিয়ে ওঠে রজতের বুক। সেই প্রথম মায়ের জন্য বুকটা ফেটে যায় তার। এই জেরিয়াট্রিক শহরে তার মায়ের মতো কত মহিলাই পড়ে আছেন। কেউ একা কেউ সবার সঙ্গে। কিন্তু রজতের মা অভিমানে চলে গেছেন শহর ছেড়ে অনেক দূরে। চোখে টলটল করে জল। অনুরূপা আসে পৌষালীর হাত ধরে। কী হল তোমার? এত ভাবছটা কী তুমি?
কিন্তু রজতের মনে অশান্তির মেঘ। ঝেঁপে বৃষ্টি এল বলে। অগত্যা শপিং মলের বাইরে আসতেই সে ডিসিশন নিয়ে ফেলে।
অবশেষে বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সে মেসেজ করে, “স্যরি এন্ড অ্যাপোলজি। উইকেন্ড পার্টি ক্যান্সেলড ডিউ টু আন অ্যাভয়েডেবল সারকামস্ট্যান্সেস”
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
2 Responses
বাহ্ দারুণ গল্প
Khub bhalo laglo