Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

নজরুলগীতির রাজপুত্র ধীরেন বসু

অরিজিৎ মৈত্র

জুলাই ১৩, ২০২৪

Dhiren Basu
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

ধীরেন বসু (Dhiren Basu) মানেই সুন্দর সুপুরুষ এবং সুকণ্ঠের অধিকারী নিপাট সুভদ্র একজন শিল্পী যাঁর কণ্ঠে কাজী নজরুলের কাব্যগীতি এক স্বতন্ত্র মাত্রা পেত। আমার বাবা-মায়ের ধীরেনদা, সুতরাং আমিও ছোট থেকে ধীরেনদা বলেই ডাকতাম। নাম, যশ-খ্যাতির আড়ালে তাঁর মনটা ছিল শিশুর মতো সরল, কোনওদিন কোনও জটিলতা দেখিনি তাঁর মধ্যে। অনেকেই হয়তো জানেন না যে আশা ভোঁসলের মতো শিল্পী নজরুলগীতির রেকর্ড করেছিলেন ধীরেনদার ট্রেনিংয়ে। এই রেকর্ড করতে তিনি যখন কলকাতায় আসেন তখন ধীরেনদার আমন্ত্রণে তাঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে এক সন্ধ্যায় আসেন। আমি যদি খুব ভুল না করি তাহলে যতদূর সম্ভব মনে পড়ে যে সেদিন আশা ভোঁসলের সঙ্গে আমন্ত্রিত ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক বিমল মিত্র প্রমুখ। অনেক রাত পর্যন্ত আমরাও ছিলাম।

ধীরেনদার সঙ্গে একটা খুব সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। আমার জন্য ওঁর বাড়িতে ছিল অবারিত দ্বার। একেকদিন সকালে গিয়ে অনেকক্ষণ ধীরেনদার সঙ্গে গল্প করতাম। আবার কোনও কোনওদিন বিকেলে চলে যেতাম, অন্যদিকে বাবা আর মা’ও আসত অফিস থেকে। এরপর একদম রাতের খাওয়া শেষ করে আমরা ফিরতাম। বেশিরভাগ দিন ধীরেনদাই নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিতেন। অনেকদিন এমনও হয়েছে যে বাবা-মা বাড়িতে বসে ধীরেনদার সঙ্গে গল্প করছে, হঠাতই ধীরেনদা আমাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে সোজা চলে যেতেন বালিগঞ্জ ফাঁড়ির ধাবায়। ওখানকার খাবার উনি খুব পছন্দ করতেন। তাই প্রায় দিনই আমরা গেলে ওখান থেকে খাবার নিয়ে আসতেন। যেদিন অনুষ্ঠান থাকত সেদিন মাঝে-মধ্যে আমিও ধীরেনদার সঙ্গে যেতাম। রবীন্দ্রসদনে বা শিশির মঞ্চে অনুষ্ঠান থাকলে বা কাছে কোথাও প্রোগ্রাম হলে আমি নিজেই সেখানে চলে যেতাম। আসার সময় ধীরেনদার সঙ্গেই ফিরে আসতাম। একবার বলেছিলেন ঢাকায় বিদ্রোহী কবিকে গান শোনাবার অভিজ্ঞতা। সেই ছবিও ওঁর বাড়িতেই দেখেছিলাম।

বলেছিলেন, ‘একবার কবির জন্মদিনে ঢাকার বাড়িতে সবাই উপস্থিত কিন্তু কবি তখন অসুস্থ মানসিকভাবে, ভেতরে একটা অস্থির ভাব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানও সাহস পাচ্ছেন না কবিকে পুষ্পস্তবক দিতে। তখন সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী ধীরেনদাকে বলেন গান শুরু করতে। ধীরেনদা গান শুরু করার পর কবির মুখে এক প্রসন্নভাব জেগে ওঠে আর তখনই বঙ্গবন্ধু ঘরে ঢুকে কবির গলায় মালা পরিয়ে দেন।’ এ ঘটনা ধীরেনদার কাছেই শোনা। নজরুলগীতি গাইলেও ধীরেনদা কিন্তু ছিলেন মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। বলেছিলেন, ‘গ্রামাফোন কোম্পানিতে প্রথম যখন অডিশন দেন, তখন তাঁকে বলা হয় এমন একটা গান গাইতে যে গানে গলা খুব উঁচুতে উঠবে আবার খাদেও নামবে। তখন ধীরেনদা গেয়েছিলেন ‘তুমি রবে নীরবে’ গানটি।’ সন্তোষ সেনগুপ্ত পরিচালিত ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ এবং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘তাসের দেশে’ও ধীরেনদা গান করেছেন। কলকাতা দূরদর্শনে তাঁর গাওয়া ভাটিয়ালি সুরে নজরুলগীতি ‘আমার গহীন জলের নদী’ আজও কানে বাজে।

একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করতাম যে, ধীরেনদা বেঁচে থাকাকালীন কলকাতা দূরদর্শন কখনও কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকত না। আজও তাঁর অগণিত রেকর্ডিং দূরদর্শনে থাকা সত্ত্বেও সেগুলো দেখানো হয় না। এর পেছনে কী কারণ বা কোনও রহস্য আছে কী না, আমার জানা নেই। সুপুরুষ ধীরেনদাকে নিয়ে মজার দুটি গল্প ভাগ করে নেব সকল পাঠকের সঙ্গে। মহানায়ক উত্তমকুমার ভাল গান গাইতেন, সেটা অনেকেই জানেন। অভিনয়ের সব গানের প্রতিও ছিল তাঁর অনুরাগ। সঙ্গীত সংক্রান্ত বিষয়ে ধীরেনদার সঙ্গে আলোচনা করতে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলে একদিন ধীরেনদা নিজেই ভবানীপুরে গিরিশ মুখার্জি রোডে উত্তমকুমারের বাড়িতে যান। তখন বাড়িতে তরুণকুমারও ছিলেন। কাজ সেরে ধীরেনদা বেরিয়ে আসার পরে তরুণকুমার তাঁর দাদা উত্তমকুমারকে জিজ্ঞেস করেন কে এসেছিলেন। উত্তমকুমারের কাছে ধীরেনদার পরিচয় জানার পরে তরুণকুমার বলেছিলেন, ‘এমন সুন্দর চেহারার পুরুষমানুষ জীবনে দেখিনি।’ ধীরেনদার সঙ্গীত জীবনের চল্লিশ বছরের অনুষ্ঠানে উত্তম মঞ্চে তরুণকুমার নিজেই ধীরেনদার পাশে বসে এই কথা বলেছিলেন।

আর একবার কোনও এক অনুষ্ঠানে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় আর ধীরেনদা একসঙ্গে যাচ্ছিলেন। চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় ধীরেনদার বাড়িতে গেছেন, অপেক্ষা করছেন ধীরেনদা প্রস্তুত হলে একসঙ্গে বেরোবেন বলে, কিন্তু কোনও একটি কারণে ধীরেনদার প্রস্তুত হতে একটু সময় লাগছিল। চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় কৌতুক করে বৌদিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার বর কি সাজগোজ করছে?’ সঙ্গে সঙ্গে বৌদি সপ্রতিভ উত্তর দেন, ‘আমার বর এমনিতেই সুন্দর দেখতে, ওর সাজবার দরকার হয় না।’ প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখি এবং সকলে জানেনও যে ধীরেন বসুর মতো চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় সুন্দর দেখতে ছিলেন। ব্যাপারটা যেন ‘এ বলে আমায় দ্যাখ আর ও বলে আমায় দ্যাখ’। ধীরেনদার সঙ্গে কতরকম গল্প হত। কোনওদিন কোনও ক্রিকেট খেলার ফাইনাল থাকলে চলে যেতাম ধীরেনদার বাড়ি। একসঙ্গে আমরা খেলা দেখতাম। ধীরেনদা বসে থাকতেন আর পাশে রাখা থাকত ফাইভ ফাইভ সিগারেটের প্যাকেট।

একবার আমাদের আর একজন কাছের মানুষ মৃণালকাকু মানে মৃণাল চক্রবর্তী আমাকে বললেন, ‘চল ধীরেনের বাড়ি যাই, আসার সময় তোর ক্যাসেট রেকর্ডারটা সঙ্গে আনিস।’ তখন আজকের মতো সিডির চল হয়নি। রেকর্ডার নিয়ে গেলাম মৃণালকাকুর বাড়িতে। সেখান থেকে আমাদের গন্তব্য ধীরেনদার বাড়ি। সেখানে গিয়ে একথা-সেকথার পরে মৃণালকাকু ধীরেনদাকে বললেন, ‘একটা ক্যাসেট নিয়ে এসেছি, তোকে ক’টা গান শোনাব, আমার সুর করা আর গানগুলো আমি নিজেই গেয়েছি।’ আমি টেপ চালিয়ে দিলাম। আমরা তিনজনেই গানগুলো শুনলাম। শোনার পরে ধীরেনদা মৃণালকাকুকে বললেন, ‘ভালোই তো গেয়েছিস, একটা আধুনিক বাংলা গানের ক্যাসেট কর এই নতুন গানগুলো নিয়ে।’ মৃণালকাকু উত্তরে বললেন, ‘দূর – এই গানগুলো কী আর আমি গাইবার জন্য সুর করেছি। কথা ছিল হেমন্তদা গাইবেন। ভাবো এই গানগুলো যদি হেমন্তদার কণ্ঠে পড়ত, তাহলে কি কাণ্ডটাই না হত।’ এরকম কত যে ঘটনার সাক্ষী রয়েছি, ভাবলে নিজেরই অবাক লাগে। চলে যাওয়ার কয়েক বছর আগে ধীরেনদা একটা বাংলা আধুনিক গানের ক্যাসেট করেছিলেন। তাতে আমার দাদু অমিয় বাগচীর লেখা একটা বিখ্যাত গান যেটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন সেই ‘কথা কোয়ো নাকো শুধু শোনো’ গানটাও গেয়েছিলেন।

মনে আছে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরে দূরদর্শনে ওঁর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান আমরা সবাই ধীরেনদার বাড়িতে দেখেছিলাম। সব শেষ হলে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ধীরেনদা বলেছিলেন, ‘মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে, চল কোথাও একটু ঘুরে আসি। পক্স হয়ে আমি অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে শুয়েছিলাম বেশ কিছুদিন। ধীরেনদা মাঝেমধ্যেই ফোন করে খোঁজ নিতেন। এরপর একদিন বাবার হাত দিয়ে আমাকে একটা চিঠি লিখে পাঠালেন। লিখেছিলেন, ‘একটু ব্যস্ততা চলছে, কয়েকটা কাজ সেরেই তোমাকে একদিন বাড়ি গিয়ে দেখে আসব, সাবধানে থেকো।’ কথা রাখতে প্রায়ই সকালের দিকে বাড়িতে চলে আসতেন। এছাড়াও অনেকদিন সন্ধেবেলায় লোডশেডিংয়ের মধ্যেও বাড়িতে এসে অনেক গল্প করে গেছেন। নতুন কোনও ক্যাসেট প্রকাশ পেলেই ফোন করে জানাতেন আর বাড়িতে গেলেই সেটা উপহার দিতেন। শুধু গানের অনুষ্ঠান নয়, সামাজিক অনেক অনুষ্ঠান যেমন পার্থদা-গৌরীদির (ঘোষ) ছেলের বিয়েতেও একসঙ্গে গিয়েছি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির অনুষ্ঠানে আমরা সবসময় একসঙ্গে যেতাম। ওখানে গিয়ে বিশেষ একজনের আচরণ দেখে আমি আর ধীরেনদা নিজেদের মধ্যেই হাসি আর মজার কথা আলোচনা করতাম। ধীরেনদার গাওয়া বিশেষ দুটি গান ‘আমার গহীন জলের নদী’ আর সোভিয়েত রাশিয়াকে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে নিয়ে গাওয়া ‘জাগো অনশন বন্দি ওধরে কতো, জগতেরও লাঞ্ছিত ভাগ্যহত’ আমার বিশেষ প্রিয়।

আজও ওঁর গলায় শুনতে ভাল লাগে ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদ মুখ তাই’ গানটি। আর গেয়েছিলেন ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে’। আজ সত্যিই ধীরেন বসু অনেক অনেক দূরে চলে গেছেন তবু কি তাঁকে ভুলতে পেরেছি? ধীরেনদা শুধু গানই করেননি, ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। তাঁর অভিনীত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘মাথুর’, ‘কৃষ্ণ সুদামা’ ইত্যাদি। তাঁর অনেক স্মৃতির ভার বহন করে আজও দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুস্থান পার্কের বাড়িটা কিন্তু শিল্পী ধীরেন বসু আজ কত দূরে। অনেক কথাই মনে থাকে আবার অনেক কথাই ডিজিটাল যুগের ভারে ভুলে গিয়েছি। যতটা মনে ছিল, ভাগ করে নিলাম সবার সঙ্গে। আমাদের ধীরেনদা তো সবার ধীরেন বসুও বটে। তাই সবারই আগ্রহ এবং অধিকার রয়েছে তাঁর কথা আর অজানা সব তথ্য ও গল্প জানার।

Author Arijit Maitra

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।

Picture of অরিজিৎ মৈত্র

অরিজিৎ মৈত্র

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।
Picture of অরিজিৎ মৈত্র

অরিজিৎ মৈত্র

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস