পিকুরা লিফ্টে দশতলায় এল। বেল বাজাতে একজন মহিলা দরজা খুলে ভেতরে এসে বসতে বললেন।
ফ্ল্যাটে ঢুকতেই প্রথমে বিশাল একটা বসার জায়গা। বসার যা ব্যবস্থা তাতে একসাথে জনা পনেরো লোক অনায়াসে বসে আড্ডা মারতে পারে। সদর দরজার অন্যপ্রান্তে বারান্দা, সেখান থেকে দ্বিতীয় হুগলি সেতু দেখা যাচ্ছে। (Short Story)
বছর পঁয়ষট্টির একজন ভদ্রলোক এসে নিজেকে দেবু মিত্তিরের শালা বলে পরিচয় দিলেন। তপন বোস নাম। সল্টলেকে থাকেন, আজ সকালেই এসেছেন। উনিই সব ঘুরিয়ে দেখালেন।
বসার জায়গার বাঁ-পাশে প্রথমেই খাবার ঘর আর লাগোয়া রান্নাঘর, তারপর বারান্দার দিকে একটা ঘর, যেখানে দেবুবাবুর স্ত্রী থাকেন, সাথে একটা এ্যাটাচড টয়লেট। বসার জায়গার ডানদিকে দুটো বড় বড় ঘর সাথে টয়লেট আর বসার জায়গার পাশেই ভিজিটার্স ওয়াশরুম। সব মিলিয়ে খুবই বিলাসবহুল ব্যাপার।
মিত্রবাবুর অন্তর্ধান রহস্য : পর্ব – ১ : অরূপ দাশগুপ্ত
দেবুবাবু যে ঘরে থাকেন সেখানে একটা খাট আর একটা আরাম কেদারা ছাড়া একটা ল্যাপটপ আর একটা ছোট বুক সেল্ফ আছে তাতে কিছু পুরোনো ম্যাগাজিন, কিছু লুজ কাগজ ছাড়া আর কিছুই নেই। ইনফ্যাক্ট পুরো বাড়িতে পিকু কোনও বইপত্রের সন্ধান পেল না। ল্যাপটপটার পাসওয়ার্ড ফেস রিকগনাইজিং, তাই এখনও কিছু করা যায়নি। বাড়িতে লোক বলতে একজন নার্স আর জনা দুয়েক কাজের লোক দেখতে পেল পিকু। দেবু মিত্তিরের স্ত্রী একেবারেই কথা বলতে পারেন না, তাই যা কিছু জানার পিকুদের তপনবাবু আর বাড়ির অন্য কাজের লোকেদের কাছ থেকেই জানতে হল।
সবার সাথে কথা বলে এটাই বোঝা গেল যে দেবুবাবু সারাদিনই বাড়িতে থাকেন। হয় অসুস্থ স্ত্রীর পাশে বা বারান্দায় আর নয়তো নিজের ঘরে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করেন। খুব একটা পড়াশুনা করতে কেউ কখনও দেখেনি। তবে নার্সের কথায় জানা গেল ওঁর নাইট ডিউটি থাকতে উনি দেখেছেন দেবুবাবু নিজের ঘরে অনেক রাত অবধি ল্যাপটপে কাজ করেন। এতকিছু জানার পরেও পিকুর মনে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল, দেবু মিত্তিরের ইনকামের সোর্স কী! তপনবাবুর কথা অনুযায়ী দেবুবাবু নাকি কখনও চাকরি করেননি, সারাজীবন শুধুই কনস্যালটেন্সি করেছেন। কিন্তু কীসের কনস্যালটেন্সি করেন সেটা বলতে পারলেন না।
কথাবার্তার শেষে পিকু ফ্ল্যাটটা ভাল করে ঘুরে দেখে সন্তুকে বলল ও দেবুবাবুর ঘরের বুকসেল্ফের সব ম্যাগাজিন আর কাগজপত্র নিয়ে যেতে চায় আর ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড ব্রেক করে যদি ওকে ল্যাপটপে অ্যাক্সেস দেওয়া যায়। পাছে কিছু মিস ক’রে যায় তাই পিকু মোবাইলে ফ্ল্যাটের বিভিন্ন অংশের কিছু ছবি তুলে নিল।
কুট্টিদাদুর মিস্ট্রি : অরূপ দাশগুপ্ত
বাড়ি পৌঁছাতে একটু সন্ধ্যাই হয়ে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে পিকু মেঘনাকে ফোন করল কেসটার কথা জানানোর জন্যে। আশ্চর্যের ব্যাপার মেঘনা পিকুর ফোনটা কেটে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে উত্তর দিল। বুঝতে না পেরে পিকু আবার ফোন করাতে মেঘনা হোয়াটসঅ্যাপে জানাল ওর কথা বলা বারণ, সাথে কয়েকটা হাসিমুখের ইমোজি।
বেশ কিছুক্ষণ টেক্সট চালাচালির পর যা বোঝা গেল তা হ’ল, মেঘনার দাদা কয়েক মাস আগে একটা গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুর এনেছে। সেটা এখন খাওয়াদাওয়া করে বেশ মোটাসোটা হয়েছে। মধ্যবিত্তের বাড়ির পোষা কুকুররা যেহেতু ইংরাজি ছাড়া অন্য ভাষা বোঝে না তাই তার নামও রাখা হয়েছে সুইটি। এখন নাকি প্রতিদিন মেঘনার ঠাম্মা আর দাদার ছেলে তাতাই, সুইটিকে ট্রেনিং দেয়। গতকাল দুপুরে সেই ট্রেনিং চলাকালীনই বিপত্তি। তাতাই প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল সুইটিকে বসার ইন্স্ট্রাকশন ফলো করতে শেখাতে আর বারে বারে বলছিল “সুইটি সিট”! কিন্তু সুইটি কিছুতেই তা মানছে না দেখে ঠাম্মা এসে বলতে লাগে “ছুইটি বও ছুইটি বও ছুইটিইি বোইয়া পড়ো”! সুইটি বেচারা এতরকম শব্দ শুনে ঘাবড়ে গিয়ে পড়ল পাশে দাঁড়ানো মেঘনার উপর আর তাতে মেঘনা পড়ে গিয়ে কাটল ঠোঁট। এখন তাই মেঘনা কথাই বলতে পারছে না।
যাইহোক, আসল কথায় ফেরা যাক। দেবু মিত্তিরের কেসটাতে পিকুর বারে বারে একটা কথাই মনে হচ্ছে দেবু মিত্তির কীসের কনস্যালটেন্সি করেন যে এত টাকা?
সন্তুর ইন্স্ট্রাকশনে কলকাতা পুলিশ দিকে দিকে তল্লাশি চালালেও পিকুর প্রয়োজনে সাথে সাথে দেবুবাবুর ব্যাংক ট্রানজ্যাকশন আর ব্যাকগ্রাউন্ড ভেরিফিকেশনও চলছে।
সেদিন অলমোস্ট সারারাত পিকু দেবু মিত্তিরের বাড়ি থেকে আনা কাগজ পত্রগুলো তন্নতন্ন করে ঘাঁটল কিন্তু কিচ্ছু সেরকম পেল না। শুধু বহু জায়গায় অ্যালজেব্রিক ইকুয়েশনের মতো কিছু লেখা, অনেকটা এইরকম: ২২.৫৬৪৩নস্কর+৮৮.৯৮৪৩ঈশান বা
১৪.০৯৩২নমিতা+১০৮.১০৯৪ইকবাল। কিছুই বুঝতে পারল না।
ফেসবুকের বেড়াল : সৌরভ হাওলাদার
সকালে সন্তুর ফোন। “দেবু মিত্র ইজ ডেড। কাল রাত্রে কালীঘাট আর মাঝেরহাট স্টেশনের মাঝে নিউআলিপুর জি ব্লকের কাছে ট্রেনে কাটা পড়েছেন। বডি পোস্টমর্টেমে পাঠানো হ’য়েছে।” কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে গেল সন্তু। “তুই কোনও ক্লু পেলি? আমার ওপর তো প্রেসার বাড়ছে!”
“না মামা! এখনও তো কিছু পাইনি তবে চেষ্টা করছি। তোমায় বিকেলে ফোন করছি।” কথাগুলো বলে পিকু ফোনটা রেখে দিল। পিকু বুঝতে পারছে যতক্ষন না দেবু মিত্তিরের প্রফেশনটা জানা যাবে এই কেসে এগোনো ভীষণ মুশকিল। ভদ্রলোক কী করতেন কাদের সঙ্গে মিশতেন কোনও কিছুই জানা যাচ্ছে না।
এদিকে দেবু মিত্তিরের রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ আর খুনী এখনও পর্যন্ত না জানতে পারাতে সন্তুর উপর ওপরতলার চাপ আসতে শুরু করেছে। হোম সেক্রেটারি সরাসরি সন্তুকে ডেকে পাঠিয়ে ইমিডিয়েট কিছু একটা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। মিনিস্টার নাকি প্রেসকে ফেস করতে পারছে না। পিকুর ইনভল্ভমেন্টটা যদিও আনঅফিশিয়াল তাহলেও সন্তু অনেকটাই পিকুর ওপর ভরসা করে আছে। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও খুব একটা এগোতে পারছে না।
পরদিন সকালে সন্তু জানাল ফরেন্সিক রিপোর্ট বলছে দেবু মিত্রের মৃত্যু অস্বাভাবিক। তার মানে খুন। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ঘটনাটা ঘটেছে। খবরটা শুনে পিকু কিছু না বলে ফোনটা রেখে দিল।
এখন দেবু মিত্তিরের কেসের জন্যে সন্তুকে মাঝেমধ্যেই লালবাজারে যেতে হচ্ছে। আজকেও লাঞ্চের পরে কমিশনার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। অফিসে ফিরতে ফিরতে চারটে বেজে গেল। এসে দেখে করিডোরে পিকু খুব উত্তেজিত হ’য়ে পায়চারি করছে। সন্তুকে দেখেই হাত ধরে টেনে সন্তুর ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল এক্ষুনি ওর সাথে আসতে আর সাথে যেন দু’একজন আর্মড সাদা পোশাকের পুলিশ থাকে। সন্তু পিকুকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও পিকু কোনও উত্তর দিল না। শুধু বলল সময় মতো সব বলবে।
পিকু এবং দুজন ইয়ং পুলিশকে নিয়ে সন্তু গাড়িতে উঠতে পিকু জানাল জীবনদীপ যাবে। গাড়িতে উঠে পিকু সন্তুকে মোটামুটি ব্রিফ ক’রে দিল। জীবনদীপে পৌঁছে পিকুর কথা মতো ওরা দশতলায় ইস্টার্ন শিপিং কোম্পানীতে এসে পৌঁছাল। রিসেপ্শনিস্টকে পিকু জানাল ওরা এখানকার মালিকের সাথে দেখা করতে চায়। রিসেপ্শনিস্ট পিকুদের বসতে বলে অফিসের ভিতরে চলে গেল। পিকু আর সন্তু রিসেপ্শনে অপেক্ষা করল আর বাকি দুজন অফিসের বাইরে করিডোরে। কিছুক্ষণ পরে রিসেপ্শনিস্ট জানাল “স্যার একটা কলে আছেন, একটু বসুন ডাকছেন।” পিকু সন্তুকে ব্রিফ করলেও পুরোটা বলেনি তাই সন্তু একটু কনফিউজড।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিতর থেকে ডাক আসাতে পিকুরা ইস্টার্ন শিপিং কোম্পানীর মালিক মিঃ নাগার্জ্জুনার ঘরে গিয়ে ঢুকল। সন্তু বেশ ভাল করে বোঝার চেষ্টা করল। মধ্যবয়সী লোক। বেশ মোটা, কালো। গলায় মোটা একটা সোনার চেন, দুহাতের প্রায় সব আঙ্গুলেই নানান রঙের পাথর বসানো সোনার আংটি। চোখে সোনালী চশমা আর কপালে একটা লাল তিলক। পোশাক আশাক আর সাজগোজের চাকচিক্য বেশ ঝাঁঝাল। পরিস্কার বাংলা বলেন, কোনো জড়তা নেই। আর প্রয়োজনের থেকে একটু বেশি কথা বলেন।
কুশল বিনিময় করার আগেই পিকু সন্তুর আসল পরিচয় জানাতে মি: নাগার্জ্জুনা একটু হতবাক হলেও সামলে নিলেন। মিঃ নাগার্জ্জুনা কিছু বলার আগেই সন্তু পকেট থেকে আই ডি বার করে দেখিয়ে মিঃ নাগার্জ্জুনাকে জানাল তাঁকে ওদের সঙ্গে একটু ভবানী ভবনে আসতে হবে। নাগার্জ্জুনা একটু আপত্তি জানালেও সন্তু তাকে বাধ্য করল। ততক্ষণে মিঃ নাগার্জ্জুনার ঘরে সন্তুর বাকি দুই সাগরেদ এসে হাজির। সব মিলিয়ে বেশ একটা সাসপেন্স তৈরি হল।
পিকু আগেই সন্তুকে বলেছিল পিকুর মতে এই নাগার্জ্জুনাই দেবু মিত্রের মৃত্যুর সব রহস্যের সন্ধান দিতে পারবে।
ভবানী ভবনে পৌঁছে মিঃ নাগার্জ্জুনাকে নিয়ে সন্তুরা একটা ছোট মিটিংরুমে বসল। সন্তু আর পিকু ছাড়া হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের মিঃ বোস আর মিঃ মিত্রও জয়েন করলেন। কুশল বিনিময়ের সময় মিঃ নাগার্জ্জুনা জানালেন উনি “নাগা” ডাকেই বেশি কমফর্টেবল। পিকু সরাসরি মিঃ নাগার্জ্জুনাকে প্রশ্ন করল “আপনি দেবাঞ্জন মিত্রকে চেনেন? আপনারই প্রফেশনের।”
“হতে পারে! তবে আমি এই নামে কাউকে চিনি না।”
পিকু: “দেবু মিত্রকে নিশ্চই চেনেন!”
এর মধ্যে মিঃ বোস বলে উঠলেন “দেখুন মিঃ নাগা, আমাদের কাছে ইনফরমেশন আছে যে আপনি দেবু মিত্রকে চেনেন এবং আপনাদের মধ্যে রেগুলার বেসিসে বিজনেস ট্রানজাক্সন হয়।”
মিঃ নাগা: না স্যার আপনারা ভুল করছেন, আমি সত্যিই এই নামে কাউকে চিনি না!
মিঃ বোস : আপনি মর্নিং ওয়াকে যান?
মিঃ নাগা: হ্যাঁ যাই!
মিঃ বোস: কোথায় যান?
মিঃ নাগা: সল্টলেকে সেন্ট্রাল পার্কে।
মিঃ বোস: রবিবার গেছিলেন?
মিঃ নাগা: না যাইনি, তবে বেরিয়েছিলাম, আলিপুরে এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। ভোরবেলা সকাল ছটা নাগাদ।
বালক বীরের মহাপ্রয়াণ : শরণ্যা মুখার্জী
সবাই বুঝতে পারল নাগা লোকটি একটু ধুরন্ধর লোক। মিঃ মিত্র: পুলিশের কাছে আপনার কললিস্ট বলছে আপনি দেবু মিত্রের বাড়ির সামনে থেকে মানে অর্কিড অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থেকে কালিপদ বলে একজনকে কল করেন আর কালিপদ তখন কম্যান্ড হাসপাতালের সামনে ছিল।
এটা শুনে নাগার্জ্জুনের অর্জ্জুনি চেহারাটা কেমন চুমসে গেল। কিন্তু মিঃ নাগাও দমবার পাত্র নন। সাথে সাথে উত্তর দিল “এসব আপনারা কী বলছেন বুঝতে পারছি না।”
মিঃ মিত্র: তাহলে এটা নিশ্চই বলতে পারবেন রবিবার রাত্রে সাড়ে এগারোটা নাগাদ আপনি নিউআলিপুর আর মাঝেরহাট স্টেশনের মাঝে নিউআলিপুর জি ব্লকের কাছে রেল লাইনে কী করছিলেন।
এইবারে মিঃ নাগার্জ্জুনের মুখটা ফ্যাকাশে হ’য়ে গেল। মাথার পেছনে হাতদুটো দিয়ে পিছনদিকে মাথাটাকে হেলিয়ে দিলেন। মিঃ বোস জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলেন।
এর মধ্যে খবর এল কমিশনার অশোককুমার এসেছেন। সন্তু মিঃ বোসদের বলল “আপনারা কথা বলুন আমি পাশের ঘরে আছি।” বলে পিকুকে নিয়ে সন্তু পাশের কনফারেন্স রুমে গিয়ে দেখে অশোককুমার বসে আছেন।
তখন প্রায় রাত আটটা বাজে। পিকু বাড়িতে জানিয়ে দিল ও বাড়ি ফিরবে না, সন্তুর সাথে মামাবাড়িতে চলে যাবে।
পরদিন সকালে পিকু বাড়ি ফেরার পথে সন্তুর সঙ্গে ওর অফিসে গেল। দুপুরের খাওয়াটা সন্তুর সাথে সেরে বাড়ি যাবে।
অফিসে পৌঁছুতেই কমিশনারের ডাক। বললেন পিকুকে নিয়ে ওঁর কনফারেন্স রুমে আসতে। কথাও হবে লাঞ্চও হবে। কমিশনার পিকুকে দেখে আর সন্তুর কাছ থেকে পিকুর সম্মন্ধে জেনে তো ভীষণ ইমপ্রেস্ড। আর সবুর করতে না পেরে কমিশনার অশোক কুমার পিকুকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে ফেললেন “হোয়াট লেড ইউ টু মিঃ নাগার্জ্জুনা ইয়ং ম্যান?”
পিকু প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও সন্তুর ইশারায় বলতে শুরু করল।
“প্রথমে তো আমি কোনোই দিশা পাচ্ছিলাম না। দেবু বাবুর সম্পর্কে এত কম ইনফরমেশন যে কী ভাবে এগোব বুঝতেই পারছিলাম না। পরশুদিন রাতে প্রথম ক্লুটা পাই। ওঁর বইয়ের তাক থেকে আনা কাগজপত্র, ম্যাগাজিন ঘেঁটে কয়েকটা লুজ শিট পাই যাতে এইরকম কিছু ইকুয়েশনের মতো লেখা ছিল।
২২.৫৬৪৩নস্কর + ৮৮.৯৮৪৩ঈশান বা
১৪.০৯৩২নমিতা + ১০৮.১০৯৪ইকবাল। এইরকম নানান সংখ্যা আর তার সাথে কিছু নাম।
তবে একটা ইকুয়েশন রিপিটেডলি লেখাছিল ২২.৪৬৬৯নাগার্জ্জুন + ৮৮.৩৭৭৭ইশ্বরন।”
এই বলে পিকু একটু জল খেল। ততক্ষণে মিঃ বোস এসে জানিয়ে গেলেন মিঃ নাগার্জ্জুন মোটামুটি কনফেস করে ফেলেছেন যে দেবু মিত্রের মৃত্যুর জন্যে ওই দায়ী।
এরই মধ্যে সন্তুর অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট স্বপনবাবুও সবার জন্যে মটন পসিন্দা কাবাব আর তন্দুরী লাচ্চা পরোটা আর এক বাটি করে রাবড়ি দিয়ে গেলেন। খেতে খেতে পিকু আবার শুরু করল। “ইকুয়েশন গুলো অদ্ভুত লাগলেও দশমিকের পরে চারটে সংখ্যা আমায় একটু অবাক করে। এত প্রিসিশন কোথায় লাগতে পারে! প্রথমে মনে হচ্ছিল ব্যাঙ্কিং ইনফরমেশন।
কিন্তু শেষে নামগুলো জাস্টিফাই করতে পারছিলাম না। ব্যাপারটা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। তবে গুগুল ম্যাপে ঢুকে দেবু মিত্তিরের বাড়ির লোকেশন আর তার চারপাশ দেখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম সংখ্যাগুলো ল্যাটিচুড-লঙ্গিচুড আর নামের প্রথম অক্ষরগুলো ইংরাজিতে দিক বোঝানোর জন্য। যেমন ১১.৬০৫৩নমিতা + ৪৩.১৩৯২ইকবাল মানে হল ১১.৬০৫৩ নর্থ আর ৪৩.১৩৯২ ইস্ট। জায়গাটা হল জিবুটি (Djibouti) পোর্ট। যেখান দিয়ে ইথিওপিয়ার যাবতীয় ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট হয়। ব্যস, এবারে ব্যাপারটা ভীষণ সহজ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম ২২.৪৬৬৯নাগার্জ্জুন + ৮৮.৩৭৭৭ইশ্বরন মানে হচ্ছে ২২.৪৬৬৯ নর্থ আর ৮৮.৩৭৭৭ ইস্ট আর জায়গাটা হল কলকাতার জীবনদীপ। যেমনি বোঝা তেমনি কাজ।
কাল সকাল সকাল জীবনদীপে পৌঁছে গেলাম। নীচের লবিতে একটু খোঁজ খবর করতে জানতে পারলাম ভেলুপল্লী ইশ্বরন নাগার্জ্জুনা নামে একজনের দশতলায় ইস্টার্ন শিপিং কোম্পানি নামে একটা কোম্পানি আছে। কোম্পানির নাম দেখে সন্দেহ হয়, এর সঙ্গে ল্যাটিচুড-লঙ্গিচুডের নিশ্চই একটা সম্পর্ক থাকবে। দশতলায় গিয়ে ইস্টার্ন শিপিং কোম্পানি আর তার মালিক ভেলুপল্লী ইশ্বরন নাগার্জ্জুনার খোঁজ পাই।
একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরছিল, দেবু মিত্তির নাগার্জ্জুনার সাথে কী করতেন। দেবুবাবুর লেখা অসংখ্য ইকুয়েশন ঘেঁটে একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম যে লোকেশনগুলো হচ্ছে সব বিভিন্ন দেশের পোর্ট বা কখনও কখনও দুএকটা ভারত মহাসাগরের ওপর কোনও একটা জায়গা যা কী না অন সি, কোনও দেশ বা দ্বীপ নয়। পোর্ট না হয় বুঝলাম কিন্তু দেবুবাবু মাঝ সমুদ্রে কী করতেন সেটা বুঝতে একটু বেগ পেতে হয়। অবশেষে সাহায্য করেন মিঃ নাগার্জ্জুনাই।
আজ সকালে নাগার্জ্জুনার অফিসে যাই। একটু আলাপচারিতার পর প্রস্তাব দিই আমার এক পার্টি দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে জিবুটিতে চাল পাঠাতে চায়, কী করতে হবে! শুনে প্রথমে উনি একটু অবাক হয়ে যান! আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চান আর শিপমেন্টের বিষয়ে অহেতুক কৌতূহল দেখাতে থাকেন।
আমি কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বলেন “এত বড় একটা শিপমেন্ট হবে আর আমি জানি না!”
মিঃ নাগার্জ্জুনার কনফিডেন্স বাড়ানোর জন্য আমি দেবু মিত্রের কাগজ থেকে পাওয়া ল্যাটিচুড লঙ্গিচুড অনুযায়ী কয়েকটা পোর্টের নাম বলাতে মিঃ নাগার্জ্জুনা কনভিন্সড হন আর আমিও ওর সাথে দেবু মিত্রের যোগাযোগটা বুঝতে পারি। বলে আসি আমার ক্লায়েন্টকে নিয়ে আসছি।
কিন্তু দেবু মিত্রের রোজগারের সোর্সটা বুঝতে একটু সময় লাগে। বাড়িতে বসে বসে কী করে মিঃ মিত্র ওরকম রোজগার করতেন যাতে ওইরকম লাইফস্টাইল মেইনটেইন করতেন! আর তার ওপর মাঝ সমুদ্রের ল্যাটিচুড লঙ্গিচুড গুলো! সেগুলো কী বলতে চাইছে!
ব্যাপারটা অনেকটাই পরিস্কার হয় কাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে। তারাতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম বেহালা চৌরাস্তার বাসের জন্য। হঠাৎ একটা ১২’র সি বাস এসে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে শুরু করল বজবজ বজবজ বলে। জিজ্ঞাসা করলাম চৌরাস্তা হ’য়ে যাবে, বলল না! মহেশতলা দিয়ে যাবে। মানে মাঝপথে ডেস্টিনেশন আর রুট বদলে ফেলল। অ্যান্ড দ্যাট ইজ দ্যা ক্যাচ। দেবুবাবু হাই সি ট্রেডিংয়ে ইনভল্ভড ছিলেন আর নাগার্জ্জুনা ছিলেন ওর পার্টনার।”
“বাট দ্যাটস্ অ্যাবসলিউটলি লিগ্যাল ওয়ে অফ ডুইং বিজনেস!” অশোক কুমার বলে উঠল।
“কিন্তু এই লিগ্যাল ওয়ে অফ ডুইং বিজনেসের মধ্যেই লুকিয়ে থাকত ইললিগ্যাল ট্র্যান্জাক্সনস!” পিকু জানাল।
“কিন্তু তুই সেটা জানলি কী করে?” সন্তু প্রশ্ন করে।
“আমি জানি না জাস্ট গেস করছি। নইলে দেবুবাবুর সঙ্গে নাগার্জ্জুনার সম্পর্কটাই বা কী আর দেবুবাবুর অত টাকার সোর্সই বা কী! আমি নেট ঘাঁটাঘাটি করে দেবুবাবুর হাই সি ট্রেডিং নিয়ে যা বুঝতে পেরেছি সেটা হল, ধরা যাক ইথিওপিয়া ভিয়েতনাম থেকে চাল কেনার অর্ডার দিয়েছে আর সেই মতো কোনও শিপিং কোম্পানি চাল নিয়ে ভিয়েতনাম থেকে ইথিওপিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে এবং দেবুবাবুর কাছে সে খবর আছে। এরই মাঝে হঠাৎ এজেন্টের মাধ্যমে দেবুবাবুর কাছে খবর আসে মিশরে চালের ক্রাইসিস যেকোনও দামে ওখানকার ব্যবসায়ীরা চাল কিনতে রাজি কিন্তু তৎক্ষণাত দরকার। দেবুবাবু এই খবরটা নাগার্জ্জুনার মাধ্যমে জাহাজে পৌঁছে দেয় আর জাহাজকে মিশরে পাঠিয়ে দেয়। আর সেই সঙ্গে ভিয়েতনাম থেকে আবার অন্য জাহাজে চাল লোড করে ইথিওপিয়ায় পাঠানোর ব্যাবস্থা করে। এইভাবে দেবুবাবু মিশরের পার্টি এবং ভিয়েতনামের পার্টি দুজনের কাছ থেকেই মোটা টাকা কমিশন নেয়। এটাই ছিল ওঁর রোজগার। এই কমিশন নিয়েই দেবুবাবুর নাগার্জ্জুনার সাথে গোলমাল আর সেখান থেকে এই পরিণতি। তবে এর সবটাই আমার গেস, নাগার্জ্জুনাই কনফার্ম করতে পারবে।”
পিকুর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে দুটো ঘটনা ঘটল। প্রথমে স্বপনবাবু ফিরনি দিয়ে গেল আর তারপরেই নাগার্জ্জুনাকে ইনটেরোগেট করছিল যারা তাদের লিডার অমিত বোস এসে জানাল নাগার্জ্জুনা মোটামুটি সবটাই কনফেস করেছে ইনক্লুডিং দ্যা মার্ডার। শুনে তো সন্তু আর কমিশনার থ! কমিশনার অমিত বোসকে বসতে বলে জিজ্ঞাসা করলেন “হোয়াট হ্যাজ হি কনফেসড?”
অমিত বোস যেটা বললেন তা পিকুর এতক্ষণে বক্তব্যের সাথে প্রায় হুবহু মিলে গেল। শুধু ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া আর মিশরের জায়গায় অন্য কিছু দেশ আর পোর্টের নাম এল।
অশোককুমার আর থাকতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে পিছন থেকে পিকুর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন “ইউ আর জাস্ট ইনক্রেডিবল! ইয়ং ম্যান!”
অলংকরণ: পারমিতা দাশগুপ্ত
পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।