হিসেব কষে দেখো,
রোজ পথের ক্ষত।
কথার পিঠে এঁকো
চাঁদের গায়ের মতো।
‘সহযাত্রী’, আমাদের এই শব্দের সঙ্গে পরিচয় রোজকার পথে। পথের দৃষ্টিভঙ্গির হিসেব কষলে দেখা যায় সরল অঙ্কের সমীকরণ মেলে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। কিন্তু মিশে যায় নিত্যযাত্রীদের সময়ের ভাগশেষ। কর্মক্ষেত্রে যাওয়া-আসার পথের সহযাত্রীরাই হয়ে ওঠেন পথের প্রতিবেশী। এই সাময়িক যাতায়াতের সময়টুকুই সারাদিনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয়, কিছু মানুষ এখান থেকেই রসদ নিয়ে ডুবে যায় কাজের ভিতর, আবার ফিরে যায় বাড়ির পথে। বেঁচে থাকার জন্য কাজের প্রয়োজন কিন্তু সেই সঙ্গে প্রয়োজন বিনোদনও। এই রোজকার যাতায়াতের পথই বেঁচে থাকার অন্যতম বিনোদন। জানলা থেকে হাওয়া আসে সহযাত্রীদের খাঁচার ভিতর… (Local Train)
এই সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার যুগে, মানুষ সহযাত্রী হিসেবে জুড়ে দেয় মানসিক রাস্তা-ঘাট। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পুরনো তারের মতন হয়ে যাচ্ছে সম্পর্কের মেন ও কর্ড লাইন। এখান থেকে তবুও ক্রসিং-এর দিকে বেঁকে যায় নিত্য পথের যাত্রীদের সম্পর্কের গতিপথ।
মানুষের দেহের ভিতর যে খাঁচা, সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও ভারী হয়ে আসে। চেপে বসে মানুষের গলায়, বদ্ধ হয়ে আসে। এই সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার যুগে, মানুষ সহযাত্রী হিসেবে জুড়ে দেয় মানসিক রাস্তা-ঘাট। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পুরনো তারের মতন হয়ে যাচ্ছে সম্পর্কের মেন ও কর্ড লাইন। এখান থেকে তবুও ক্রসিং-এর দিকে বেঁকে যায় নিত্য পথের যাত্রীদের সম্পর্কের গতিপথ। ট্রেনের চাকার আওয়াজ থেকে বাসের হর্ণ সবখানেই লেগে থাকে পড়শির ছোঁয়া। ‘যম-যাতনা’ দূরে যায় কি? কিছুটা তো যায়ই, না হলে মানুষ বাস্তবমুখী হয়ে উঠত কী করে? মানুষ এখনও ভাবতো কী করে? সেই গতিপথে হাঁটলে দেখা যায়…
ফসলের আগুনের ভিতর ‘মানুষের মুখ’: অরিন চক্রবর্তী
দাঁড়িয়ে রয়েছে ১০টা ৪০-এর বারাসাত-শিয়ালদহ লোকাল, একটু পরেই হাসনাবাদ থেকে বারাসাত আসার ট্রেন থামে। কর্মসূত্রে যাওয়ার জন্য হাজারেরও বেশি মানুষ এই ট্রেন থেকে নেমে ছোটেন শিয়ালদহ যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটির দিকে। এই ট্রেনের ভিতরেই অনেকে নিশ্চিন্তে বসার জায়গাটুকু পেয়ে যান তাঁদের সহযাত্রীর কল্যাণে। কেউ তাঁর বন্ধুর বসার জন্য নিজের রুমাল থেকে ব্যাগ, জলের বোতল রেখে দেন বসার জায়গায়। পরের স্টেশনে কেউ উঠে এই রেখে দেওয়া জায়গায় বসবেন। দিনের অন্যান্য সময়ের ট্রেনগুলির চিত্রও একইরকম। বাসের ক্ষেত্রে এটি কম দেখা গেলেও, বাসের যাত্রীরাও যাতায়াতের পথে বিভিন্নরকমভাবে পড়শিসুলভ আচরণ করে থাকেন। এখানে কে কোন পদে চাকরি করেন, কার কত মাস শেষের মাইনে সবই খুব গৌণ ব্যাপার। এখানে মানুষ নদীর মতন, ভেসে যায় আবহমান। স্রোত খুব অল্প, তবুও ছাপ রেখে যায় চরে।
‘খাঁচার ভিতর অচিনপাখি
কেমনে আসে যায়…’
অফিস টাইমে লোকাল ট্রেনে বয়ে যায় রাজনীতির ঝড়, নিত্যযাত্রীদের এই জ্ঞানের ভার বইতে পারা সহজ কথা নয়। এমন মন্তব্য ছুটে আসে পাশের সহযাত্রীর দিক থেকে, যা শুনলে মনে হতে বাধ্য তিনি বোধহয় নিউজ চ্যানেলের প্যানেলগুলোকেও হার মানাতে পারেন। বাঙালি বরাবরই যে রাজনীতিপ্রিয় মানুষ, তা এইসময় বোঝা খুব জটিল কিছু নয়। এই নিত্যযাত্রীরা বিভিন্ন দলের সমর্থক, নিজের দল সম্পর্কে খারাপ বক্তব্য শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসে ভাসিয়ে দেন অন্যদলের প্রতি ক্ষোভ, যা থেকে বাড়ে তর্কাতর্কি। সবকিছু এই যাতায়াতের সময়টুকুতেই সীমাবদ্ধ, পরদিন আবার একসঙ্গে ছুটে চলতে গিয়ে ভুলে যান সবাই গতদিনের সব ভালো-মন্দ। গড়ে ওঠে নতুন দিনলিপি।
এখানে একান্নবর্তী সংসার নেই। চোখের পর্দার আড়ালে যে জীবন গড়ে উঠেছে, সেখানে মাত্রাহীনতাও আছে, আছে হতাশা। কর্মক্ষেত্র বদলে গেলে তাল-লয় হারিয়ে যায় সুরের। সেতু ভেঙে পড়ে চলার পথের মাঝখানে। কিন্তু আবার গড়ে ওঠে নতুন সহযাত্রীর দল। যেন পরিযায়ী পাখির মতো আসে আর যায়। মাইগ্রেন হয় মানসিকতার, চিন্তাধারার গতিবেগ বদলে যায়।
রাত ১১ টা ৫০ বাজে। বনগাঁ যাওয়ার শেষ ট্রেন, হকার কামরা থেকে ছুটে আসে গানের গলা। সহযাত্রীদের সমবেত গানের সুর নিয়ে ঘরে ফিরি আমরা। লোকাল ট্রেন যেন জীবন্ত মঞ্চ মনে হয়। মিলে যায় আমাদের পথের হিসেব। পাশের যাত্রী তাঁর সহযাত্রীর জন্য কিনে দেন বাদামের প্যাকেট।
রাত ১১ টা ৫০ বাজে। বনগাঁ যাওয়ার শেষ ট্রেন, হকার কামরা থেকে ছুটে আসে গানের গলা। সহযাত্রীদের সমবেত গানের সুর নিয়ে ঘরে ফিরি আমরা। লোকাল ট্রেন যেন জীবন্ত মঞ্চ মনে হয়। মিলে যায় আমাদের পথের হিসেব। পাশের যাত্রী তাঁর সহযাত্রীর জন্য কিনে দেন বাদামের প্যাকেট। অনেকে হয়তো মনে করবেন, দৈনন্দিন জীবনের এই রহস্যভেদে কী যায় আসে? জীবন্ত পথের উপর ‘সহযাত্রী’ শব্দটি আতস কাচের নীচে রাখলে দেখা যায় গরম পিচের উপর বৃষ্টি পড়ে। এইসব ভাবতে ভাবতে আরও ভিতরে গেলে দেখা যায়, কাচের বয়ামে খুচরো জমানোর মতো জমতে থাকে সহযাত্রীর সঙ্গে দৈনন্দিন স্মৃতি। যেখান থেকে মুখ তুলে নিলেই, বাঁক পেরোবে অবসরজীবন।
জীর্ণ সভ্যতার ভিতর বারুদের দলিল : অরিন চক্রবর্তী
জীবনের সামঞ্জস্য কমছে, ঘুড়ির সুতোয় কেটে যাচ্ছে পাড়ার ব্যপ্তি। এই বহুমাত্রিক ধারায় কমা পড়ে থাকে বন্ধুত্বে। লোডশেডিং-এর পর জোনাকি আর আসে না, তেমনই আসে না প্রতিবেশীর হাঁড়ির খবর নেওয়ার সময়। এই সময়ে পথের পড়শিরা কিছুটা বিচ্ছিন্ন। তারা সাময়িকভাবে হলেও প্রকাশ করে থাকেন অনুভূতির ক্রোড়পত্র।
নিত্যযাত্রী কেবল অফিস যাওয়া মাথাদের গুণতি নয়, এরমধ্যেই মিশে আছে আরও অনেকে, হকার থেকে ভিক্ষুক! ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তারা সবাই সবার বন্ধু! কখনও নিত্যযাত্রীরা মশকরা করছেন কোনও ভিক্ষুকের সঙ্গে আবার একটু পরেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আত্মীয়তার সূত্রেই হয়তো অর্থগ্রহণের পরমূহুর্তে আশীর্বাদের বদলে বকাঝকা লাগাচ্ছেন ভিক্ষুক বৃদ্ধা! ট্রেনের চাকা গড়ালেই তা যেন এক জীবন্ত মঞ্চ, বন্ধুরা যে যার পাঠে অভিনয় করতে নেমে পড়ছেন।
এই ঠোকাঠুকির সম্পর্কের মধ্যেই এক অস্থায়ী সংসার টিকে থাকে। টিকে থাকে পড়শির স্নেহ। সদ্যবিবাহিত কোনও সহযাত্রী বদলি হয়ে এ-শহরে একা এলে তাঁর জন্য খানিক অতিরিক্ত খাবার আসে অন্যান্যদের বাড়ি থেকে।
এই ঠোকাঠুকির সম্পর্কের মধ্যেই এক অস্থায়ী সংসার টিকে থাকে। টিকে থাকে পড়শির স্নেহ। সদ্যবিবাহিত কোনও সহযাত্রী বদলি হয়ে এ-শহরে একা এলে তাঁর জন্য খানিক অতিরিক্ত খাবার আসে অন্যান্যদের বাড়ি থেকে। সেই টিফিন বাক্স খালি হয় না কখনও, হাতে হাতে ঘোরে আর সবাই ভাগ করে নেন সংসারের শান্তি।
কোকিলের সুরলহরী : অরিন চক্রবর্তী
‘ও দাদা, হাতটা একটু সরান না’, ‘আপনি কেমন মানুষ?’ এইসব বক্তব্যের পর দেখা যায় দু’জন গল্প করছেন একসঙ্গে। এ শুধু লোকাল ট্রেনেই সম্ভব। প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখের হিসেব নিকেশ গুলিয়ে যায় লোকাল ট্রেনে। চার নম্বর সিটের মতো ঝুলে থাকা থেকে জানলার ধারের মতো সম্পর্কও দেখা যায় এখানে। মানুষ খুব কম সময় একসঙ্গে, কিন্তু যতটুকু সময়ই পান; থাকে আনন্দ, টান, সুখ ও দুঃখের মিশেল। হকার কামরায় দেখা যায় সহযাত্রী এক ব্যবসায়ী অন্য যাত্রীর জিনিস নিয়ে এসে নামিয়ে দেয় স্টেশনে, এই বিশ্বাস ঘিরে রাখে তাদের। ‘সহযাত্রী’ কি তবে এখানে পথের পড়শি নাকি পড়শির পথ?
অলংকরণ : আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়

অরিন চক্রবর্তী
অরিন চক্রবর্তী। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে বেড়ে ওঠা। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা। ছোট পত্রিকা প্রিয়, শব্দের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে এই জীবন।