(Tapas Sen) ১৯৮৫ সালে প্যারিসে আয়োজিত ভারত উৎসবে খোদ আইফেল টাওয়ার সেজে উঠেছিল তাঁর আলোকসজ্জায়। আবার ‘সেতু’ নাটকে আলোর কারিকুরিতে মঞ্চে একখানা আস্ত ট্রেন ছুটিয়ে দিয়েছিলেন! যা দেখে বিখ্যাত শিল্পনির্দেশক চার্লস এলসন মন্তব্য করেছিলেন, ‘হলিউড উইথ অল ইটস রিসোর্সেস অ্যান্ড মানি কুড নট হ্যাভ এভার ড্রেমট অফ সাচ আ সলিউশন।’ তিনি আলোর জাদুকর, কিংবদন্তি তাপস সেন। বাংলা তথা ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রশংসিত হয়েছেন তাঁর অভিনব ও বিচিত্র সব কর্মকাণ্ডের গুণে।
১৯২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আসামের ধুবড়ি শহরে তাঁর জন্ম। বাবার কর্মসূত্রে এক বছর বয়সেই চলে যান দিল্লিতে। সেখানেই স্কুলের শিক্ষক প্রতাপ সেন ও সুশীল রায়চৌধুরীর কাছে তাঁর আলোকসম্পাতে হাতেখড়ি। স্কুলেরই ‘রাজপথ’ নাটকে প্রথম আলোক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পান ক্লাস নাইনের তাপস (Tapas Sen)।
ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেয়ে আলো-ছায়ার পথিক হয়ে থাকাকেই একমাত্র উপজীব্য মনে করেছিলেন। তাঁর জীবনের প্রথম নজরকাড়া কাজ, দিল্লিতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’ নাটকে। পেশাদার শিল্পী হিসাবে প্রথম কাজ করেন সাধনা বসুর নৃত্য প্রযোজনায়। ’৪৬ সালে চাকরি ছেড়ে বম্বে পাড়ি জমান ক্যামেরা আর আলোর কাজ শিখতে, তবে সেখানে বিশেষ সুযোগ না পেয়ে ’৪৭-এর শেষে তাপস (Tapas Sen) চলে আসেন কলকাতায়। বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, উৎপল দত্ত প্রমুখ দিকপালদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৯ সালে আলো করেন ঋত্বিক ঘটকের ‘জ্বালা’ এবং বহুরূপীর ‘পথিক’ নাটকে।
আরও দেখুন: ভানু’র আলো: জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় ১৯৫৪ সালে শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ‘রক্তকরবী’ নাটকের আলোক প্রক্ষেপণ। এলটিজি’র ‘অঙ্গার’ নাটকে খনিতে জলপ্লাবনের দৃশ্য, ‘কল্লোল’ নাটকে বিমান আক্রমণ, ‘সেতু’-র বহু আলোচিত সেই ট্রেনের দৃশ্য – একের পর এক নাটকে শিল্পকলা আর প্রযুক্তির মিশেলে অসম্ভবকেও সম্ভব করে তুলতেন তিনি।
তবে এত সব আশ্চর্য কাজের জন্য তাপসের কাছে যন্ত্রপাতি কিন্তু বিশেষ কিছুই ছিল না। পুরনো ক্যানেস্তারা, বিস্কুটের ভাঙা টিন, লজেন্সের কৌটো এসবই ছিল তাঁর আলোর ইতিহাসের উপকরণ! ‘অঙ্গার’ নাটকে খনির দৃশ্যে জল উঠেছিল পলিথিনের চাদরে ঢেউ খেলিয়ে, আবার ‘তিতাস’-এ বাঁশের ডগায় আলো বেঁধে দোল দিলেন তাপস সেন, আর দর্শক দেখল নদীর বুকে নৌকায় দুলছে হ্যারিকেন।
বাংলা থিয়েটারের পাশাপাশি কাজ করেছেন সারা দেশের অসংখ্য উল্লেখযোগ্য প্রযোজনায়। পৃথ্বীরাজ কাপুর আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমার থিয়েটারে সবই আছে, শুধু একজন তাপস সেন নেই!’ আবার ভি শান্তারাম থেকে শুরু করে তপন সিনহা ও বন্ধু মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’, ‘খণ্ডহর’, প্রভৃতি চলচ্চিত্র; বহু গুণী নৃত্যশিল্পীর মঞ্চ বা সুরেশ দত্তের পাপেট থিয়েটারও আলোকিত হয়েছে তাঁর আলোক ভাবনায়।
তিনমূর্তি ভবন, সবরমতী আশ্রম, চুনার দুর্গ, পুরানা কিল্লা, আগ্রার দেওয়ান-ই-আম, ’৮২-তে এশিয়াডের উদ্বোধন, ’৮৫ সালে প্যারিসের ভারত উৎসব থেকে মস্কো, লেনিনগ্রাদ, তাসখন্দেও পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর সৃষ্টি। হাওড়া ব্রিজের আশ্চর্য হলুদ-বেগুনি আলোক পরিকল্পনাও তাঁরই করা। আবার আদ্যন্ত রাজনৈতিক এই মানুষটি বারংবার সোচ্চার হয়েছেন থিয়েটার কর্মীদের নানান দাবী আদায়ে।
আজীবন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে পেয়েছেন এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ‘লাইট ডিজাইনার’-এর খেতাব, ’৭৪-সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ১৯৯৩ সালে ব্র্যাডফোর্ডের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘অ্যাসোসিয়েশন অব লাইটিং ডিজাইনার্স’ সাম্মানিক সদস্যপদ দেয় তাঁকে, ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক নির্বাচিত করে ‘এমেরিটাস ফেলো’ হিসাবে।
আলো-ছায়ার রহস্যই ছিল তাঁর আজীবনের উপাস্য, সব মিলিয়ে এক রাজকীয় আলোর যাত্রাপথ! আজ তাঁর শতবর্ষে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘অন্তরঙ্গ আলোর রাজা’ যুগপুরুষ তাপস সেনকে।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।