[১]
দুই
হাঁটতে হাঁটতে যোধাবেগমের কথা খুব মনে পড়ছে ওর। আমের রাজকুমারীর সাথে তারাবাঈও আমের ছেড়েছে প্রায় ১৪ বছর হতে চলল। ভগবান শ্রীরামও চোদ্দবছরই বনবাসে গিয়েছিলেন। রামায়ণ কথাতে শুনেছে তারাবাঈ। তবে আগ্রা বা ফতেপুরসিক্রিকে ওর বনবাস মনে হয়নি কখনোই। বাড়ির জন্য, ছোট বোনটার জন্য মন কেমন করত মাঝেমাঝে। (Historical Novel)
ফতেপুরসিক্রিতে ভোরের শব্দ অন্যরকম। আজানের সঙ্গে সঙ্গে গোটা শহরটাও জেগে ওঠে। কেল্লার ভেতর রাতপাহারা বদলে নতুন প্রহরী আরও যেন দ্বিগুণ সতর্ক পাহারায় মেতে ওঠে। হারেমের বিবিরা সব নাগিনা মসজিদে ইবাদতের জন্য যায়। তাঁদের পিছন পিছন চলে তাতার বাঁদীরা।
বাদশাহের মা, মরহুম বাদশাহ হুমায়ুনের বেগম হামিদা বানু বেগম আর বাদশাহের পহেলা বিবি রোকাইয়া বেগম সবার আগে বসে। তাদের পিছনে বসে বাদশাহের অন্যান্য বিবিরা। রোকাইয়া বেগমের খাস বাঁদী খোঁজা দিলরুবার সঙ্গে তারাবাঈ-এর খুব ভাব।

তারাবাঈ অবশ্য যোধবাঈ মহলের বাঁদী। আমের থেকে যোধবাঈ-এর সঙ্গে এসেছিল সে আগ্রায়। বাঁদীরা কোথায় যাবে, কী খাবে, কীভাবে নিঃশ্বাস নেবে এসবের ওপর তাদের নিজেদের কোনও হাত নেই। থাকলে কী তারাবাঈ আমের থেকে আগ্রা কিল্লায় আসত? আমেরের রাণী চন্দ্রিকার খাসদাসী তারাবাঈ-এর মা। রাণী চন্দ্রিকার অঙ্গ প্রসাধনের জন্য তারাবাঈ-এর মা হীরাবাঈ-এর প্রয়োজন পড়ত। হীরাবাঈ-এর মতো নথ পরাতে, হাতে মেঁহেদি আঁকতে, চন্দন, মাটি, নীম, তুলসী আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেপ বানাতে আমের কিল্লায় আর কেউ পারে না। রাণীমার তাই স্নান থেকে পোষাক পরা সবেতেই খাস দাসী হীরাবাঈকে প্রয়োজন।
সেদিন হীরাবাঈ-এর খুব অসুখ করেছিল। রাজসভায় কী একটা বিশেষ অনুষ্ঠান ছিল। রাণী চন্দ্রিকার জরুরি তলব। হীরাবাঈকে যেতে হবে রাণীসা মানবতির মহলে। সেখানে রাণীসার মেয়ে রাজকুমারী হলকা বাঈকে প্রস্তুত করতে হবে। আমেরের থেকেও বড় একটা রাজ্য আছে। আগ্রা যার রাজধানী। সেই আগ্রা থেকে এইসময়ের সবচেয়ে তাকতবার সম্রাট আসছে হলকা বাঈ-কে বিয়ে করতে।
জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে হীরাবাঈ মানবতী মহলে এসেছিল। মা’কে সাহায্য করতে তারাবাঈও সঙ্গে এসেছে। কী অপূর্ব রাণী মানবতি মহল। আর এই মহলের খাস কামরায় রাজকুমারী হলকা বাঈকে প্রস্তুত করতে এসেছে প্রায় জনাদশেক দাসী। বাইরে প্রহরায় আরও চারজন। কেউ লেপ তৈরি করছে। কেউ রাজকুমারীর চুলে তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। স্নান সারা হলে গুগগুলের ধোঁয়ায় রাজকুমারীর চুল শুকোন হল। হীরাবাঈ নথ পরাতে গেলে রাজকুমারী বলে ওঠে,-তোমার তো গায়ে খুব তাপ। তুমি পারবে? অন্য কাউকে দাও বরং। তুমি বিশ্রাম নাও।
রাজকুমারীর দয়ায় হীরাবাঈয়ের চোখে জল আসে। তবু ভয় হয় যদি রাণী চন্দ্রিকা বা মানবতী রাগ করেন? তারাবাঈয়ের কষ্ট হচ্ছিল। মা’কে দেখে। জ্বরে কাঁপছে।
রাজকুমারীর দয়ায় হীরাবাঈয়ের চোখে জল আসে। তবু ভয় হয় যদি রাণী চন্দ্রিকা বা মানবতী রাগ করেন? তারাবাঈয়ের কষ্ট হচ্ছিল। মা’কে দেখে। জ্বরে কাঁপছে।
-রাজকুমারী, যদি অনুমতি দেন, আমি পরাব নথ আপনাকে আজ? আমি ওর মেয়ে।
রাজকুমারীর দয়ার শরীর। পাকা গমের মতো রঙ স্নানের পর যেন আরও বেশি উজ্জ্বল। মুখটা কিছুটা ম্লান।
রাজকুমারীর কপালে চন্দন আর কুমকুমের ফোঁটা দিতে গিয়ে তারাবাঈ লক্ষ্য করেছিল, কাজল পরা চোখদুটো যেন জল আটকে রেখেছে। রাজকুমারীর জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন তারাবাঈয়ের। রাজকুমারীর সঙ্গে আগ্রা আসার আগেরদিন ও নিজের জন্য ও রাজকুমারীর জন্য মা অম্বের দর্শনে যায়। মা’কে বলে, রাজকুমারীকে রক্ষা করো মা। রাজকুমারীর যদি নিজের ইচ্ছার কোনও দাম না থাকে তাহলে তারাবাঈ তো দাসী মাত্র।
আগ্রায় এসে অবশ্য রাজকুমারীর দুঃখ অনেকটাই কমে যায়। এখানে মরিয়াম মকানী, বাদশাহের মা রাজকুমারীকে যোধা বলে ডাকে। মরিয়াম মকানী তাঁর পুত্রবধূ যোধাকে খুব ভালবাসেন। আর এখন তো রাজকুমারী আর শুধুই শাহেনশাহের যোধাবাঈ নন, রাজকুমারী এখন মরিয়ম মকানী। শাহেনশাহকে প্রথম সন্তান সুখ আমের রাজকুমারীই দিয়েছেন।
মুঘল শাহীতে এত জাঁকজমক, এত প্রাণের শব্দ দিনরাত্রি। তবু এখানে প্রাণের দাম কোথায়? তারাবাঈয়ের মনে আছে, সবে আমের থেকে আগ্রা এসেছে। তখন শীত প্রায় শেষের দিকে। এরপর আগ্রায় ওদের প্রথম গ্রীষ্মকাল। সেই ভয়াবহ দিনের কথা মনে পড়লে তারাবাঈ আজও কেঁপে ওঠে। শুধু তারাবাঈ নয়, হারেমের প্রতিটা মহিলাই সেদিনের কথায় যেন ভয় পেয়ে যায়। যে যার ইষ্টনাম করতে থাকে।
খুব সকালে, বাদশাহ তখন খোয়াবগাহে। তারাবাঈ গিয়েছিল ফুল তুলতে। যোধামহলে রাণীসা বসবেন পুজোয়। পুজোর আগে কানহাকে ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিতে ভালবাসে যোধারাণী। মোতিবিবি ঘিয়ের প্রদীপ সাজাচ্ছে। যোধারাণী অরতি করবেন।

বাগানে ফুল তুলতে তুলতে তারাবাঈ কার যেন ছায়া দেখতে পেল। ক্রমশ খুব লম্বা হচ্ছে ছায়াটা। পায়ের শব্দও শুনতে পেল। ভয় পেয়ে গেল তারাবাঈ। ভূতপ্রেতের থেকেও ইনসানকে ভয় বেশি ওর। সেদিন সন্ধ্যেবেলা শাহি ডাকে ও চিঠি আর রুপাইয়া পাঠাতে গিয়েছিল মা’র জন্য। হোলিতে হারেমে এবার ওরা বখশিস পেয়েছিল। ফেরার সময় এই বাগানেই আধম খাঁ-র মুখোমুখি হয় তারাবাঈ। আধম খাঁ, বাদশাহের ধাত্রী মা উজিরে আলা মাহমঅঙ্গার ছেলে। মাহম হারেমে ও রাজসভায় সবচেয়ে ক্ষমতাবান ঔরত। মরিয়াম মকানী থেকে রুকাইয়া বেগম, সেলিমা বেগম সবাই মাহমকে সম্মান করেন। তাঁর পরামর্শ নেন। আর বাদশাহ তো মাহমকে বড়ি আম্মি ডাকেন। সেই উজিরেআলা মাহম অঙ্গার ছেলে আধম খানকেও সবাই ভয় পায়। বিশেষ করে হারেমের গোলামরা। আধম খানের নজর খুব খারাপ। যোধারাণীর বিয়ের সময় থেকে তারাবাঈয়ের কেমন একটা ভয় করত আধম খানকে দেখলে।
সেদিন সন্ধ্যায় আধম খানকে দেখে তারাবাঈ দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছিল।
-দাঁড়াও। এক পা’ও যদি এগোয়, তাহলে দু’টুকরো করে দেব এই তলোয়াড়ে। আধম খান বেশি কথা বলা পচ্ছন্দ করে না। আধমের তরোয়াল কথা বলে।
আধম খানের গলা শুনে তারাবাঈ যেন কাঠপুতুলের মতো স্থির হয়ে গিয়েছেল। হাত পা নাড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিল। একমুহূর্তের জন্য বুকের হৃদস্পন্দনও বুঝি বন্ধ হয়ে যায়। আধম খান এগিয়ে এসেছে। তারাবাঈয়ের একদম সামনে।
-নাম? কী নাম তোর?
তারাবাঈয়ের গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে আধম খান অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। খুব কঠিন আর কর্কশ গলায় সে বলে,
-বত্তম্মিজ বাঁদী। প্রশ্নের জবাব দিতে জানিস না?
তারপর আরও কাছে এগিয়ে এসে তারাবাঈয়ের ঘুংঘট খুলে দেয়। একদৃষ্টে তারাবাঈয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকায়। তারাবাঈও একবার বুঝি আধমের চোখে চোখ রেখেছিল। কী বীভৎস লোভ সেই চোখে!
তারপর আরও কাছে এগিয়ে এসে তারাবাঈয়ের ঘুংঘট খুলে দেয়। একদৃষ্টে তারাবাঈয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকায়। তারাবাঈও একবার বুঝি আধমের চোখে চোখ রেখেছিল। কী বীভৎস লোভ সেই চোখে! যেন ও একটা ইনসান নয়, নরমাংস। ভয়ে শিউরে ওঠে সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নেয়। আধম কিন্তু ওকে রেহাই দেয় না। একঝটকায় টেনে ওকে বুকের কাছে নিয়ে আসে। আধমের মুঠোর ভেতর তারাবাঈয়ের দমবন্ধ হয়ে আসছিল। যন্ত্রণায় ও কুঁকরে যাচ্ছিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কেউ যদি এখন এখান দিয়ে যেত। বাদশাহের কোনও সেপাই যদি এখান দিয়ে যেত। তারাবাঈকে উদ্ধার করত এই পাশবিক অত্যাচার থেকে।
আধম চলে যাওয়ার পরে তারাবাঈ কিছুক্ষণ নির্জীবের মতোই পড়েছিল মাটিতে। ওর জীবনে প্রথম পুরুষ ছোঁয়া। কিন্তু কোনও প্রেম নেই, সম্মান নেই। ও যেন একটা খাবার। ছিঁবড়ে খেয়ে গেল একটা শৃগাল। এখন ও এই ছেঁড়া বস্ত্র পরে কী করে হারেমে ঢুকবে? যোধাবেগমের কাছেই বা কীভাবে দাঁড়াবে? বেগম যখন সন্ধ্যেবেলায় তুলসীতলায় প্রদীপ দেবেন তখন মোতিবিবি আর তারাবাঈ দুজনকেই প্রয়োজন তাঁর। শাহেনশাহ না এলে বেগমের সঙ্গে এরপর খোয়াবগাহে কানহার আরতিতেও ওরা দু’জন থাকে। মাঝেমাঝে শাহেনশাহ এলে ওরা বাদশাহকে নীচু হয়ে কুর্ণিশ করে বাইরে চলে আসে। বাদশাহ আর তাঁর বেগম একসাথে আছে দেখে খুব স্বস্তি হয় তারাবাঈয়ের। এইতো আমাদের আমেরের রাজকুমারীর আর কোনও দুঃখ নেই। স্বামী যবন হোক আর যাই হোক, স্বামী তো ঔরতের শক্তি। বেঁচে থাকার ইচ্ছে। তারাবাঈয়ের নিজস্ব বুদ্ধিতে এইসব ভাবনাই মাথায় আসে। ওর নিজের মনেও একটা গৃহস্থ জীবনের ছবি ভেসে ওঠে তখন। আর আজ আধম খান এইভাবে সব মুছে দিল! এত অপমান, কষ্ট ওর ভাগ্যে ছিল? খুব কান্না পায় তারাবাঈয়ের। এমন সময় আরেক ছায়ামূর্তি।

-কেঁদো না। তোমার সাথে যা হয়েছে, তার জন্য তুমি দায়ী নও। কোনও দোষ নেই তোমার। ওঠো। উঠে দাঁড়াও। পথে চলতে গু মারিয়ে ফেললে কি মানুষটার দোষ হয়? পা ধুয়ে আবার এগিয়ে যেতে হয়। তুমিও সব ধুয়ে ফেল তারাবাঈ।
নিজের নামটা শুনে এবার তারাবাঈ চোখ তুলে তাকাল। লম্বা মতো মানুষটা অনেকটা রাজপুতদের মতো দেখতে। তারাবাঈয়ের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল,
-আমি রতন সিং। আগ্রা কিল্লায় বাঙ্গালমহল বানানোর সময় সেই সুদূর বিহার থেকে এসেছিলাম। বাদশাহের নেকনজরে পরে আমার আর ঘরে ফেরাই হল না। এখানেই কারিগরির কাজ করি।
তারাবাঈয়ের দিকে তাকিয়ে রতন সিং এবার বলে,
-আমি এপথ দিয়ে কেল্লার বাইরে যাচ্ছিলাম। আমি সব দেখেছি তারাবাঈ।
এই নিয়ে দুবার লোকটা ওর নাম ধরে ডাকল। তারাবাঈয়ের খারাপ লাগছে না লোকটার কথা শুনতে। আবার রাগও হচ্ছে। সব দেখেছে যখন তাহলে বাধা দেয়নি কেন? কেন ওকে বাঁচায়নি ওই রাক্ষসটার হাত থেকে?
তারপরই মনে হল, ভগবান শ্রীরামও সীতা মা’কে রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করতে বানর সেনাদের সাহায্য নিয়ে তবে এসেছিলেন। আর আধম খানের মতো জঙ্গী মানুষের সাথে এই নিরস্ত্র কারিগর কী করে লড়বে?
লোকটা যেন মনের কথা টের পেল।
-তুমি ভাবছ, আমি দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখেছি। কিন্তু তা নয়। বিশ্বাস করো। আমার দুচোখ বেয়ে জল আসছিল।
গাছের এই ডালটা দিয়ে আমি নিজেই নিজেকে আঘাত করছিলাম। কিন্তু আমি যদি এগিয়ে আসতাম তাহলে তোমাকে বাঁচাতে তো পারতামই না। হয়তো আমরা দুজনেই মারা পড়তাম আধমের তরোয়ালের কোপে।
গাছের এই ডালটা দিয়ে আমি নিজেই নিজেকে আঘাত করছিলাম। কিন্তু আমি যদি এগিয়ে আসতাম তাহলে তোমাকে বাঁচাতে তো পারতামই না। হয়তো আমরা দুজনেই মারা পড়তাম আধমের তরোয়ালের কোপে।
তারাবাঈ ভাবে রাজপুত ছাড়া আর সবাই খুব ভীতু। এত প্রাণের ভয়? আমাদের রাজপুত ছেলে হলে প্রাণের তোয়াক্কা না করেই একজন ঔরতের সম্মান বাঁচাতে ছুটে যেত।
এসব ঘটনা সত্ত্বেও তারাবাঈয়ের সঙ্গে রতন সিং-এর ভাব হয়ে গেল। ভালবাসাও হল দুজনের মধ্যে। রতন সিং-এর সাথে সংসার গড়ার স্বপ্নও ও আজকাল দেখে। কিন্তু কাউকে বলতে পারে না। ফুল তুলতে তুলতে কানহার কাছে এই প্রার্থনাই ও করছিল। ছায়া মূর্তিটা কাছে আসতেই তারাবাঈ টের পায়। আবার এসেছে ওই শয়তানটা। আধম খান। সেদিন রতন সিং একটা ছেনি দিয়েছিল ওকে। এটা দিয়ে রতন সিং পাথর কাটে। বাদশাহের নির্দেশে যখন কিল্লার কোথাও কিছু খোদাই করে নতুন নকশা আঁকতে হয়, এই ছেনি দিয়েই সেই খোদাইয়ের কাজ হত। কাবুল থেকে অনেক যন্ত্রপাতি এসেছে। রতন সিং-এর একটা নতুন ছেনি হয়েছে। পুরনোটা সে তারাবাঈকে দিয়েছে। তারাবাঈ শক্ত করে ওটা হাতে ধরে। আজ ও প্রতিরোধ করবেই। ভয় পেয়ে ওই শয়তানের হাতে কিছুতেই আজ ও ধরা দেবে না।
আধম এগিয়ে আসতে তারাবাঈ এবার আর সাহস ধরে রাখতে পারল না। সত্যি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেল ও। আধমের হাতে খোলা তরোয়াল। আর তরোয়ালের গায়ে ও কী? রক্তমাখা যে!
আধম এগিয়ে আসতে তারাবাঈ এবার আর সাহস ধরে রাখতে পারল না। সত্যি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেল ও। আধমের হাতে খোলা তরোয়াল। আর তরোয়ালের গায়ে ও কী? রক্তমাখা যে! তারাবাঈ ঠিক দেখছে তো? এরকম তো এই কিল্লায় এই তিনমাসে ও দেখেনি। আর আধম তারাবাঈয়ের দিকে তাকালও না। সোজা হারেমের দিকে ছুটে গেল।
সর্বনাশ। আধম খান হারেমে নাঙ্গা তরোয়াল নিয়ে ছুটে গেল? শাহেনশাহও যে হারেমেই রয়েছেন! শাহেনশাহের ক্ষতি করতেই কি আধম খান ওভাবে ছুটে গেল? তারাবাঈ আর দাঁড়ায় না। একমুহূর্তও সময় নষ্ট করা চলবে না। তারাবাঈ দৌড়াতে থাকে যোধামহলের দিকে।
-যোধাবেগমকে তো খবর করি! যদি না শয়তানটা যোধামহলে আক্রমণ করে।
এরপরের ঘটনা অবশ্য পুরোটা তারাবাঈ দেখেনি। কিছুটা দেখেছে, কিছুটা লোকমুখে শুনেছে।
আধম খান বাদশাহের আতালিক শামসুদ্দিন আৎকা খানকে হত্যা করে সেই রক্তমাখা তরোয়াল নিয়েই ছুটে এসেছে বাদশাহের খোয়াবগাহে। লক্ষ্য এবার বাদশাহ স্বয়ং। বাদশাহের হাতে কোনও অস্ত্র ছিল না। খোয়াবগাহের দ্বাররক্ষীর দেওয়া একটা বাগদাদী ছোঁড়া ছাড়া। প্রায় খালি হাতেই সম্রাট ওই অত শক্তিশালী আধম খানকে মাটিতে ফেলে দেন। প্রহরীদের আদেশ দেন, কিল্লার ছাদ থেকে যেন আধম খানকে ছুঁড়ে নীচে ফেলে দেওয়া হয়। প্রথমবার প্রহরীরা আদেশ পালন করে জিজ্ঞাসা করতে আসে, পরবর্তী আদেশের জন্য। শাহেনশাহ্ বলেন, যতক্ষণ না মারা যাচ্ছে ততক্ষণ যেন আধম খানকে কেল্লার ছাদ থেকে ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়।
এই ঘটনার পর মাহম আর কেল্লামুখো হননি। নিজের ঘর থেকেই তিনি আর বেরোননি। শাহেনশাহ দেখা করতে চাইলেও তিনি দেখা করেননি তাঁর আদরের জালালের সঙ্গে।
আধম খান যখন মারা যায়, তার মা মাহমাঙ্গা নিজের কক্ষে ছিল। বাদশাহ নিজে এসে তাকে খবর দেন।
-আধম খান আমার আতালিক আৎকা খানকে হত্যা করেছে। আমি ওকে শাস্তি দিয়েছি।
মাহমাঙ্গা এইটুকু শুনেই বলেছিল, তুমি ঠিকই করেছ।
মাহম তখনও জানতেন না তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ততক্ষণে অন্তিম শয্যায় শায়িত।
এই ঘটনার পর মাহম আর কেল্লামুখো হননি। নিজের ঘর থেকেই তিনি আর বেরোননি। শাহেনশাহ দেখা করতে চাইলেও তিনি দেখা করেননি তাঁর আদরের জালালের সঙ্গে। পুত্রশোকাতুর বৃদ্ধা আহার নিদ্রা ত্যাগ করে আর মাত্র ৪০ দিন বেঁচেছিলেন।
মাহমাঙ্গা মারা গেলে তাঁকে শোয়ানো হয় তাঁর ছেলেরই পাশে। বাদশাহ স্বয়ং তাঁর বড়িআম্মির জানাজায় সামিল হন। মা ছেলের স্মরণে একটা মকবরাও তৈরি করে দেন। আগ্রা থেকে কিছুটা দূরে। আৎকা খানের মকবরাও একসাথে তৈরি হয়। তবে অন্য জায়গায়। এইসব তারাবাঈ রতন সিং-এর কাছে শুনেছে।
(ক্রমশ)
অলংকরণ – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
আনন্দবাজার, বর্তমান, প্রতিদিন, এই সময়, আজকাল, একদিন, স্টেটসম্যান বাংলা ইত্যাদি বাংলার প্রায় প্রত্যেকটি খবরের কাগজেই নিবন্ধ লেখেন। দেশ, সানন্দা, সাপ্তাহিক বর্তমান, কৃত্তিবাস, কথাসোপান, পরিচয় ইত্যাদি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত।
আনন্দমেলা, জয়ঢাক ইত্যাদি ছোটোদের পত্রিকায় গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত।
প্রকাশিত বই সাতটি। একটি উপন্যাস, দুটিগল্পগ্রন্থ, তিনটে কবিতার বই ও একটি ছোটোদের উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশিত।
উপন্যাস- ’১৫ নিমতলা ঘাট স্ট্রিট’, ইতিকথা প্রকাশনী (২০২৩)
গল্প-সংকলন- ‘ছাতা হারানোর পরে’-হাওয়াকল প্রকাশনী (২০২২)
-‘দময়ন্তীর জার্ণাল, সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী(২০১৯)
কবিতার বইগুলি-
‘পরজন্মের মুদ্রণপ্রমাদ’- সিগনেটপ্রেস (২০২২)
‘মালিনীর দ্রোহকাল’- পরম্পরা প্রকাশনী(২০২০)
‘মিথ্যে ছিল না সবটা’, কলিকাতা লেটার প্রেস(২০১৮)
ছোটোদের উপন্যাস-
‘বাড়ি ফেরার তাড়া’- বরানগর দর্পণ প্রকাশনী (২০২৪)