সবকিছু শুরুর আগেও একটা শুরু থাকে। গাছের শেকড়ের মতো। যাকে দেখা যায় না অথচ সে না থাকলে ডাল, পালা, ফল, ফুল কিছুই হত না। আমার এই একলা টোটো করে এদিক সেদিক ঘোরা শুরু হয়েছিল অনেক অনেক পরে। কিন্তু ইচ্ছেটা মনের মধ্যে শেকড় গেঁথেছিল তার অনেক অনেক আগে থেকেই। ছোটবেলায় নিবেদিতা স্কুলের গেট দিয়ে অল্প ঢুকলেই রোজ চোখে পড়ত লাঠি হাতে বিবেকানন্দের ছবি। তখন ছোট। পরিব্রাজক কথাটার ভাল করে মানে জানতাম না। জানতাম না মাধুকরী কাকে বলে-কিন্তু ইছে করত এরকম পায়ে হেঁটে ঘুরতে (Solo Travel)। স্কুলে মাঝে মধ্যে স্বামীজির জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে নাটক হত। কখনও দেখতাম আবার কখনও অভিনয়ও করতাম।

আধ্যাত্মিকতা বুঝতাম না – অদ্বৈত বেদান্ত কাকে বলে জানতাম না। আমায় টানত স্বামীজির একা একা নানা অজানা জায়গায় ঘোরার কাহিনি, অজানা মানুষকে চেনার গল্প। কখনও- ফুটপাতে তো কখনও রাজার প্রাসাদে। ইচ্ছে করত এরকমভাবে আমিও পায়ে হেঁটে ট্রেনে চড়ে সারা ভারত ঘুরব। সারা জীবন মায়ের কড়া নজরে বড় হয়েছি, স্কুল বাসে স্কুল গেছি- কোচিং ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট রিক্সাওয়ালা ও কাজের মাসি থাকত আমার সঙ্গে। ভাবতাম প্রথম স্বাধীনতা পাব মাধ্যমিকের পর– একটা অচেনা বাসে চড়ে অজানা স্টপে নেমে যাব। স্বামীজি থেকে তখন আমি নীললোহিতে পৌঁছে গিয়েছি। সময়টা নয়ের দশকের মাঝামাঝি। এগারো ক্লাসে একা বাসে করে নতুন স্কুলে যেতে গিয়ে নার্ভাস হয়ে সম্পূর্ণ উল্টোদিকের বাসে উঠে স্কুল লেট প্রথম দিনেই। সে যাত্রায় ভয় পেলেও একা ঘোরার ভূত দিনে দিনে মনের মধ্যে আরও বেশি করে বাসা বেঁধেছিল। আর আশ্চর্য এই সমস্ত মানস ভ্রমণে কোনওদিন মনে হয়নি পারব না। বা আমি মেয়ে বলে বিপদে পড়ে যাব। মেয়ে বোধটা পরে এসেছে। আর মেয়ে বলে সীমারেখা টেনে দেওয়ার বোধ এসেছে অনেক বড় হয়ে।

কলেজের প্রথম বছর। ইতিহাস নিয়ে ভর্তি হলাম প্রেসিডেন্সিতে। একঝাঁক ঝলমলে বন্ধু, বেশির ভাগই ছেলে। সে বছর ইতিহাস সংসদ হল মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনজন ছেলে বন্ধু চেপে ধরল- আমাকে যেতেই হবে। আমি একপায়ে রাজি। তখন এক মেয়ে বন্ধু আলাদা করে ডেকে নিয়ে আমাকে বোঝাল– দ্যাখ, তুই তো একা মেয়ে। তিনটে ছেলের সঙ্গে যাওয়া তোর মানায় না। কাঁচুমাঁচু মুখে ‘ছেলে’ বন্ধুদের বললাম আমি যেতে পারব না- কেমন লাগবে তোরা তিনটে ছেলে আর আমি একটা মেয়ে চলেছি তোদের সঙ্গে! শুনে তারা অবাক, প্রশ্ন ‘তুই আবার কবে মেয়ে হলি?’ এই উওরটা আমাকে আবার আমার বাস্তবে ফিরিয়ে এনেছিল যে এই যে আমি, যে দেখতে, শুনতে, প্রেমে-অপ্রেমে প্রবল ‘মেয়ে’ সে প্রথমত একটা মানুষ। সেই মানুষের ইচ্ছেটাকে কলেজ জীবনে মর্যাদা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হৈহৈ করতে করতে তারপর গেছি কত জায়গায়। বন্ধুত্বে যা হয়েছে প্রেমে অপ্রেমে তা হয়নি। জীবনে যতবার প্রেমে পড়েছি সেই সব পুরুষের মধ্যে একটা মিল ছিল যে এরা সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে চষে বেরিয়েছে- কেউ আমাকে শোনাত ইউরোরেল করে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, কেউ বলত আমেরিকার রকি মাউন্টেন, কারোর চোখ দিয়ে চোখের সামনে দেখেছি জাপানের চেরিব্লসম উৎসব। কিন্ত না- সম্পর্ক করলেও কেউ আমাকে সে সবের সঙ্গী করেনি। অথবা ‘মেয়ে’ বলে হয়ে ওঠেনি হয়তো। তিরিশের কোঠায় তাই ঠিক করেছিলাম কেউ নিয়ে গেল না তো কী হয়েছে। আমি নিজেই নিজেকে নিয়ে যাব। একা একা। যেখানে মন চায়।

দেখলাম মন শুধু বেড়াতে চায় না, চায় না দামি হোটেল বা আরামের বাথটব। মন চায় নতুন কিছু জানতে, নতুন কিছু শিখতে। সময়টা ২০০০ এর শুরুর দশক। ওয়েবসাইট, গুগল আর অর্কুট এর দুনিয়া। সে সময় বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় তিন বছর। মা হওয়ার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও হতে পারছি না। চলছে নানা রকম ওষুধ, পরীক্ষা নিরীক্ষা। খুব ইচ্ছে ছিল বাচ্চা হলে তাকে গল্প শোনাব। গল্প শোনাতে আমার বরাবর ভাল লাগে। নিজের সন্তানকে তখনও পাইনি তাই এক পথশিশুদের স্কুলে কাজের ফাঁকে ছুটির দিনে যেতাম গল্প শোনাতে। সে এক অনাবিল আনন্দের অভিজ্ঞতা।

এরকমই এক সময় জানতে পারলাম ব্যাঙ্গালোরে এক সংস্থা আছে- যেখানে গল্প কী করে বলতে হয় তা শেখানো হয়। দশদিনের কোর্স। দেখে ভাবলাম- সাহস করে গেলে হয়- কিন্তু টাকা জমাতে হবে। নিজের টাকায় যাব। নিজের তখন ওই টাকা টুকুও ছিল না। সে সময় সাংবাদিক ছিলাম এক প্রথম সারির পত্রিকায়। আর ভাবতাম- বাচ্চা হলে রাত জেগে নাইট ডিউটি, পাতা ছাড়া সামলাব কী করে। এমন সময় জাতীয় স্তরের এক টিভি সংস্থার বাংলা চ্যানেলে চাকরি পেয়ে গেলাম। মাইনে দুগুণ হলেও একবছর কোনও ছুটি নেওয়া যাবে না- বসের হুকুম। ছোট পর্দায় মা-মাসি-মানুষকে কী করে আটকে রখতে হয় সে গল্প শিখতে শিখতে দূরে চলে গেল ব্যাঙ্গালোরে যাওয়ার পরিকল্পনা। কিন্তু হবি ভোলেনি। বছর ঘুরতেই বসকে বললাম- ছুটি চাই। দশ দিন! বস জানতে চাইলেন কোথায় যাবে ইউরোপ! ‘না-ব্যাঙ্গালোর! শিখতে যাব কী করে গল্প বলতে হয়।” বস বললেন- ডিটেলস দাও। অফিস স্পনসর করবে তোমার যাওয়া আর ফিরে এসে যা শিখলে আমাদের বলবে। সেই প্রথম একা যাওয়া। সেই প্রথম একা প্লেনে ওঠা। আর সেই প্রথম ফেরার পথে ফ্লাইট মিসও করা। আর সেই প্রথম আমার নিজের চেনা গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে অনেক অজানা মানুষের সঙ্গে মেশার শুরু, তাদের গল্প জানার শুরু, নতুন কিছু শেখার শুরু আর শুরু ভয় কাটানোর।

আজকাল একটা কথা খুব শুনি- manifestation মানে কোনও কিছু যদি মন প্রাণ দিয়ে চাওয়া যায়- তা নাকি কোনও না কোনও ভাবে সত্যি হয়। তো! মন-প্রাণ দিয়ে আমি ছোটবেলা থেকে চেয়েছিলাম টোটো করে ঘুরতে। কথায় বলে মেয়েদের নাকি ‘বলা মুখ আর চলা পা হতে নেই’। আমার মনে হয় আমার এই দুটো জিনিসকেই আমি সব চেয়ে বেশি ভালবেসেছি। চেয়েছি সারাজীবন আরাম করে গল্প করতে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, তাদের গল্প জানতে আর পৃথিবীর অলি-গলি ঘুরে বেড়াতে। আর চাকরি সূত্রে আজকাল আমায় তাইই করতে হয়- ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে জানতে হয় মানুষের জীবন, তাদের সংস্কৃতি ও মানসিকতা। তার উপর ভিত্তি করে আমাকে বানাতে হয় সিরিয়াল। তবে সিরিয়াল বানানোর একটা গতানুগতিক ছক আছে- এই পৃথিবীর অনেক কিছুই সেখানে খাপছাড়া, বেমানান।

চেনা জগতের বাইরে সেই জগতকে জানতে, সেই জীবনকে চিনতে নিজেই ছুটে যাই তার দিকে। কখনও হিমাচলের বৃষ্টি দেখতে দেখতে সেরামিক বানানোর শিল্প কর্মশালায় তো কখনও নন্দাদেবী ত্রিশূল পাহাড় দেখে ধ্যানের মধ্যে দিয়ে এক শান্ত পৃথিবীর সন্ধানে। ইতালির এক দুর্গের ছাদে একা দাঁড়িয়ে একবার গা ছমছম করছিল। টাসকানির অপূর্ব কমলা সূর্য ডুবছে আর আমি ভয় কাটাতে জোরে জোরে গাইছি—
“আমারে যে নামতে হবে ঘাটে ঘাটে,
বারে বারে এই ভুবনের প্রাণের হাটে।
ব্যবসা মোর তোমার সাথে চলবে বেড়ে দিনে রাতে,
আপনা নিয়ে করব যতই বেচা কেনা…
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না!”

এই ভদ্রলোকের বাইরে বেরোনো খুব খুব কঠিন। আর বেরোবই বা কেন? তিনিই তো জীবনদেবতা। তাঁর পথের পথিক হলে কীসের ভয়। কীসের লজ্জা! অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার মধ্যে দিয়ে এই চলার সফরে একটু একটু করে নিজেকে জেনেছি আমি। জন্ম নিয়েছে এক নতুন আমি। সেই চেনার, অজানা কথা বলব এবার। আর সেই সফরে চিনব আরও নতুন জীবনকে। এটিই আমার মাধুকরী!

অলংকরণ : মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
ছাত্রী ইতিহাসের আর চাকরি গণমাধ্যমে। তাতে কী! নেশা কিন্তু আঁকা এবং লেখা। বিশেষত নকশা। নোটবুক ভর্তি তার প্রতিটি ছবিই গল্প বলে চলে। গুছিয়ে বসে বা দফতরের মিটিংয়ের ফাঁকে - রং কাগজ এবং কলম সবসময় মজুত।
3 Responses
অচেনাকে চেনার, অজানাকে জানার এই নিষ্ঠাকে আমার কুর্ণিশ রে মেয়ে, আঁকা আর লেখা চলতে থাকুক জীবনবোধের নিত্য উত্তরণে… অভিনন্দন, মধুজা
অনন্য এই মাধুকরী…..একই সঙ্গে কী সহজ সাবলীল! আঁকাটাও ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘুরপাকের নাগরদোলায়।
Tukro tukro Bhromon er suto die ek khana darun thas bunot haechhe. Pore mone holo aha besh!