(Anil Chattopadhyay) ‘যোগ-বিয়োগ’ সিনেমার শুটিং চলছে। ফ্লোরে উপস্থিত ছবি বিশ্বাস, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা। কিন্তু একজন অভিনেতা তখনও অনুপস্থিত। রীতিমতো অধৈর্য হয়ে উঠছেন ছবি বিশ্বাস, পরিচালকের কপালেও চিন্তার ভাঁজ। শেষে আর উপায় না দেখে ক্যামেরার পিছন থেকে সহকারী পরিচালককেই ডেকে নিলেন ছবির ব্যবস্থাপক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়। বলা হল তাঁকেই অভিনয় করতে হবে। (Anil Chattopadhyay)
এর আগে কোনোদিনও ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেননি তিনি (Anil Chattopadhyay)। কিন্তু, প্রথম সুযোগেই তাক লাগিয়ে দিলেন! শুধু তাই নয়, তাঁর স্বতস্ফূর্ত অভিনয় দেখে একটি শটে নিজের সংলাপ ভুলে গেলেন ছবি বিশ্বাস স্বয়ং! আর এভাবেই বাংলা চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটল এক নতুন চরিত্রাভিনেতার। সেদিনের সেই নবাগত অভিনেতা আর কেউ নন – অনিল চট্টোপাধ্যায়। (Anil Chattopadhyay)
১৯২৯ সালে আজকের দিনেই জন্মগ্রহণ করেন তিনি (Anil Chattopadhyay)। মাত্র এগারো বছরে বাবাকে হারিয়ে ছেলেবেলা কাটে দিল্লিতে। পরে সিনিয়র কেমব্রিজে উত্তর ভারতের মধ্যে প্রথম এবং কলকাতায় ফিরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক। প্রবাসী বাঙালি হওয়ায় প্রথমে বাংলা ভাষাকে বেশ ভয়ই পেতেন অনিল। কিন্তু তখনও জানতেন না, অভিনয়ই হতে চলেছে তাঁর পেশা, তাও আবার বাংলা চলচ্চিত্রে। (Anil Chattopadhyay)
ভিডিও: অনন্য অরুন্ধতী: জন্মশতবর্ষে ফিরে দেখা (১৯২৪-১৯৯০)
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে জার্মান কোলাবরেশনের এক সংস্থায় যোগ দেন চাকরিতে। মাইনে মাসে ৮০০ টাকা। কিন্তু মাত্র পঁচিশ দিন গিয়েই কাজ ভাল লাগছে না বলে চাকরি ছেড়ে দিলেন। তখন তিনি বিবাহিত, তাঁর এই সিদ্ধান্তে পূর্ণ সমর্থন জানালেন তাঁর স্ত্রী। যোগ দিলেন তাঁরই আত্মীয়, পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রোডাকশন হাউসে সহকারী পরিচালক হিসাবে। এক ধাক্কায় মাইনে কমে দাঁড়াল মাসে ৫০ টাকায়। কিন্তু ওই! এই কাজের মধ্যে আনন্দ আছে! (Anil Chattopadhyay)
পরিচালনার নানা খুঁটিনাটি শিখেই দিন কাটছিল, তবে অদৃষ্টের ফেরে ‘যোগ-বিয়োগ’ সিনেমায় চলে আসতে হল ক্যামেরার সামনে! কলেজে পড়াকালীন উৎপল দত্ত পরিচালিত কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লেগে গেল এইবার। ‘যোগ-বিয়োগ’-এর শুটিং চলাকালীনই ডাক পেলেন ঋত্বিক ঘটকের কাছ থেকে। তিনি তখন নাটকের মঞ্চ থেকে সিনেমার জগতে সদ্য পা রেখেছেন। ‘নাগরিক’ সিনেমার একটি চরিত্রে ঋত্বিক বেছে নিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়কে। যদিও সে ছবি মুক্তি পায়নি তখন।
নায়কের ভূমিকায় তাঁর প্রথম অভিনয় প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ময়লা কাগজ’ ছবিতে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। খুব কম অভিনেতাই বাংলা ছবির তিন মহারথীর ছবিতেই অভিনয় করেছেন। অনিল চট্টোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম! সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালের পাশাপাশি কাজ করেছেন তপন সিনহা, অসিত সেন থেকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো দিকপালদের ছবিতেও।(Anil Chattopadhyay)
একের পর এক কালজয়ী ছবিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয়, স্ক্রিন প্রেজেন্স আর কণ্ঠ-মাধুর্য মন জয় করেছে আপামর বাঙালির। সে ‘হিরো’-ই হোক, নায়কের বন্ধুই হোক কিংবা দাদা। যেমন ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় সুরপাগল শঙ্কর, যে বোন নীতার আনন্দে-দুঃখে পাশে থেকেছে বরাবর; সত্যজিতের ‘মহানগর’-এ চূড়ান্ত হীনমন্যতায় ভোগা স্বামী, ‘আগুন’ ছবির পরোপকারী তিন বন্ধুর একজন, ‘সাগিনা মাহাতো’র শ্রমিক নেতা, ‘বনপলাশির পদাবলী’-তে রাগী এক ডাক্তার, ‘আঁধার পেরিয়ে’-র সাংবাদিক থেকে ‘আতঙ্ক’-এর সেই আইনজীবী। (Anil Chattopadhyay)
পাশাপাশি ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া গানগুলি আজও সকলের মুখে-মুখে ফেরে। ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘নির্জন সৈকতে’-র মতো একাধিক ছবিতে তিনি যে চরিত্রই পেয়েছেন, তাই বাস্তবোচিত করে তুলেছেন তাঁর অভিনয়গুণে। ‘অগ্নি সংস্কার’ ছবিতে সাইকোপ্যাথ ভিলেনের ভূমিকায় অনিলের অভিনয় দেখে উত্তমকুমার বলেছিলেন, “অনিল, তুই দেখিস, এই ছবিতে তোর খুব নাম হবে।” (Anil Chattopadhyay)
(Anil Chattopadhyay) বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সত্যজিতের ‘মহানগর’-এর স্ক্রিনিংয়ে অনিলের অভিনয় দেখে বিখ্যাত চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব সিডনি পয়টর তাঁকে হলিউডে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু অনিল বাংলা ছেড়ে যেতে রাজি হননি। যদিও পরে কাজ করেছেন বেশ কিছু হিন্দি ছবিতেও। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত ‘ফারার’ ছবিতে নায়ক হিসাবে তাঁর বলিউডে পদার্পণ। মৃণাল সেন তাঁকে নেন ‘একদিন আচানক’ ছবিতে। অমল পালেকরের ‘আঁখে’, তপন সিংহের ‘এক ডক্টর কি মৌত’ এবং ‘আজ কা রবিনহুড’ বা গৌতম ঘোষের ‘পার’, সবেতেই অসাধারণ অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন অনিল। (Anil Chattopadhyay)
(Anil Chattopadhyay) ওই উচ্চতায় থাকার পরেও আজীবন স্টারডমের তোয়াক্কা করেননি। ছুটির দিনে জনপ্রিয়তার কথা ভুলে আড্ডায় মেতে উঠতেন বসুশ্রী কফি হাউসে। উত্তমকুমার বলেছিলেন, একটু আড়াল রাখতে শিখতে। কিন্তু অনিল চট্টোপাধ্যায় (Anil Chattopadhyay) পাত্তা দেননি। তিনি তো তারকা নন। তিনি যে প্রকৃত অভিনয়-শিল্পী। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের প্রণতি!
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।