কলকাতায় ফেরার মাত্র সপ্তাহ খানেক পরেই আমি আর অলক রওনা হলাম বারাণসীর দিকে। ইন্দ্রাণী বলল, আপনি তো কেবল বাইরে বাইরেই ঘোরেন দেখছি। মা বলল, বেনারস যাচ্ছিস যখন বিয়ের বেনারসি ওখান থেকেই কিনে আনিস। সেই মতন টাকা নিয়ে যা। (Ravi Shankar)
জীবন থেকে জীবনে: তৃতীয় পর্যায় – পর্ব-২২ : শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
বারাণসীতে এক অন্য রবিশঙ্করকে দেখলাম। সারাটা দিন হইচই আর কাজের মধ্যে অদ্ভুত মেজাজি এক জীবন। এয়ারপোর্টের দিকটায় ওঁর প্রাসাদের মতন বাড়ি। যেমন বাড়ি তার তেমন চোখ জুড়োনো বাগান৷ শীতের মরশুমি ফুলে তখন ভরাট হয়ে আছে। একদিন ওই বাড়ির কাচ-ঘেরা জলসাঘরে রবিশঙ্কর সেতার বাজালেন। সংগত করতে এলেন কিষেণ মহারাজ। পুরোনো ধ্রুপদাঙ্গে আলাপের পর জমল ধামার তালে গৎ। ভারতের দুই শ্রেষ্ঠ লয়দার শিল্পীর হিসেবের বনিবনা।

আমার জন্য একটা ঘর সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছিলেন কমলাদি। স্নানের সময়ে পাঠিয়ে দিলেন বড় সাইজের ইয়ার্ডলে সাবান। বলে পাঠালেন, স্নানের পরে যেন একবার নীচে নামি। নামতেই হাতে দিলেন এক বড় বোতলের রোজে গ্যালে ওদ কলোন। বললেন, তুমি গন্ধপাগল ছেলে। এটা রাখো। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর কাজে বসলাম দু’জনায়। বিকেলে অলক এল। ওকে নিয়ে গেলাম ডালমানডিতে বেনারসি বাইজির গান শুনতে। রাতের বেলায় খাবার টেবিলে রবিশঙ্কর আর কমলাদি প্রায় সমস্বরে বললেন, মনে হচ্ছে বহুদিন পর নিজেদের ছেলে ঘরে ফিরল। শুতে যাওয়ার আগে গায়ে বেশ করে কমলাদির দেওয়া রোজে গ্যালে মেখে নিলাম। স্বপ্ন দেখলাম, আমি লন্ডনের রাস্তায় ইন্দ্রাণীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ওর হাতে একটা কাগজের ঠোঙা তাতে কেনটাকি ফ্রাইড চিকেন, এবং অন্য হাতে একটা ফুলের তোড়া। যার থেকে রোজে গ্যালের গন্ধ বেরুচ্ছে। স্বপ্নটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে অছে। কিছুটা লজ্জা হয়েছিল বলে পরের দিন রবুদাদের এই গল্পটা বলতে পারিনি।
অলক সমানে ছবি তুলল এবং রবিশঙ্করের সেক্রেটারি আনন্দ দুবে প্রত্যেককে প্রাণ ভরে উচ্চস্তরের বেনারসি লস্যি খাইয়ে যেতে থাকলেন।
বারাণসীতে একদিন বিকেলে আমি, রবুদা এবং প্রসিদ্ধ তবলাশিল্পী ও কবিরাজ আশুতোষ ভট্টাচার্য ও অপর একজন কবিরাজ মশাই বজরায় করে কাশীর ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়ালাম। অলক সমানে ছবি তুলল এবং রবিশঙ্করের সেক্রেটারি আনন্দ দুবে প্রত্যেককে প্রাণ ভরে উচ্চস্তরের বেনারসি লস্যি খাইয়ে যেতে থাকলেন। দুবে’জি শুধু রবুদার সেক্রেটারিই নন, কাশীর মস্ত বড় শরবতের দোকানের মালিকও। কিন্তু ওঁর ধ্যানজ্ঞান রবিশঙ্কর। গোটা ভারতবর্ষ উনি রবুদার দেখাশোনা করে বেড়ান। হিসেব মতন দুবে’জি প্রত্যেকের শরবতে খানিকটা খানিকটা সিদ্ধিও মিশিয়ে দিচ্ছিলেন। সে যে কী ফুর্তি আর শান্তি, সে কাগজেকলমে লিখে বোঝানো যাবে না। সূর্য তখন ডোবে-ডোবে। বজরায় রবিশঙ্কর। কাশীর গঙ্গায় সোনালি ছ-টা। আকাশে রামধনু-রঙের আভাস। আমার মনে পড়ল প্রায় এক বছর আগের সেই দিনটা যেদিন রবিশঙ্করের পাশে বসে আকাশে রামধনু দেখতে দেখতে মাদ্রাজের পথে উড়ে যাচ্ছিলাম।
এই বজরান যাত্রাটা আর-একদিন সূর্যোদয়ের আগে হল। ভয়ংকর ঠান্ডার মধ্যে। কারণ অলক বায়না তুলেছিল সূর্যোদয়ের পটভূমিতে গঙ্গার মাঝখানে রবিশঙ্করের ছবি তুলবে। বজরা থেকে নেমে সেদিন দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে অসংখ্য অলিগলি ধরে আমরা হাঁটলাম সেদিন। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিলেন রবিশঙ্কর। দুবে’জির বাড়িতে ইয়াইয়া লুচি আর জিলিপি দিয়ে নাস্তা হল। তারপর বসা হল এক পুরোনো আমলের দোকানে। রবুদা আর কমলাদি আমাকে দেখিয়ে বললেন, এ হচ্ছে আমাদের ছেলে। সামনে বিয়ে ওর। খুব ভাল বেনারসি বার করে রাখবেন। বিকেলে কিনতে আসব।

ফেরা পথে তিলভাণ্ডেশ্বর মন্দিরে গেলাম আমরা। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে বাঙালিটোলায়, এবং অবশেষে তারই কাছে উদয়শঙ্কর, রবিশঙ্করদের সেই পুরোনো ভিটেয়। যে-বাড়িতে মায়ের সঙ্গে রবিশঙ্করের ছেলেবেলা কেটেছে। বহুক্ষণ উদাস দৃষ্টিতে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন রবিশঙ্কর। ষাট বছর বয়সে হয়তো ওঁর মনে পড়ছিল ছয় বছর বয়সের কথা। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল অলক। হঠাৎ কোত্থেকে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে বললেন, এই যে, আমাদের রবু না? রবিশঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, আরে তুমি অমুক তো?
রবিশঙ্করকে জাপটে ধরে বললেন, চলো, চলো একবার আমাদের বাড়ি। আমাদের সেই রবু আজ কত বড় হয়ে গেছে। পৃথিবীবিখ্যাত লোক তুমি। একটু দেখেই কী ছাড়া যায়? একটু চা তো অন্তত খেয়ে যাবে।
খবর পেয়ে বেরিয়ে এলেন ভদ্রলোকের বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই, যাঁকে দেখে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের চরিত্র বলে ভ্রম হতে পারে।
এই ভদ্রলোক বাঙালিটোলায় প্রসিদ্ধ ধনীগৃহের সন্তান। রবুদার সঙ্গে ইস্কুলে পড়েছেন। বিরাট একটা বাগান (পরিচর্যার অভাবে এখন যা প্রায় জঙ্গল), আর সেই বাগান পেরিয়ে এক প্রান্তে ছড়ানো-বিছোনো সাবেক কালের মার্বেল মেঝের বাড়ি। ধনীগৃহের সমৃদ্ধির ছাপটাই পড়ে আছে, পরিবারের সেই অবস্থা আর নেই। খবর পেয়ে বেরিয়ে এলেন ভদ্রলোকের বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই, যাঁকে দেখে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের চরিত্র বলে ভ্রম হতে পারে। একটু পরে এল চা। রবুদা বললেন, ছোটবেলায় আমরা এখানে এসে খাওয়াদাওয়া করে যেতাম বড়োলোক বলে এঁদের তখন মস্ত ঠাঁটবাট। সেই শুনে বৃদ্ধ জ্যাঠামশাইও বহু পূর্বের স্মৃতিচারণা করলেন কিছুক্ষণ। দুবে’জি তাড়া না দিতে থাকলে আমাদের চট করে ওঠা হত না। দাঁড় করানো সাইকেল রিকশাও রীতিমতো অধৈর্য্য হয়ে উঠছে তখন। শহরের ঘিঞ্জি এলাকা ছেড়ে এসে রবুদা ওঁর ফিয়েট গাড়িতে উঠে বললেন, কাশীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপারটি কি জানো? যেভাবে চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন বছর আগে দেখেছি সেভাবেই থেকে গেছে শহরটা এতকাল। গঙ্গাঘাট, মন্দির পাণ্ডা, ধ্রুপদ-ধামার, গলি, গরু, আকাশ-বাতাস সবই যেন যে-কে-সেই আছে। কাশীতে থাকলে নিজের কতখানি বয়স হল টের পাই না।
একদিন সকালে একটা চুল-দাড়ি কাটার সেলুনে বসে জমিয়ে আড্ডা দিলাম কিষেণ মহারাজের সঙ্গে। দাড়ি কাটা হচ্ছে, বাঘ শিকারের গল্পও হচ্ছে, তারপর কিষেণজি আমাকে আর অলককে নিয়ে রওনা হলেন ওঁর বাড়ির দিকে। ওঁর ইচ্ছে ওঁর বাড়ির মন্দির আর বন্দুকের কালেকশন দেখাবেন। তারই মধ্যে কখন জানি হাজির হল গেলাস-গেলাস শরবত আর থালাভরতি কাশীর মিঠাই। এবং অবধারিতভাবে, বাটা ভরতি পান।

এই পান আমরা গাল পুরে-পুরে খেয়েছিলাম বাইজির গানের আসরেও। নাচের মেয়েটি ছিল অতীব সুন্দরী, যদিও ওর নাচের ‘ভাও’ ওঁর চেহারার পর্যায়ের ছিল না মোটেই। কিন্তু ওঁর পাশে বসে ওর বৃদ্ধ পিসিমা গালে হাতের তেলো ঠেকিয়ে যে ঠুংরি গাইলেন তার স্মৃতি আমার এখনও উজ্জ্বল। গানগুলো ছিল বড়ে মোতিবিবির স্মরণীয় নিবেদন সব। ঠুংরি রসিকরা এক লহমায় চিনবে। ভদ্রমহিলা গাইলেনও বড়ে মোতি বিবির ঢং-এ। দুবেজির ভাই ছিল আমাদের সঙ্গে। গানরসিক লোক। তিনি কিছু মালা কিনলেন আগত ফুলওয়ালির কাছ থেকে। আর সুন্দরী নর্তকী সেই মালা আমাকে পরাতে এলে অলক এমন মুখের শব্দ করে বলল, ও? মালা দেবার বেলায় শঙ্করলাল? আর আমরা সব ফালতু বুঝি? ঘরসুদ্ধ সবাই হো হো করে হাসতে লাগল। রাতে অলক এই ঘটনাটি রসিয়ে রসিয়ে রবুদাকে বলল যখন, তখন তিনি আচমকা বলে উঠলেন, তাহলে দুবে, আমাকে দেখছি কাল গান শোনার বাহানা করে বাইজি বাড়ি যেতে হয়! শঙ্কর তো বেশ কালচার আর জার্নালিজমের নামে সমস্ত অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। কমলাদি খাবার পরিবেশন করতে করতে বললেন দাঁড়াও, ইন্দ্রাণীর সঙ্গে আলাপ হোক। সব কথা ওকে বলব।
যাওয়ার দিন সন্ধেবেলায় তাড়াহুড়ো করে এমন বাক্স প্যাক করলাম যে একতলায় সেটিকে নামানো মাত্রই বাক্স খুলে হাট হয়ে গেল। রবিশঙ্কর আর কমলাদি হেসেই বাঁচেন না
যাওয়ার দিন সন্ধেবেলায় তাড়াহুড়ো করে এমন বাক্স প্যাক করলাম যে একতলায় সেটিকে নামানো মাত্রই বাক্স খুলে হাট হয়ে গেল। রবিশঙ্কর আর কমলাদি হেসেই বাঁচেন না। তখন কমলাদি পাট পাট করে সব গুছিয়ে বাক্সটাকে ভদ্রস্থ করে লক করলেন। ট্যাক্সি থেকে হাত নাড়ার সময়ে দেখলাম দুজনের মুখই বেশ করুণ। ট্যাক্সিতে সোজা চলে এলাম মোগলসরাই, কাশীর থেকে অনেকখানি পথ। আমাকে ট্রেনে তুলে হাত নাড়তে নাড়তে ফিরে গেলেন দুবে’জির ভাই।
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।