(Ravi Shankar) আমরা জিপে করে পরের দিন ভোর-রাতে রওনা দিই, টাইগার হিলের দিকে। প্রথম প্রথম ঠান্ডা তেমন লাগেনি। কিন্তু যতই ওপরে যাই ততই ঠান্ডা বাড়ে। শেষকালে সোয়েটার কোট পরেও হি-হি করা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। টাইগার হিলের ওই ভিউপয়েন্টে গিয়ে দেখি ওই সাত সকালেই সে-জায়গা লোকে লোকারণ্য। একদল সাহেব-মেম এসেছে গায়ে কম্বল, বিছানা জড়িয়ে। আমরা গুটি গুটি একটা সরু খাঁজ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। যদিও সূর্যোদয়ের তখনও বেশ খানিকক্ষণ বাকি। ওই এক চিলতে জায়গায় পাহাড়ে হেলান দিয়ে আমরা নিসর্গ নিয়ে গল্পে মজে গেলাম। ইন্দ্রাণী গল্পের ফাঁকে ফাঁকেই ছবি তুলছিল। ছবি তুলছিল শান্তনুও। রবুদা বললেন, “এ যাত্রায় অলক নেই। ভাবলাম ক্যামেরার থেকে রক্ষে। তা’ আর দেখি হবার না।” (Ravi Shankar)

হঠাৎ কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ বদলে গেল। পাশাপাশি তিনটে সুউচ্চ চুড়োয় রঙের খেলা শুরু হল। একরাশ আবিরের মতন রং এসে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে। প্রথমে কমলা রং, ক্রমে লাল টকটকে, তারপর যেন রক্তের ধারা! তারপর রক্ত বিবর্ণ হয়ে রুপোলি, যেন গলিত রুপোর নদী। (Ravi Shankar)
আরও পড়ুন: জীবন থেকে জীবনে: তৃতীয় পর্যায় – পর্ব-২৪
পাহাড়ের চুড়ো বেয়ে নেমে আসছে। সদ্য উদিত সূর্য বলে, আমায় দেখ। সূর্যস্নাত হিমালয় বলে, আমায় দেখ। সেই রক্তের আভা ঠিকরে পড়ছে আমাদের চোখে, আমাদের মুখমণ্ডলে। আমি মুহূর্তের জন্য তাকালাম রবিশঙ্করের মুখের দিকে। বিস্মিত বালকের মতন তাঁর মুখ। তিনি জোড় হাতে প্রণাম করলেন সূর্য এবং হিমালয়কে। (Ravi Shankar)
বিস্মিত বালকের মতন তাঁর মুখ। তিনি জোড় হাতে প্রণাম করলেন সূর্য এবং হিমালয়কে।
আমি ফের তাকালাম কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে, তারপর সূর্যের দিকে। সমস্ত নিসর্গের রূপ তখন আমার মনে! ওই দৃশ্য এবং আমার এই জীবনের জন্য তখন আমি ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম ঈশ্বরকে। আমার মনে হল ঈশ্বরকে আমি চিনি, এই সূর্যোদয়ের কোনো এক মুহূর্তে তাঁকে আমি দেখেছি। এই মুহূর্তে সমস্ত প্রকৃতি যাঁর বন্দনা গান গাইছে।
এরপর আমরা গিয়েছিলাম লেবং রেসকোর্স দেখতে, নর্থ পয়েন্ট স্কুল দেখতে এবং তারই পাশে রোপওয়ে দেখতে।(Ravi Shankar)
আরও পড়ুন: জীবন থেকে জীবনে: তৃতীয় পর্যায় – পর্ব-২৩
রোপওয়ে দেখে আমরা গাড়িতে চড়েছি। হঠাৎ একটি বড়োসড়ো বাঙালি ভ্রমণ দলের এক ভদ্রলোক তাঁর কোলে বাচ্চা নিয়ে এসে গাড়িতে বসা রবিশঙ্করকে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, আপনাকে কোথাও কি আমি দেখেছি?” রবিশঙ্কর হাসতে হাসতে বললেন, “হতে পারে!”
-আচ্ছা আপনি কী করেন?
-এই একটু সেতার-টেতার বাজাই।
-অ্যাঁ! আপনি রবিশঙ্কর?

রবিশঙ্কর বললেন, হ্যাঁ। আর অমনি ভদ্রলোকের চোখ দুটো একেবারে গোল হয়ে যেন কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম। হাতে বাক্স ছিল, তাই অন্য হাতে তিনি অনবরত কপালে নমস্কার ঠুকতে লাগলেন। লোকে যেমনটি করে মন্দিরে বিগ্রহের সামনে। আমাদের গাড়ি তখন স্টার্ট দিয়ে এগোতে শুরু করেছে। চলমান গাড়ি থেকেই ভদ্রলোকের জন্য প্রতিনমস্কার জানালেন রবিশঙ্কর। কিন্তু তখনও তাঁর হাসি থামেনি। (Ravi Shankar)
জীবন থেকে জীবনে: তৃতীয় পর্যায় – পর্ব-২২ : শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
আমরা টাইগার হিল থেকে ফেরার পথে নেমেছিলাম এক তিব্বতি বৌদ্ধ মন্দিরেও। খুব বড়ো এবং সুন্দর প্যাগোডা। গোটা মন্দির প্রাচীন পুঁথিতে গিজগিজ করছে। রবুদা চোখ বুজে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলেন বুদ্ধদেবের মূর্তির সামনে। কমলাদি ঘুরে ঘুরে দেখলেন মন্দিরের কারুকার্য! তারপর বেরিয়ে একটা ছোটো ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা টয় ট্রেন দেখলাম।
রবিশঙ্কর বললেন, হ্যাঁ। আর অমনি ভদ্রলোকের চোখ দুটো একেবারে গোল হয়ে যেন কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম। হাতে বাক্স ছিল, তাই অন্য হাতে তিনি অনবরত কপালে নমস্কার ঠুকতে লাগলেন।
একটা মজা ঘটল সেদিন হোটেলে। হোটেলের মালিশওয়ালাকে ঠিক করা হল রবুদাকে মালিশ করবে বলে। সে মনের সুখে চাটি-চাপটা দিয়ে মালিশ করতে লাগল ওঁকে আর অদূরে রাখা সেতারটা দেখিয়ে বলতে লাগল, সাহেব আচ্ছাসে সিতার বাজাইয়ে। বহুৎ ফায়দা হ্যায়। দেখতে নেহি রবিশঙ্করজি কো? রিয়াজ কিজিয়ে তব তো উনকা মাফিক হো সকতে হ্যায়। কিতনা মশহুড় সিতারি, কিতনা ফেমাস্ দুনিয়ামে! (Ravi Shankar)
রবুদা চোখ বুজে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলেন বুদ্ধদেবের মূর্তির সামনে। কমলাদি ঘুরে ঘুরে দেখলেন মন্দিরের কারুকার্য!
রবুদা চোখ বুজে মালিশ নিতে নিতে ওর উপদেশ শুনছিলেন। জ্ঞান দেওয়ার সঙ্গে মালিশওয়ালার চড়-চাপটা বেড়ে গেল। যেন বাধ্য শিষ্য পেয়েছে। শেষে থাকতে না-পেরে কমলাদি বলে ফেললেন, আরে ভাই, ইনহিই তো পণ্ডিত রবিশঙ্কর হ্যায়। আর তাই শুনে বেচারির তো সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবার অবস্থা। রবিশঙ্করের পা চেপে ধরে, মাফ কিজিয়েগা পণ্ডিতজি। ম্যায় তো আপকো নেহি পইছানা। গুস্তাকি মাফ কিজিয়েগা কৃপাসে। ইত্যাদি বলতে বলতে মালিশের টোনটাও যথাসম্ভব মিহি করে আনল। আমরা সবাই সেদিন হেসে বাঁচি না। (Ravi Shankar)
হোটেলের মালিশওয়ালাকে ঠিক করা হল রবুদাকে মালিশ করবে বলে। সে মনের সুখে চাটি-চাপটা দিয়ে মালিশ করতে লাগল ওঁকে আর অদূরে রাখা সেতারটা দেখিয়ে বলতে লাগল, সাহেব আচ্ছাসে সিতার বাজাইয়ে।
দার্জিলিং থেকে বাগডোগরা ফেরার কথাটাও ভুলতে পারি না। যদিও রোদ ঝলমলে সকালবেলায় গাড়িতে ওঠার সময়ে আমাদের সকলের মন বেশ খারাপ ছিল। পুরো পাঁচ-পাঁচটা দিন যে কীভাবে কখন কেটে গেল, কেউ টেরই পেলাম না! গাড়ি যখন আঁকবাঁক কষে নেবে আসছে শহর থেকে, আমরা চারজনই খুব ইস! ইস! করছিলাম। শান্তনু দার্জিলিং-এর লোক, ওখানে ‘স্নো ভিউ’ হোটেলের তরুণ মালিক। মন খারাপ হলেও ওকে তো থেকে যেতেই হল। আর আমাদেরও মন পড়ে রইল দার্জিলিং শহরে। গাড়ি নামছে, আর নামছে, আর মনে-মনে আমরাও দমে যাচ্ছি। হঠাৎ রবুদা বললেন, নাও ইন্দ্রাণী, রবীন্দ্রসংগীত ধরো। বলেই সিটের মাথায় তাল ঠুকে-ঠুকে গাইতে লাগলেন ‘বাণিজ্যেতে যাবই আমি যাব।’ প্রাণের আনন্দের গান। (Ravi Shankar)

জর্জ বিশ্বাসের ঢং-এ। আমি জানতাম জর্জদা রবিশঙ্করের খুব প্রিয় শিল্পী। আই পি টি এ-তে থাকতে হৃদ্যতা হয়েছিল। জর্জদার দরদ-ভরা গান, আর ‘মাই ডিয়ার’ স্বভাব মুগ্ধ করেছিল রবিশঙ্করকে। সে-কথা তিনি ‘রাগ-অনুরাগ’-এ বলেছিলেন। ‘দেশ’-এ তাই পড়ে আবার ভীষণ বিচলিত হয়েছিলেন জর্জদা। একদিন জর্জদার ডেরায় যেতেই বললেন, এ কী কথা ল্যাখসেন রবিশঙ্কর? সব্বাই আমাকে মন্দ কয়। আর কী দরকার হইলো আমারে ভালো কওনের?
বুঝলাম এসব জর্জদার অভিমান। আসলে মনে-মনে খুব আনন্দ পেয়েছেন। বললাম, ওঁর কথা উনি লিখেছেন। তাতে আমার কী বলার আছে। (Ravi Shankar)
আমি জানতাম জর্জদা রবিশঙ্করের খুব প্রিয় শিল্পী। আই পি টি এ-তে থাকতে হৃদ্যতা হয়েছিল। জর্জদার দরদ-ভরা গান, আর ‘মাই ডিয়ার’ স্বভাব মুগ্ধ করেছিল রবিশঙ্করকে।
জর্জদা তখন ওঁর দুষ্টু হাসিটা হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে আমার একখান চিরকুট পৌঁছাইয়া দ্যান। বললাম লিখে দিন। তখন খসখস করে অনেক সোহাগ জানিয়ে রবিশঙ্করকে একটা চিঠি লিখলেন জর্জদা। তারপর চিঠিটা খামবদ্ধ করে আই পি টি এ-তে দেখা তরুণ, সুন্দর রবিশঙ্করের গল্প শোনাতে লাগলেন আমার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। আমার ভয়ানক দুঃখ এই যে, জর্জদার ওই অমূল্য চিঠিটা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার যা স্বভাব। (Ravi Shankar)
আগের পর্ব পড়তে: [১] , [২], [৩], [৪], [৫], [৬], [৭], [৮] , [৯], [১০], [১১], [১২], [১৩]
রবুদাকে জর্জদার গল্প শোনাতে পারলাম, কিন্তু ওই সুন্দর চিঠিটা দিতে পারিনি। আজও ভাবি, সত্যি চিঠিটা কোথায় ফেললাম? যা’ হোক, দার্জিলিং থেকে বাগডোগরার তিন ঘণ্টার পথ নিমেষে কেটে গেল ‘তাসের দেশ’-এর গানে গানে। প্লেন যখন আকাশে উঠল তখন একরাশ মেঘ সেখানে পাহাড়ের মতন জমেছে। প্লেন ঢুকল তারই মধ্যে আর ভেতরটাও অন্ধকার হয়ে গেল। দমদমে নেমে দেখলাম সেখানে মাঠঘাট ভিজে। কলকাতায় খুব বৃষ্টি হয়েছে দু-দিন। (Ravi Shankar)
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।