এরপর আমার খেলার পালা। এতক্ষণ অন্যদের গল্প শুনতে শুনতে মন চলে গিয়েছিল তাদের জীবনে। মনে মনে কত রাজ্য, কত সংস্কৃতি ঘুরলাম। তাই ভুলে গিয়েছিলাম আমাকেও উঠে আমার খেলা খেলতে হবে। কী খেলব? পুতুল? আমি উঠে দাঁড়িয়েছি—চারপাশে ঘিরে আছে জনা তিরিশজন। একটু ঘাবড়ে গেলাম। সত্যি তো মনে পড়ছে না আমি সাড়ে তিন বছরে কী নিয়ে খেলতাম! অথচ আমার ধারণা আমার স্মৃতি খুব পরিষ্কার। আমার খুব পরিষ্কার মনে আছে আমি পাঁচ বছরে কী পুতুল নিয়ে খেলতাম, তাদের কী কী নাম ছিল—সেই পুতুলের কোনটা আমাকে কে দিয়েছিল। কিন্তু তিন সাড়ে তিন বছরে?
নিজের মনগড়া একটা পুতুলের বিয়ের ঘটনা বানিয়ে আমি সেদিন খেলতেই পারতাম। আজ জীবনের পঁয়তাল্লিশ বছরেও পরিষ্কার মনে আছে কেমন আমি আর আমার দিম্মা দুজনে মিলে আমার মেয়ে আর ছেলে পুতুলের বিয়ে দিয়েছিলাম। (Column)
আপনাকে এই জানা ২: কথালয়া – কথার জন্ম হয় যেখানে : মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
কেমন সেই বিয়েতে ছোটখাটো লুচি আর পায়েস হয়েছিল! বানিয়ে খেলাই যেত। কিন্তু, আমার আগে এত মানুষের যখন সৎ স্বীকারোক্তি, সরল অনুভূতি তুলে ধরল, নিজের মন চাইল সৎ হই। কিন্তু মনে দ্বিধা সৎ হলে লোকে যদি কিছু ভাবে? আমাকে অন্য চোখে দেখে! যদি ভাবে আমি তাদের দলে থাকলেও ঠিক তাদের দলের নই! তাদের মতো নই! ২০০৯-১০-এ Judge কথাটা জানতাম না। আজকাল আমরা যেমন অনায়াসে বলতে পারি ‘ও আমাকে judge করছে’—তখন একটা ধারণা হয়তো মনের মধ্যে ছিল judge করাটাই স্বাভাবিক। তাদের কৌতূহল, তীর্যক প্রশ্নের উত্তরে সংকোচ বোধ হতে পারে, তাই এই judgement-এর থেকে বাঁচতে চুপ করে থাকাটাই ভদ্রতা। নিজের যেটুকু খাপছাড়া, এলোমেলো, অন্যরকম—তাকে ভুলে গিয়ে, মনের অনেক তলায় চেপে রেখে স্বাভাবিকতার মুখোশ পরে সমাজে ঘোরো। জানতাম না ‘স্বাভাবিক’ কথাটার আসল মানেটা উল্টো! এক একজনের এক এক স্বভাব হয়—একরকমের মানুষ হয় না কখনও। প্রত্যেকে আলাদা। প্রত্যেক জীবন আলাদা, তাই একরকমের হতে চাওয়াটা আসলে অস্বাভাবিক।

মনের অনেক ভেতরে লুকিয়ে থাকা ছোটবেলাটাকে তখন খুঁজে চলেছি! ভ্যাবলার মতো! আমার দিকে তাকিয়ে আছে সারি সারি মুখ। ‘স্বাভাবিক’ আমার থেকে অনেক মজার গল্প শুনবে। কিন্তু তখনও সাহস হচ্ছে না বলতে যে আজ আমি কোনও মজা করব না। এক ভাঙাচোরা জীবনের গল্প শোনাবো!
একবারও বাবার মুখের দিকে অভিমানে ফিরে তাকাইনি। আস্তে আস্তে বাবা আর এল না। মা-বাবার বিয়ের অ্যালবামও সরে গেল। ভুলে গেলাম বাবাকে কেমন দেখতে।
চোখ বন্ধ করে চোখে জল এল। দেখতে পেলাম এক পুঁটলি জিনিস থেকে বেরিয়ে আসছে ছেঁড়া খোঁড়া এক চোখ কানা টেডি বেয়ার। আট-নয় বছর বয়সী আমি দূর থেকে একবার তার দিকে চাইলাম। মাকে বললাম ‘ফেলে দাও আমার আর লাগবে না’! মা আর বাবার সাত বছর ধরে চলা লম্বা ডিভোর্স শেষ হয়েছে। জেতা-হারায় না গিয়ে নিঃশর্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। এমনকী আমাকে নিয়েও টানাহেঁচড়া হয়নি। তিন বছরের জন্মদিনে বাবাকে শেষ দেখি। মনে আছে সেদিন খুব অশান্তি হয়েছিল। ভয়ে জানলার শিক শক্ত করে ধরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। একবারও বাবার মুখের দিকে অভিমানে ফিরে তাকাইনি। আস্তে আস্তে বাবা আর এল না। মা-বাবার বিয়ের অ্যালবামও সরে গেল। ভুলে গেলাম বাবাকে কেমন দেখতে। শুনলাম ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাবা আমার ওপর কোনও অধিকার রাখেনি। দেখতে চায়নি। মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মাঝে মাঝেই ভয়ে আমার সাতাশ-আঠাশ বছরের মা আমাকে জড়িয়ে কাঁদত। আর আতঙ্কে ভুগত—‘যদি ওরা নিয়ে নেয়’! নেবে কী নেবে না এই টানাপোড়েনের, আতঙ্কের ইতি ঘটল। কিন্তু ওই সাত বছর আমার সব খেলনা—যা নিয়ে আমি দু-আড়াই বছর পর্যন্ত বড় হয়েছি—তা পড়ে রইল বাবার বাড়ির এককোণে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল আমার হলুদ টেডি ভাল্লুক। যাকে কোলে করে আমি খেলতে যেতাম, বুকের কাছে রেখে ঘুমোতাম। যেন আমি ওর মা। বাবার বাড়ি উল্টোডাঙা— আর মা চলে এল দিম্মার কাছে পাইকপাড়ায়। পড়ে থাকল আমার সংসার, আমার বাচ্চা টেডি। আমি জানতাম না তার কাস্টডি নিয়ে আমায় লড়তে হবে। মনে পড়ে গেল নতুন পরিবেশে এসে ওকে না পেয়ে আমি কাঁদতাম।
আপনাকে এই জানা : শেকড়ের ডানা আর ডানার শেকড় : মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
দিম্মা তাই অনেক পুতুল এনে দিল। পুতুলের খাট, আলমারি, আয়না, ছোট ছোট নয় বেশ বড় সাইজের। স্টিলের বাসন, প্লাস্টিকের বাহারি ফল আর সব্জি। নতুন সংসার পাতলাম আমি। এভাবেই একদিন মনের অনেক অতলে তলিয়ে গেল সে! এতটাই দূরে যে পরে কোনও উঁচু ক্লাসে পড়া, কলেজে পড়া বড় মেয়ের ঘরে টেডি বিয়ার দেখলে তাকে ন্যাকা মনে হত। অনেক পরে জেনেছি বেড়ে ওঠার বয়সে কোনও কিছু চেয়ে না পেলে সে জিনিসের ওপর বিতৃষ্ণা জন্মায় বা বিশ্বাস হয় তার কোনও প্রয়োজন নেই জীবনে। তাই অন্য কেউ তার ঘরে টেডি সাজিয়ে রেখেছে— তাকে নিয়ে শুতে যায় দেখে মনে হত আদিখ্যেতা। কিন্তু সেদিন যখন অনেক লোকের সামনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম— জানতাম না এত কিছু! হু হু করে মন থেকে উঠে আসছে সেই টেডি ভাল্লুকের ছেঁড়া ছেঁড়া হলুদ শরীরের স্মৃতি—কখনও বা তার নরম আশ্রয়— যা আমি বহুদিন খুঁজতাম।
জড়তা কাটিয়ে বললাম— আসলে সাড়ে তিন বছরে যা নিয়ে খেলতাম তা পরে চেয়েও পাইনি বলে ভুলে গেছি কেমন খেলতাম! একটু একটু করে সব বললাম সবার সামনে। কারোর মুখে করুণা দেখলাম না।
ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছি দেখে গীতা ম্যাম জানতে চাইলেন আমি কিছু বলতে চাই কী না? জড়তা কাটিয়ে বললাম— আসলে সাড়ে তিন বছরে যা নিয়ে খেলতাম তা পরে চেয়েও পাইনি বলে ভুলে গেছি কেমন খেলতাম! একটু একটু করে সব বললাম সবার সামনে। কারোর মুখে করুণা দেখলাম না। যেটা সবচেয়ে বেশি আশ্বস্ত করল। ছোটবেলা থেকে স্কুলে, পাড়ায়, আত্মীয়মহলে এত করুণা পেয়েছি, ‘আহা রে!’ বলে পেয়েছি Special treatment— আবার তার জন্য সমবয়সী বন্ধুদের থেকে পেয়েছি বিরক্তি। আলাদা করে দেওয়ার, একা করে দেওয়ার প্রবণতা! নিজের ছোটবেলা কেমন ছিল সে ব্যাপারে নিজে তাই মুখ খুলিনি। কারণ আমি সবার মতো হতে চাইতাম প্রাণপণে। আজ সাহস করে মুখ খুললাম যখন দেখলাম কারোর চোখে আহা! উহু! করুণা নেই। যেন আর একটা জীবনের গল্প শুনল সবাই। তাতে বিস্ময় আছে, বেদনা আছে! কিন্তু করুণা নেই।
ম্যাম বললেন—আজ সেই টেডিকে আবার পেলে কী করবে? বললাম যত্ন করব। ম্যাম বললেন তাই করো। নিজের মনের মধ্যে সেই ছেঁড়া ভাল্লুকের কল্পনা করে তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করলাম। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। মনে মনে তাকে চান করালাম, ছেঁড়াখোঁড়া জায়গায় ছুঁচ-সুতো দিয়ে সেলাই করলাম, তার গা-মাথায় হাত বোলালাম—তারপর তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি পেড়ে কোলের কাছে ছোট বাচ্চার মতো কুঁকড়ে শুলাম। করতে করতে দেখলাম প্রচণ্ড কাঁদছি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। আর আমাকে ঘিরে জড়িয়ে আছে অনেক মানুষজন। করুণা নয়, অনেক ভালবাসা নিয়ে।

আমরা কেউ অভিনেতা নই। প্রথাগত অভিনয় শিক্ষা মেলেনি। কিন্তু কোনও বিষয়কে এক কথক তখনই সুন্দর করে তুলে ধরতে পারে যখন সে সেই গল্পের অনুভূতি ছুঁতে পারে— ছেলেবেলার অনুভূতিগুলো অনেকটাই সরল, বড়দের ভাবনার প্রলেপ পড়ে না সেখানে—সেই সহজ অনুভূতি খুঁজতে গিয়ে আমরা যেন একটা ক্যালাইডোস্কোপের মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম অনেক অনেক ছোট গল্প। যা জীবন থেকে উঠে আসা—কথকের নিজের মনের কথা। আজকাল অনেককে শুনি inner child healing therapy করাতে যাতে নাকি ছোটবেলার দুঃখ-কষ্ট যা পরবর্তীকালেও আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের ভুলতে, সেই ক্ষতে মলম লাগাতে সাহায্য করে। আমারই এক সত্ত্বা অন্য সত্ত্বার অভিভাবক, বন্ধু, কাছের মানুষ হয়ে আহত সত্ত্বার ক্ষতে প্রলেপ লাগায়। ২০০৯-২০১০-এ এইসব জানতাম না। শুনিওনি। কিন্তু ক্ষতে প্রলেপ লেগেছিল। পরবর্তীকালে নিজেই কিনতাম নরম পুতুল আর সফট টয়। জীবনে যখন একটা জ্যান্ত সফট টয় এল তাকে চান করিয়ে, খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে ক্ষতর প্রলেপ লেগেছিল বই কী!
আমার ছেলে আহির বা জুজু। জন্মাল আর একই সঙ্গে কাজে আমার দায়িত্ব হু হু করে বাড়ল। কিন্তু আমি ভুলে যাইনি কথালয়ার স্মৃতি।
আমার ছেলে আহির বা জুজু। জন্মাল আর একই সঙ্গে কাজে আমার দায়িত্ব হু হু করে বাড়ল। কিন্তু আমি ভুলে যাইনি কথালয়ার স্মৃতি। তাই নিজের টিমকে গল্প বলার ক্লাস করাতে গীতা ম্যামকে কলকাতায় আনার প্রস্তাব রাখলাম অফিসের H.R-এর কাছে। প্রচণ্ড হাই-ফাই মহিলার, প্রস্তাবটা মনের মতো হয়নি। অফিসের কাজ ফেলে ছেলেমেয়েরা গুলিসুতোয় গল্প বুনছে, নিজেরা নাটক করছে আর কখনও আইসক্রিমের মতো গলে পড়ছে বা জঙ্গলে খরগোশের মতো দৌড়চ্ছে— এই সব দেখতে দেখতে ভদ্রমহিলা খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন সেদিন। সমানে আমার কাছে জানতে চাইছিলেন— এইসব ছেলেমানুষি করে আমরা কী উপকারটা করব চ্যানেলের? সিরিয়ালের গল্পের সঙ্গেই বা এর কী সম্পর্ক। সম্পর্কটা বোঝা গেল তার ক’মাস পর অফিসের অফসাইটে।

অফসাইটে সেইবার, সম্ভবত ২০১৪ বা ১৫ পাঁচটা গ্রুপের মধ্যে প্রায় চারটে presentation-এ PPT-র মধ্যে না গিয়ে গল্প বলার মতো করে present করল। আজকাল বিভিন্ন Social Media-র বিজ্ঞাপনে Corporate story telling শেখানো হয় দেখি— আর ভাবি সেই H.R-এর কথা যিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না কর্পোরেটদের কোন কাজে লাগবে এই গল্প বলতে শেখা, যা দেখে আপাত অর্থে বালখিল্যপনা লাগে! আসলে কথককে হতে হয় আকাশের মতো বড় আর জলের মতো স্বচ্ছ, বাচ্চাদের মনের মতো! তবেই তো সেখানে গল্পের বিস্ময় ধরা পড়বে।
ওঁর ব্যস্ততা আরও বেড়েছে— কথক হওয়ার পাশাপাশি ম্যাম এখন ছোটদের জন্য বই লেখার কাজেও ব্যস্ত। সারা পৃথিবী ঘুরে কত মানুষকে গল্প বলতে শেখান ম্যাম।
গীতা ম্যামের সঙ্গে আমার এখন যোগাযোগ আছে। ওঁর ব্যস্ততা আরও বেড়েছে— কথক হওয়ার পাশাপাশি ম্যাম এখন ছোটদের জন্য বই লেখার কাজেও ব্যস্ত। সারা পৃথিবী ঘুরে কত মানুষকে গল্প বলতে শেখান ম্যাম। ওঁকে আমি ফেসবুকে follow করি। আর সেভাবেই একদিন আমার সামনে খুলে যায় আরও এক নতুন জানলা। সে গল্প বলব কিছুদিন পর।
অলংকরণ – মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
ছাত্রী ইতিহাসের আর চাকরি গণমাধ্যমে। তাতে কী! নেশা কিন্তু আঁকা এবং লেখা। বিশেষত নকশা। নোটবুক ভর্তি তার প্রতিটি ছবিই গল্প বলে চলে। গুছিয়ে বসে বা দফতরের মিটিংয়ের ফাঁকে - রং কাগজ এবং কলম সবসময় মজুত।
One Response
কাস্টডি শব্দটার আরো এক গভীর অর্থ পেলাম।