(Village Food) ইতু পুজো ফুরিয়ে গেল। আলের পাশটিতে বসে অঘ্রাণের সংক্রান্তির দিনে খিচুড়ি খাওয়ার সুখ কি কম! সেই খিচুড়ির নরম শরীরে ছড়িয়ে থাকে ধনেপাতার সুঘ্রাণ। কী আশ্চর্য তারে বাঁধা রান্নাঘরের সুরগুলি। আমাদের কৃষিজীবনের কবেকার কোন পলি এমন করে শস্যের গানকে আলাপে বিস্তারে ছড়িয়ে দিতে চাইছে, সেই কবে থেকে। সেই সুর অঘ্রাণ পেরিয়ে পৌষের নরম রোদ্দুরে এসে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে। এ যেন কোন আধ্যাত্মিক যাপনের মতো। (Village Food)

কুয়াশার পর্দা সরিয়ে গোল সূর্যটি যখন ওই দূরের ইউক্যলিপটাস গাছগুলির উপরে দেখা দেয়, তখন এই মায়াবী কুয়াশা সরে যেতে থাকে। তার অপসৃয়মান শরীর আর কিছুক্ষণেই ফুরিয়ে যাবে জেনেও কী নিপুণ তার সজ্জা! জেগে উঠবে সর্ষের খেত, চুকাইয়ের নুয়ে পড়া ডাল। মৌমাছিরা ভিড় করবে সর্ষে মধুর গন্ধে। এসব গন্ধ নিয়ে জেগে উঠবে আস্ত একখানা পৌষের দিন। (Village Food)
এই গাছপালা আর রান্নঘরের কথায় ভারতীয় দর্শনের ছায়াটি এসে পড়ে এক গভীর বিশ্বাস আর ভালোবাসার স্পর্শে। এই নদী মাঠ আর ফসলি মাঠের গল্পকে তখন কি ভালো না বেসে পারা যায়! তখন এও হয়ে ওঠে এই নিবিড় যাপন, সেই যাপনকে পূজা বলা উচিত হবে নাকি প্রেম – সে প্রশ্ন তর্কসাপেক্ষ।
সর্ষেফুলের রঙে রঙে ভিড় করবে সর্ষেপোকার দল। মানুষের গায়ে মাথায় তারা উড়ে এসে বসতে চাইবে নিতান্ত সরল স্বেচ্ছায়। তবু, কেজো মানুষদের সেসব ভালো লাগতে যাবে কেন! কেউ বা তখন চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে জাউভাত রাঁধতে বসেছেন কাঠের জ্বালে। রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে সকলে জলখাবার খাবে এখন। এখন কি আর জ্বালাতন ভালো লাগে! কেউ বা পিঁড়ি পেতে বসে বসে শাক বাছছে। এত ব্যস্ত সকালেও কী শান্ত ওর ভঙ্গিটি। (Village Food)

আলু বেগুন কুচিয়ে নিয়ে মেথিশাক ভাজবে হয়তো কেউ। শীতের বেগুন ভারী সুন্দর। আসলে, যা স্বাভাবিক তাই সুন্দর। শিশিরে জবুথবু হয়ে আছে যে বাঁধাকপির খেত, তার জাড় কি সহজে কাটে! সে তখন রোদ্দুরের প্রত্যাশী। এই জঙ্গম জীবনের মতো সে তো চাইলেই রোদ্দুরে পিঁড়ি পেতে বসতে পারে না! তাই সে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে সাত-পাঁচ ভাবে। আসলে ওর ভিতরে ভিতরে একখানা চলমান যাপন প্রতিদিন ফুটে উঠছে। সে বারে বারে চিনিয়ে দিতে চাইছে এই গতিময় বিশ্বের সুরটিকে। ইতুপুজোর খিচুড়ি থেকে পৌষের ভাতে সেই সুর ছড়িয়ে পড়ছে অবলীলায়। (Village Food)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫][৬][৭]
মানুষের রান্নাঘর আর বাজার পেরিয়ে একেকদিন তাই ফসলি মাঠের প্রান্তটিতে গিয়ে বসতে ইচ্ছে করে। মানুষেরা কী নিপুণ হাতে আলুর খেতে বীজ বুনেছে! আলুশাকের কী অপূর্ব রঙ! কত যত্ন কত পরিচর্যা। যাঁরা আলুখেত পরিপাটি করে রাখতে জানেন, তাঁরা নিপুণ হাতে বেতোশাক(বাথুয়া) নিড়িয়ে তুলে ফেলতে চান। চটের বস্তায় ঢেলে ঢেলে সেসব বিকোয়, দেদার।
এই বেতোশাকের কী আশ্চর্য যাপন দেখুন। বর্ষা পেরিয়ে শরৎ পেরিয়েও মাটির পৃথিবীতে তার ঘুম ভাঙে না। (Village Food)
বৃষ্টির জল যে জঙ্গম পৃথিবীর ঘুমে ভাঙায় তার রূপোর কাঠির ছোঁয়ায়, সেও কিন্তু বেতোশাকের খবর পায় না সহজে। ওকে আমরা চলতি কথায় বেতো শাক বলি বটে, কিন্তু ওরও তো একখানা ভালো নাম আছে! সে নাম সময়ের পদযাত্রায় হারিয়ে গিয়েছে। সে তো যাবেই, যায়ও কত। ওর নাম বাস্তাকু। এখন ওকেই বলি বেতো/বেথো। মাটিতে বীজ পরেই ও অঙ্কুরিত হয় না বরং ও কিছুদিন এই মাটির পৃথিবীতে ঘুমিয়ে থাকে বা বলা ভালো বাস করে। (Village Food)

এই বাস করার কথাটি কী সুন্দর করে ভেবেছিলেন মানুষেরা। তাই ওর নাম দিয়েছিলেন বাস্তাকু। সমাসোক্তি অলঙ্কার যাঁরা চেনেন, যাঁরা সাহিত্যের বা সঙ্গীতের ভিতরের কথাটি খুঁজে বেড়ান, তাঁদের কাছে এও এক দৃষ্টান্তস্বরূপ। এই গাছপালা আর রান্নঘরের কথায় ভারতীয় দর্শনের ছায়াটি এসে পড়ে এক গভীর বিশ্বাস আর ভালোবাসার স্পর্শে। এই নদী মাঠ আর ফসলি মাঠের গল্পকে তখন কি ভালো না বেসে পারা যায়! তখন এও হয়ে ওঠে এই নিবিড় যাপন, সেই যাপনকে পূজা বলা উচিত হবে নাকি প্রেম – সে প্রশ্ন তর্কসাপেক্ষ। (Village Food)

আমি কেবল দেখি পৌষের শরীরে সর্ষের মধুর গন্ধ জড়িয়ে আছে কী অবলীলায়! মিশে আছে পাকা চালতার গন্ধ। সেই চালতার ঝোলে শরীর জুড়োয়। সেই চালতায় গুড়ের পাক মিলেমিশে যায়। বটি পেয়ে ওই যে বসে বসে চালতা কেটে নিচ্ছে ও কি জানে কি অপূর্ব ওর ফুলগুলি। সেই যে, যে ফুলের অসামান্য ছবি এঁকেছিলেন চিত্রনিভা চৌধুরী। (Village Food)
সর্ষেশাক দিয়ে মাছ মাখা
উপকরণ – সাদা সর্ষের শাক, পছন্দ মতো কম কাঁটার মাছ দু এক টুকরো, সর্ষের তেল, শুকনো লঙ্কা, পেঁয়াজ, নুন আন্দাজ মতো।

পদ্ধতি – সর্ষে শাকগুলি ভালো করে বেছে ধুয়ে নিন। কাটার পরে আর ধোয়া যাবে না, সেইভাবেই ধুয়ে নেবেন। ভালো করে জল ঝরিয়ে খুব মিহি করে শাক কুচিয়ে নিন। কুচানো শাক নুন মাখিয়ে চাপা ঢাকা দিয়ে রাখুন। অন্যদিকে নুন হলুদ মাখিয়ে মাছ ভেজে নিন। ভাজা মাছ একটু ঠাণ্ডা হলে কাঁটা বেছে নিন। অল্প তেলে গোটা শুকনো লঙ্কা ভেজে নিন। মিহি করে পেঁয়াজ কুচিয়ে নিন। এবারে শাকগুলি ভালো করে কচলে নিন। অনেকটা জল বেরোবে। যতটা সম্ভব জল চিপে নিন। চিপে নেওয়া শাকগুলি, ভাজা মাছ, নু্ন, সর্ষের তেল, পেঁয়াজ ও শুকনো লঙ্কা দিয়ে খুব ভালো করে মেখে নিন। গরম ভাতের পাতে এই শাক মাখা উপাদেয়। চাইলে পরিবেশনের সময় এক টুকরো জামীর লেবু বা যে কোনো লেবুর টুকরো দিতে পারেন।
গুড় চালতা
উপকরণ – পাকা চালতা, গুড়, নুন, সর্ষের তেল, হলুদের গুঁড়ো, লঙ্কার গুঁড়ো, পাঁচ ফোড়ন, পাঁচ ফোড়নের গুঁড়ো, জিরে-শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো।

পদ্ধতি – চালতা বেশ পাকা দেখেই নেবেন। যে চালতায় সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে। ভালো করে কেটে নিয়ে পাকা চালতা নুন হলুদের জলে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখুন। এরপরে জল থেকে তুলে ভালো করে জল ঝরিয়ে নিন। জল ঝরানো চালতা শিলে ছেঁচে নিন এবং দুই তিন ঘণ্টা ভালো রোদে দিয়ে রাখুন। রোদ থেকে তুলে কড়াই বসান। এই ধরণের রান্নায় তেল একটু বেশি লাগে। কড়াইয়ে তেল গরম হলে পাঁচ ফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন। ফোড়নের গন্ধ বেরোলে চালতাগুলি দিয়ে দিন। ভালো করে কিছুক্ষণ নেড়ে চেড়ে নুন হলুদ দিন। আরেকটু নরম আঁচে হতে দিন এবং ক্রমে লঙ্কার গুঁড়ো দিন।
আরেকটু কষে নিয়ে গুড় দিয়ে চালতাগুলো পাক হতে দিন। খুন্তি দিয়ে ভেঙে ভেঙে দেবেন চালতা গুলি। গুড় পাক হয়ে গেলে পাঁচ ফোড়নের (শুকনো তাওয়ায় টেলে নেওয়া) গুঁড়ো দিন। রান্না শেষ করে কড়াই ঠাণ্ডা হতে দিন। ঠাণ্ডা হলে ভাজা মশলার গুড়ো মিশিয়ে বয়মে তুলে রাখুন। এক দুদিন রোদ খাওয়ালে আরও ভালো হয়। দুপুরের খাওয়ার পরে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসে গুড় চালতা খাওয়ায় ভারী সুখ। (Village Food)
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons , Facebook, Wikimedia Commons
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।