রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের অন্যতম বিশিষ্ট মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতভবনের অধ্যক্ষ। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের ভাষায় গোরা সর্বাধিকারী ছিলেন একজন অসম্ভব ধৈর্যশীল শিক্ষক। সাল ১৯৬৫, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হল রবিগানের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এরপর থেকে গোরা সর্বাধিকারী তাঁর প্রিয় মোহরদির ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠলেন। (Gora Sarbadhikari)
গানের পাশাপাশি গোরাদার আরও একটা জগত ছিল, সেটা আধ্যাত্মিকতার। অ্যান্ড্রুজ পল্লির অদূরে সাধুবাবার আশ্রমে ছিল যাতায়াত। অবসর সময়ে আধ্যাত্মিক বই পড়ে সময় কাটত। বাইরে থেকে তাঁর চেহারা দেখে হয়তো অনেকেই ভাবতেন মানুষটা দাম্ভিক। কিন্তু তাঁর অন্তরটা ছিল একদমই অন্যরকম।
রবীন্দ্রসঙ্গীত যাঁরা ভালোবাসেন বা এই গান সম্পর্কে যাঁদের আগ্রহ রয়েছে, তাঁদের মধ্যে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, যাঁরা গোরা সর্বাধিকারীর নাম শোনেননি। একটি মজার বিষয় বলি, জার্মানি যাওয়ার আগে ছুটিতে শান্তিনিকেতন বেড়াতে গিয়ে লালমাটির দেশেই থেকে গেলেন, জার্মানি যাওয়া আর হল না। কথা ছিল কল-কবজা নিয়ে কাজ করার। হলেন সঙ্গীতের শিক্ষক এবং শিল্পী।

এই গোরাদাকে প্রথম দেখি বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে, তখন আমার বয়স খুব কম। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে অনুষ্ঠান করতেন, সেই সব অনুষ্ঠানের বেশিরভাগ জায়গাতেই দেখা যেত কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সঙ্গত করতেন গোরাদা। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাওয়ার কয়েক বছর পরে কোনও একটি কাজের সূত্রে যোগাযোগ হয় গোরাদার সঙ্গে, সেই যোগাযোগ রূপ নেয় ঘনিষ্ঠতায়।
দাদা এবং ছোট ভাইয়ের সম্পর্ক। কিন্তু বেশ কিছু বছর পরে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। যার পেছনে অবদান ছিল ওঁকে ঘিরে থাকা কিছু মানুষের। তাঁরা নিজেরাও তাঁর শেষ জীবনে গোরাদার পাশ থেকে বহুদূরে সরে যায়। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও কিন্তু গোরাদার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা, দুটিই আজও অটুট রয়েছে। কয়েক বছর আগে তাঁর চলে যাওয়ার খবর পেয়ে বিমর্ষ বোধ করেছিলাম এবং আজও গোরাদার সান্নিধ্যের অভাব অনুভব করি।
দক্ষিণ ভারতে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রশান্তিনিয়ম জায়গাটা ওঁর খুব ভাল লেগেছিল তাই আমার ফ্ল্যাট রয়েছে শুনে উনিও কিনতে চান। আমরা দুজনে সেখানে যাই এবং ফ্ল্যাট কেনার ব্যবস্থাও হয়। এই সূত্রে আমার ভাল লাগে গোরাদাকে খুব কাছ থেকে দেখে। ট্রেনে যেতে যেতে বিশেষ কোন খাবারটা খাওয়া যায়, সেটার খোঁজ নিতে মাঝে মধ্যেই প্যান্ট্রিতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসছিলেন। হাসি-খুশি মানুষটির কাছে কত গল্পের সম্ভার।
বলেছিলেন হরিদ্দারের গঙ্গাতীরে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ওঁর স্বামী বীরেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়-র সঙ্গে বসে দিলীপ কুমার রায়ের মুখে ‘সেই বৃন্দাবনের লীলাঅভিরাম’ গানটি শোনার অভিজ্ঞতার কথা। পুরোনো শান্তিনিকেতনের কত মজার কথা। প্রশান্তিনিলয়মে পৌঁছে আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে আমরা দুজনে ঘর পরিষ্কার করে মাটিতে বিছানা পেতে শোওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলাম। সেখানেও একই ছবি। গোরাদা খোঁজ খবর নিতে শুরু করলেন কোন খাবার সেখানে প্রসিদ্ধ। ওখানে থাকাকালীন সময়েই প্রকাশিত হল লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল। আমরা রাত পর্যন্ত দেশ উদ্ধার করতে আলোচনা শুরু করলাম ভোটের ফল নিয়ে।

শুধুই আলোচনা। কোনও তর্ক-বিতর্ক নয়। সেইবার ফেরার পর আমাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হল আবার কবে যাব আর এবারে গেলে দক্ষিণ ভারতের কয়েকটা জায়গা ঘুরব। পরেরবার গিয়ে আমরা ঘুরতে গেলাম মাইসোর, বন্দিপুর এবং মধুমালাই ফরেস্ট। এইবারে শুধু আমরা দু’জন নয়, একেবারে স্বপরিবারে ঘোরা হল। ফেরার সময় একটা হোটেলে ভূতের অভিজ্ঞতাও হল। সেই ঘটনা না হয় অন্য কোনও সময় বলা যাবে।
তখন আমাদের দেখা হলেই পরেরবার ঘোরার পরিকল্পনা হত। ঠিক হল পুজোর পরে যাব পেলিং, কালিম্পঙ ইত্যাদি জায়গায়। এর মধ্যে আবার সত্য সাই বাবাকে নিয়ে আমার লেখা ‘চিরপথের সঙ্গী’ বইটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশ অনুষ্ঠানে গোরাদা উপস্থিত থাকতে কলকাতায় এসে আমাদের বাড়িতেই উঠলেন। এখানে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে দক্ষিণ ভারতে ঘোড়ার সময় আমাদের সঙ্গী ছিলেন আমাদের অতি আপনজন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য এবং ওঁর স্ত্রী ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য। সেইসব দিনে রাতে খাওয়ার পরে গান আর গোরাদার মুখে ভূতের গল্প শোনা ছিল আমাদের কাছে এক অন্যতম আকর্ষণ।

আরেকবার প্রশান্তিনিলয়ম যাওয়ার সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন পূর্ণদা মানে পূর্ণদাস বাউল। ট্রেন বদলাতে আমরা বিজয়ওয়াড়া স্টেশনে এক বেলা রিটায়ারিং রুমে ছিলাম। দুপুরে বিশ্রামের পরে যখন ঘুম ভাঙল, তখন বুঝতে পারলাম গোরাদা আর আমি পূর্ণদাকে পাশবালিশ করে ঘুমিয়েছিলাম। পূর্ণদা শুয়েছিলেন আমাদের মাঝখানে। কত কথাই না মনে পড়ে! আর একবার আমরা সকলে মিলে দেখতে গেলাম বিজয়ওয়াড়ার দুর্গামন্দির। গোরাদার সঙ্গে যেখানেই যাই, এক টুকরো শান্তিনিকেতন যেন আমাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত! কারণ গোরাদার বেশিরভাগ গল্পেই ঘুরে ফিরে আসতো শান্তিনিকেতনের প্রসঙ্গ।
একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি : অরিজিৎ মৈত্র
গোরাদা ভীষণ ভালবাসতেন বেড়াতে। বিশ্বভারতীর কাজে এবং মোহরদির সঙ্গে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রচুর। অনেক দেখেছেন আর সঞ্চয় করেছেন অভিজ্ঞতা। গোরাদার মতো এমন সহজ, সরল, ভদ্র মানুষ আজকের দিনে বড় একটা দেখা যায় না কিন্তু সুখের দিনের স্থায়িত্ব বোধহয় বেশিদিন থাকে না। আমাদের সখ্যও খুব বেশিদিন টিকল না। আগেই বলেছি যে তাঁকে ঘিরে থাকা কিছু মানুষজন আর কলকাতা সাই সমিতির কয়েকজন গোরাদা আর আমার ভেতর একটা ব্যবধান তৈরি করতে সচেষ্ট এবং সফলও হন। কিন্তু আমার মন থেকে গোরাদার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মুছে দেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। এটাই আমার কাছে আনন্দের তবে গোরাদার সঙ্গে আর কোনওদিনও দেখা বা কথা বলার অবকাশ হয়নি, হলে হয়তো আমাদের সম্পর্কের ওপর জমে থাকা মেঘটা সরে যেত।

ডিমেনসিয়া তাঁর শরীরে বাসা বাঁধল আর এর ফলে সবার কাছ থেকেই দূরে সরে গেলেন। আজও যখন রেকর্ডে গোরাদার গলায় ‘সারা বরষ দেখিনে মা’ গানটি শুনি, তখন মনটা কোথায় চলে যায় বলতে পারব না আর চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে।
ছবি- লেখক
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।