(Bharatpur) একসময় ইংল্যান্ডের সাহেবদের পাখি শিকার দেখে রাজস্থানের ভরতপুরের রাজার সাধ হলো তিনি নিজের রাজত্বের বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকায় পাখি শিকার করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। প্রতি শীতের মরসুমে বিভিন্ন রাজা-মহারাজা, রথী-মহারথীদের তিনি নিমন্ত্রণ করতেন পাখি শিকারের উল্লাসে। প্রত্যেক বছর রাজাদের এ হেন নিষ্ঠুর মনোরঞ্জনে হাজার হাজার নিরীহ পাখি মারা পড়তে লাগলো। (Bharatpur)
এরপর ধীরে ধীরে বন্যপ্রাণী শিকার বেআইনি ঘোষিত হলে এখানেও পাখি শিকার বন্ধ হলো। পক্ষী বিশারদ ড:সেলিম আলী দীর্ঘদিন পাখির ওপর রিসার্চ করলেন। এখন এই অরণ্য বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পাখির শীতকালীন নিশ্চিন্ত আবাস। পাখি ছাড়াও চিতাবাঘ, ভালুক, হরিণ, নীলগাই, শেয়াল, হায়না ,অজগর, কচ্ছপ ইত্যাদি প্রাণীরও দেখা মেলে কপালজোরে।
আমাদের মনও পাখির মতো ডানা মেলেছিল। তাই এবারের শীতকালীন ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে বাছা হলো ভরতপুরের পক্ষী নিবাস কেওলাদেও ঘানা ন্যাশনাল পার্ক। আগ্রা হয়ে ভারতপুর পৌছলাম সন্ধ্যে নাগাদ। অস্থায়ী আস্তানা আয়োরা গেস্ট হাউস। সুন্দর সুন্দর ফুল গাছ ও পাতাবাহারে পরিপাটি করে সাজানো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বড় ঘর। রাতে ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। কাল ভোরেই জঙ্গলে প্রবেশ। (Bharatpur)

পরেরদিন ভোররাত্রে উঠে বেরোনোর প্রস্তুতি। ঠিক সাড়ে ছটায় ই-রিকশা চেপে, টিকিট কেটে জঙ্গলে ঢুকলাম। একজন গাইডকেও সঙ্গী করেছি। কিছুটা এগোতেই দেখি গাছে গাছে পেইন্টেড স্ট্রর্ক তাদের সন্তান সন্ততি নিয়ে সংসার সাজিয়ে বসেছে। সকাল থেকেই তারা খুব ব্যস্ত। কেউ বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে। কেউ বাসায় বিছানোর জন্য ঘাস তুলছে, যাতে খরকুটো দিয়ে তৈরি বাসায় পক্ষী শাবকের নরম গায়ে কোনও শক্ত ডালপালার খোঁচা না লাগে। ওদের এই সব কার্যকলাপ যতটা সম্ভব লেন্সবন্দি করলাম। ইতিমধ্যে পিছন ফিরে দেখি একটি নাদুসনুদুস কচ্ছপ মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে। তখন পাখি ছেড়ে কচ্ছপে মন দিলাম। (Bharatpur)

ক্যামেরাকে হয়তো বন্দুক ভেবেছে কচ্ছপ। ভয়ের চোটে একটু রাস্তা ভিজিয়ে ফেললো সে। মনে মনে হয়তো ভাবছে, “কার মুখ দেখে আজ ঘুম থেকে উঠেছি। প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরতে পারলে হয়”। বেচারাকে আর বিরক্ত না করে, চললাম সারস দেখতে। (Bharatpur)
রিক্সা থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম ঘন জঙ্গলের স্যাঁতস্যাঁতে পথে। ষাঁড়ের গোবর ছড়ানো পথ। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, এখানে বেশ কয়েকটা ষাঁড়ের দেখা পেলাম। কিন্তু গরু নেই। এরা সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে এই অরণ্যে ঠাঁই নেয়নি। শোনা যায়, বেশ কয়েকবছর আগে এখানে কিছু গ্রাম ছিল। গ্রামের মানুষ কোনও কারণে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় গবাদী পশু সঙ্গে করে নিয়ে যায়। কিন্তু শিবের বাহনগুলিকে এখানেই ছেড়ে রেখে যায়। (Bharatpur)

আমরা সারস দেখার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেখলাম ইতিমধ্যে আরও ৩-৪ জন ক্যামেরা রেডি করে বসে রয়েছে। আমরাও নিজের নিজের ক্যামেরা তাক করে দাঁড়ালাম গাইড নরেন্দ্র শর্মাজীর দেখানো নির্দিষ্ট স্থান বরাবর। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই দূরের ঘাস পাতায় হিল্লোল তুলে এক সারস দম্পতি তাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সাথে সাথে ক্যামেরার শাটার টিপতে লাগলাম লাগাতার যেন কোনোভাবেই ছবি মিস না হয়। (Bharatpur)

তবে সারস দম্পতি বোধ হয় কিছু বিপদ বুঝেছে। তারা পিছন ফিরে রাস্তা বদল করলো। আবার অপেক্ষা। গাইড বলল, ওরা রাস্তা পার হবে। আমাদের ক্যামেরার মুখ ডানদিক থেকে বামে ঘুরেছে। সারস পরিবার সম্ভবত মাঝখানের রাস্তা পেরিয়ে এদিকের জঙ্গল থেকে ওপাশের জঙ্গলে যাবে। (Bharatpur)

কিছুক্ষণ পরেই তেনারা এলেন এবং আমাদের একটুও নিরাশ না করে যথেষ্ট ছবি তোলার সুযোগও দিলেন। এক মানুষ সমান পাখিগুলো কোনও দিকে ভ্রক্ষেপ না করে দুলকি চালে ধীরে ধীরে গভীর অরণ্যের মধ্যে মিলিয়ে গেল। আমরাও মনে বেশ আনন্দ নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। (Bharatpur)

পথে আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। নজরে এলো গাছের ন্যাড়া ডালে ব্ল্যাক হেডেড আইবিস দল বেঁধে বসে আছে। এছাড়াও রয়েছে লিটল গ্রীন হেরন, পার্পল হেরন, গ্রে হেরন। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। শুধু ইন্ডিয়ান স্কোপস আউল দম্পতি, স্পটেড আউলেটের মতো পেঁচারা চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমরা গিয়ে ছবি তুলতেই খুব অচ্ছেদ্যার সাথে চোখ মেলে তাকালো এবং মনে মনে নিশ্চয় খুব গালি দিলো স্কোপস পেঁচা দম্পতি। তাদের সুখ নিদ্রায় আর ব্যাঘাত না করে এগিয়ে চলি। (Bharatpur)

একটা পুকুরের ধারে এলাম। গাছে গাছে ডার্টার আর পানকৌড়ি সদ্য স্নান সেরে ডানা মেলে বসে রয়েছে। ডানা না শুকালে ওরা উড়তে পারে না। কয়েকটা ডার্টার বা স্নেক বার্ড জলে ডুব দিচ্ছে মাছের আশায়। শুনেছি, এরা মাছটাকে সুঁচালো ঠোঁটে বিঁধিয়ে জলের ওপরে তুলে উপরদিকে ছুঁড়ে দেয়, পরক্ষণে মাছটা উপর থেকে ওর মুখের মধ্যে এসে পড়ে। এক্ষেত্রে, মাছের মুড়োটা কিন্তু পাখির মুখের ভিতরে পড়তে হবে। লেজের দিকটা পড়লে পাখিটা পুনরায় মাছটিকে উপরদিকে ছুঁড়ে দেয়। আমরাও অপেক্ষা করি ওর অভিনব মাছ খাওয়ার প্রক্রিয়াকে ক্যামেরাবন্দি করার জন্য। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও নিরাশ হলাম। পাখি তার পছন্দ মতো মাছ পেলো না। আমদেরও আর সাধের ছবি তোলা হলো না। (Bharatpur)

এখানে একটা ছোট ক্যান্টিন আছে। সেখানে চা, বিস্কুট, কেক, চাউমিন, পরোটা ইত্যাদি পাওয়া যায়। অবশ্য রিকশাচালক দেবেন্দ্রজী আগেই গেস্ট হাউস থেকে আমাদের লাঞ্চবক্স নিয়ে এসেছে। খাওয়ার পর আবার চলা। হঠাৎ দুটো শিয়ালকে রাস্তার ধারে বসে থাকতে দেখলাম। আমরা ক্যামেরা রেডি করেছি, ওরা দুজনে আমাদের রিক্সার সামনে দিয়ে দৌড়তে লাগলো। আমরাও ওদের পিছনে চলতে লাগলাম। তারপর একসময় শিয়াল দুজন হার মেনে রাস্তায় বসে পড়লো। ভাবখানা এমন… “নে ভাই! দুটো ছবি তুলে আমাদের মুক্তি দে।“

শেয়ালের কিছু ছবি তুলে দেখি, পাশের জমিতে একটা নীলগাই চড়ে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা চিতল হরিণের দেখাও পেলাম। একটি ময়ূর দম্পতি পাঁচিলে বসে ছিল। ক্যামেরা তাক করতেই পাঁচিলের উল্টোদিকে গা ঢাকা দিল। লালমুখো বানরের দল রাস্তার ধারে একটি গাছের কোটরে হাত ঢুকিয়ে কী যেন বের করে হাত চেটে খাচ্ছে। গাইড বললেন, ওই গাছের আঠা ওরকম তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে ওরা। কিছুটা এগোতেই দেখলাম উলি নেকড স্টর্ক গাছে বসে ধ্যান করছে। কোনদিকে ভ্রক্ষেপ নেই তার।

একটি গাছের কোটরে দুটো টিয়া পাখির বাসা।মাঝে মাঝে তারা মুখ বের করে আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে। ওদিক থেকে নজর ঘোরাতেই চোখে পড়ল একটা গোসাপ বিকেলের পড়ন্ত রোদে ঝিমোচ্ছে। হয়তো খাওয়াদাওয়া সেরে পাওয়ায় ন্যাপ নিচ্ছে।

দেবেন্দ্রজী একটি শ্রাইকের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।। শ্রাইকের পাশাপাশি চোখে পড়লো একটা পায়েড বুশ চ্যাট উড়ে বেড়াচ্ছে এক গাছ থেকে অন্য গাছে। এই সব ছোট্ট পাখিগুলি সদা চঞ্চল। এদের ছবি তোলা বেশ দুষ্কর ব্যাপার।

ধীরে ধীরে সূর্যদেব পাটে বসতে চলেছেন। দিনের শেষে পাখিদেরও বাসায় ফেরার তাড়া। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে, আমাদেরও বন থেকে বেরোনোর তাড়া লেগেছে। পক্ষীশাবকের অক্লান্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস মুখরিত। মা পাখি তড়িঘড়ি খাবার নিয়ে ছানাদের খাওয়াচ্ছে। একটু পরেই কালো অন্ধকারে ছেয়ে যাবে গহীন অরণ্য। ভরতপুরের পক্ষী সমাজকে এবার বিদায় জানানোর পালা।
ছবি সৌজন্য: লেখক
ভ্রামণিক, লেখিকা এবং ফটোগ্রাফার।