(Doodhpathri) অপরূপ কাশ্মীর, এ যেন প্রাচ্যের স্বর্গ। সেই যে স্কুলের দিনগুলিতে ভূগোল বইতে পড়া ‘ভূস্বর্গ’, তাকেই যেন ছুঁয়ে দেখা। নীলাভ দেওয়ালের মতো চারিদিকের প্রকৃতিকে ঘিরে আছে বরফে ঢাকা সুউচ্চ পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে দেবদারু, পাইন, ফার এবং ওক গাছ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে, যেন সেই প্রাচীন কাল হতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরী সবাই। নিশ্চুপ, নিশ্চল। (Doodhpathri)

এক বসন্তে আমার সুযোগ হয়েছিল ‘দুধপাথরি’ দেখার, তার রূপে মুগ্ধ হওয়ার। কাশ্মীর ভ্রমণে একটা গোটা দিন রেখেছিলাম দুধপাথরির জন্য। শ্রীনগর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি ‘দুধপাথরি’, যার অর্থ ‘দুধ ভর্তি পাথর’ বা ‘দুগ্ধ উপত্যকা’। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ৯০০০ ফিট। (Doodhpathri)

ঝিরঝির করে বয়ে চলা বুনো ঝোরা আর উপত্যকার বুক চিরে শুয়ে থাকা স্বচ্ছতোয়া নদী। এই নদী এখানে শালিগঙ্গা নামে পরিচিত। ভরা শীতে জল প্রায় বেশির ভাগটাই জমে সে শ্বেত বসনা। বড় পাথরে জলতরঙ্গের সুর তুলে উচ্ছ্বল কিশোরীর মতো ছুটে চলেছে সে। পাহাড়ের ফাঁকে কোথাও একটু সমতলে জমিতে ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়ি, বাগান, ফসলের খেত। রং-তুলিতে আঁকা প্রকৃতি যেন। (Doodhpathri)

আমরা যখন শ্রীনগর থেকে রওনা দিয়ে উপত্যকার কাছাকাছি পৌঁছলাম, বেশ জোরে বৃষ্টি নামল। পথের ধারে একটি দোকানে গরম গরম আলুর পরোটা এবং কফি সহযোগে জলযোগ সেরে নিলাম। পিছনদিকের জানলা দিয়ে এক অপরূপ ভ্যালি দৃশ্যমান। হাল্কা বৃষ্টি পড়ছে। সবুজ চাদরের মাঝে দু’একটি ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে। স্বর্গীয় শোভা। জানলার ফাঁক দিয়ে কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর বর্ষাতি আর গামবুট চাপিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম দুধপাথরির দিকে। (Doodhpathri)

গাছের ফাঁকে ফাঁকে দুধের সরের মতো বরফের আচ্ছাদন। মনে হচ্ছে গৃহিনীর ক্ষণিকের অসাবধানতায় দুধ উথলে সর পরে আছে চারিদিকে। এঁকেবেঁকে গাড়ি চলেছে। আমাদের সারথি জহুর ভাই ঢোকার মুখে একজনের সঙ্গে কথা বলে নিলেন। তখনও বেশি গাড়ির ভিড় না থাকায় পারমিশন নিয়ে শেষ পর্যন্ত গাড়ি নিয়েই চললেন। (Doodhpathri)
আমার চোখে এ যেন পরীদের গ্রাম। মানুষেরা এখানে পরিযায়ী। আসে, চলে যায়। নীড় বাঁধে না। গরমের দিনগুলোতে ভেড়ার পাল নিয়ে রাখালের দল এ পথে যাওয়া আসা করে ঠিকই, কিন্তু শীতের কয়েকমাস প্রচন্ড তুষারপাতের ফলে এই অঞ্চল মনুষ্যবসবাসের একেবারে অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে।
‘দুধপাথরি’ নামকরণের পিছনে লুকিয়ে আছে এক মজার গল্প। স্থানীয় উপকথা মতে, অনেককাল আগে এই কাশ্মীর উপত্যকায় বাস করতেন এক ধর্মপ্রাণ মানুষ। একাধারে কবি, গীতিকার ও সুফি সাধক সেই মানুষটার নাম শেখ নূর-উদ্দিন নূরানী। একদা বিশেষ এক প্রয়োজনে এই পথ দিয়েই চলেছিলেন সুফি পীর শেখ নূর। (Doodhpathri)
নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় পথের ধারে ঘাসে ঢাকা এক অজানা মাঠে থামতে বাধ্য হন তিনি। নামাজের আগে অজু করতে জল দরকার। এদিকে আশেপাশে নদী বা ঝরনা কিচ্ছুটি নেই। ভারি বিপদে পড়লেন সুফি নূর। জল খুঁজতে গিয়ে মাঠের শক্ত মাটিতে লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন। সেই আঘাতে আশ্চর্যভাবে মাটি ফেটে বেরিয়ে আসে দুধের ধারা। (Doodhpathri)

কথিত আছে, দুধ বেরোতে দেখে বিস্মিত হয়ে বলে ওঠেন শেখ নূর, এ দুধ দিয়ে কী করব আমি! দুধ পান করা যেতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে তো অজু করা যাবে না। সাধকের মুখে এ কথা শোনামাত্র দুধের সেই ধারাই বদলে যায় স্বচ্ছতোয়া জলে। পাহাড়ের উপরে ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে সেই দুধেল জল নাকি আজও বয়ে যায়! আর এই ঘটনার পরই এই ঘাসে ঢাকা উপত্যকার নাম হয়ে যায় ‘দুধপাথরি’। (Doodhpathri)

গরমের দিনে পরিস্কার আকাশে প্রকৃতি যেন তার রঙের বাক্স উপুড় করে দেয় এই দুধপাথরি উপত্যকায়। হাতছানি দিয়ে ডাকে পুরু সবুজ ঘাসের গালিচা আর ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা রঙের বুনো ফুল। মৃদুমন্দ বয়ে চলেছে পাথুরে নদী। তার বরফগলা ঠান্ডা জল ক্লান্ত শহুরে শরীরকে শীতল করে। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়ে দূরে দিঘল গাছের সারির মাথায় নানা রঙের খেলা শুরু হয়। (Doodhpathri)
আরও পড়ুন: তুষার নিসর্গে মোহময়ী আউলি
আমরা অবশ্য অন্য একটি রূপ দেখলাম দুধপাথরির। কনকনে ঠান্ডা। মাঝে মাঝে হাল্কা তুষারপাত। বেশ কয়েক ইঞ্চি পুরু বরফ। দূরে পীরপঞ্জালে জমেছে মন খারাপের মেঘ। অনেক নীচে শালিগঙ্গা নদীর ধার পর্যন্ত নেমে যাওয়া যায়। বরফ গলা জলে বেগবতী শালিগঙ্গার তাকিয়ে থাকলে ঘোর লেগে যায়। (Doodhpathri)

অনেকে আবার সেতু পেরিয়ে হয়ে অন্য পাড়ে যাচ্ছে। আমরা আর সূঁচ-বেঁধা ঠান্ডায় ওপারে গেলাম। তবে মন-প্রাণ ভরে উপভোগ করেছিলাম এই দুধের উপত্যকার সৌন্দর্য। যেন প্রতি বাঁকেই অপেক্ষারত বিস্ময় আর প্রকৃতির উজাড় করে দেওয়া শোভা। বৃষ্টি অনেকটা হাল্কা, কিন্তু গা ভিজে যাচ্ছে। চারিদিকের অপার সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয়। তাই অন্য কোনও প্রতিকূলতাই আর স্পর্শ করে না।

একদিকে হিমাচল প্রদেশ আর অন্যদিকে জম্মু-কাশ্মীর, এর ঠিক মাঝখানে পীরপঞ্জাল রেঞ্জ। ভৌগলিকভাবে হিমালয়ের এই পীরপাঞ্জাল রেঞ্জেরই অংশ দুধপাথরি, যার একদিকে ছড়িয়ে আছে চিরসবুজ পাইন আর দেবদারু গাছের জঙ্গল, আর অন্যদিকে ঘাসের গালিচা। পশুচারণের উপযুক্ত এই তৃণভূমিতে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় কাশ্মীরি ভেড়ার পাল। গ্রীষ্মে উপত্যকা ছেয়ে যায় ডেইজি এবং বাটারকাপের মতো হলুদ সাদা বুনো ফুলে।
আমার চোখে এ যেন পরীদের গ্রাম। মানুষেরা এখানে পরিযায়ী। আসে, চলে যায়। নীড় বাঁধে না। গরমের দিনগুলোতে ভেড়ার পাল নিয়ে রাখালের দল এ পথে যাওয়া আসা করে ঠিকই, কিন্তু শীতের কয়েকমাস প্রচন্ড তুষারপাতের ফলে এই অঞ্চল মনুষ্যবসবাসের একেবারে অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মের ছ’মাসই দুধপাথরিতে বেড়াতে যাওয়ার ভালো সময়।

সমগ্র কাশ্মীরের সৌন্দর্যের প্রতিভূ হয়েই আমাদের মনে জায়গা করে নিল এই দুধের উপত্যকা। পশ্চিমে অবস্থিত বিখ্যাত তুসামিদান। অল্প দূরেই রয়েছে স্বচ্ছ জলের লেক ‘নীল নাগ’। লেকের জলে কেউ যেন নীল রঙ গুলে দিয়েছে। আশেপাশে গভীর জঙ্গল, ঘাসজমি আর দূরের পাহাড় নিয়ে আদর্শ পিকনিক স্পট এই ‘নীল নাগ’। আমরা অবশ্য ঐদিকে আর যাই নি।
শালিগঙ্গার দিকে যেতেই চোখে পড়েছিল দুধপাথরির JKTDC’র আবাস। কেমন যেন ভয় করে উঠল! জন-মানব শূন্য। বরফের আচ্ছাদনের মাঝে বাংলো যেন গা ছমছমে হানা বাড়ি। শুনলাম গরমকালে ভালোই লোকজন থাকে এখানে। এবার যেহেতু বরফ অনেকটাই দেরিতে পড়া শুরু হয়েছে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে, তাই এই মার্চ শেষেও চলছে বরফের মরসুম।

ফেরার সময়ে বেশ খানিকটা যানজটে পড়তে হল। ততক্ষণে অনেক গাড়ি ভিতরে ঢুকে এসেছে। জহুর ভাই বলেই রেখেছিল দুধপাথরি থেকে ফেরার পথে এখানকার লোকাল কুইজিন ‘সর্ষো দা শাক’ আর ‘মক্কি দি রোটি’ (ভুট্টার গুঁড়োর রুটি) খাওয়াবে। ফিরতি পথে এই খাবারের অসংখ্য ঝুপড়ি চোখে পড়ল। হলুদ রঙের ভুট্টার গুঁড়ো দিয়ে রুটির মতো বেলে নিয়ে তা তাওয়ায় সেঁকে বেশ কুড়মুড়ে এক ধরণের রুটি বানানো হয়। স্থানীয় আচার এবং সর্ষে শাকের সঙ্গে পরিবেশন। অত্যন্ত সুস্বাদু পদ। ঝুপঝুপে বৃষ্টির মধ্যে এই গরম গরম রুটি ও শাকের তরকারি যেন অমৃতসমান।
দুধপাথরিকে পিছনে ফেলে এবার এগিয়ে চলার পালা। খাবারের জায়গাটির পিছনেও উঁকি মারছে পীরপঞ্জাল। চারিদিক দিয়ে ঘিরে এই উপত্যকার অতন্দ্র প্রহরী সে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দুধের সর তখনও বিদ্যমান। জহুর ভাই বললেন, “আগলি বার গরমি মে আনা, পুরা ভ্যালি দুসরা দিখেগা।” পরিতৃপ্ত এবং সৌন্দর্য-সম্পৃক্ত মনে আমরা দুধের উপত্যকাকে বিদায় জানালাম।
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons
পেশায় জৈব-প্রযুক্তিবিদ। শখ বই ও শাস্ত্রীয় নৃত্য। চেনা অচেনা জায়গায় বেড়াতে যেতে এবং স্থানীয় খাবার চেখে দেখতে ভালোবাসেন। ছুটি, রংরুট, চল যাই, ভ্রমণপিপাসু ইত্যাদি বিভিন্ন ছোট-বড় পত্রিকা, ওয়েবজিন ও ব্লগে ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। এছাড়াও লিখেছেন ব্যক্তিগত গদ্য, রম্যরচনা এবং ছোট গল্প।