Subhash Mukhopadhyay
চল্লিশের দশক। স্বাধীনতার দিকে যত এগোচ্ছে দেশ, ততই সেই স্বাধীনতার গতি-প্রকৃতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ এই বাংলার দিকে দিকে। শ্রমিক-মজদুররা কোথায় পাচ্ছে ন্যায্য পাওনা তাদের? নৌ-বিদ্রোহ তবু আলাদা ভাবে জাগিয়ে দিয়ে গেল শ্রমিক শ্রেণীকে। ‘জবাব চাই রক্তের ধার রক্তে শুধবো কসম ভাই’! (Subhash Mukhopadhyay)
এবং এইভাবে চলতে চলতেই এই শালতি, গরুর গাড়ির দেশে স্বাধীনতা চলে এল একদিন হুড়মুড় করে। হঠাৎ কেমন যেন একটা আধুনিকতার মোড়ক আঁকড়ে ধরল এই গঞ্জ থেকে মফস্সলের দিকে পা বাড়ানো অঞ্চলটাকেও। এল তার সঙ্গেই মূল্যবৃদ্ধি। দুর্নীতি। খেটে খাওয়া মানুষদের পরিশ্রমও বয়ে যেতে লাগল জলের দরের মতোই। নাগাড়ে ছাঁটাই হয়ে চলল বজবজের জুট মিলগুলোতে। এই কি সত্যি স্বাধীনতা? নাকি ঝুটা সবটাই? ১৯৪৯ সালের স্বাধীনতা দিবসের দিন কমিউনিস্টদের ডাকে এই মেকি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল বজবজের মানুষ। ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’! পনেরোই আগস্টের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে গুলি চলল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বুড়ুল অঞ্চলে বিক্ষোভকারীদের উপর। আরও একটু চিন্তায় যেন কুঁচকে গেল বজবজের চড়িয়ালের রাস্তা। (Subhash Mukhopadhyay)
সাতচল্লিশে যে স্বাধীনতা এসেছিল অনেক রক্ত, দাঙ্গা আর দেশভাগের মিথ্যেকে সঙ্গে নিয়ে, সেই স্বাধীনতারই বছর পাঁচেক পরে বজবজে এসে পৌঁছালেন অদ্ভুত সেই কবি। কবির চামড়ার নীচে যিনি আদতে প্রেমিক বিপ্লবী একজন। সর্বক্ষণ পায়ের তলায় সর্ষে যেন। বছর তেত্রিশের কোঠায় তখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সদ্য ইউরোপ-ফেরতা স্ত্রীকে নিয়ে এসে উঠলেন এই বজবজে। চড়িয়ালের কয়লা সড়কের কাছেই ব্যাঞ্জনহেরিয়ায়। মানুষের কাছে কী এত বলার তাঁর? কিংবা এতকিছু নয়, বলার শুধু এটাই যে, ‘কমরেড আজ নবযুগ আনবে না?’ (Subhash Mukhopadhyay)
সুভাষ লিখেছেন:
‘নেমেছিলাম চড়িয়ালে। গ্রাম ব্যাঞ্জনহেড়িয়া। চটকল আর তেলকলের মজুরদের বাস। মাটির ঘর। সামনে এঁদো পুকুর। আঠারো টাকা ভাড়া। দু’জনেই সর্বক্ষণের কর্মী। বিনা ভাতায়। লেখালেখি থেকে মাসে সাকুল্যে আয় পঞ্চাশ টাকা। একে অনিশ্চিত, তাও পাঁচ-দশ টাকার কিস্তিতে। তাই সই। চলো বজবজ।’ (Subhash Mukhopadhyay)
আর কী দেখলেন তিনি এসে এখানে?
‘কী এক গভীর চিন্তায়
কপাল কুঁচকে আছে
চড়িয়ালের রাস্তা।
একবার এ-আলোর নিচে, একবার ও-আলোর নিচে
গাছের পাতায়
বারবার নড়েচড়ে বসছে ধৈর্যচ্যুত অন্ধকার।…’
আরও পড়ুন: কুম্ভমেলায় একলা নবনীতা
ঠিকানাটা ৭৩ ফকির মহম্মদ খান রোড, গ্রাম ব্যাঞ্জনহেড়িয়া, বজবজ, ২৪ পরগনা। সেই রাস্তার নাম বদলে এখন হাজী মহম্মদ মহসীন রোড। বজবজ থেকে ট্রাঙ্ক রোড ধরে সোজা এগোতে থাকলে, চড়িয়ালের আগেই বাঁদিকে ঢুকছে ব্যাঞ্জনহেড়িয়ার রাস্তা। খানিকটা এগিয়ে যে কোনও কাউকে ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি’ বললেই দেখিয়ে দেবে আঙুল তুলে। এবং সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই, তেলচিটে চাদর বিছানো একটা পুকুর। তার পাশে একটা কালো বেদীর উপর খোদাই করা সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবয়ব। (Subhash Mukhopadhyay)
যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় রাস্তা। খোঁজ চলতে থাকে এমন কারোর, যাঁরা দেখেছিলেন সেই সময় সুভাষকে। কেউ একজন বলে যান, “দেখেছিল তো! কালোর মা দেখেছিল!” কালোর মা, অর্থাৎ সালেমন বিবি। সালেমন বিবি, অর্থাৎ ‘সালেমনের মা’ কবিতার সেই সালেমন। (Subhash Mukhopadhyay)
যে বার্লিনে জয়ের নিশান উড়িয়েছিল লাল ফৌজ, সেই বার্লিন-ফেরত স্ত্রী গীতাকে নিয়ে পদাতিক কবি উঠেছিলেন ছোট্ট মাটির বাড়িতে। সেই বাড়ি পাকা হয়েছে এখন। সুভাষ-গীতার মাটির বাড়িতে তখন পাশাপাশি দুটো ঘর। সামনে একচিলতে বারান্দা। আছে এক ফালি উঠোনও। বাড়ির দরজা সবসময়ের জন্য খোলা। রাস্তাই যেন বসবার ঘর। (Subhash Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের কবিচেতনায় লক্ষ্মী ও সরস্বতীর দ্বন্দ্ব…
প্রায় আড়াই বছর ধরে চলল একের পর এক কারখানার গেট মিটিং। শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার কাজও চলছে একনাগাড়ে। সন্ধেবেলাতেও হাজির পার্টি বা ইউনিয়নের অফিসে। অথবা বস্তির সভায়। মাঝের সময়টায় সুভাষ ব্যস্ত ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। নীহার রঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’-এর কিশোর সংস্করণ তৈরির কাজও তো থেমে নেই! (Subhash Mukhopadhyay)
কিন্তু কেন হঠাৎ বজবজে? কেন শ্রমিকদের প্রতি ঝুঁকে পড়লেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়? শুধুই কি পার্টির কথায়? তার আগে ১৯৪৮ সালে নিষিদ্ধ হল কমিউনিস্ট পার্টি। জেলে বাকি বন্দীদের সঙ্গে অনশন আন্দোলন করছেন সুভাষ। আর মনের ভিতর গেঁথে নিচ্ছেন জেলে বন্দী অন্য শ্রমিকদের জীবনযাপন। গেঁথে নিচ্ছেন তাদের পাঁচালী। আর সেইসব শুনতে শুনতে তাদের জীবনে ঢুকে পড়তে ইচ্ছা করছে ভীষণ সুভাষের। বুঝতে পারছেন তিনি, এই বাংলাকেই নিজের চোখে আরও বেশি করে না দেখলে কীভাবে তৈরি হবে সঠিক সাম্যবাদের ভিত? ‘ওপর ওপর বেঁচে থাকা নয়। কোথাও বেশ একটু গভীরে ডুব দিতে হবে।’ (Subhash Mukhopadhyay)
বজবজে সেইসময় কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব নিয়ে আছেন সন্তোষ ঘোষ। এই সন্তোষ ঘোষের সঙ্গেই লেবার পার্টি বা কমিউনিস্ট পার্টির পথে পথে হাঁটা শুরু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। সুভাষের সেই ‘চেনা লোক’-এর মাধ্যমে বজবজে এসেই নতুন দিশা পেয়েছিল তাঁর কবিতা। ‘বজবজে এসেই ফুটেছে ক্যাকটাসের ফুল’, লিখেছিলেন তিনি পরে।
আরও পড়ুন: দাবানলে জ্বলছে পৃথিবী
ব্যাঞ্জনহেড়িয়ায় তখন কুঁড়েঘর এদিক-ওদিক। এঁদো পুকুরের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই লিখছেন, ‘পুকুরটা আকণ্ঠ বুঁজে আছে পাতা-পচা ছ্যাতলায়। জলের ওপর যেন কেউ বিছিয়ে দিয়েছে একটা তেলচিটে চাদর। তার মাঝখানে বিজগুড়ি কাটছে বেলফুলের কুঁড়ির মতো অসংখ্য বুদবুদ।’ আর সেই পুকুরের পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে ছোট্ট সালেমন। ‘সালেমনের মা’ কবিতার সেই ছোট্ট সালেমন বিবি। সেই বেয়াল্লিশ বা তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়ই জন্ম যাঁর। (Subhash Mukhopadhyay)
কিন্তু বিয়ের একবছরও ঘোরেনি তখনও। সদ্যবিবাহিতা গীতাও মিশে যাচ্ছেন সুভাষের সঙ্গে এই লড়াইয়ে। অবৈতনিক স্কুল খুলছেন গীতা। শ্রমিকদের বাড়ির মেয়েরা অক্ষর চিনবে যেখানে। পড়াশোনা শিখতে আসে সেখানে সালেমনও। আর তার বাইরে অন্য সময়েও প্রায়ই এসে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তোলে খোদ সুভাষকেই। সঙ্গে বন্ধু সাকিনা। সুভাষ হয়তো লিখছেন তখন। (Subhash Mukhopadhyay)
‘কী কর তুমি?’ ও জানতে চেয়েছিল আমি পেট চালাই কেমন করে। বলেছিলাম, ‘আমি লিখি’। শুনে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘বা রে, লিখে কেউ টাকা পায় নাকি? লেখাপড়া করতে গেলে তো টাকা দিতে হয়।’ খুব মিথ্যে বলেনি, হাড়ে হাড়ে আজ টের পাচ্ছি।’
সালেমনের বন্ধু এই সাকিনাকেই আবার পরে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন সুভাষ-গীতা। কিন্তু সাকিনার বাবা-মায়ের আপত্তিতে যদিও সেটা সম্ভব হয়নি শেষ অবধি। (Subhash Mukhopadhyay)

এই সালেমনের মাকে দেখেই মিছিলের মতো শব্দ ঢুকে পড়েছিল তাঁর কবিতায় হুড়মুড় করে। সেই সময় এই অঞ্চলেরই ছোট্ট আহম্মদের মা কবিরণকে নিয়েও লিখেছিলেন ‘পায়ে পায়ে’ কবিতা।


‘একেবারে হুড়মুড় করে আসার দলে ছিল আমার ‘সালেমনের মা’ কবিতাটি। পকেটে কাগজ ছিল। লেগেছিল দু’কাপ চা। তা-ও খুব একটা ঠান্ডা করে খেতে হয়নি। কাটাকুটি হয়েছিল সামান্য। ‘সালেমনের মা’ কি আমার মনে কিংবা মাথায় আগে থেকে সাজানোই ছিল? অনেক ভেবেও এ সব জিনিসের কূলকিনারা পাওয়া যাবে না।’ (Subhash Mukhopadhyay)
সালেমনের মায়ের নাম গোলসান। গোলসান বিবির স্বামী বাবরালির মাথার গন্ডগোল। একরত্তি মেয়ে সালেমনকে নিয়ে তাই বাপের বাড়ি চলে আসা ছাড়া উপায় ছিল না গোলসানের। হঠাৎ বছর চারেক পরে দেখা গেল সেই পাগল মানুষটাকে আবার। তার চোখ যেন চটকলের ধোঁয়ায় ঢাকা বজবজের আকাশের মতোই ঘোলাটে। মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে সে এই পুকুর পাড়েই। কিন্তু আশেপাশের সকলে ভয় পেয়ে গেল বেশ। শুরু হল হইহই। মেয়েকে কোলের থেকে নামিয়ে রেখে কোথায় যেন হারিয়ে গেল ঘোলাটে দুটো চোখের পাগল বাবরালি। (Subhash Mukhopadhyay)
আর নিজের মেয়ের দিকে এভাবে চেয়ে থাকা একটা লোকের এই দৃষ্টিই আতান্তরে ফেলে দিচ্ছে তখন কবিকে খুব। নিজের লেখায় সব উপমা বদলানোর কথা মনে হচ্ছে তাঁর। কী খুঁজছিল আসলে পাগল বাবরালি মেয়ের মুখের ভিতর? দশ বছর আগের গোলসানের সেই মুখের আদল? (Subhash Mukhopadhyay)


সেই পুকুর, আর সেদিনের সেই ছোট্ট সালেমন বিবি, এখন।
এরপর সুভাষ মুখোপাধ্যায় আবার ফিরে আসছেন বজবজে প্রায় বিশ বছর পর। রাজনীতির পরিবর্তন হয়ে গেছে আমূল ততদিনে। কিন্তু বজবজে এসে পরিচিত মানুষগুলোর চেহারা ছাড়া আশেপাশে আর কিছুর মধ্যেই কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে না তাঁর। সেদিনের সেই ছোট্ট সাকিনার কোলে পনেরো দিনের শিশু। চতুর্থ সন্তান। আর সালেমন? (Subhash Mukhopadhyay)
‘দেখি উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে আছে সালেমন। ওর কোলেও তিন মাসের ময়না। এটা নিয়ে ওর ছ’টা হল।’
ঝাঁকড়া চুলের মানুষটা হাঁটতে থাকে ব্যাঞ্জনহেড়িয়া, চড়িয়ালের রাস্তা ধরে কখনও বাজার কিংবা চটকলের দিকে কখনও। দেখা হতে থাকে পুরোনো পার্টি কমরেডদের সঙ্গে। শান্ত বা রাগী মানুষগুলোর সঙ্গেও। এমার্জেন্সি সমর্থন করা যুব-কংগ্রেস নেতা কিংবা খতমলাইনে বিশ্বাসী ক্লান্ত রোগা কোনও ছেলে একসঙ্গে বসে চা খায় চায়ের দোকানে। একটু পরেই যে যার বিশ্বাসের দিকে সরে যাবে তারা যখন, ঠিক তখনই একটা মিছিল আসছে বড় শ্রমিকদের। মিছিলের লাইনে আছে সেই লোকটাও, মিছিলে দাঁড়িয়েই যার মনে পড়ে যায় সেই যুগটার কথা, যখন মিছিল-টিছিল ছিল না এইসব। কিন্তু রাগ ছিল মানুষের। (Subhash Mukhopadhyay)
আর কেমন একটা রং ফুটে উঠতে থাকে আকাশে তখন। জীবনের সঙ্গে শেষবারের মতো বোঝাপড়া করার জন্য যে আকাশ তৈরি হয়ে উঠেছে। সুভাষ লিখে চলেন মার খেয়েও মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সত্যি গল্প। ভদ্দরলোকের ছেলে হয়েও রোগা টিংটিংয়ে চটকল নেতার কথা। কয়লা সড়কের কাছে মিশে যাওয়া চিত্রিগঞ্জ আর বিড়লাপুর থেকে আসা মিছিলের কথা। বজবজ মিলের মেশিনে হাত জড়িয়ে গিয়ে কব্জি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া চা-ওয়ালার কথা। তার জন্য কষ্টের বদলে বরং একটা দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আক্ষেপ ভেসে আসে সুভাষের লেখায়, ‘দুটো হাত থেকেও চটকলের লোকগুলো আজকাল সাহেবদের পিটিয়ে লাশ করে না কেন?’ (Subhash Mukhopadhyay)
হরতালের দিন সকালে আগুনের শিখার মতো জ্বলতে থাকা লোককে চড়িয়াল বাজারে শান্ত ভাবে বাজার করতে দেখে অবাক হন তিনি। লিখে চলেন চটকল মজুরের কাগজের মতো সাদা আঙুলের কথা। ভীষণ অ্যানিমিয়া। শুধু কৃষক, মজদুর বা শ্রমিকদের মধ্যেই নয়, এই নতুন স্বাধীন হওয়া দেশটার শরীরেও যেন। দুশ্চিন্তায় কপাল কুঁচকে থাকা চড়িয়ালের রাস্তাকে দেখে তাই এখন সুভাষের মনে হয়, আজ যেন সইতে সইতে বাঁধ ভেঙে গেছে তাঁর ধৈর্যের। আজ সে কোনও একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য মুঠো করে আছে হাত। (Subhash Mukhopadhyay)
আরও পড়ুন: নেতাজির অন্তর্ধান, প্রত্যাবর্তন-বিতর্ক ও একটি বিস্মৃত বই
এদিকে মড়ক লেগে মরতে থাকে মোরগের দল। ভাদ্রের গরমে আশফল গাছে দুলতে থাকে হিলহিলে লাউডগা সাপ। ঝপ করে সকাল হওয়া একটা দিন এভাবেই কেমন এগিয়ে যাবে কড়িকাঠের গা ঘেঁষে এলিয়ে পড়া সবুজ কালো ছবিদের দিকে। আর দূরে কে যেন কেঁদেই চলে একটানা তখন।
‘কান্নার মধ্যে থাকে এক সুদীর্ঘ কথাচিত্র। একটি মানুষের গোটা জীবনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। কেমন দেখতে ছিল সে? কবে কী বলেছিল? কী সে ভালবাসতো?’
লিখতে থাকেন সুভাষ ভালবাসতে-বাসতে পাগল হতে চাওয়া খ্রিস্টান যুবক টমাসের কথাও। দমকলের চাকুরে ছেলেটা ধর্মতলায় পুলিশের একটা হল্লার মুখে পড়ে যায় হঠাৎ। পরে তাকে পাগল প্রমাণ করে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। সেখানে সত্যিই একদিন মাথা খারাপ হয়ে যায় টমাসের। তার কিছু মাস আগেই বিয়ে হয়েছে তার। বছর ঘুরতেও টমাস না ফেরায়, বাপের বাড়ি চলে যায় তার বউ। নতুন জায়গায় বিয়েও হয়ে যায় মেয়েটার। এরপর একদিন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে টমাস। আর ফিরে এসেই বুঝতে পারে, এর থেকে পাগল হওয়াই বোধহয় ভাল ছিল তার! (Subhash Mukhopadhyay)
এই বজবজ— তার মানুষ, রাস্তাঘাট, চটকল, মিছিল থেকে একটার পর একটা কবিতা কুড়িয়ে নিয়েছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। নিঃশ্বাসের মতো ছিল বজবজ তাঁর কাছে। চটকল শ্রমিকেরাই ছিলেন তাঁর লেখার আত্মা। নিজেই বলেছেন তিনি, শ্রমিক আন্দোলনই তাঁকে ঠেলে দিয়েছে লেখার দিকে। এবং অনেকেই তাঁকে মনে না রাখলেও, নিজের ‘সুভাষ কাকা’কে তখনও ভোলেননি সালেমন বিবি। বয়সের কারণে স্মৃতি সাময়িক টাল খেলেও, সুভাষ-গীতার সব কথা বলে যাচ্ছিলেন গড়গড় করে তখনও। আর সব কথার শেষে ঘুরেফিরে আসে একটাই কথা, অমন করে ভাল তো বাসতে পারল না আর বাকি সকল মানুষ…
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো শুধু মানুষকে ভালবেসে মানুষের কবিতা লিখে চলাও কি দু-একজন ব্যতিরেকে বাকি কবিকুলের পক্ষেও সম্ভব হয়ে উঠেছে আর?

তথ্য:
১। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখালেখি
২। সুপ্রকাশ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ‘একটি শিশির বিন্দু (বজবজ ও বাটানগর সংলগ্ন অঞ্চলের ছুঁয়ে দেখা গল্প-কথা-রাজনীতি-ইতিহাস)

শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
শুভদীপের জন্ম মফস্বল শহর বাটানগরে, ইডেন গার্ডেনসে সে বছর বিশ্বকাপ ফাইনালে ভুল রিভার্স সুইপ মারছেন মাইক গ্যাটিং। পড়াশোনা নঙ্গী হাই স্কুল, এবং পরবর্তীতে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। অর্থনীতি এবং সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনার পর চাকরিসূত্রে পুরুলিয়া থেকেছেন বেশ কিছু বছর।